ভোগ শব্দটা শুনলেই আমি একটা আলতো আওয়াজ শুনতে পাই। মিষ্টি একটা থপ করে আওয়াজ। কলার পাতে কাঁসার ডাব্বা হাতা থেকে হলদে রঙের খিচুড়ি পড়ার শব্দ।
ভোগের খিচুড়ি।
সরস্বতী পুজো হলে ভর দুপুরে। লক্ষ্মীপুজো হলে রাতে। আর কালীপুজো হলে ভোর ভোর।
সাধারণত ভোগের খিচুড়িতে আমি টমেটো ছাড়া আর কোনও সবজির উপস্থিতি টের পাইনি কখনও। কারণ আলু, মটরশুঁটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি আর যা যা খিচুড়ি-উপযোগী তরিতরকারি, তার সবগুলো দিয়েই খিচুড়ির সঙ্গত ডালনাটি তৈয়ার হয়। লক্ষ্মী-সরস্বতীর পুজো হলে ফুলকপির ডালনা বা বাঁধাকপির শুকনো তরকারি। কালীপুজোর ভোগের মেনু অবশ্য দেখেছি নির্ভর করে কোন সময়ে পুজো হচ্ছে, তার উপরে অনেকটাই। মধ্যবিত্ত বাড়ির কালীপুজোয় পাঁচ-তরকারি মেশানো লাবড়া বা পুঁইশাক চচ্চড়ি খেয়েছি খিচুড়ির অনুপানে। তবে সব ভোগেই খিচুড়ি-তরকারির শেষপাতে টমেটো আমসত্ত্বের চাটনি। একটু সম্পন্ন বাড়ি হলে তাতে দু চারটে কিশমিশ কিংবা খেজুরের টুকরোও ক্কচিৎ মিলে যায়। তারপর ছোট্ট ছোট্ট ধবধবে সাদা ন্যাতানো লুচির ওপর এক থাবা পায়েস।

সেকেলে বামুনবাড়ির মেজবৌ আমার ঠাকুমাকে দেখতুম পুজোর দিন সকাল থেকে উপোস করে ভোগ রাঁধতে। মা-কাকিমারা মাঝেমধ্যে একটু আধটু বেগুনভাজা কি পটলভাজার অনুমতি পেতেন কখনও সখনও। কিন্তু ঠাকুমা সচল থাকতে খিচুড়ির ভার কারও হাতে ছাড়তে দেখিনি। ছোটখাটো চেহারার ঠাকুমা ইয়াব্বড় পেতলের হাঁড়ি আর কড়াই আগুনে বসিয়ে তেমনি বড় এক পেতলের খুন্তি ডুবিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাড়তে থাকতেন। ঘি কিম্বা নুন-মিষ্টি দেবার সময় হাঁড়ির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়াটুকু শুঁকে নিয়ে হাত কপালে ঠেকিয়ে ঢেলে দিতেন। ঠাকুমার হাতের সে খিচুড়ির স্বাদ ছিল অমৃতের মতো।
[the_ad id=”266918″]
পুজোগন্ডার দিনে শরিকি বাড়ির বড় তরফের জ্যাঠাইমারা ভোগ পাঠাতেন। আশপাশের দত্তবাড়ি, নাহাবাড়ি থেকেও ভোগের থালা, টিফিন কেরিয়ার আসত। সকলের ভোগেই তো নিয়মমাফিক মিশে থাকত ধূপধুনোর গন্ধ, ফল-বাতাসার মিঠে, নৈবিদ্যির গাঁদাফুলের পাপড়ি, শান্তিজলের ফোঁটা… তবু আমি পরীক্ষার উৎসাহে সব বাড়ির খিচুড়ি একটু একটু খেয়ে দেখতাম। কিন্তু আমার ঠাকুমার সেই ভাজা সোনামুগ ডাল আর আলোচালের হাল্কা সুগন্ধী খিচুড়ির সঙ্গে আর কোনও বাড়ির খিচুড়ির যেন তুলনাই চলত না। না আলুনি, না কটকটে নোনতা, না হুশফেলানি ঝাল, না জিভ-শুলোনো মিষ্টি – ঠাকুমার ভোগের খিচুড়ির স্বাদ নিয়ে বরাবর একটা শব্দই মনে আসত। পারফেক্ট। নিখুঁত।
বড় হতে হতে ক্রমে ঠাকুমার হাতের তেজ কমে এল। পুজোর আয়োজনেও এল সারসংক্ষেপ। সংক্ষিপ্ত হয়ে এল ভোগের থালাও। তখন ভরসা পাড়ার কারও বাড়ির পুজো, কিংবা বারোয়ারি পুজোর খিচুড়ি।
