পরিযায়ী
‘বৈশাখ মাসের প্রথমে হরিহর নিশ্চিন্দিপুর হইতে বাস উঠাইবার সব ঠিক করিয়া ফেলিল। গ্রামের মুরুব্বিরা আসিয়া হরিহরকে বুঝাইয়া নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। নিশ্চিন্দিপুরে দুগ্ধ ও মৎস্য কত সস্তা বা কত অল্প খরচে এখানে সংসার চলে সে বিষয়ের একটা তুলনামূলক তালিকাও মুখে মুখে দাখিল করিয়া দিলেন। কেবল রাজকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর স্ত্রী সাবিত্রীব্রত উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়া অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর বলিলেন– বাপু, আছেই বা কি দেশে যে থাকতে বলব, তা ছাড়া এক জায়গায় কাদায় গুণ পুঁতে থাকাও কোনও কাজের নয়, এ আমি নিজেকে দিয়ে বুঝি- মন ছোট হয়ে থাকে, মনের বাড় বন্ধ হয়ে যায়।’
ঠাকুমা বইটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আট বছরের তিতলি হাত পা ছুঁড়ে বায়না করল,
– পড়ে শোনাও আর একটু। ভাল্লাগছে না বাড়িতে বসে বসে। স্কুলে কত মজা হত। ঠাম্মা, অপুরা কি নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে দূরে চলে গেছিল?
– হ্যাঁ, দিদিভাই।
– কোথায়?
– কাশী।
– সেটা কি আমাদের দেশেই?
– ওমা! কাশী তো ভারতের তীর্থক্ষেত্র। বাবা বিশ্বনাথ!
ঠাকুমা দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল।
– এইসব করোনা মরোনা চলে গেলে তোমার বাবাকে বলব বারাণসী, কাশী ঘুরিয়ে আনতে।
– কাশী ভারতের মধ্যে? তাহলে অপুর বাবাকে গ্রামের লোকেরা বারণ করছিল কেন যেতে?
ঠাকুমা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন,
– আমরা বাঙালিরা ভারতীয় হতে পারিনি যে। আমরা দেশের লোকেদের উড়ে, মেড়ো, খোট্টা, গুজ্জু- এসব বলে আনন্দ পাই। এটাই আমাদের ছোটমনের পরিচয়। অপু কিন্তু বড় হয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছিল।
তিতলি জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ঠাকুমার কথাগুলো ভাবছিল। মহামারী কী ব্যাপার কে জানে! মা, বাবা পইপই করে কানের কাছে বলে চলেছে, বাইরে যাওয়া যাবে না, এমনকী ছাদেও না। কতদিন তিতলি পার্কের দোলনায় চড়েনি, স্লিপ বেয়ে হুশ করে পড়ে মজা পায়নি। দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমাবে, লুকিয়ে একবার দুলে আসবে। মনে মনে ভাবল তিতলি। মেঘলা আকাশ। আমফান ঝড় আসবে। “আমফান ইজ ফান।” হি হি। বেশ মজার। রোদ নেই বাঁচোয়া। এই ফাঁকে একছুট্টে দোলনায়। চুপি চুপি দরজা খুলে বেরিয়ে গেল তিতলি। দোল খেতে খেতে দেখল কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাশে দুটো খরগোশ। ধপধপে সাদা। তিতলি দৌড়ে গেল। খরগোশ এল কোত্থেকে?
