সত্যজিৎ রায়। বাঙালির চিরকেলে আইকন। ঘরের লোক। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। শতবর্ষে সত্যজিতের অজস্র মণিমানিক্য থেকে গুটিকয়েক তুলে নিয়ে বাংলালাইভ সাজিয়েছে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্যের ছোট্ট নিবেদন। আজ থেকে এক পক্ষকাল বাংলালাইভে চলবে সত্যজিত উদযাপন। কখনও তাঁর সুরের মায়া, কখনও তাঁর ক্যামেরার আঙ্গিক, কখনও তাঁর তুলিকলমের দুনিয়া – আমরা ধরতে চেয়েছি বিভিন্ন বিশিষ্টজনের লেখায়-ছবিতে-চলচ্ছবিতে-সাক্ষাৎকারে। আজ সত্যজিতের আবহসঙ্গীত নিয়ে লিখছেন বিশিষ্ট সরোদিয়া শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে বাংলালাইভের জন্য স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন তিনি, যিনি সত্যজিৎ রায়ের বারোটা ছবির গান এবং নেপথ্য সঙ্গীতে সরোদ বাজিয়েছেন। তাঁর স্মৃতিচারণে উঠে এল রেকর্ডিং-এর নানা গল্প এবং কম্পোজার সত্যজিতের নানা দিক।
১৯৭৮ সালের কথা। তখন আমি শ্যামনগরে থাকি। স্টুডিও পাড়ায় ততদিনে আমার সরোদ বাজিয়ে হিসেবে খানিকটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। দিলীপ রায়, অলোকনাথ দে, হিমাংশু বিশ্বাস, ওয়াই এস মুল্কির মতো বেশ কয়েকজন সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে একাধিক ছবির গানে, নেপথ্য সঙ্গীতে বাজিয়েছি। একদিন ভোরবেলা আমার বাড়িতে দুলাল দা এসে হাজির। দুলাল দা অর্থাৎ দুলাল রায়চোধুরী, ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক অলোকনাথ দে-এর মেসেঞ্জার। তখনকার দিনে সমস্ত সঙ্গীত পরিচালকেরই একজন করে মেসেঞ্জার থাকতেন, যাঁরা কবে কোথায় রেকর্ডিং আছে, সেই খবর আমাদের দিতেন। দুলাল দা এসে বললেন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, দশটার মধ্যে এইচ এম ভি স্টুডিওতে পৌঁছতে হবে। ওঁকে একটু অপেক্ষা করতে বলে, তৈরি হয়ে ওঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। সেই সময়ের দস্তুর ছিল, মেসেঞ্জারের পাঠানো খবর অনুযায়ী স্টুডিওয় পৌঁছে যেতে হবে। কোন ছবি, কী গান, কে পরিচালক, এইসব প্রশ্ন করা চলবে না। সেইমতো আমিও দুলালদাকে কোনও প্রশ্ন না করেই ওঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় যেতে যেতে দুলাল দা বললেন “আজ কার রেকর্ডিং জানো? সত্যজিৎ রায়ের।“ আমি তো শুনেই বললাম “ওরে বাবা এ তো সাঙ্ঘাতিক সুযোগ! আমার তো এখনই হাত-পা কাঁপছে।” দুলাল দা একটু মুচকি হেসে বললেন, “চলো দেখবে, খুব মজার ব্যাপার। এতদিন তো তুমি বাজাচ্ছ, খানিকটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু এখানে একেবারে অন্যরকম স্টাইল দেখতে পাবে।” তার আগে আমি যত ছবিতে বাজিয়েছি, বড় বাজেটের ছবি হলে, একদম স্ক্রিনে ছবি দেখে, মার্কিং করে, মিউজিক কম্পোজ করে, তারপর ওই ছবি দেখে আমাদের বাজাতে হত। যেগুলো একটু ছোট বাজেটের, সেখানে সঙ্গীত পরিচালক, সহকারি