banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

লাইব্রেরি নিয়ে ব্যক্তিগত…

জুন ৩, ২০২২

The history of Library
বসে পড়ার ব্যাপারটাকে যে রিডিং রুম বলা হয়, তখনও জানা ছিল না
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

মানুষ লিখতে শিখল তার কথাকে স্থায়ী করার জন্যে, বারবার তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যে, তাকে বহন আর সঞ্চয় করার জন্যে। আর যেসব কথাকে মানুষ রক্ষা করার মতো মূল্যবান মনে করল, সেগুলো হয় সুন্দর কথা, না হয় জ্ঞানের কথা। ইংরেজি কথাটা ‘লাইব্রেরি’, আক্ষরিকভাবে গ্রন্থভাণ্ডার। কথাটার সঙ্গে বইয়ের লাতিন প্রতিশব্দ ‘লিবের’ (liber) কথাটির যোগ আছে, যেমন লাইব্রেরির ফরাসি প্রতিশব্দ ‘বিব্লিওথেক’-এর সঙ্গে আছে বইয়ের গ্রিক প্রতিশব্দ ‘বিব্লিওস্’-এর যোগ। তবু এ কথা বলা যায় যে, চেনা বাঁধানো বইয়ের (মুদ্রকদের ভাষায় ‘কোডেক্স’ না কী যেন) লাইব্রেরি মানবসভ্যতায় এসেছে অনেক পরে। হয়তো বাঁশের বাখারির কলমের ছাপ মারা বাচ্চাদের খেলনা বালিশের মতো দেখতে পোড়ামাটির ইটের লাইব্রেরিই পৃথিবীর প্রাচীনতম।

লাইব্রেরি আদৌ তৈরি হল কেন মানুষের সভ্যতায়? মূলত লিখিত তথ্য সঞ্চয়ের জন্য, যা পরে কাজে লাগবে। ছ-হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে সুমেরীয় সভ্যতায় মাটির ছোট বালিশের মতো খণ্ডে একাধিক তিরের ফলার মতো কিউনেইফর্ম চিহ্ন দিয়ে পোষা প্রাণীদের কেনাবেচার হিসেব রক্ষা করা হত। তারপর মানুষ যখন পুঁথি লেখার পর্যায়ে পৌঁছল, তখন তাতে নিহিত বিনোদন আর জ্ঞান ও সঞ্চিত করে রাখার ব্যবস্থা হল। শাসকেরা করল, মন্দির মসজিদ মঠের অধ্যক্ষরা করল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি করল। আর অষ্টম শতাব্দীতে চিনে আর চতুর্দশ শতাব্দীতে জার্মানিতে মুদ্রণ প্রযুক্তি শুরু হওয়ার পরে তো আর কোনও বাধাই রইল না।  

আরকাইভ বা মহাফেজখানা থেকে লাইব্রেরির দূরত্ব সামান্যই। তার ইতিহাস উইকিপিডিয়া আর অন্যান্য সূত্রে প্রচুর পাওয়া যাবে, আমরা তার মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজারাজড়াদের বা সরকারি মহাফেজখানার কোনও যোগ সাধারণভাবে ঘটে না, আগে তো আমাদের ঢোকবারই অধিকার ছিল না সে সব জায়গায়। আমরা বইয়ের পাঠক হিসেবে পাড়ার পাবলিক লাইব্রেরি বা লেখাপড়া-গবেষণার সহায়তার জন্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি খুঁজি, তার সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুক্ত হই।  সাধারণ মানুষ অবশ্য এশিয়াটিক সোসাইটি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, সাহিত্য পরিষদ বা জয়কৃষ্ণ পাঠাগার খোঁজেন না। নেপাল বা কোচবিহারের রাজদরবারের লাইব্রেরিতেও যান না। যেমন বলেছি, তাঁদের যাবার উপায়ও ছিল না।  

Library 2
আমরা বইয়ের পাঠক হিসেবে পাড়ার পাবলিক লাইব্রেরি খুঁজি

 