প্রথম অন্যরকম ভোগের স্বাদ পেলাম আদ্যাপীঠের কালীমন্দিরে। নাটমন্দিরে বসে দূরে ঠাকুরের আরতি দেখার পর লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়। লম্বা টানা হলঘরে মেঝেতে বসা, শালপাতে বা কলার পাতে খাওয়া। তবে গোড়াতেই খিচুড়ি নয়। প্রথমে আসবে গোবিন্দভোগ চালের সাদা ভাত। তারপর বাসন্তী ভাত, যাকে বলে পুষ্পান্ন। সঙ্গে শুক্তো, ভাজা, পাঁচমিশেলি ব্যঞ্জন। আদ্যাপীঠের আরাধ্যা আমিশাষী নন। তাই লাউ, কুমড়ো, চালকুমড়ো, থোড়, এই সব সবজি বলি দেওয়া হয় তাঁর সামনে। তারপর সেই বলিপ্রদত্ত সবজি দিয়ে আশ্রমিকরাই রাঁধেন এক পরম স্বাদু ব্যঞ্জন। পুষ্পান্নের পর ভক্তদের পাতে পড়ে নিয়মমাফিক খিচুড়ি, ভাজা, তরকারি। দু’বেলাই আদ্যাপীঠে ভক্তসেবার ব্যবস্থা আছে, যদিও আমি নিজে সন্ধের ভোগের স্বাদ পাইনি কখনও। শুনেছি সন্ধ্যারতির আগে আদ্যামাকে যে বিশেষ অন্নভোগ দেওয়া হয়, তার নাম অমৃতভোগ। খুব ভালো সুগন্ধী চালের সঙ্গে ঘি, কিসমিস, বাদাম, পেস্তা, দারচিনি, তেজপাতা, লবঙ্গ আর অনেকটা চিনি মিশিয়ে জাফরান সহযোগে পাক করে তৈরি হয় হলুদ রঙের অমৃতভোগ। শেষের পাতে পায়েস থাকে দু’বেলাই।
[the_ad id=”266919″]
আদ্যাপীঠে মূর্তি রয়েছে তিন জনের। রামকৃষ্ণ পরমহংস, আদ্যা মা এবং রাধাকৃষ্ণ। দীর্ঘদিনের পুরোহিত ভবতারণ মুখোপাধ্যায় প্রতিদিন তিন দেবদেবীকে ভোগ উৎসর্গ করেন। সবই ‘দৃষ্টিভোগ’ অর্থাৎ মন্দিরের দরজার সোজাসুজি খানিক দূরের এক হলঘরের মতো জায়গায় তিন ভাগে রাখা থাকে ভোগ। নৈবেদ্যের সময় মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয় যাতে দেবদেবীদের দৃষ্টি পড়ে ভোগে। রামকৃষ্ণদেবের জন্য সাড়ে বারো কিলো, আদ্যা মায়ের জন্য সাড়ে বাইশ কিলো এবং রাধাকৃষ্ণের জন্য সাড়ে বত্রিশ কিলো চালের ভোগ হয় প্রত্যেক দিন। হয় দরিদ্রনারায়ণ সেবাও।

দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী অবশ্য ঘোর আমিশাষী। তবে বলি বন্ধ হওয়ার পর থেকে আর মাংস দেওয়া হয় না। এখন মাছই দেবীর প্রিয়। কারণবারির বদলে দেবীকে দেওয়া হয় ডাবের জল। আদ্যাপীঠের মতো কুপন কেটে ভক্তদের ঢালাও ভোগ খাওয়াবার বন্দোবস্ত না থাকলেও মায়ের ভোগের আয়োজন এলাহী। শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ের জন্য আলাদা খাবার পছন্দ করতেন না। তাই নিজেদের মতো সাদাসিধে আয়োজনেই ভোগ নিবেদন করতেন। সে প্রথাই এখনও চালু রয়েছে। অন্তত সেবায়েতরা তাই বলেন। সাদা ভাত, ঘি ভাত, পাঁচ ভাজা, পঞ্চব্যঞ্জন আর পঞ্চমৎস। বাজারে সেদিন যা ভালো মাছ পাওয়া যায়, তাই-ই দেওয়া হয় ভোগে। বাছবিচার নেই। পাকা রুই, কাতলা, পারশে, কই, এমনকি চিংড়ি মাছও নাকি দেওয়া হয় ভোগের পাতে। সঙ্গে চাটনি, পায়েস ও পঞ্চমিষ্টান্ন। বিকেলে ফল নিবেদনের পর রাতের ভোগে লুচি, ছানার তরকারি, রাবড়ি-সহ নানা মিষ্টি। বিশেষ অন্নভোগেরও ব্যবস্থা থাকে। এই ভোগ রান্নার দায়িত্বে গত পঁচিশ বছর ধরে রয়েছে মিশ্র পরিবার। এখনও তাঁরাই সামলান দৈব-হেঁশেলপাট।