সঙ্গীত পরিচালক এঁরা সবাই মিলে আগে থেকে স্টপওয়াচ দেখে টাইমিংগুলো ঠিক করে রাখতেন, তারপর সেই মিউজিকগুলো কম্পোজ করে আলাদা বাজানো হত। কারণ সব জায়গায় তো ফিল্ম প্রোজেকশনের সুযোগ থাকত না, আর তার খরচও অনেকটাই বেশি ছিল। আমি তখন দুলাল দাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এইচ এম ভি তে রেকর্ডিং বলছ, তা ওখানে তো প্রোজেকশনের ব্যবস্থা নেই। তাহলে?” দুলাল দা বললেন “ওসব লাগে না। গেলেই বুঝবে।“ যথাসময়ে স্টুডিওয় পৌঁছে দেখলাম সব মিউজিশিয়ন এসে গেছেন। প্রত্যেকে নিজের নিজের যন্ত্র পরিষ্কার করে রেডি করে নিজেদের সামনে রেখেছেন। আমরা যখন হাল্কা আলাপচারিতায় ব্যস্ত হঠাৎ “এসে গেছে” ”এসে গেছে” বলে একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। স্টুডিওয় তখন পিন পড়লেও শব্দ হবে। তারপরেই মানিকদার প্রবেশ। ঢুকতে ঢুকতেই ওই বাজখাঁই গলায় “অলোক, তোমার সব মিউজিশিয়ান এসে গেছে?” বলে হাঁক দিলেন। অলোকদা ইতিবাচক উত্তর দিতেই উনি সন্দীপ রায়কে বললেন “বাবু, ব্যানার্জিকে গানটা রেডি করতে বলো।” ব্যানার্জি হলেন এইচএমভির রেকর্ডিস্ট সুশান্ত ব্যানার্জি। তারপর উনি দুলালদ দা কে বললেন সবাইকে নোটেশন দিতে। নোটেশন পেয়ে আমি অবাক। এর আগে আমি যত জায়গায় বাজিয়েছি, সেখানে পুরো গান লেখা থাকত। গানের মাঝে কোথায় ইন্টারল্যুড, সেখানে কী কী যন্ত্র বাজবে সেই সমস্ত ডিটেল লেখা থাকত। এখানে সেসব কিছুই লেখা নেই। একটা সাদা এ-ফোর কাগজে শুধু লেখা ‘আফটার থার্টি সেভেন বারস’, তারপর নোটেশন। এক একটা বার চার মাত্রার ছিল। এইরকম আবার লেখা ‘আফটার সিক্সটি সিক্স বারস’। অর্থাৎ শুধু যে চারটে বার সরোদ বাজবে সেটুকু লেখা। আমি তো নোটেশন প্রথমে কিছু বুঝতেই পারছিলাম না কীভাবে কী বাজাব। ঘাবড়ে গিয়ে নির্মলদাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম “ও নির্মলদা, এসবের মানে কী?” নির্মলদা, মানে নির্মল বিশ্বাস আমাকে খুব স্নেহ করতেন। নির্মলদা অগুনতি ছবিতে সেতার, তারসানাই, দিলরুবা এইসব যন্ত্র বাজিয়েছেন। কমার্শিয়াল মিউজিকের জগতে খুব পরিচিত নাম। সেই নির্মলদা হেসে বললেন, “হুঁ হুঁ মানিকদার কাজ তো তুমি আগে করনি এখন বুঝতে পারবে।” কিন্তু আমি ওনাকে ধরে পড়লাম আমাকে ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিতে। জানতে চাইলাম গানটা কোথায়। তাতে উনি বললেন “গানটা তো তুমি পাবে না বাবা। তোমাকে প্রথম থেকে যেই অলোক ফোর কাউন্ট দেবে, তুমি এক একটা করে বার গুনবে। ছত্রিশটা বার হয়ে গেলেই থার্টি সেভেন্থ বারে যেটা লেখা আছে সেটা বাজিয়ে দেবে। গানটা কানে হেডফোনে শুনতে পাবে কিন্তু হাতে পাবে না। নোটেশন বলতে এটুকুই পাবে।” প্রথম প্রথম একটু থতমত গেছিলাম। এই বার গোনার পদ্ধতিটা রপ্ত করতেও খানিকটা সময় লেগেছিল। কিন্তু পরে একটা উপায় বের করেছিলাম। আমার আগের বারগুলো কে বাজাচ্ছে সেটা খেয়াল