banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মানিকদার গান-গল্প

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

courtesy Delhi Art Gallery and Nemai Ghosh
এইচএমভি রেকর্ডিং স্টুডিওতে। ছবি সৌজন্যে Delhi Art Gallery

সত্যজিৎ রায়। বাঙালির চিরকেলে আইকন। ঘরের লোক। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। শতবর্ষে সত্যজিতের অজস্র মণিমানিক্য থেকে গুটিকয়েক তুলে নিয়ে বাংলালাইভ সাজিয়েছে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্যের ছোট্ট নিবেদন। আজ থেকে এক পক্ষকাল বাংলালাইভে চলবে সত্যজিত উদযাপন। কখনও তাঁর সুরের মায়া, কখনও তাঁর ক্যামেরার আঙ্গিক, কখনও তাঁর তুলিকলমের দুনিয়া – আমরা ধরতে চেয়েছি বিভিন্ন বিশিষ্টজনের লেখায়-ছবিতে-চলচ্ছবিতে-সাক্ষাৎকারে। আজ সত্যজিতের  আবহসঙ্গীত নিয়ে লিখছেন বিশিষ্ট সরোদিয়া শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে বাংলালাইভের জন্য স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন তিনি, যিনি সত্যজিৎ রায়ের বারোটা ছবির গান এবং নেপথ্য সঙ্গীতে সরোদ বাজিয়েছেন। তাঁর স্মৃতিচারণে উঠে এল রেকর্ডিং-এর নানা গল্প এবং কম্পোজার সত্যজিতের নানা দিক।

১৯৭৮ সালের কথা। তখন আমি শ্যামনগরে থাকি। স্টুডিও পাড়ায় ততদিনে আমার সরোদ বাজিয়ে হিসেবে খানিকটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। দিলীপ রায়, অলোকনাথ দে, হিমাংশু বিশ্বাস, ওয়াই এস মুল্কির মতো বেশ কয়েকজন সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে একাধিক ছবির গানে, নেপথ্য সঙ্গীতে বাজিয়েছি। একদিন ভোরবেলা আমার বাড়িতে দুলাল দা এসে হাজির। দুলাল দা অর্থাৎ দুলাল রায়চোধুরী, ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক অলোকনাথ দে-এর মেসেঞ্জার। তখনকার দিনে সমস্ত সঙ্গীত পরিচালকেরই একজন করে মেসেঞ্জার থাকতেন, যাঁরা কবে কোথায় রেকর্ডিং আছে, সেই খবর আমাদের দিতেন। দুলাল দা এসে বললেন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, দশটার মধ্যে এইচ এম ভি স্টুডিওতে পৌঁছতে হবে। ওঁকে একটু অপেক্ষা করতে বলে, তৈরি হয়ে ওঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। সেই সময়ের দস্তুর ছিল, মেসেঞ্জারের পাঠানো খবর অনুযায়ী স্টুডিওয় পৌঁছে যেতে হবে। কোন ছবি, কী গান, কে পরিচালক, এইসব প্রশ্ন করা চলবে না। সেইমতো আমিও দুলালদাকে কোনও প্রশ্ন না করেই ওঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় যেতে যেতে দুলাল দা বললেন “আজ কার রেকর্ডিং জানো? সত্যজিৎ রায়ের।