প্রথমেই সেইজন্য লাইব্রেরির বিনোদন-সন্ধানী পাঠক আর জ্ঞানসন্ধানী পাঠকএ দুয়ের মধ্যে একটা সরল এবং নড়বড়ে তফাত খাড়া করতে ইচ্ছে হয়।  পুরুষ-শাসিত সমাজে এতদিন মেয়েদের প্রথম দলে ফেলে তাদের সম্বন্ধে নানা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দুপুরে নিদ্রালস্যের আগে একটি উপন্যাস হাতে নেওয়া মেয়েদের সম্বন্ধে প্রচুর ঠাট্টা আছে, বলা হয়েছে যে তাদের জন্যেই ‘সিক্স-পেনি সিরিজের’ সস্তা রোমান্সের বইগুলো লেখা হয় আর সারকিউলেটিং লাইব্রেরিগুলো বেঁচে থাকে। কিন্তু আমার কৈশোর-জীবনে একটি মফস্সল শহরের লাইব্রেরিতে বছর চার-পাঁচ স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, পাঠবিনোদন-শিকারি পুরুষও প্রচুর আছেন। 

সেই অনুসারে লাইব্রেরি ব্যবস্থাও অনেকটা দু’রকম চরিত্র নেয়। সব দেশেই বৃহৎ সরকারি ও বেসরকারি পাঠাগার-ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এই সাধারণ পাঠকদের কথা ভেবেই। বিশেষার্থী পাঠকপাঠিকাদের জন্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আর ওপরের সব গুরুত্বপূর্ণ লাইব্রেরিগুলো আছে, কিন্তু সাধারণ পাঠককে লক্ষ করেই দেশের বিশাল ‘পাবলিক’ গ্রন্থাগারব্যবস্থা গড়ে ওঠে, একটা সামাজিক পরিষেবা হিসেবে। অবশ্যই পাঠক এবং লাইব্রেরি, দুটিকেই এরকম সিধে ছকে ভাগ করা যায় না। সাধারণ পাঠকও কখনও বিশেষ পাঠক হয়ে উঠতেই পারেন, আবার সাধারণ লাইব্রেরির মধ্যেও বিশেষ একটি কক্ষ গড়ে তোলা হতেই পারে। অনুপাতের কম বা বেশি।  

লাইব্রেরি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কারও উদ্ধৃতি দিতে আমার একান্ত অনিচ্ছা, কারণ লাইব্রেরির কী মাহাত্ম্য, তা আমাদের কী উপকার (বা অপকার) করেতা বাঙালি শিক্ষিত মানুষেরা জানেন না তা নয়। আপনারা বলবেন, উপকার করে তা তো বুঝলাম, কিন্তু এর মধ্যে আবার অপকারের কথা আসে কী করে? কেন, তা কি কেউ ভাবতেন না? আমাদের শৈশবে অনেক অভিভাবক তো আমাদের ‘বাজে’ বই পড়তে বারণ করতেন, মনে নেই? ‘বাজে বই’ মানে গল্প-উপন্যাস, যা পড়ে এক শ্রেণির অভিভাবক ভাবতেন আমাদের চরিত্র খারাপ হবে। আর লাইব্রেরিগুলোতে মানুষ যে গল্প-উপন্যাস পড়তেই হামলে পড়ে বা পড়ত, তা কে না জানে? 

আরকাইভ বা মহাফেজখানা থেকে লাইব্রেরির দূরত্ব সামান্যই। তার ইতিহাস উইকিপিডিয়া আর অন্যান্য সূত্রে প্রচুর পাওয়া যাবে, আমরা তার মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজারাজড়াদের বা সরকারি মহাফেজখানার কোনও যোগ সাধারণভাবে ঘটে না, আগে তো আমাদের ঢোকবারই অধিকার ছিল না সে সব জায়গায়। আমরা বইয়ের পাঠক হিসেবে পাড়ার পাবলিক লাইব্রেরি বা লেখাপড়া-গবেষণার সহায়তার জন্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি খুঁজি, তার সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুক্ত হই।  