রাখতাম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার আগে সেতারের বাজনা থাকত। ওনার বেশিরভাগ ছবিতে সেতার বাজিয়েছেন দীপক চৌধুরী। অথবা অলোকদার বাঁশি তারপর আমার সরোদ। একটু ধাতস্ত হবার পর এই পদ্ধতিটা মেনেই বাজাতাম। বাজানো হয়ে যাওয়ার পর যকন শোনা হচ্ছে তখন আমার দিকে ফিরে বললেন – “বাহ, ভালো বাজিয়েছ।” ওঁর ছবিতে সেই আমার প্রথম কাজ। গানটা ছিল হীরক রাজার দেশে ছবির ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’। তারপর তো মানিকদার প্রায় সব ছবিতেই বাজিয়েছি। শুধু সুকুমার রায়ের ওপর উনি যে তথ্যচিত্র করেছিলেন সেটাতে বাজাতে পারিনি কারণ তখন আমি দেশে ছিলাম না। হীরক রাজার পরে পরেই দুটো কাজ করি – ‘সদগতি’ আর ‘পিকুর ডায়রি’। তারপর কিছুদিন গ্যাপ দিয়ে ‘ঘরে বাইরে’। ১৯৮৮ সালের পর আবার অনেকগুলো কাজ করেছিলাম। গণশত্রু, শাখাপ্রশাখা, আগন্তুক। ওঁর সঙ্গে শেষ কাজ করেছিলাম গুপী বাঘা ফিরে এল ছবিতে। যদিও ছবির পরিচালক ছিলেন বাবুদা (সন্দীপ রায়), মানিকদাই মিউজিক করেছিলেন। সেই সময় ওঁর শরীর ভাঙ্গতে শুরু করেছে। যতদূর মনে পড়ে, গুপী বাঘা ফিরে এল ছবির গানের কাজ হওয়ার মাঝেই উনি উডল্যান্ডস নার্সিং হোমে ভর্তি হন পেসমেকার বসানোর জন্য। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আবার স্টুডিওয় ফিরে ওই ছবির নেপথ্য সঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। ওঁর মিউজিকের নোটেশন কে করত এই নিয়ে অনেকের মনে অনেক কৌতূহল আছে। ওঁর নোটেশন অলোকদা করে দেন কিনা অনেকে আমাকে এমন প্রশ্নও করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, ওঁর সেটে অলোকদার ভূমিকাটা ছিল মূলত কন্ডাক্টরের। রেকর্ডিং-এর সময় মানিকদা কনসোল রুমে বসতেন। ওইখান থেকে সব নির্দেশ দিতেন। আর ফ্লোরে অলোকদা কন্ডাক্ট করতেন। কার পরে কে বাজাবে হাত নেড়ে অলোকদা এটা বুঝিয়ে দিতেন আর নিজে বাঁশি বাজাতেন। তখন তো আর পাঞ্চ করে রেকর্ড করার প্রযুক্তি ছিল না, সব মিউজিশিয়নকে একসঙ্গে বাজাতে হত। অলোকদাকে তাই নিজের বাজনার ওপরেও মনোনিবেশ করতে হত। নোটেশন গোটাটাই মানিকদা নিজে হাতে করতেন। নোটেশন করার একটা অদ্ভুত কায়দা ছিল ওঁর। ধরা যাক আট মাত্রার একটা গানের নোটেশন করছেন। একটা এ-ফোর সাইজের কাগজ আড়াআড়ি ভাঁজ করে চার চার মাত্রার এক একটা ঘর কাটতেন। প্রথম যে আটটা বার তাতে কোন কোন যন্ত্র বাজবে সেটা আগে ঠিক করে নিতেন। হয়তো সেতার, ভিওলা, সরোদ, বেহালা, ভাইব্রাফোন এরকম পাঁচ ছটা যন্ত্র বাজবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা যন্ত্রের জন্য আলাদা আলাদা কম্পোজিশন থাকত। গ্রুপ ভায়োলিন, ভিওলা, চেলো একসঙ্গে শোনা গেলেও ওঁর বাজনায় একসঙ্গে সেতার সরোদ দুইই বাজছে এরকম বিশেষ শোনা যায়না। এবারে যখন নোটেশন করতেন, প্রথম যে ছটা যন্ত্র বাজবে সেখানে ছটা লাইন টানতেন। তারপর চার চার মাত্রার এক একটা বিভাগ করতেন। আর যন্ত্রগুলোর নাম