“ আমি তো শুনেই বললাম “ওরে বাবা এ তো সাঙ্ঘাতিক সুযোগ! আমার তো এখনই হাত-পা কাঁপছে।” দুলাল দা একটু মুচকি হেসে বললেন, “চলো দেখবে, খুব মজার ব্যাপার। এতদিন তো তুমি বাজাচ্ছ, খানিকটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু এখানে একেবারে অন্যরকম স্টাইল দেখতে পাবে।” তার আগে আমি যত ছবিতে বাজিয়েছি, বড় বাজেটের ছবি হলে, একদম স্ক্রিনে ছবি দেখে, মার্কিং করে, মিউজিক কম্পোজ করে, তারপর ওই ছবি দেখে আমাদের বাজাতে হত। যেগুলো একটু ছোট বাজেটের, সেখানে সঙ্গীত পরিচালক, সহকারি সঙ্গীত পরিচালক এঁরা সবাই মিলে আগে থেকে স্টপওয়াচ দেখে টাইমিংগুলো ঠিক করে রাখতেন, তারপর সেই মিউজিকগুলো কম্পোজ করে আলাদা বাজানো হত। কারণ সব জায়গায় তো ফিল্ম প্রোজেকশনের সুযোগ থাকত না, আর তার খরচও অনেকটাই বেশি ছিল। আমি তখন দুলাল দাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এইচ এম ভি তে রেকর্ডিং বলছ, তা ওখানে তো প্রোজেকশনের ব্যবস্থা নেই। তাহলে?” দুলাল দা বললেন “ওসব লাগে না। গেলেই বুঝবে।“ যথাসময়ে স্টুডিওয় পৌঁছে দেখলাম সব মিউজিশিয়ন এসে গেছেন। প্রত্যেকে নিজের নিজের যন্ত্র পরিষ্কার করে রেডি করে নিজেদের সামনে রেখেছেন।  আমরা যখন হাল্কা আলাপচারিতায় ব্যস্ত হঠাৎ “এসে গেছে” ”এসে গেছে” বলে একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। স্টুডিওয় তখন পিন পড়লেও শব্দ হবে। তারপরেই মানিকদার প্রবেশ। ঢুকতে ঢুকতেই ওই বাজখাঁই গলায় “অলোক, তোমার সব মিউজিশিয়ান এসে গেছে?” বলে হাঁক দিলেন। অলোকদা ইতিবাচক উত্তর দিতেই উনি সন্দীপ রায়কে বললেন “বাবু, ব্যানার্জিকে গানটা রেডি করতে বলো।” ব্যানার্জি হলেন এইচএমভির রেকর্ডিস্ট সুশান্ত ব্যানার্জি। তারপর উনি দুলালদ দা কে বললেন সবাইকে নোটেশন দিতে। নোটেশন পেয়ে আমি অবাক। এর আগে আমি যত জায়গায় বাজিয়েছি, সেখানে পুরো গান লেখা থাকত। গানের মাঝে কোথায় ইন্টারল্যুড, সেখানে কী কী যন্ত্র বাজবে সেই সমস্ত ডিটেল লেখা থাকত। এখানে সেসব কিছুই লেখা নেই। একটা সাদা এ-ফোর কাগজে  শুধু লেখা ‘আফটার থার্টি সেভেন বারস’, তারপর নোটেশন। এক একটা বার চার মাত্রার ছিল। এইরকম আবার লেখা ‘আফটার সিক্সটি সিক্স বারস’। অর্থাৎ শুধু যে চারটে বার সরোদ বাজবে সেটুকু লেখা। আমি তো নোটেশন প্রথমে কিছু বুঝতেই পারছিলাম না কীভাবে কী বাজাব। ঘাবড়ে গিয়ে নির্মলদাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম “ও নির্মলদা, এসবের মানে কী?” নির্মলদা, মানে নির্মল বিশ্বাস আমাকে খুব স্নেহ করতেন। নির্মলদা অগুনতি ছবিতে সেতার, তারসানাই, দিলরুবা এইসব যন্ত্র বাজিয়েছেন। কমার্শিয়াল মিউজিকের জগতে খুব পরিচিত নাম। সেই নির্মলদা হেসে বললেন, “হুঁ হুঁ মানিকদার কাজ তো তুমি আগে করনি এখন বুঝতে পারবে।” কিন্তু আমি ওনাকে ধরে পড়লাম আমাকে ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিতে। জানতে চাইলাম গানটা কোথায়। তাতে উনি বললেন “গানটা তো তুমি পাবে না বাবা। তোমাকে প্রথম থেকে যেই অলোক ফোর কাউন্ট দেবে, তুমি এক একটা করে বার গুনবে। ছত্রিশটা বার হয়ে গেলেই থার্টি সেভেন্থ বারে যেটা লেখা আছে সেটা বাজিয়ে দেবে। গানটা কানে হেডফোনে শুনতে পাবে কিন্তু হাতে পাবে না। নোটেশন বলতে এটুকুই পাবে।” প্রথম প্রথম একটু থতমত গেছিলাম। এই বার গোনার পদ্ধতিটা রপ্ত করতেও খানিকটা