আমিও যখন ছেলেবেলায় আমার ছেড়ে-আসা শহর খড়্গপুরের মিলন মন্দির লাইব্রেরিতে ক’বছর গ্রন্থাগারিক হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছি, তখন দেখতাম গল্প-উপন্যাসই লোকে বেশি পড়ত। জনপ্রিয় লেখকদের গল্প-উপন্যাসগল্পের চেয়ে বেশি করে উপন্যাসের পাতা, মলাট আগে ময়লা হত আর ছিঁড়ত, তাই আগে বাঁধাইকারকে দিতে হত। আর প্রবন্ধের বইগুলো শেলফে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন ঘুমোত। অবশ্য পঞ্চাশের বছরগুলোতে মুজতবা আলী প্রমুখের রম্যরচনা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কোনও কোনও লেখক অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন সংখ্যাগুরু মধ্যম শিক্ষিতদের মধ্যে। 

মহিলাদের দ্বিপ্রাহরিক প্রাগ্-দিবানিদ্রা উপন্যাসপ্রেম নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে অনেকেই কটাক্ষ করেছেন, কিন্তু পুরুষেরাও তখন কম যেতেন না। তাড়াতাড়ি বাঁধাইয়ে পাঠাতে হত শরৎচন্দ্রকে, কিন্তু তারই সঙ্গে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী বা নীহারঞ্জন গুপ্তের বইও। অনেক সময় কারও কারও বইয়ে কোনও রসালো অংশ থাকলে তার লাইনগুলোর নীচে দেখতে-না-দেখতে দাগ পড়ে যেত, পাশে একাধিক তারা চিহ্নও পড়ত, অতিরিক্ত ‘বিঃ দ্রঃ’ বা ইংরেজিতে Good, Very Good-ও লেখা থাকত পরবর্তী পাঠকপাঠিকাদের সাহায্য করার জন্যে। এইসব সমস্যা নিয়েও আমি যেন কেমন করে লাইব্রেরি নামক ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। তারই ফল আজ আপনাদের ভুগতে হচ্ছে। 

না, ‘কেমন করে’ কথাটা একটু ন্যাকা-ন্যাকা-কথা হল। আমি বই পড়তে ভালোবাসতাম, বই কিনতামও। বাড়িতেই নিজের একটা ছোটখাটো বইয়ের আলমারি তৈরি করেছিলাম। তবু আমি বই পড়া থেকে একসময় একটু দূরে সরে যাচ্ছিলাম, সেটা ১৯৫১ নাগাদ, ক্লাস সেভেনে উঠে। সে কথা আমার আত্মজীবনী ‘অল্প পুঁজির জীবন’-এ লিখেছি, নানা জায়গায় লেখা আর কথায় পুনরাবৃত্তিও করতে হয়েছে, তবু বাংলালাইভের পাঠকদের জন্যে আর একবার লিখতে ইচ্ছে হল, ওই ভালো বাংলায় আজকাল যাকে ‘শেয়ার করা’ বলে সেই। 

 

আরও পড়ুন: পবিত্র সরকারের কলমে: বাংলা ভাষার চর্চা

 

উদ্বাস্তু বালক, পশ্চিমবাংলার একটা নদীহীন কাঁকুড়ে শহরে ছিটকে এসে পড়েছিলাম সেই ১৯৪৭-এই। শহরটাতে সম্বল ছিল একটা রেলের কারখানা, তাতে রেলের কামরা তৈরি হত, তারই সাইরেনের তাগিদে, আর তার অর্থনীতিতে শহরের বাঙালি, তেলুগু, ওডিয়া আর হিন্দি ও বিচিত্রভাষীদের জীবন আর সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হত। সেখানে ছিল অজস্র পানের দোকান, আর একটা সস্তা pun করে বলি যে, এই পান-সংস্কৃতিও ছিল দ্ব্যর্থক, তাতে গোপনে পানীয়ও বিক্রি হত। 