তিতলি যত দৌড়ায়, খরগোশও ছোটে। লকডাউনে রাস্তায় গাড়ি কম। তিতলি রাস্তা পেরিয়ে অলিগলি ঘুরেও খরগোশ ধরতে পারল না। ঘেমে সপসপ করছে গা। ফ্রক ভিজে। জলতেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার রাস্তা কোথায়? সল্টলেকের সব রাস্তা একরকম দেখতে। গুলিয়ে যায়। তিতলি কীভাবে খুঁজে পাবে ওর বাড়ি? নিজের ব্লকের নাম-ঠিকানা ও জানে, কিন্তু ঝড়ের জন্য কিনা কে জানে, রাস্তায় একটাও লোক নেই। একটা বাড়িতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করবে ভাবছিল, বারান্দায় বিরাট এক কালো কুকুর এমন হিংস্রভাবে গরররর করছে , ভয় পেয়ে তিতলি উল্টোদিকের বাড়িতে ঢুকে গেল।
বারান্দার দেওয়ালে মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, ছোটা ভীমের কার্টুন আঁকা। এটা তো একটা কিডজি! তিতলি বুঝল ও একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলবাড়ির বারান্দায়। স্কুল বন্ধ বলেই দরজা আঁটা। প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে। পাশের বাড়ির জানলা থেকে একটা মেয়ে তাকে দেখছে। ক্রমশ বুঝতে পারল তিতলি, আশপাশের বাড়ি থেকে তার বয়সী বেশ কিছু ছেলেমেয়ে তাকে লক্ষ করছে উঁকিঝুঁকি দিয়ে।
– একটু জল দেবে প্লিজ?
কোনও উত্তর পেল না তিতলি।
– এটা কোন ব্লক? আমি বাড়ি চিনতে পারছি না।
– তুমি কোন ব্লক?
– আই বি। ফিফটি সিক্স।
– সো ইউ আর অ্যান আইটসাইডার। দিস ইজ জি ডি ব্লক।
– মে আই হ্যাভ এ গ্লাস অফ …
তিতলির কথা শেষ হওয়ার আগেই দুজন ছেলে একসঙ্গে বলে উঠল,
– নেভার। উই আর নট অ্যালাওড টু টেক কেয়ার অফ এনিবডি আউট অফ আওয়ার জোন।
– বাট আই অ্যাম এ সল্টলেক রেসিডেন্ট। আমার বাবাকে একটা ফোন করবে প্লিজ?

তিতলির কান্না পেয়ে গেল। শোঁ শোঁ করে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে। টিপটিপ বৃষ্টি। কুকুরটা বিশ্রীভাবে চেঁচাচ্ছে। কেন যে নিজের এলাকা থেকে বেরতে গেল। এখন কীভাবে সে ফিরবে? বাড়ি এসে ঢকঢক করে আগে দু’গ্লাস জল খেল তিতলি। ভাগ্যিস বাবা মা পুলিশে খবর দিয়েছিল, নয়তো এতটা রাস্তা কীভাবে ফিরত এই তুফানের মধ্যে! মা কাঁদছিল। বাবা রেগেমেগে তার হাত ধরে বলছিল,
– আর যদি বেরিয়েছ, ঠ্যাং খোঁড়া করে রেখে দেব। জানো কত বড় বিপদ হতে পারত?
– আহা, অমন বকিস না দিদিভাইকে। আশেপাশের বাচ্চাগুলোকে দ্যাখ! কেউ এক গ্লাস জল দিল না! – তোমার নাতনি মাইগ্রেটরি বার্ডের মতো উড়ে উড়ে বেড়াবেন আর দুনিয়ার লোক হেল্প করবে?
– কেন করবে না? অন্য বাড়ির বাচ্চা হারিয়ে গেলে আমরা এমন চুপ করে বসে উহু আহা করব?
ঠাকুমা তিতলিকে নিয়ে পাশে বসালেন।
– অনেক হাঙ্গামা হল আজ। টিভি দ্যাখো দিদিভাই।
কার্টুনের চ্যানেলে বোতাম টেপার আগে খবরের চ্যানেলে দেখল তিতলি হাজার হাজার লোক হেঁটে যাচ্ছে। তার মতো দু’ একটা বাচ্চা মেয়েও আছে।
– ওই দেখো বাবা। তুমি কত বকলে আমায়।
– তোমাকে ওদের কথা ভাবতে হবেনা। যত্তসব!