সময় লেগেছিল। কিন্তু পরে একটা উপায় বের করেছিলাম। আমার আগের বারগুলো কে বাজাচ্ছে সেটা খেয়াল রাখতাম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার আগে সেতারের বাজনা থাকত। ওনার বেশিরভাগ ছবিতে সেতার বাজিয়েছেন দীপক চৌধুরী। অথবা অলোকদার বাঁশি তারপর আমার সরোদ। একটু ধাতস্ত হবার পর এই পদ্ধতিটা মেনেই বাজাতাম। বাজানো হয়ে যাওয়ার পর যকন শোনা হচ্ছে তখন আমার দিকে ফিরে বললেন – “বাহ, ভালো বাজিয়েছ।” ওঁর ছবিতে সেই আমার প্রথম কাজ। গানটা ছিল হীরক রাজার দেশে ছবির ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’। তারপর তো মানিকদার প্রায় সব ছবিতেই বাজিয়েছি। শুধু সুকুমার রায়ের ওপর উনি যে তথ্যচিত্র করেছিলেন সেটাতে বাজাতে পারিনি কারণ তখন আমি দেশে ছিলাম না। হীরক রাজার পরে পরেই দুটো কাজ করি – ‘সদগতি’ আর ‘পিকুর ডায়রি’। তারপর কিছুদিন গ্যাপ দিয়ে ‘ঘরে বাইরে’। ১৯৮৮ সালের পর আবার অনেকগুলো কাজ করেছিলাম। গণশত্রু, শাখাপ্রশাখা, আগন্তুক। ওঁর সঙ্গে শেষ কাজ করেছিলাম গুপী বাঘা ফিরে এল ছবিতে। যদিও ছবির পরিচালক ছিলেন বাবুদা (সন্দীপ রায়), মানিকদাই মিউজিক করেছিলেন। সেই সময় ওঁর শরীর ভাঙ্গতে শুরু করেছে। যতদূর মনে পড়ে, গুপী বাঘা ফিরে এল ছবির গানের কাজ হওয়ার মাঝেই উনি উডল্যান্ডস নার্সিং হোমে ভর্তি হন পেসমেকার বসানোর জন্য। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আবার স্টুডিওয় ফিরে ওই ছবির নেপথ্য সঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। ওঁর মিউজিকের নোটেশন কে করত এই নিয়ে অনেকের মনে অনেক কৌতূহল আছে। ওঁর নোটেশন অলোকদা করে দেন কিনা অনেকে আমাকে এমন প্রশ্নও করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, ওঁর সেটে অলোকদার ভূমিকাটা ছিল মূলত কন্ডাক্টরের। রেকর্ডিং-এর সময় মানিকদা কনসোল রুমে বসতেন। ওইখান থেকে সব নির্দেশ দিতেন। আর ফ্লোরে অলোকদা কন্ডাক্ট করতেন। কার পরে কে বাজাবে হাত নেড়ে অলোকদা এটা বুঝিয়ে দিতেন আর নিজে বাঁশি বাজাতেন। তখন তো আর পাঞ্চ করে রেকর্ড করার প্রযুক্তি ছিল না, সব মিউজিশিয়নকে একসঙ্গে বাজাতে হত। অলোকদাকে তাই নিজের বাজনার ওপরেও মনোনিবেশ করতে হত। নোটেশন গোটাটাই মানিকদা নিজে হাতে করতেন। নোটেশন করার একটা অদ্ভুত কায়দা ছিল ওঁর। ধরা যাক আট মাত্রার একটা গানের নোটেশন করছেন। একটা এ-ফোর সাইজের কাগজ আড়াআড়ি ভাঁজ করে চার চার মাত্রার এক একটা ঘর কাটতেন। প্রথম যে আটটা বার তাতে কোন কোন যন্ত্র বাজবে সেটা আগে ঠিক করে নিতেন। হয়তো সেতার, ভিওলা, সরোদ, বেহালা, ভাইব্রাফোন এরকম পাঁচ ছটা যন্ত্র বাজবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা যন্ত্রের জন্য আলাদা আলাদা কম্পোজিশন থাকত। গ্রুপ ভায়োলিন, ভিওলা, চেলো একসঙ্গে শোনা গেলেও ওঁর বাজনায় একসঙ্গে সেতার সরোদ দুইই বাজছে এরকম বিশেষ শোনা যায়না। এবারে যখন নোটেশন করতেন, প্রথম যে ছটা যন্ত্র বাজবে সেখানে ছটা লাইন টানতেন। তারপর চার চার