এই খড়্গপুর শহরে যেমন কারণে অকারণেবিবাহ থেকে মৃত্যুশোভাযাত্রা, মন্দিরপ্রতিষ্ঠা থেকে ক্যারম প্রতিযোগিতাসব কিছুতে হিন্দি ছবির গান বাজত তারস্বর মাইকে, তেমনই পানের দোকানে সব সময় রেডিয়ো চলত। তাতেও রেডিয়ো সিলোন বলে একটা স্টেশনের অন্তহীন হিন্দি গান। এখানকার লোকেরা বৈধ জীবিকা বলতে স্বপ্ন দেখত ওই রেলের কারখানায় একটা চাকরি পাবে। কিন্তু অবৈধ জীবিকাও ছিল ব্যাপক ও লোভনীয়, মূলত লুম্পেন-প্রজাতির সদস্যদের রেলের মালগাড়ির কামরার সিল ভেঙে জিনিসপত্র বার করে কালোবাজারে সস্তায় বিক্রি করা।  এদের বলা হত ‘সিল-তোড়’। এই সুরম্য জীবিকার পাশাপাশি তারা ছোটখাটো খুনজখম, বদলা নেওয়া ইত্যাদি সম্পাদন করার জন্য ভাড়া খাটত। খড়্গপুরে এদের দাপটের কথা খুব অতীতের স্মৃতি নয়। 

Library 3
পাড়ার দাদা জয়রামদার কল্যাণে লাইব্রেরিতে হাতেখড়ি হল

আমার দ্বিপত্নীক পিতা তখনও পূর্বপাকিস্তানে, আমি ওই শহরে দুই মহিলার (তাঁর দুই পত্নীর, দুই বোন, আমার দুই পিসিমা-কাম-পালিকা মাতার) তত্ত্বাবধানে আছি, স্কুলে পড়ছি। ছাত্রও তত খারাপ নই। কিন্তু কিছু পাড়ার বন্ধুবান্ধবের সংসর্গে এসে আমার মনে হল, লেখাপড়া করে কী হবে, তার চেয়ে ‘সিল-তোড়’ হতে পারলে জীবনে অনেক সার্থকতা (নানা অর্থে) পাওয়া যাবে। তাই মস্তান হওয়ার সাধনপথে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে আমি ওই ক্লাস সেভেনে, মাথার চুলটা– যাতে বাঁ দিকে একটা লম্বালম্বি সিঁথি ছিল ভালো ছেলেদের মতোসেটার ভালুমানুষি ঘুচিয়ে তখনকার জনপ্রিয় নায়ক অশোককুমারের মতো আগাগোড়া উলটে দিলাম। সামনে একটা চুড়োর মতো দাঁড় করিয়ে, এবং এক ছুটির দিনে দুপুরে পাড়ার মোড়ে একটা বাঁধানো বড় ইঁদারার পাশে মস্তানের মতো ঘাড় উঁচু করে, হাফপ্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে এসে দাঁড়ালাম। যেন নিজের অধীন এলাকা পরিদর্শনে দাঁড়িয়েছি, আর সবাইকে বলছি, ‘আমাকে দ্যাখো ! আমি সিলতোড়ের উজ্জ্বল ও মহৎ জীবন নিতে চলেছি।’  

এমন সময় আমাকে, পাড়ার এক দাদা, জয়রামদা, মনে হল কিছুক্ষণ থেকে আমার হাবভাব লক্ষ করছিলেন, সামনে এসে ধরলেন। তিনি লেখাপড়া বেশি করেননি, ক্লাস ফোর পর্যন্ত এগিয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হল বলে থেমে যান। কারখানার রেলগাড়ির কামরাগুলো রং করতেন, তাঁর ছবি আঁকার হাতও ছিল ভালো। আর তিনি ভালোবাসতেন যাত্রা করতে। নিজে যাত্রাপালাও লিখতেন, তাঁর হাতের লেখাও খুব সুন্দর ছিল পরে দেখেছি। তিনি আমাকে দেখে একটু ভুরু কুঁচকে একটু দূরে আমাদের বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘তুমি ওই বাড়িতে থাকো না? অতুলমণি স্কুলে পড়?’ অতুলমণি হল রিফিউজি ছেলেমেয়েদের জন্যে তৈরি একটা স্কুল, আমি যার ছাত্র ছিলাম। আমি ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি বললেন, ‘কোন্ ক্লাসে পড়?’ সে খবর বলতে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ক্লাস সেভেনে পড় তো এমন করে চুল উলটেছ কেন? তোমার বয়সে?”