লেখা থাকত কাগজের বাঁদিকে। প্রথম চারটে বার যদি বাঁশি থাকে তাহলে বাঁশির জায়গায় সেই কম্পোজিশন লেখা থাকত। এভাবেই একে একে বাকি যন্ত্রগুলোর কম্পোজিশন লিখতেন। এইরকম আটটা করে বার হিসেবে ভাগ করে মাস্টার নোটেশন তৈরি হত। দুলাল দার কাজ ছিল ওই মাস্টার নোটেশন দেখে গুনে গুনে কটা বার-এর পর কোন যন্ত্র আসছে দেখে লেখা। আমার প্রথম রেকর্ডিং-এর সময় যে আফটার থার্টি সেভেন বারস সরোদ এরকম লেখা ছিল, সেটা ওই দুলাল দার লেখা। দুলাল দা এভাবে গুনে গুনে কোন যন্ত্র কখন আসছে সেটা লিখে প্রত্যেক মিউজিশিয়ানকে তার যন্ত্রের নোটেশন ধরিয়ে দিতেন। পরে জেনেছি যে উনি নোটেশন লেখার সময় অনেকটা স্টাভ নোটেশন পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। রেকর্ডিং-এর যখন মহড়া চলত, পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত সজাগ এবং সতর্ক হয়ে মানিকদা শুনতেন। অসংখ্যবার মহড়া দেওয়াতেন। যতক্ষণ না বাজনা ওঁর মনমতো হচ্ছে ততক্ষণ রিহার্সাল দিয়ে যেতে হত। সবচেয়ে বেশি রিহার্সাল হত গ্রুপ ভায়োলিনে। কোনও শিল্পী একটু ভুল করলেই ঠিক ধরে ফেলতেন। কে বোয়িং-টা ঠিক বাজায়নি, কে স্ট্যাকাটোর বদলে লিগাটো বাজাচ্ছে, কিছুই ওঁর কান এড়িয়ে যেত না। কোনও একজনেক বাজনা ওঁর পছন্দ না হলে সেই শিল্পীর কাছে সোজা চলে এসে বলে দিতেন কীভাবে বাজাতে হবে। আমাকে এমনও বলেছেন এখানে দুটোর বদলে একটা স্ট্রোক দিয়ে মীড়ে বাজাও। সঙ্গীতের বিষয়ে এমনই অগাধ ওঁর পান্ডিত্য ছিল।
6 Responses
মুগ্ধ করে দিলে। নোটেশন আর বার এর কথা যা শোনালে তার অনেকটাই মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। দেখা হলে আরও ভাল করে বুঝতে হবে। অসাধারন স্মৃতিচারণ। তুমি তো ছুপারুস্তম।
কত অজানা বিষয় জানলাম। খুব ভালো লাগল।
লেখক সত্যি ভাগ্যবান কাছের ঐ বিরাট মাপের মানুষটিকে দেখেছেন, কথা বলেছেন এবং তাঁর সৃষ্টির সংগে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ছেন।
ভীষণ ভালো একটি প্রতিবেদন । Music of Ray নিয়ে
একটু কাজ করতে গিয়ে অনেক সংশ্লিষ্ট অজানা তথ্যের সন্ধান পেয়েছিলাম , এই বিশাল মাপের মানুষটির সম্পর্কে আরও কত যে তথ্য জানার আছে এবং সবিশেষ আগ্রহে তার কিছুটা পেলেই সমৃদ্ধ হই। শ্রীকুমার বাবুর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় নি থাকলেও ওঁর সম্বন্ধে অনেক টাই জানি ইনি একজন শিক্ষিত সরোদ বাদক । অভিযোগ নয়, একটি বিশেষ অনুরোধ রইল আপনার কাছে , Violinist group এর মিহির গুপ্তর নামটি বোধ হয় Violin brothers এর আগে উল্লিখিত হওয়া উচিত । ভালো থাকবেন ।
প্রতিদিন এই মহান মানুষটির সম্পর্কে নতুন নতুন বিষয় জানছি , আর তত বিস্ময়ের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে । এই লেখাটি সঙ্গীতের ব্যাপারে ওঁর জ্ঞান যে কী পরিমাণ গভীর তা কত সহজ ভাষায় জানিয়ে দিল !
খুব ভাল একটা প্রতিবেদন পড়লাম। মন ভরে গেল।