মাত্রার এক একটা বিভাগ করতেন। আর যন্ত্রগুলোর নাম লেখা থাকত কাগজের বাঁদিকে। প্রথম চারটে বার যদি বাঁশি থাকে তাহলে বাঁশির জায়গায় সেই কম্পোজিশন লেখা থাকত। এভাবেই একে একে বাকি যন্ত্রগুলোর কম্পোজিশন লিখতেন। এইরকম আটটা করে বার হিসেবে ভাগ করে মাস্টার নোটেশন তৈরি হত। দুলাল দার কাজ ছিল ওই মাস্টার নোটেশন দেখে গুনে গুনে কটা বার-এর পর কোন যন্ত্র আসছে দেখে লেখা। আমার প্রথম রেকর্ডিং-এর সময় যে আফটার থার্টি সেভেন বারস সরোদ এরকম লেখা ছিল, সেটা ওই দুলাল দার লেখা। দুলাল দা এভাবে গুনে গুনে কোন যন্ত্র কখন আসছে সেটা লিখে প্রত্যেক মিউজিশিয়ানকে তার যন্ত্রের নোটেশন ধরিয়ে দিতেন। পরে জেনেছি যে উনি নোটেশন লেখার সময় অনেকটা স্টাভ নোটেশন পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। রেকর্ডিং-এর যখন মহড়া চলত, পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত সজাগ এবং সতর্ক হয়ে মানিকদা শুনতেন। অসংখ্যবার মহড়া দেওয়াতেন। যতক্ষণ না বাজনা ওঁর মনমতো হচ্ছে ততক্ষণ রিহার্সাল দিয়ে যেতে হত। সবচেয়ে বেশি রিহার্সাল হত গ্রুপ ভায়োলিনে। কোনও শিল্পী একটু ভুল করলেই ঠিক ধরে ফেলতেন। কে বোয়িং-টা ঠিক বাজায়নি, কে স্ট্যাকাটোর বদলে লিগাটো বাজাচ্ছে, কিছুই ওঁর কান এড়িয়ে যেত না। কোনও একজনেক বাজনা ওঁর পছন্দ না হলে সেই শিল্পীর কাছে সোজা চলে এসে বলে দিতেন কীভাবে বাজাতে হবে। আমাকে এমনও বলেছেন এখানে দুটোর বদলে একটা স্ট্রোক দিয়ে মীড়ে বাজাও। সঙ্গীতের বিষয়ে এমনই অগাধ ওঁর পান্ডিত্য ছিল।
courtesy Srikumar Banerjee
রেকর্ডিং স্টুডিওতে মানিকদা আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন। নোটেশন হাতে দাঁড়িয়ে অলোকদা।
সিনেমা জগতের অনেকের মতোই মানিকদাও নিজের পরিচিত শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। আমি নিজেই ওঁর বারোটা ছবিতে কাজ করেছি। এরকম অনেকে ছিলেন। যেমন নির্মলদা। আগেই লিখেছি যে নির্মলদা অনেক ছবিতে সেতার তারসানাই এসব বাজিয়েছেন। কিন্তু মানিকদার ছবিতে নির্মলদাকে দেখা যেত সুরমন্ডল বাজাতে। মানিকদার মিউজিকে সাধারণত সুরমন্ডলের কিছু সোলো পিস থাকতই। আর সেগুলোর জন্য ওঁর নির্মলদাকে চাইই। আরেকজন হচ্ছেন রবি রায়চৌধুরী। মানিকদার ছবি মানেই ভাইব্রাফোনে রবিদা। বাজিয়েদের মতোই কিছু কিছু যন্ত্রের ওপরও ওঁর দুর্বলতা ছিল। যেমন বেহালা। ওঁর ছবিতে পনের ষোলটা বেহালা থাকবেই। তার মধ্যে আবার ভিওলা ওঁর বিশেষ পছন্দের ছিল। ভিওলার অনেক সোলো পিসও থাকত। আমি যেকটা ছবিতে কাজ করেছি তার বেশিরভাগেই এই ভিওলাটা বাজিয়েছেন সমীর শীল। তবে এক আধটা ছবিতে ভায়োলিন ব্রাদার্স বলে এখন আমরা যাদের চিনি সেই দেবশঙ্কর কিংবা জ্যোতিশঙ্কর এর মধ্যে কেউ একজন বাজিয়েছেন। ওঁর আর একটা যন্ত্রের ওপর বিশেষ দুর্বলতা ছিল – সেটা হচ্ছে চেলো। বেশ কিছু ছবিতে চেলো বাজিয়েছিল মৃদুল। একবার রেকর্ডিং-এর মাঝপথে মৃদুল অসুস্থ হয়ে পড়ে। মানিকদা তখন গোটা কলকাতায় চেলো প্লেয়ার