[the_ad id=”270084″]
তারাপীঠের মন্দিরে অবশ্য ছাগবলি এখনও বহাল। দেবীকে নিবেদনও করা হয় তান্ত্রিক মতে বলি দেওয়া সেই ছাগমাংস। সঙ্গে বিলিতি কারণবারি। এখানেও ভক্তেরা প্রসাদ পান। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো মাছ, মাংস, সবজি দেবীকে নিবেদনও করতে পারেন। কালীপুজোর দিন দেবীকে যে ভোগ নিবেদন করা হয় তার নাম ‘রাজকীয় ভোগ।’ এতে তিন রকমের ভাত থাকে। সাদা-ভাত, ঘি ভাত এবং খিচুড়ি। সঙ্গে নিয়মমাফিক পাঁচভাজা, তরকারি, মৎসভোগ। শেষপাতে চাটনি, দই, মিষ্টি। রাতে অবশ্য খিচুড়িরই চল। দশ খানা বড় বড় হাঁড়িতে রান্না হয় দেড় কুইন্টাল চাল-ডালের খিচুড়ি। সঙ্গে পাঁচ ভাজা, তরকারি, শোল মাছ পোড়া আর কারণবারি সহযোগে বলি দেওয়া ছাগমাংস। এখানও দক্ষিণেশ্বরের মতোই বংশপরম্পরায় হেঁশেল সামলাচ্ছেন বীরভূমের ময়ূরেশ্বর এলাকার গুটিকয় পরিবার। তাঁদের ওপরেই ন্যস্ত দেবীর ভোগের ভার। হাতে হাতে সাহায্যের জন্য অবশ্য মন্দিরের সেবায়েতরা সর্বদাই হাজির থাকেন।

তবে কালীঘাটের কালীতীর্থে নিয়মের বেশ কড়াকড়ি। এমনকি পাঁচ ভাজায় কী কী সবজি দেওয়া হবে, তারও বিচ্যুতি হবার জো নেই। দিনে দু’বার ভোগ হয়। সকালে শুক্তো, শাকভাজা, ঘি ছড়ানো মুগের ডাল, আলু বেগুন পটল উচ্ছে ও কাঁচকলা ভাজা, পুষ্পান্ন, রুই, ইলিশ ও চিংড়ি মাছের মৎসভোগ, কচি পাঁঠার ঝোল, খেজুর আমসত্ত্ব আনারসের চাটনি, পায়েস আর পান। সন্ধ্যাভোগে এই সব ছাড়াও থাকে লুচি, আলুভাজা, রাবড়ি, ছানার সন্দেশ আর রসগোল্লা।
এ তো গেল বাংলার চিরায়ত ভোগের কথা। কিন্তু বাংলার বাইরে শ্রীক্ষেত্রের সেই অনবদ্য মহাপ্রসাদের কথা না বললে যে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, মহাপ্রসাদ নাকি ফুরোয় না। পাতিল থেকে বেরতেই থাকে, বেরতেই থাকে। যে পাতিলের আকার দেখে মনে হয় দু’জনের খাবার, তাতে জনা ছয়েক পূর্ণবয়স্ক মানুষ আইঢাই করে খেয়ে উঠতে পারেন। শুনে মনে মনে হাসতুম। বলতুম, বিশ্বাসে মিলায় ভোগ! কিন্তু নিজে যখন খেতে বসলুম, বুঝলুম, এ কেবল বিশ্বাস নয়, খানিকটা হয়তো বিজ্ঞানও! মন্দিরে ঢুকে রান্নাঘরের চেহারা দেখে অবশ্য বোঝার জো নেই যে এখানে দশ-বারো হাজার লোকের রান্না হচ্ছে।

