(Summer recipe) গাঁ-গঞ্জের ব্যাপার আমাদের। নিত্যকার রান্নাঘরে নিতান্ত মামুলি রান্না, ফোড়নে তার স্বাদ। বাবা, জ্যাঠা দুই দিন পরপর বাজার যেতেন। আশেপাশের চাষিরা খেতের আনাজপাতি তুলে এনে বাজারে বিক্রি করতেন। মরসুমি সবজি। তাই অসময়ে আমরা কিছুই খাইনি – আচার, বড়ি, কাসুন্দি ও আমসত্ত্ব ছাড়া। এই জিনিসগুলো হেঁশেলের ভাঁড়ারে সারা বছর সংরক্ষণ করে রাখা হতো। মাটির হাঁড়িতে প্রলেপ দিয়ে আচার, কাসুন্দি ভরে লিনটনে তুলে রাখা থাকতো। (Summer recipe)

প্রতিদিন ভাতের পাতে এটা ওটা সেদ্ধ, শাক ভাজা, উচ্ছে ভাজা, তিত বেগুনের চচ্চড়ির পাশে কাসুন্দি নিয়ে আয়েশ করে ভাত খেতেন মা, বড়মা। ওইটুকু তাদের আয়েশ, তাদের মহার্ঘ্য বেঁচে থাকা।
রান্না শেষ হলে উনুন লেপে, স্নান সেরে মা, বড়মা মাড় দেওয়া ছাপা শাড়ি পরতেন। পুজো দিতেন ঠাকুমা বুড়ি। পুজো সেরে সবাই মিলে খেতে বসা। খেতে খেতে কত গল্প, থালা শুকিয়ে আসে। তাড়া দেন ঠাকুমা বুড়ি। তখন হুঁশ ফেরে, ধড়ফড় করে উঠে বড়মা হিসেবের খাতা নিয়ে বসেন। সেদিনের বাজার, ইস্ত্রি, পান সুপারির হিসেব। বড়মার গা ঘেঁষে বসা আমি, লক্ষ্য বড়মার হাতের কলম। (Summer recipe)
সাধারণত উচ্ছে সবচেয়ে বেশি তিতা হিসেবে প্রচলিত সবজি। কিন্তু উচ্ছে করলা ছাড়াও আমাদের গাঁ ঘরে নানান তেতো উপকরণের প্রচলন আছে। বিশেষ করে গরমকালে এইসব তেতো খাওয়ার চল বেশি।
দিন পার হয়ে গেছে, বছরও। কত বছর তার হিসেব নেই। খালি মনে রয়ে গেছে মা বড়মার রান্নার টুকরো টুকরো কথা। (Summer recipe)
“হেলা ছেদ্দা নেমত্তন্ন
তিত পল্লার ঝোল।”
এইটে আমাদের গ্রামের দিকের প্রচলিত কথা। অর্থাৎ যত্ন করে নেমতন্ন করা হয়নি, তাই বাড়িতে ডেকে পলতা পাতার ঝোল খেতে দিয়েছে। সাধারণত উচ্ছে সবচেয়ে বেশি তিতা হিসেবে প্রচলিত সবজি। কিন্তু উচ্ছে করলা ছাড়াও আমাদের গাঁ ঘরে নানান তেতো উপকরণের প্রচলন আছে। বিশেষ করে গরমকালে এইসব তেতো খাওয়ার চল বেশি। (Summer recipe)
আরও পড়ুন: সাবেকি পুজোর ভোগ প্রসাদ
শিউলি পাতা, কচি পটলের ডগা, পাতা, সজনে ফুল, গিমা শাকের পাতা, তেলাকুচা, থানকুনি এইসব জিনিস দিয়ে ঝোল, শুক্তোনি, বড়া ইত্যাদি খাই আমরা। এই সবজিগুলো বাজারে সাধারণত একটু খোঁজ করলে পাওয়া যায়। এইসব ভেষজ শাকপাতা খেলে শরীরে রোগভোগ হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা ইমুনিটি গড়ে ওঠে। আজ এইসব ব্যবহার করে দু একটা রেসিপি বলবো। (Summer recipe)