খুঁজে না পেয়ে শেষে সোমনাথ শেঠ নামে মাদ্রাজ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একজনকে ডেকে আনেন। সোমনাথ ছিল বম্বের নামকরা চেলো প্লেয়ার মদন শেঠের ভাইপো। পরবর্তিকালে কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক সঙ্গীত পরিচালককে দেখেছি কোনও একটা যন্ত্রের লোক না পেলে মিউজিক পাল্টে যা পাচ্ছেন সেইমতো একটা সুর করে ফেলতে। কিন্তু মানিকদা ওঁর মিউজিক নিয়ে কোনও কম্প্রোমাইজ করতেন না। একটা কিছু চাই মানে সেটা চাইই। এর একটা প্রধান কারণ ছিল, একটা সিনেমার প্লট সিন ডায়লগ ইত্যাদির সমস্ত ডিটেইল মানিকদার মাথায় ছবির মতো স্পষ্ট সাজানো থাকত। কিন্তু আমরা তো আর ওঁর মাথাটা দেখতে পেতাম না, তাই মাঝেমাঝে কিছুটা মুশকিলে পড়তাম। এমন অনেক সময় হয়েছে যে রেকর্ডিংটা আমাদের হয়তো পছন্দ হয়নি, আমরা ভাবছি কাজটা ভালো হচ্ছেনা, কিন্তু উনি খুব খুশি। পরবর্তিকালে ছবিটা দেখে বুঝতাম যেখানে যতটুকু যা দরকার ঠিক ততটাই করা হয়েছে। এর একটা মজার গল্প আছে সেটা বরং বলি। পায়ে পড়ি বাঘ মামা গানের রেকর্ডিং হবে। তার আগে মানিকদা অলোকদাকে বললেন লাঞ্চ ব্রেক দিয়ে দিতে। শুধু দীপক দা, অলোক দা, রাধু দা (রাধাকান্ত নন্দী) আর এক দুজন কে থাকতে বললেন। গল্পে যাওয়ার আগে রাধুদার কথা একটু না বললেই নয়। গুপী বাঘা আর হীরক রাজার দেশে দুটো ছবিতেই যত বাংলা ঢোলের বাজনা আছে সব রাধুদার বাজানো। আমি তো জুনিয়র। নির্মলদার কাছে আবদার করলাম আমাকে থাকতে দিতে। উনি রাজিও হয়ে গেলেন। রেকর্ডিং শুরুর আগে মানিকদা রাধুদাকে বললেন একটু দক্ষিণ ভারতীয় স্টাইলে মৃদঙ্গের মতো করে বাজাতে। রাধুদাও অমনি পাখোয়াজে দেশলাই কাঠি লাগিয়ে হুবহু মৃদঙ্গের মতো আওয়াজ বের করে শুনিয়ে দিলেন। গানটায় কিছুই নেই। শুধু খোকনদা মানে অনুপ ঘোষাল গাইছেন আর দীপকদাকে বলেছেন বীণার মতো একটা এফেক্ট দিয়ে যাও। ফাইনাল টেকের সময় আমি একটু উসখুস করছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল গলাটা আর একটু স্টেডি হলে ভালো হত, পিচটাও একটু বেশি হলে ভালো হত হয়তো। নির্মলদাও অলোকদাকে ইশারায় বলছেন আর একটা টেক করতে। এদিকে গানটা যেই শেষ হয়েছে মানিকদা একেবারে “ওয়ান্ডারফুল! এক্সেলেন্ট!” বলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এসেছেন। আমরা ভাবছি আমাদের কানে লাগল ওঁর লাগল না এ কী করে হয়। অলোকদা সাহস করে বলেই ফেললেন যে এটাকে রেখে আর একটা টেক নেবেন কিনা। ততক্ষণে মানিকদাও আমাদের মুখ দেখে ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন। তখন আমাদের কনসোল রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে পায়ে পড়ি বাঘ মামা দৃশ্যের স্কেচটা দেখিয়ে বললেন “শোনো, ওই বাঘটাকে দেখে ভয়ে গুপী এই গানটা গাইছে। গলা একেবারে স্টেডি হলে কি সেটা ঠিক হত?” মানিকদার গানের লয় সবসবময় মেট্রোনোমে ঠিক করা থাকত। পরে শুনেছিলাম, এই গানে যে বাঘটাকে উনি ব্যবহার করেছিলেন, এই গানের লয় নাকি সেই