banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

শুধু সেই সে দিনের মালি নেই! (শেষ পর্ব)

পল্লবী মজুমদার

মে ২, ২০২০

Bengali songs of Manna Dey
Bengali songs of Manna Dey
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Suparnokanti Ghosh
কিংবদন্তী সুরকার নচিকেতা ঘোষের সুযোগ্য পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ, যাঁর সুরে আমৃত্যু গান গেয়েছেন মান্না। ছবি – সুপর্ণকান্তির ব্যাক্তিগত সংগ্রহ থেকে

কথা বলতে বলতে যেন সেই সোনালি দিনেই ফিরে গিয়েছিলেন সুপর্ণদা। আমার সামনে না থাকলেও বুঝতে পারছিলাম, ওঁর একটা ঘোর লেগে গিয়েছে। বলতে থাকলেন, “আসলে তখন তো কিছু ভাবতাম না গান তৈরির আগে। একদিকে মানাকাকু গাইছেন, আর একদিকে পুলককাকা লিখছেন, গৌরীকাকা লিখছেন… সে এক অবিশ্বাস্য সময়। আমি আবার তখন ইউনাইটেড ব্যাঙ্কে চাকরি করি। একদিন বসে সিগারেট খাচ্ছি, পিছন থেকে পিঠে এক চাপড়, “এই খোকা বসে বসে সিগারেট ফুঁকছিস? ফ্যাল শিগগিরই।” আমি তাড়াতাড়ি উঠে সিগারেট ফেলে ঘুরে দেখি, পুলককাকা। বসালাম। দেখি মেজাজ খারাপ। বললাম, ‘কী হয়েছে পুলককাকা?’ বললেন, “জানিস খোকা, কোদাইকানাল বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখনই শুরু হল মণ্ডল কমিশনের ঝামেলা। আমার একটা গান এল। লিখে ফেললাম। আজ মান্নাদার কাছে গেলাম। আমাকে বললেন, “দূর মশাই, এসব কী লিখে এনেছেন? আমি এসব গান গাই না। প্রেমের গান গাই।” বলে খাইদাইয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।” আমি বললাম, ‘দেখি কী গান।’ দিলেন। গানের কথাটা আমার খুব অন্য রকম লাগল –
দশ বছরের বংশি মুচির ছেলে
বাড়িতে কাজের লোক রাখলাম তাকে।
আমার শ্রীমতি বলল শুনে
ও যেন ঠাকুরঘরে কখনও না ঢোকে।

এবার মানাকাকু মুম্বই থেকে এসে ফোন করলেন। “খোকা এসো আড্ডা মারি।” গেলাম। তার আগের বছরেই ওঁর বাইপাস সার্জারি হয়েছে। পুজোর গান সে বছর করেননি। এ বার যথারীতি জিজ্ঞাসা করলেন, “নতুন গান টান করলে কিছু?” বললাম, “হ্যাঁ কাকু সুর করেছি পুলককাকার লেখা একটা গানে।” কী গান? বললাম ওই গানটার কথা। চোখ টোখ কুঁচকে বলে উঠলেন, “ছিছিছিছি, তোমার এত ডিগ্রেডেশন হয়েছে খোকা? এই সব কী করছ তুমি? মুচির ছেলে, মুদির ছেলে, এসব একটা গান হল?” আমি অকুতোভয় হয়ে বলে ফেললাম, “কাকু আমার কনসেপ্টটা খুব ভালো লেগেছে। আপনি একবার সুরটা শুনবেন?” রাজি হয়ে গেলেন। একবার গাইলাম। শেষ হতে না হতেই বললেন, “আর একবার গাও তো!” এই করে বেশ ক’বার শুনলেন চোখ বুজে। তারপর হঠাৎ বলে বসলেন, “সপ্লেনডিড লাগছে! আমি গাইব এই গান।”