আমি কী উত্তর দেব? তখনও পাড়ার দাদাকে ‘তাতে আপনার পিতার কী’ ধরনের কথা বলার প্রচলন হয়নি, তাঁরাও অভিভাবকের দায়িত্ব নিতেন। আর মস্তানগিরি তখনও আমার পাকা হয়নি, সবে মস্তানের শারীরিক ছবি আয়ত্ত করবার চেষ্টা করছি মাত্র। শুকনো গলায় আমতা আমতা করছি দেখে তিনি আমাকে বললেন, পশ্চিমে একটা বাড়ি দেখিয়ে, “এই বাড়িটা কী জানো?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, মিলন মন্দির লাইব্রেরি।” তিনি বললেন, “আজ সন্ধেবেলায় এখানে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।” একে পাড়ার দাদা, তার ওপর আমরা তখনও রিফিউজি হিসেবে বহিরাগত, ফলে কথা অমান্য করার সাহস হল না। সন্ধেয় গেলাম। তিনি নিজের পকেট থেকে চার আনা ভর্তি ফি আর মাসিক চাঁদা দু আনা মোট ছ-আনা বার করে অফিসে জমা করলেন, বললেন, “এই ছেলেটাকে মেম্বার করে নাও।” পরে শুনেছিলাম তিনি ওই লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, কাজেই তাঁর কথা সকলের মান্য। রসিদ আমার হাতে গুঁজে দিয়ে জয়রামদা বললেন, “এখান থেকে বই নিয়ে পড়বে আর ফেরত দেবে, আর চুলটা আগে যেমন বাঁদিকে সিঁথি কাটছিলে তেমনই কাটবে।”

আমিও যখন ছেলেবেলায় আমার ছেড়ে-আসা শহর খড়্গপুরের মিলন মন্দির লাইব্রেরিতে ক’বছর গ্রন্থাগারিক হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছি, তখন দেখতাম গল্প-উপন্যাসই লোকে বেশি পড়ত। জনপ্রিয় লেখকদের গল্প-উপন্যাস— গল্পের চেয়ে বেশি করে উপন্যাসের পাতা, মলাট আগে ময়লা হত আর ছিঁড়ত, তাই আগে বাঁধাইকারকে দিতে হত। আর প্রবন্ধের বইগুলো শেলফে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন ঘুমোত। অবশ্য পঞ্চাশের বছরগুলোতে মুজতবা আলী প্রমুখের রম্যরচনা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। 

তাতে এক সঙ্গে অনেকগুলো কাজ হল। আমার মাথা থেকে অশোককুমার অদৃশ্য হলেন, মন থেকে অদৃশ্য হল ‘সিলতোড়’ হওয়ার স্বপ্ন। বইয়ের জগতে আমি সেই যে একবারে আকর্ণ ডুবে গেলাম, আর তার থেকে ওঠা হল না। তাতে কার কী লাভ হল, কার কী ক্ষতি তা জানি না, কিন্তু আমি আজকের আমি হবার দিকে এগোলাম।  একটু একটু করে। তাই অবিশ্বাসী আমার কাছে ইস্কুল-কলেজের মতোই লাইব্রেরিও একটা মন্দির-মসজিদ-গির্জার মতো। বইয়ের দোকানও প্রায় সেই রকমই।