বাঘের নিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে করার চেষ্টা করেছিলেন। কথাটা কতদূর সত্যি আমি জানিনা কারণ আমাকে এটা ওঁর এক সহকারী বলেছিলেন। তবে ছবিটা দেখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, গানের লয়ের সঙ্গে বাঘের নিশ্বাস প্রশ্বাস হুবহু মিলে যাচ্ছে। এই ছিল ওঁর কাজের ধরন। কোনটা কেন করাচ্ছেন তা আমরা সবসময় হয়তো ধরতে পারতাম না কিন্তু ছবি দেখতে গিয়ে বুঝতাম যেখানে যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই রয়েছে। কোথাও কোনও ঘাটতি কিংবা বাড়তি মেদ নেই। অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। অনেকেই অনেক ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু মানিকদা যেভাবে একটা ছবির প্রয়োজন মাথায় রেখে তার গান, নেপথ্য সঙ্গীত, সবকিছুকে এক তারে বাঁধতে পারতেন, সেরকম আমি আর কাউকে করতে দেখিনি। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯১ অবধি মানিকদার সঙ্গে কাজ করেছি। এই পেশায় আসার আগে বাজনা আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মধ্যে কোনটাকে বেছে নেব তা নিয়ে খানিকটা দোলাচলে ছিলাম। কারণ তার আগেই ১৯৭৭-এ সদ্য যাদবপুর থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি। ১৯৯২-এ মানিকদা চলে যাওয়ার পর আমি সঙ্গীতের পেশা থেকে সরে এসে চাকরিতে ঢুকে পড়ি এবং সেই একই সংস্থায় একটানা ২০১৫ সাল অবধি চাকরি করে অবসর গ্রহণ করি। অনুলিখন: পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়

6 Responses

  1. মুগ্ধ করে দিলে। নোটেশন আর বার এর কথা যা শোনালে তার অনেকটাই মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। দেখা হলে আরও ভাল করে বুঝতে হবে। অসাধারন স্মৃতিচারণ। তুমি তো ছুপারুস্তম।

  2. লেখক সত‍্যি ভাগ‍্যবান কাছের ঐ বিরাট মাপের মানুষটিকে দেখেছেন, কথা বলেছেন এবং তাঁর সৃষ্টির সংগে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ছেন।

  3. ভীষণ ভালো একটি প্রতিবেদন । Music of Ray নিয়ে
    একটু কাজ করতে গিয়ে অনেক সংশ্লিষ্ট অজানা তথ্যের সন্ধান পেয়েছিলাম , এই বিশাল মাপের মানুষটির সম্পর্কে আরও কত যে তথ্য জানার আছে এবং সবিশেষ আগ্রহে তার কিছুটা পেলেই সমৃদ্ধ হই। শ্রীকুমার বাবুর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় নি থাকলেও ওঁর সম্বন্ধে অনেক টাই জানি ইনি একজন শিক্ষিত সরোদ বাদক । অভিযোগ নয়, একটি বিশেষ অনুরোধ রইল আপনার কাছে , Violinist group এর মিহির গুপ্তর নামটি বোধ হয় Violin brothers এর আগে উল্লিখিত হওয়া উচিত । ভালো থাকবেন ।

  4. প্রতিদিন এই মহান মানুষটির সম্পর্কে নতুন নতুন বিষয় জানছি , আর তত বিস্ময়ের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে । এই লেখাটি সঙ্গীতের ব্যাপারে ওঁর জ্ঞান যে কী পরিমাণ গভীর তা কত সহজ ভাষায় জানিয়ে দিল !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com