“তখন ওঁর জামাই জ্ঞান দেব একটা ক্যাসেট কোম্পানি খুলেছেন। প্যারামাউন্ট ক্যাসেটস। সেই কোম্পানির প্রথম অ্যালবাম বেরল এই গান দিয়ে। আর বেরতেই সুপার ডুপার হিট। এক লক্ষ ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল এই এক গানের জোরে। আরও যে কত স্মৃতি, কত বলব? একবার আমি মুম্বইতে ছবির গান রেকর্ডিং করছি। সত্যদা মানে সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি সত্যজিতের ‘নায়ক’ ছবিতে সাধুবাবার পার্ট করেছিলেন) রয়েছেন। মানাকাকু এসে হাজির। সত্যদাকে বললেন, “আপনি তো মশাই দারুণ লেখেন আর আবৃত্তি করেন! কিছু শোনান না!” সত্যদাও এক কথায় রাজি। বললেন, “এই তো ফুটবল নিয়ে একটা লিখেছি। বলে ‘খেলা ফুটবল খেলা’টা পুরোটা আবৃত্তি করে শোনালেন। শোনামাত্র বললেন, “আপনি এই লেখাটা খোকাকে দিয়ে দিন তো! ও ছাড়া কে এটা সুর করবে! এত রকম ইমোশন গানটার মধ্যে, এত ঘটনা! আমি গাইব এটা।” আসলে মানাকাকু নিজে খেলাপাগল ছিলেন। অসম্ভব ভালোবাসতেন খেলাধুলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক সঙ্গে বসে খেলা দেখা, খেলা নিয়ে আড্ডা দিতেন। তাই এ গানটা ওঁকে খুব অ্যাপিল করেছিল।”

ততক্ষণে আমার মনে পড়ে গিয়েছে ফুটবল নিয়ে বাঙালির আইকনিক গান – ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল!’ সেও যে মান্না দে-র কণ্ঠে! বলতেই সুপর্ণদা ফিক করে হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, “এটা ঠিকই বলেছ। ফুটবল নিয়ে বাঙালির এই দুটোই গান। দুটোই গেয়েছেন মান্না দে। একটা আমার বাবার সুরে। আর একটা আমার সুরে।” দুজনেই এরপর খুব খানিক হাসলাম।

Manna Dey
খেলা ফুটবল খেলা গান তৈরির সময় সুপর্ণকান্তির সঙ্গে মান্না এবং তরুণকুমার। ছবি – সুপর্ণকান্তি ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

গল্প করতে করতে আড্ডার মুড এসে গিয়েছিল সুপর্ণদার। বলছিলেন, “মানাকাকুর সঙ্গে গল্পের কি কোনও শেষ আছে গো? আমাদের সম্পর্কটাই তো একটা অনিঃশেষ গল্প। একবার আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা-মেয়ের গান’ বলে একটা অ্যালবাম করবেন। উনি আর ওঁর মেয়ে। কী কঠিন পরীক্ষা ভাবো! আটখানা গান, পুলকবাবুর লেখা। নানারকম মুডের। উনি আর ওঁর মেয়ে সুমিতা (চুমু) গাইবেন…”
চলো বাবা ঘুরে আসি
আজ গান থাক
তানপুরা বাঁধব না
আজ গলা সাধব না,
একি কথা শোনালি রে
হচ্ছি অবাক!

“তখন আমি মুম্বইতে ছবির কাজ করছি। শানু আর কবিতা কৃষ্ণমূর্তি গাইছে। পরের দিন রেকর্ডিং। উনি বললেন, “কাজ সেরে তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবে।” আসলে উনি নিজেও খাদ্যরসিক ছিলেন। আমার বাড়িতে এসে আবদার করতেন, “একটু ব্র্যান্ডি আনাও তো! খাব!” আমি তো ড্রিংক করি না। ফলে কিস্যু জানি না ও বিষয়ে। কিন্তু একবার উত্তমকাকুর বাড়ির নিমন্ত্রণে শুনেছিলাম যে নেপোলিয়ন ব্র্যান্ডি নাকি খুব বিখ্যাত। তাই আনালাম। আর তার সঙ্গে পেপারনি পিৎজা উইথ ডাবল চিজ! ভাবতে পারো? সে হেন লোক আমাকে ডাকলেন প্রাতঃরাশে। কিন্তু আমার এমন কপাল, শানু গানটা গাইতে নিল ঝাড়া তিনটি ঘণ্টা। যেতে পারলাম না ঠিক সময়ে ওঁর কাছে। ভরদুপুরে কাজ শেষ করে হাজির হলাম ওঁর বাড়ি। বললাম, কেন দেরি হয়েছে। তখন লাঞ্চটাইম। সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম বের করে গানের জোগাড় হল। গান শেখা শুরু হল। হঠাৎ এক সময় বললেন, “খোকা চুমুকে শেখাও। আমি আসছি।” বলে চড়চড়ে রোদ্দুরে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বেরিয়ে গেলেন। আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে খেতে ডাকলেন। আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা কী হল বুঝলাম না তো!’ রহস্যটা ভাঙল চুমু। বলল, “আসলে আজ আমাদের বাড়ি নিরামিষ। আর তুমি মাছ-মাংস খেতে ভালোবাসো। তাই বাবা বেরিয়ে গিয়ে তোমার জন্য নন ভেজ খাবার কিনে আনলেন।” এই রকম ছিল মানাকাকুর স্নেহ, তাঁর ভালোবাসা, তাঁর কনসার্ন।” বলতে বলতে গলাটা কেমন গভীর হয়ে আসছিল সুপর্ণদার। বুঝলাম, সেই আদর, সেই বন্ধন আজও একা একা মিস করেন।

তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার প্রিয় কয়েকটা গানের কথা বলুন এ বার। নিজে হাতে তৈরি করে ওঁকে শিখিয়েছেন, গাইয়েছেন, এরকম প্রিয় গানের কথা বলুন।” কাজটা কঠিন, সন্দেহ নেই। বলে চললেন নিজের প্রিয়তম কম্পোজিশনগুলো – “মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, আমায় চিনতে কেন পারছ না মা, মা মাগো মা, চলে গেছে বন্ধু আমার, আজও আমার পরাজয়ে কাঁদো… এই কটা গান করে যে পরিতৃপ্তি পেয়েছিলাম, আজও মনে রেশ রেখে গিয়েছে। বিশেষত ‘মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়’ গানটা রেকর্ড করার পরে নিজের হাত থেকে সিটিজেন ম্যানুয়াল ঘড়ি খুলে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, “আজ থেকে এটা তোমার।” এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি, তৃপ্তি আর কী হতে পারে জীবনে?”

Manna Dey
কফি হাউসের রেকর্ডিং-এ! ছবি – সুপর্ণকান্তি ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

ঘড়ির কাঁটা এদিকে এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। বক্তা-শ্রোতা কারওই সে দিকে বিশেষ খেয়াল নেই। সুপর্ণদা তাও একবার মনে করিয়ে দিয়েছেন সময়ের কথা। কিন্তু আমার কৌতূহল তো শেষ হওয়ার নয়! এখনও যে আসল কথাই জিজ্ঞাসা করা বাকি! এ বার সেই প্রসঙ্গ তুললাম। কিংবদন্তী শিল্পীর গলায় কিংবদন্তী গান – কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই! প্রশ্ন করলাম, “এ গানটা যে এ রকম উচ্চতায় চলে যাবে, মান্না দে-র সিগনেচার সং হয়ে থেকে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, ভাবতে পেরেছিলেন?”

সুপর্ণদা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন আমাকে। “ধুশশশ। কেউ ভাবতে পারেনি। মানাকাকু নিজেও কিচ্ছু ভাবেননি।” তাহলে এই মহাকাব্য কী করে সৃষ্টি হল? সুপর্ণদা বলতে লাগলেন, “আমাকে হাজরার একতলার ঘর থেকে ডেকে এনে সে আমার ছোট বোন দিয়েছিলেন উনিই। দেড় বছর বসে থাকার পর ফের উনিই ডেকে সারা জীবনের গান দিয়েছেন আমায়। খেলা ফুটবল খেলা- সেও ওঁর দেওয়া। উনিই সত্যবাবুকে বলে কবিতাটা আমাকে দিলেন। না হলে ও গান হত না। আর সবকটাই তুবড়ির মতো হিট। তবু আমার ভেতরে কেমন যেন ঘুণপোকার মতো কুরকুর করত সারাক্ষণ। এত করছেন মানুষটা আমার জন্য, কৃতজ্ঞতা রাখার জায়গা নেই আমার। তবু যেন মনে হত, আমি তো ওঁকে কিছু দিতে পারলাম না। এর মধ্যেই ১৯৮২ সালে পারিবারিক সূত্রে প্যারিস বেড়াতে গেলাম। দাদা বলে দিয়েছিলেন, একটা জায়গা আছে তোর খুব ভালো লাগবে। মঁমার্ত। ঘোড়ার খুরের মতো একটা জায়গা যেখানে রাজ্যের ক্যাফে আর শিল্পীদের আড্ডা। গেলাম মঁমার্ত। অদ্ভুত মনকাড়া পরিবেশ! আর গাইড বলে চলল, এই ক্যাফেতে বসে স্কেচ করতেন সালভাদর দালি। এই ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিতেন ত্রুফো। গল্প করতেন পাবলো নেরুদা। ওই আমার মাথায় ঢুকে গেল আড্ডা।”