গজগজ করে উঠল বাবা। মা চায়ের কাপ নিয়ে ঠাকুমা আর বাবাকে দিচ্ছে। জেঠু ডাক্তার। খবর পেয়ে দোতলা থেকে নেমে এসেছে তিতলিকে দেখতে। টিভির একটা খবরে সবার চোখ আটকে গেল। একটা লোককে রাস্তায় ফেলে মারছে পুলিশ। পিছমোড়া করে হাত বাঁধা।
– দাদা, চা দিই আপনাকে?
– দাঁড়াও। এই দ্যাখ, মাস্ক না পাওয়ার প্রতিবাদ করেছেন বলে কী হাল করেছে ডাক্তার রাওয়ের। হি ইজ অ্যান এক্সট্রিমলি এডুকেডেট ডক্টর।
– দেশের এমন ইমার্জেন্সির সময় এইভাবে একজন ডাক্তারকে নির্যাতন করছে। ছিঃ তোরা প্রতিবাদ করবি না দাদা?
– ধুস, ছাড় তো। হায়দ্রাবাদের মেডিক্যাল অ্যাসোশিয়েসন বুঝবে। আমাদের কী?
তিতলি জেঠুর হাত ধরে নিজের দিকে টানল।
– জেঠু, হায়দ্রাবাদ কোন দেশে?
তিতলি জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ঠাকুমার কথাগুলো ভাবছিল। মহামারী কী ব্যাপার কে জানে! মা, বাবা পইপই করে কানের কাছে বলে চলেছে, বাইরে যাওয়া যাবে না, এমনকী ছাদেও না। কতদিন তিতলি পার্কের দোলনায় চড়েনি, স্লিপ বেয়ে হুশ করে পড়ে মজা পায়নি। দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমাবে, লুকিয়ে একবার দুলে আসবে। মনে মনে ভাবল তিতলি। মেঘলা আকাশ। আমফান ঝড় আসবে। “আমফান ইজ ফান।” হি হি। বেশ মজার।
বাইরে আমফান শক্তি বাড়িয়েছে। ধুয়ে দিয়ে যাবে সব। তিতলি খেয়াল করল, কেউ কোনও উত্তর দিতে পারছে না। নির্বাক। চোখে ভাষা নেই। ঠাকুমা শুধু চোখ মুছে বলে উঠলেন,
– আমিই শুধু বাংলাদেশের। দেশভাগের পর এসেছিলাম। ঠিক তোমার বয়সে। বরিশাল, ঝালোকাঠি। রণমতি গ্রাম।
তিতলি হেসে ফেলল।
– ঐ দ্যাখো বাবা, তুমি শুধু আমাকেই বকছ, ঠাম্মাও কিন্তু মাইগ্রেটরি বার্ড!
পাখিজীবন
প্রবল হাওয়ায় ঠকঠক করে কাঁপছে জানলা। শার্সি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। দামাল ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে তছনছ হচ্ছে বাংলা। নারীটি বুঝতে পারে শক্তিশালী এই ঝড়ের সঙ্গে তাকে যুঝতে হবে আজ একা। সময়ের দশায় আজকের রাতে সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। শ্বশুরবাড়িতে একাকিনী। মেয়েদের পাখিজীবন। না থাকে নিজের ঘর, না কিছু। ডিম পাড়ার জন্য বাসা বাঁধতে হয়। তাকে অবশ্য ভাগ্যের পরিহাসে নয়, পেশার বাধ্যতায় থাকতে হচ্ছে এখানে।
শাশুড়ি গত হয়েছেন একযুগ আগে। শ্বশুরের বাৎসরিক ক্রিয়াকর্ম সমাধা হল সবে। একমাত্র ছেলে মা-বাবার জিম্মায়। রোজই কাজে বেরোতে হয়। এতবড় বাড়িতে বালকের পক্ষে একা থাকা ঝুঁকির। স্বামী কর্মস্থলে দূরে। তালাবন্ধ শহরে ছেলের ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে তাই দাদু দিদিমার নিরাপদ আশ্রয়ে। পুরনো বাড়িতে আজকাল কেই বা থাকতে চায়? কিন্তু তারা চায়নি নগরের কৃত্রিম বৈভবে মোড়া খুপরি ফ্ল্যাটঘরে থাকতে। সেখানে নিত্যদিন হাজার সুবিধা। মসৃণ পিচঢালা রাস্তা, ঝলমলে বিপণি, ঝাঁ চকচকে সুইমিং পুল। আধুনিক বিলাসব্যসনের শতেক উপকরণ। নিরন্তর আন্তর্জালের মধ্যে মানুষগুলো জলহীন মাছের মতো খাবি খায়। বারান্দায় গোনাগুনতি টবে ফুল ফুটলেই সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যায় সেই ফুলের ছবিতে।

কিন্তু ঘ্রাণ? তার সাবেকি বাড়ির পুরনো দালান, লাল মেঝে, খড়খড়ির জানলা খুললেই বাগান থেকে ভেসে আসে হাস্নুহানা, বেল, জুঁই, কামিনী। ভোর হতেই ঘুম ভাঙায় একজোড়া বুলবুল। বেলায় আসে দোয়েল। পুকুরপাড়ে আকন্দর ডালে বসে থাকে একজোড়া মাছরাঙা। পুকুরে বুড়বুড়ি কাটে জলফড়িং। পাকা পেয়ারা খেতে রোজ আসে জোড়ায় জোড়ায় টিয়া। শ্বশুর শাশুড়ি বেঁচে থাকতে একদিনের জন্যও তুলসিতলায় ফুল দেয়নি সে। ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজোআচ্চার বিরুদ্ধে বরাবরই স্বঘোষিত বিদ্রোহী। এখন অবশ্য তুলসিতলায় যত্ন করে প্রদীপ দেয়। মনে হয় ওখানেই ঘুমিয়ে আছেন শ্বশুর শাশুড়ি।
আজ তুফান উঠেছে। শোঁ শোঁ আওয়াজে উথালপাথাল করছে ঘূর্ণিঝড়। বহুদূর জেলা থেকে একটা ফোন এল।
– ঠিক আছ তো? পাম্পে জল তুলে রেখ। হাতের কাছে টর্চ, মোবাইল। আমিও জেগে থাকব রাতভর। এগারো বছর আগে এমনই এসেছিল আয়লা। কত ক্ষয়ক্ষতি ! কত ঘর ভেঙে গেছিল। সেসব আর ফিরে পায়নি তারা। রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে তলিয়ে গেছিল ঘর ফিরে পাওয়ার আশা। আজও কত লক্ষ মানুষের ঘরের দেওয়াল পড়ে গেছে, চাল উড়ে গেছে। ঝুপ করে পাওয়ার কাট হল। ইনভার্টার চালু হয়েছে। কিছুক্ষণ অন্তত নিশ্চিন্তি। ঘর থাকতেও যারা আজ ঘরছাড়া , এক এক করে ফোন করতে শুরু করল সে।
– হ্যালো সুমন্ত্র, কী খবর?
– আড়াই মাস বাড়ি যাইনি লকডাউনে। বউ, মেয়ের মুখ ভুলেই গেছি।
– হ্যালো ইন্দ্রাণী, কী করছিস?
– এই তো লেবার রুমে। একটা ডেলিভারি করব রে।
নারীটির আর একা লাগে না। তার মনে হয় তার একলার ঘরখানা মিশে গেছে অন্য অনেক ঘরে। ঘরছাড়াদের সঙ্গে।
*ছবি সৌজন্য: RuralIndiaonline, Pinterest
পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।
One Response
খুব খুব ভাল ।❣❣❣