থানকুনি পাতার পথ্যি ঝোল
আজ বলি এই আটপৌরে ঝোল কেমন করে বানায় তার কথা। পেঁপে, আলু, ঝিঙে এর মূল উপকরণ। ডাঁটা ভালো পেলে তাও দেওয়া যায়। সামান্য তেল গরম করে তাতে মৌরি আর সরষে ফোড়ন দিয়ে সবজি সাঁতলে জল দিতে হবে। লবণ দিয়ে ঢাকা দিয়ে সবজি সেদ্ধ হয়ে এলে ঢাকা খুলে এতে রাঁধুনি বাটা, সামান্য থেঁতো করা গোলমরিচ আর থানকুনি পাতা দিয়ে সব মিশে গেলে তৈরি এই পথ্য ঝোল।
এই ঝোল খুব আটপৌরে। কোনও কারিকুরি নেই। তাই অনেকের পছন্দ না হতে পারে, তবে পেটের সমস্যায়, অরুচিতে এই ঝোল উপকারী।

শিউলি পাতার শুক্তোনি
শশা, লাউ, উচ্ছে ইত্যাদি সবজি দিয়ে তৈরি হয় এই শুক্তোনি। মটর ডাল বেটে বড়া ভেজে নিন। তেলে মেথি, সরষে ফোড়ন দিন। তাতে ডুমো করে কাটা সবজি, নুন আর আদা বাটা, সামান্য সাঁতলে নিয়ে জল দিয়ে ঢেকে দিন। সবজি সেদ্ধ হয়ে এলে ডালের বড়া আর সামান্য চিনি দিয়ে আবার একটু ঢেকে রাখতে হবে। অন্য একটা পাত্র ১ চামচ ঘি গরম করে তাতে শিউলি পাতা ভেজে নিন। সব্জির ঢাকা খুলে এই পাতা ভাজা মিশিয়ে নেড়ে নিয়ে আঁচ বন্ধ করে দিন। কড়াই ঢেকে রাখতে হবে প্রায় ২০ মিনিট। এই শুক্তোনি পেট ঠান্ডা রাখে।

তিলবাটায় শুক্তোনি
অনেকেই জানেন, একটু পুরনো রেসিপি। ভারি যত্নের নিরামিষ দিনের রান্না। এ রান্না মা, দিদাদের হাতের গুন।
মটর ডালে নুন, চিনি, হিং দিয়ে বেটে ফেটাতে হবে ভালো করে। ছোট ছোট বড়া ভেজে নিন। আলু, বেগুন, কাঁচাকলা ভেজে নিতে হবে। সেই তেলেই মেথি, কালোজিরে ফোড়ন দিন। ঝিঙে, ডাঁটা, মরসুমি সবজি অল্প সাঁতলে নিয়ে তারপর আগে ভেজে রাখা সবজিগুলো দিন। এক চামচ আদা বাটা, আর সাদা তিলবাটা দি্ন ২ চামচ। হালকাভাবে মিশিয়ে জল, নুন, মিষ্টি দিয়ে ঢাকা দিয়ে সেদ্ধ করতে দিন সবজি আর ডালের বড়া। তারপর সবজি প্রায় হয়ে এলে দুধ আর একটু রাঁধুনি বাটা দিন। ফুটে এলে ঘি দিয়ে নামিয়ে নিন।
এর স্বাদ বড় মোলায়েম। কোনো মসলার আধিক্য নেই, অথচ শান্তি আছে। আপনারা অনেকেই হয়তো এটি বানান, আর যারা এই রেসিপি পড়ে রান্না করবেন, খেয়ে বুঝবেন এর স্বাদ।

উচ্ছে আলু আর চাপড় শুক্তো
২টো উচ্ছে, ১টা আলু, সরষে বাটা আর মটর ডালের চাপড় – এই হলো মূল উপকরণ। প্রথমে মটর ডাল বাটা দিয়ে তার চাপড় বানাতে হবে। মটর ডাল ভিজিয়ে, নুন চিনি মিশিয়ে বেটে ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে। অনেকে এই মিশ্রণটিতে হিং মেশান। হাতের তালুর সাইজে চাপড়ে চাপড়ে বড়ার আকারে গড়ে নিতে হবে। একটা চাটুতে অল্প তেল দিয়ে বড়াগুলো বসাতে হবে। কম আঁচে সেঁকা হবে তেলে। এক পিঠ হলে উল্টো পিঠ সেঁকে নিতে হবে। (Summer recipe)
তেলে মেথি ফোড়ন দিয়ে উচ্ছে আলু ভেজে তাতে নুন, হলুদ আর সরষে বাটা দিয়ে ঢাকা চাপা দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। গায়ে গায়ে হয়ে এলে চাপড় আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামাতে হবে। (Summer recipe)
ছবি সৌজন্য: লেখক
নিবাস গুরগাঁও। পেশায় বাবুর্চি। নিয়মিত রান্না বিষয়ক লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এছাড়া স্কুলছুট বাচ্চাদের স্কুলে ফেরানোর কাজ করেন শমীতা।