Manna Dey
রেকর্ডিস্টের সঙ্গে, কফি হাউসের রেকর্ডিংয়ে। ছবি – সুপর্ণকান্তি ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

“কলকাতায় ফিরতেই এম কম পরীক্ষা। পড়ায় ডুবে গেলাম। এমন সময় একদিন শক্তিদার (শক্তি ঠাকুর) জন্য একটা গানের সঞ্চারী লিখতে আমার বাড়িতে এলেন গৌরিকাকা। শক্তিদা আবার প্রফেসর ছিলেন। আমার বোনেদের পড়াতেন। গৌরিকাকা এসেই জমে গেলেন শক্তিদার সঙ্গে গল্পে। বেশ কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হয়েছে আমি নেই ঘরে। ব্যাস। দুম করে রেগে গেলেন। “কোথায় খোকা? সে কি তার বাপের চেয়ে বড় সুরকার হয়ে গিয়েছে, যে আমাকে বসিয়ে রেখে সে আড্ডা মারছে? বিড়ি ফুঁকছে?” হাঁকডাক শুনে বেরিয়ে এসে বললাম, “আড্ডা মারিনি কাকা। পড়ছিলাম, সামনে পরীক্ষা। আর খুব তো আড্ডা আড্ডা করছ। আড্ডা নিয়ে জমিয়ে একটা লেখ দেখি! সেই তো গান চাইতে গেলে পুলককাকার কাছে যেতে হবে আমাকে!” এ খোঁচায় তো আগুনে ঘি পড়ল! চোখ গরম করে বলে উঠলেন, “কী ভাবো তুমি নিজেকে হে? আড্ডা নিয়েও গান হবে?” বললাম, কেন হবে না? এই যে আমাদের কফি হাউস রয়েছে, বাঙালির নিজস্ব আড্ডাখানা, কত কী প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে সেখানে, এ নিয়ে একটা গান হয় না? গৌরিকাকার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। “ভালো বলেছিস তো খোকা! লেখ লেখ লিখে নে”,
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই
আজ আর নেই।

সঙ্গে সঙ্গে ওই নিউ আলিপুরের একফালি বাড়ির মেঝেতে বসেই সুর বেঁধে ফেললাম। আর সেই প্রথম লাইন শুনেই বেঁটেখাটো শক্তিদা আমার পায়ের সামনে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে বললেন, “খোকা এ গানটা তুই আমায় দে।” আমি খুব হাসতে হাসতে বললাম, তোমার গান গৌরিকাকা তো লিখে এনেছেন গো! শক্তিদা নাছোড়। কিন্তু গৌরিকাকার তো মুখড়া লেখা শেষ। হাঁটা লাগালেন বাড়ির দিকে। পরের দিন সাতসকালে কাকিমার ফোন। “কী এক গান দিয়েছিস রে খোকা? সারারাত না-ঘুমিয়ে গান লিখে যাচ্ছে! জানিস না ওঁর শরীর কতো খারাপ? এ রকম গান দিবি না ওঁকে।” আমি জানতাম, গৌরিকাকার গলায় ক্যান্সারটা সবে তখন জানান দিতে শুরু করেছে। তাই চুপ করে রইলাম। বেলা বাড়তেই আমার কুঠরিতে তাঁর পদধূলি। কাগজ ফেলে দিয়ে বললেন, “এই নাও তোমার কফিহাউস।”

পড়লাম। অসামান্য কথা। কিন্তু শেষ হয়েও হল না যে শেষ! আরেকটা অন্তরা দাবি করছে যে! বললাম। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আমার সঙ্গে মারপিটের উপক্রম। মানাকাকুকে সটান ফোন। “খোকা ওর বাবার চেয়েও বড় ভাবছে নিজেকে মান্নাবাবু। গৌরিপ্রসন্নকে ডিকটেট করছে কী লিখতে হবে। বলছে আরও একটা শেষ অন্তরা নাকি লিখতেই হবে। এ গান আমি ওকে এমনিই দিয়ে দিলাম। আপনাকে বলে দিলাম আমি আর লিখব না।” বলে কাগজ ফেলে বাড়ি। ঝগড়াঝাঁটি, ফাটাফাটি, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। মাঝে মাঝেই ফোন করে খোঁচা দিচ্ছি, “উফফ, সে আমার ছোট বোনে পুলককাকা কী লিখেছিল বল তো শেষ স্তবকটা! তার গান থেমে গেছে, নেই শ্রোতা আর…! ভাবতে পারছ? ”