তারপর থেকে দেশবিদেশে প্রচুর লাইব্রেরি আর বইয়ের দোকান ঘুরেছি। আমার ওই মিলন মন্দিরে বছর পাঁচ-ছয় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছি শুধু নয়, একটা ছোটখাটো লাইব্রেরিয়ানশিপ ট্রেনিংও নিয়েছিলাম। খড়্গপুরের মাইল দশেক উত্তরে জেলা শহর মেদিনীপুরে, রাজনারায়ণ বসু পাঠাগারে বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ একটি পনেরো দিনের ট্রেনিং-এর আয়োজন করেছিলেন, সেখানে, সেই ১৯৫৫ সালে।  সাইকেলে করে যাতায়াত করতে গিয়ে একবার তো কালবৈশাখীর ঝড়ে কাঁসাই নদীতে পড়ে যাবার মতো হয়েছিল। ট্রেনিং হল, আমাদের রাস্তার কোণের ছোট লাইব্রেরিটি বড় হতে লাগল, এখন তো সে টাউন লাইব্রেরির মর্যাদা পেয়েছে।  সে অনেক পরের কথা অবশ্য। 

National Library
কলকাতায় হস্টেল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আর ন্যাশনাল লাইব্রেরি হয়ে ১৯৬৯ সালে হঠাৎ প্রমোশন হল বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে, ফুলব্রাইটের দাক্ষিণ্যে

আমি নিজে তারপর কলকাতায় হস্টেল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আর ন্যাশনাল লাইব্রেরি হয়ে ১৯৬৯ সালে হঠাৎ প্রমোশন হল বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে, ফুলব্রাইটের দাক্ষিণ্যে। সেখানে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগেন‌স্টাইন লাইব্ররিতে, দেখলাম অসম্ভব চমৎকার ব্যবস্থা। সারাদিন, পরীক্ষার আগে সারারাত, সেখানে বসে পড়ো, মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে গিয়ে কফি খেয়ে এসো, কেউ কিচ্ছু বলবার নেই। শুধু তাই নয়, তুমি মার্কিনদেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বই চাও তাই পেয়ে যাবে ‘ইন্টার-লাইব্রেরি লোন’ হিসেবে। দাবি জানাও, অমনি ডাকে তোমার বই এসে যাবে, শুধু তোমার স্টুডন্ট আইডির নম্বর হলেই চলবে। সে এক মহা ফুর্তির ব্যাপার। 

ওদিকে ৫৩ স্ট্রিটের সুপারমার্কেটের মলে আসে রোববার-রোববার একটা সার্কিউলেটিং লাইব্রেরি, বিশাল এক বাসের মতো। সেখানে বাবা-মায়েদের সঙ্গে বাচ্চারা আসে। বাবা-মায়েরা বাজার করতে ঢোকেন, বাচ্চারা ওই বাসের মেঝেতে বসে বই পড়ে। আমরাও বই ধার নিই। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক-একটা টার্মের পরীক্ষা হয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা কত বই বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে অতি সস্তায় ‘ঝেড়ে’ দেবে বলে সাজিয়ে রাখে, পঁচিশ ডলারের বই পঞ্চাশ সেন্টে, আমরা গোরুর মতো হামলে পড়ি। কিনি, আর জেফি ব্যাগে করে দেশে পাঠাই জাহাজ-ডাকে। লন্ডনে ফয়েলের দোকানে তীর্থদর্শন করি, কিয়োতোতে চারতলা বইয়ের দোকান দেখে হাঁ করে ঘুরি, ওসাকা রেলস্টেশনের বেসমেন্টে বিশাল বইয়ের দোকান দেখে বিশ্বাস করতে পারি না। সাধ্যমতো কিনি, বই কিনে আস্তানা ভরি, বই পাইও প্রচুর। এখন সেগুলি আমার মাথাব্যথা। 

লাইব্রেরি হল স্কুল-কলেজের একটা বিকল্প আর সহায়ক শিক্ষার জায়গা। আমাদের ছেলেবেলার রিফিউজিদের জন্যে তৈরি গরিব স্কুলে লাইব্রেরি ছিল, কিন্তু তা থেকে আমরা যে খুব বই পড়তে পেতাম, এমন স্মৃতি নেই। প্রথম দিকে কলেজের লাইব্রেরিও খুব ব্যবহার করিনি। বঙ্গবাসীতে অনার্স পড়ার সময় একটু চাড় তৈরি হল, সহপাঠীদের তাগিদ দেখে। নিজের বই কেনার অভ্যেসও তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ধার নিয়ে ফেরত দিতে ভুলে যাওয়ার অভ্যাসও। আর একটা অভ্যেসের চর্চা খুব বেশি হয়নি, তবে একবারেই যে নিষ্পাপ ছিলাম, তা কী করে বলি?  