রান্নার পদ্ধতি শুনলে গোপালভাঁড়ের গল্পের কথা মনে পড়ে। বিশাল বিশাল কাঠের চুলো, এক একটা প্রায় ফুট চারেক উঁচু। তার উপর বসানো এক অতিকায় পোড়ামাটির হাঁড়ি। তার উপরে আর একটা, তার উপরে আরও এক। এরকম করে নয় পাত্রের মাল্টিস্টোরিড বানানো। একে বলে নবচক্র। এক একটায় রান্না হয় এক এক রকম ভোজ্যদ্রব্য। উনুনের সংখ্যা ৭৫২, তার মধ্যে গোটা দশেক নাকি কংক্রিটের। তবে সেখানে কেবল পিঠে, নাড়ু, মুড়কি এসব বানানো হয়। রান্নার কৌশলে নাকি সবার উপরের পাত্রের রান্না সবার আগে শেষ হয়। তারপর সেই ভোগ সোনার থালায় আর মাটির পাত্রে ভোগমণ্ডপে চলে যায়। রান্নার প্রণালিরও রকমফের আছে। চার রকমের পাক রয়েছে মহাপ্রসাদের – ভীমপাক, নালপাক, সৌরিপাক, গৌরিপাক।

মহাপ্রসাদের রকমফের অবশ্য মূলত দুই – সাংকুড়ি আর সুখিলা। প্রথমটি হল রান্না করা বা সিদ্ধ ভোগ। অর্থাৎ কিনা ভাত, ডাল, সবজি, দই, টক, হালুয়া এইসব। আর সুখিলা অর্থে শুকনো ভোগ। যেমন নানা রকমের নানখাটাই বিস্কুট, কেক, পিঠে, নাড়ু, মুড়কি, খাজা, ফল। সব মিলিয়েই ছাপান্ন রকমের আইটেম, যাকে বলে জগন্নাথ দেবের ছপ্পন ভোগ।
[the_ad id=”270085″]
তবে দাক্ষিণাত্যের ভোগের ধারা আবার একেবারেই আলাদা। তামিলনাড়ুর মন্দির থেকে কেরলের মন্দিরের ভোগের ধাঁচে অনেক তফাত। আবার কর্ণাটকের মন্দিরের ভোগ একদম আলাদা। পোঙ্গল যেমন একরকমের দক্ষিণী ভোগ – চাল, দুধ আর গুড় দিয়ে তৈরি পায়েসের মতো। কেরলের তিরুঅনন্তপুরমের ভগবতী মন্দিরের পোঙ্গলের খ্যাতি ভারতবিখ্যাত। এর মধ্যে নারকোল কোরা, চটকানো কলা আর এলাচগুঁড়ো পড়ে দেবভোগ্য হয়ে ওঠে সহজেই। পোঙ্গলকে অবশ্য স্রেফ ভোগের খাবার বলা চলে না কখনওই। নতুন চাল দিয়ে তৈরি এই পায়েসের অনুষঙ্গে বাংলার নবান্নের ধাঁচে পোঙ্গল উৎসব পালিত হয় গোটা তামিলনাড়ুতে। কেরালার আর এক বিখ্যাত মন্দির গুরুভায়ুরের ‘পাল পায়সম’ ভোগও দারুণ বিখ্যাত। আটশো লিটার দুধের সেই পায়েসের রেসিপি নাকি খুব সহজ।

কোয়মবত্তুরের মুরুগন মন্দিরের পঞ্চামৃতম ভোগও অনেকটা সেরকমই। তবে সেখানে দুধ পড়ে না। প্রধান উপকরণ হল কলা, আর সেটা আনতে হবে পালানি পাহাড়ের মাথায় বিরুপাচি গ্রাম থেকে। তারপর সেই চটকানো কলার সঙ্গে গুড়, খাঁটি গোদুগ্ধের ঘি, মধু আর ছোট এলাচের গুঁড়ো দিয়ে থকথকে জেলির মতো পঞ্চামৃতম তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে স্বাদ বাড়ানোর জন্য ঢালা হয় চিনি, কিশমিশ আর খেজুর। এমনই মহিমা সে ভোগের, যে তাকে দেওয়া হয়েছে জিআই তকমা! তবে এ ভোগ কিন্তু নৈবেদ্য হিসেবে অর্পিত হয় না! মুরুগন ঠাকুরের সারা গায়ে এই জেলি লেপে তাঁকে স্নান করানো হয়। তারপর সেটাই বিতরণ করা হয় প্রসাদ হিসেবে।