তারপর? তারপর? আমি যেন ক্রাইম থ্রিলার পড়ছি, এমন উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাম। সুপর্ণদা গল্প বলে চললেন, “তার পরেই গৌরিকাকার কোথায় যেন একটা যাবার ছিল। চেন্নাই না মুম্বই কোথায় যেন। ট্রেনে উঠে বসেও পড়েছেন। ওখানে অত লোকজনের মধ্যে আচমকা মাথায় এসেছে ওই কটা লাইন-
সেই সাতজন নেই
আজও টেবিলটা তবু আছে
সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই
একই সে বাগানে আজ
এসেছে নতুন কুঁড়ি
শুধু সেই সে দিনের মালি নেই।

Manna Dey
খোকার কাছ থেকে কফি হাউসের শেষ স্তবকের নোটেশন লিখে নিচ্ছেন মানাকাকু! ছবি – সুপর্ণকান্তি ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

“লিখবেন কোথায়? একটা সিগারেটের রাংতায় লাইন কটা লিখে স্টেশনে আসা এক চেনা লোককে ধরে বললেন, “এই কাগজটা খোকাকে দিয়ে আসতে পারবে?” সে তো আকাশ থেকে পড়েছে! কে খোকা? বললেন, “ওর নাম সুপর্ণকান্তি। নিউ আলিপুরে থাকে। ঠিকানা জানি না। পৌঁছে দিও।” বলতে বলতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ভাগ্য ভালো সেই সহৃদয় ব্যক্তি আমাকে খুঁজে বের করে কাগজটা পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমি তদ্দিনে মানাকাকুকে বাকি গানটা শিখিয়ে দিয়েছি। শুধু ওই শেষটা বাকি। লাইভ রেকর্ডিংয়ের জন্য স্লিপার ক্লাসে মুম্বই যাচ্ছি। তখনও সুর হয়নি শেষটার। উপরের বার্থে উঠে বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালতেই সুরের খেইটা এসে গেল। তখন মোবাইলও নেই। গুনগুন করে গেয়ে গেয়ে মনে রাখলাম। পরদিন মুম্বই পৌঁছে কাকুকে শেখালাম। উনি মুগ্ধ।

ওঁর অ্যারেঞ্জার ওয়াই এস মুলকির সঙ্গে কথা হল। আমাকে বললেন, “বলো খোকা কী অ্যারেঞ্জমেন্ট লাগবে তোমার।” আমি ওঁকে আমার একটা ভাবনার কথা বললাম, যে এটা তো আসলে একটা বন্ধুত্বের গান। আর সুরের কাঠামোটা অন্য রকম। এখানে যদি আইরিশ লোকগান অল্ড ল্যাং সাইন-এর সুরটা (যে সুর ভেঙে রবীন্দ্রনাথ পুরানো সেই দিনের কথা করেছিলেন) রূপকের মতো ব্যবহার করা যায় ইন্টারলিউডে, খুব ভালো হয়। মুলকি আংকল এক কথায় রাজি। ওঁর সঙ্গে পরের দিন স্টুডিওতে গেছি। তখনও মানাকাকু আসেননি। দেখলাম আমরা দু’জন ছাড়া আরও একজন এক কোণে বসে রয়েছেন বেস গিটার হাতে। চিনলাম না। এদিকে আমার হাতে হারমোনিয়ম ধরিয়ে দিয়ে মুলকি আংকল গিয়েছেন নিচে ব্রেকফাস্ট খেতে। আমি গান প্র্যাকটিস করছি।