পশ্চিমবঙ্গে উনিশ শতক থেকেই জনসাধারণের যেমন, তেমনই বড়লোক জমিদারদের প্রশ্রয়ে একটা ভালো লাইব্রেরি-শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছিল। স্বদেশচেষ্টার একটা অংশ ছিল লাইব্রেরি তৈরি, বা সান্ধ্য স্কুল খোলা। পাড়ার ক্লাব-সংস্কৃতির সঙ্গে তার যোগও ছিল স্বাভাবিক, ফলে সন্ধেবেলায় দু-চারখানা খবরের কাগজ পড়ে, তাস-ক্যারম পিটিয়ে, একখানা বই ফেরত দিয়ে নতুন একখানা বই নিয়ে ফেরা যেত। 

jaikrishna-library-front-view-2
উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি

শাসকের আরকাইভ বা ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি তো ছিলই, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির পাশাপাশি বাঙালিরা তৈরি করেছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি, মেদিনীপুরের রাজনারায়ণ বসু পাঠাগার, জেলায় জেলায় আরও কত কত লাইব্রেরি। পরে সেগুলি সরকারি ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে একটি শৃঙ্খলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বিশেষ করে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। তার আগে থেকেই অবশ্য কিছু উদ্যোগী মানুষ এই বাংলায় ‘বেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে তুলে গ্রন্থাগারিক তৈরির আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারবিজ্ঞান বিভাগও খুব পুরোনো। ওই অ্যাসোসিয়েশনের প্রশিক্ষণেই আমি বই সাজানোর ডিউই প্রণালী, কোলন প্রণালী বা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বর্গীকরণ প্রণালীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম।

কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করি, ইদানীং এ রাজ্যের লাইব্রেরিগুলির প্রতি সরকার আর জনসাধারণউভয়ের মনোযোগই কমে এসেছে। পশ্চিমবাংলার বহু সরকারি লাইব্রেরিতে গ্রন্থাগারিক নেই, লাইব্রেরিগুলি অমনোযোগের শিকার। বিশ্বায়ন বা বৈদ্যুতিন মাধ্যম, মোবাইল ইত্যাদির কারণে বই পড়ার সংস্কৃতিও হয়তো দুর্বল হয়েছে কিছুটা, যদিও বইমেলার ভিড় এবং বইয়ের বিক্রির হিসেব কিছুটা আশা জাগায়। যাই হোক, বইয়ের বিকল্প কিছু নেই যে, তার প্রমাণ প্রযুক্তিতে আর অর্থেবিত্তে উন্নত দেশগুলি। সেখানে হাজার ডিজিটাল প্রযুক্তিতেও বইয়ের ব্যবহার কমেছে বলে শুনিনি। 

আর প্রযুক্তিও তো আমাদের কাছে বইকে আরও সুলভ করে দিযেছে। শুধু বইয়ের চেহারাটা বদলেছে। এখন আমার কম্পিউটারের মোবাইলের ইন্টারনেট এক বিশাল লাইব্রেরি সাজিয়ে রেখেছে আমার জন্যে, আমি তো তার অন্ত পাই না। ফলে কাগজে মুদ্রিত না হোক, বই যার পড়ার ইচ্ছে আছে তার সামনে অন্তহীন বইয়ের সারি সাজানো আছে, খোলো আর পড়ো। হয়তো এক সময় বই শুধু এই কম্পিউটার, ট্যাব আর স্মার্টফোনের পর্দাতেই পড়া যাবে। এ পড়াটার শরীরে কায়দা অন্যরকম, কিন্তু পড়া বন্ধ হবে না।  লাইব্রেরিও থাকবে। হয়তো অনেক গাছ প্রাণে বেঁচে যাবে। 

 

*ছবি সৌজন্য: Whatshot, Camden county, Facebook, Indian Express

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com