কিন্তু তা বলে এ কথা ভাবা উচিত হবে না দক্ষিণী ভোগ মাত্রেই দুধ-ভাতের গপ্পো। কর্ণাটকের উদুপির মন্দিরের কথাই ধরা যাক। সেখানকার পেঁয়াজ–রসুন ছাড়া সাত্ত্বিক মসালা ধোসার স্বাদ নাকি একবার খেলে ভোলা যাবে না। সাধারণ ভাবে এলাকার মানুষ যে রকম খাবারদাবার খান, ঈশ্বরও তার ব্যতিক্রম নন। খেতের সবজি, চাল, ডাল দিয়েই তৈরি হয় ভোগ। সবজিও খুব মহার্ঘ্য কিছু নয়। রোজকার চালকুমড়ো, মিষ্টি কুমড়ো, মিষ্টি আলু, ওল দিয়ে তৈরি হয় সাম্বার আর তরকারি। তিরুপতির মন্দিরের প্রসাদের বুন্দি লাড্ডু তো জগদ্বিখ্যাত। এক এক দিনে প্রায় লাখ তিনেক লাড্ডু তৈরি হয় তিরুমালার মন্দিরে। ঘি, ময়দা, চিনি, এলাচগুঁড়ো, তেল আর শুকনো ফল দিয়ে বানানো হয় লাড্ডু। এ ছাড়াও পৃথিবীর বৃহত্তম সেই ভোগের পাকশালে হাজারেরও বেশি রাঁধুনি মিলে রোজ রান্না করেন অতি সুস্বাদু ভোগ। তিরুপতির পোঙ্গলের খ্যাতিও দুনিয়াজোড়া। গোটা জিরে-সহ বেশ কয়েক রকমের মশলা দিয়ে রান্না করা হয় এই পোঙ্গল।

তবে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে একটি মন্দিরের কথা উল্লেখ করতেই হবে যার নাম দাক্ষিণাত্যের ভোগ-পরিক্রমায় একেবারে সামনের দিকে থাকবে। কারণ, এখানকার ভোগ হিসেবে উৎসর্গ করা হয় মটন বিরিয়ানি! আজ্ঞে হ্যাঁ, এক্কেবারে ঠিক শুনেছেন। মাদুরাইয়ের মুনিয়ান্ডিস্বামী মন্দিরে প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসে, ফসল কাটার পর ভোগ দেওয়া হয় মটন বিরিয়ানি। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের খেতের ফল, চাল, তরিতরকারি এবং ঘরের পাঁঠা-মুরগি ভেট দিয়ে যান দেবতাকে। তাদের বলি দেওয়া হয়। তারপর সেইসব দিয়েই তৈরি হয় শৈবশিষ্য মুনিয়ান্ডির ভোগের বিরিয়ানি। কয়েকশো কিলো চাল, পাঁঠার মাংস (মুরগির মাংসও থাকে) এবং তরিতরকারি সম্বলিত সেই বিরিয়ানি রান্না হয় কাঠের আগুনে, সারারাত ধরে। রথের রশি ছোঁওয়ার মতো ভোগের পবিত্র খুন্তি ঘুরিয়ে যান ভক্তেরা। ভোর চারটে বাজলে ভোগের থালা দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করে ঘণ্টাখানেক পর বিতরণ করা হয় ভক্তদের।
[the_ad id=”270086″]
দক্ষিণ থেকে একেবারে উত্তরের দিকে চলে যেতে গেলে আবারও ফিরতে হবে সেই ছপ্পন ভোগের খপ্পরেই। মথুরা-বৃন্দাবনে কৃষ্ণের ছপ্পন ভোগের কথা অতি সুবিদিত। কিন্তু কেন এই ৫৬ সংখ্যা নিয়ে মাতামাতি, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। নৃতত্ববিদ পল টুমি এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর বইতে। তাঁর মতে, যে সব মন্দিরে ছপ্পন ভোগ নিবেদন করা হয়, সে সব দেবতারা সকলেই কৃষ্ণের নানা রূপ। কৃষ্ণকে দিনে আটবার ভোগ-সহ অর্চনা করতে হয়। যশোদা যেমন তাঁর সন্তানকে সারাদিন ধরে খাইয়ে দাইয়ে পুষ্টি জোগাতেন, এও অনেকটা তেমনই। ফলে সপ্তাহের সাতদিন আটবার করে ভোগ নিবেদন করলে ভোগের সংখ্যা হয় (৭X৮) ৫৬। তবে এ ছাড়াও আরও একটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাখ্যা রয়েছে টুমির ঝুলিতে। তাঁর মতে, চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় – এই চার রকমের খাদ্য ব্রহ্মাণ্ডের ১৪টি ‘লোক’-এর সবগুলিতে নিবেদন করলেও সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫৬-তে।

কাজেই ভোগ ব্যাপারটা যে শুধুমাত্র কসমিক পুরাণের উপর দাঁড়িয়ে নেই, এটা টুমির গবেষণা থেকে বেশ স্পষ্ট। ভোগ বিষয়টা আসলে প্রতীকী এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অর্থনৈতিক। যেমন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের যিশুর রক্তের প্রতীক হিসেবে ওয়াইন খাবার প্রথার ফলে ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ওয়াইন তৈরি শুরু হয়। ধর্মস্থানে খাবারের প্রয়োজনে তৈরি করা হয় খেত-খামার, শুরু হয় পশুপালন। তিরুমালার মন্দিরগাত্রে তো খোদাই করে লেখাই আছে, কী ভাবে মন্দিরে অনুদানের বিনিময়ে বিতরণ করা হত খাবার, ভোগ হিসেবে। কখনও বা স্থানীয় সনাতন উপকরণের উৎপাদন বাঁচিয়ে রাখতে তৈরি করা হয়েছে ভোগের নিয়ম। যেমন, স্পিতির সনাতনী উৎপাদন কালো মটরশুঁটি দিয়ে রান্না করা হয় সেখানকার কাই গোম্পার ভোগ। যদিও উৎপাদনের সুবিধে এবং কম দামের জন্য স্পিতির অনেক গোম্পাই আজকাল সবুজ মটর ব্যবহার করার দিকে ঝুঁকছে। তবু, এই ধর্মীয় রীতির মধ্যে দিয়ে কাই গোম্পার ভিক্ষুরা বাঁচিয়ে রাখতে চান সনাতনী প্রথা, উৎপাদন, রীতি। আবার কখনও আমদানি-রপ্তানির যোগান বাড়াতে সেই নিয়মকেই সামান্য পাল্টে নেওয়া হয়েছে। যেমন অনেক মন্দিরেই ভোগের অন্যতম প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় হিং, যা মূলত মধ্য এশিয়া থেকে আমদানি করা, একেবারেই স্থানীয় উৎপাদন নয়। কাজেই পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরই হোক বা স্পিতি উপত্যকার তিব্বতি গোম্পা, কলকাতার ইহুদি সিনাগগ হোক বা মেঘালয়ের কার্বি উপজাতির উপাসনা মন্দির, ঐশ্বরিক খাদ্যের নামে যে প্রথা যুগ যুগ ধরে চলছে, তা আদতে সর্বত্র এক মানবিক প্রয়োজনের কথাই বলে।
তথ্যঋণ –
১. Paul M Toomey – Food from the Mouth of Krishna: Feasts and Festivals in a North Indian Pilgrimage Centre.
২. Geeta and Arun Budhiraja – Bhog: Temple food of India
৩. Sudha G Tilak – Temple Tales
৪. Reader’s Digest – October 2019 Issue
৫. Financial Express, New Indian Express, Times of India articles
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!
One Response
এই তথ্যসমৃদ্ধ ও উপাদেয় লেখাটি পড়ে আমি মুগ্ধ।