এমন সময় দেখি গুটি গুটি পায়ে ওই গিটারিস্ট ভদ্রলোক এগিয়ে এসে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, “এটা কি তোমার সুর করা গান?” বললাম হ্যাঁ। উনি আবার বললেন, “মান্নাদা গাইছেন?” এবারও হ্যাঁ বললাম। উনি আস্তে আস্তে বললেন, “আমি কি এই গানটার সঙ্গে নিজের মতো বাজাতে পারি?” আমি ফাঁপরে পড়ে বললাম, “মুলকি আংকল আসুন। উনি তো অ্যারেঞ্জার। ওঁকে জিজ্ঞাসা না-করে কী করে বলি?” মুলকি আংকল আসতেই কথাটা বললাম। ওঁর তো চোখ কপালে। বললেন, “খোকা, কাকে কী বলেছ তুমি! জানো উনি কে? উনি হলেন টোনি ভাজ। ওঁকে ছাড়া পঞ্চমদা স্টুডিওতে ঢোকেন না পর্যন্ত! টোনি, তোমার যেখানে যেমন ইচ্ছে তুমি বাজাও।” ব্যাস! বাকিটা তো ম্যাজিক।”

এ বার আমার গলা ধরে আসার পালা। এমন ভাবে গান তৈরি হয়? সুপর্ণদা বললেন, “ম্যাজিক এ ভাবেই হয়, জানো তো! এ ম্যাজিক আসলে শ্রদ্ধার ম্যাজিক। ভালোবাসার ম্যাজিক। ওটা ছিল বলেই এ ভাবে যা ইচ্ছে তাই করতে পেরেছি ওঁর প্রশ্রয়ে। নিজের সন্তানদের থেকেও বোধ করি বেশি স্নেহ পেয়েছি ওঁর কাছে। আর শিখেছি। সারা জীবন ধরে শিখেছি। ওঁকে আমি সারাজীবনে এই একটাই উপহার দিতে পেরেছি। আর মনে করলে গর্ববোধ হয় যে সেই উপহার ওঁর উপযুক্ত হয়েছিল। মান্না দে আর কফি হাউস আজও সমার্থক। এমন কোনও অনুষ্ঠান হয়নি পৃথিবীর কোনও প্রান্তে, যেখানে ওঁকে এ গানটা গাইতে হয়নি। এ গান ওঁর স্বাক্ষর। এ গান ওঁর আইডেনটিটির অঙ্গ। এ গান ওঁর অ্যানথেম। আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি ওঁকে এই উপহার দিতে পেরেছিলাম।”

আজ শতবর্ষের জন্মদিনে মনে পড়ছে ওঁর ভালোবাসার কথা। একবার রবীন্দ্রভারতীর আর্কাইভ উদ্বোধনে গিয়েছেন। গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সামনে বসে ভাষণ দিচ্ছেন। আমি অনেক পিছনে এক জায়গায় বসে। ঠিক দেখতে পেয়েছেন। ভাইপো ভুতুকে ডেকে কী যেন একটা বললেন। একটু বাদে ভুতু হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে এসে আমাকে দিয়ে গেল। বলল, “কাকা তোমার জন্য আমেরিকা থেকে এনেছেন।” ওই অত ভিড়ভাট্টার মধ্যেও আমাকে উপহার পাঠানোর কথা ভুলতে পারতেন না। ওঁকে ভালো না-বেসে আমার উপায় আছে কী? উনি আজও আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। প্রথম প্রেমে পড়া, প্রেম ভাঙা, পুরস্কার, শরীরখারাপ, সব কথা ওঁকে সকলের আগে জানাতাম। ওঁর কথা, ওঁর ঠাট্টা, ওঁর শিক্ষা- এ জীবনে ভোলার নয়। ডিসিপ্লিন, ডিটারমিনেশন, ডিভোশন – এই তিন শিক্ষা আমার ওর থেকেই শেখা। সারাজীবন ধরে এই পথেই চলেছি। আমার ক্ষমতা কী যে ওঁর সঙ্গীত আমি ধরব? আমি শুধু শিখতাম ওঁর জীবনদর্শন। উনি ছিলেন আমার বাবা। আমার সুহৃদ। আমার প্রেরণা।”

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

4 Responses

  1. সুপর্ণবাবুর অভিজ্ঞতা পল্লবীর কলমে – এক্কেবারে মিঠা পাত্তির সাথে বেনারসি জর্দা! মনটা এক্ধাক্কায় মৌতাতে চলে গেলো !

  2. সুপর্ণবাবুর স্মৃতিচারণ আর পল্লবীর কলম – যেন মিঠা পাত্তি আর বেনারসী জর্দার যুগলবন্দী। এখনও তার মৌতাতে বুঁদ হয়ে আছি !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com