আমরা
সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের এক উইকএন্ডের সকালে নতুন শাড়ি, পরে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে যাই কোনও একটা স্কুলের জিমন্যাশিয়ামে মা দুর্গার সামনে, তখন হয়তো শেষ বারের মতো অঞ্জলির ঘোষণা চলছে। সকাল থেকে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে তৈরি করেছি ছেলেদের পাঞ্জাবি পরিয়ে। তার পর নিজের তৈরি হওয়া। এখন শরীরে অ্যাড্রিনালিনের ছোটাছুটি। যা হোক, পরিবারের বাকিরা পাশে আছে দেখে নিয়ে প্রথম বার চোখ বুজি, জোড় করা হাতের পাতায় অঞ্জলির ফুল…চোখ খুলে মা-র প্রত্যাশিত অপরূপ মুখ…একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসে, হ্যাঁ এ বছরও পুজো এসে গেল। অঞ্জলি হয়ে যাবার পর শুরু হয় পারস্পরিক কম্পলিমেন্টের আদানপ্রদান-”ইশ কী দারুন কম্বিনেশন রে শাড়িটা, দেখি দেখি তোর ব্লাউসের কাটটা, তোর বুটিকটার নম্বর এ বার নিতেই হবে দেশে যাবার আগে। সবাইকে দারুন সুন্দর লাগছে এই আত্মতুষ্টিতে ভরপুর হয়ে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর অন্য জায়গায় থাকা বাকি বন্ধুদের সহমত হওয়ার (পড়ুন like পাবার) আশায় মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো মা দুর্গার সামনে কিছুক্ষণের জন্য ছবি তোলার জন্য জায়গা পাবার একটা কম্পিটিশন চলতে থাকে।
তার পর হইহই করে দুপুরের ভোগের লাইনে দাঁড়ানো; গরম খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি পাঁপড় মিষ্টি একসঙ্গে প্লেটে নিয়ে এসে বসা। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়তে থাকে প্রশস্তি-সমালোচনার ছোট ছোট টুকরোরা- নুন কম,তরকারিটা খুব ভালো হয়েছে রে, হাড় বড্ডো বেশি, আলু সেদ্ধ হয় নি…ওহ আবার গুলাবজামুন, বাঙালিরা আবার কবে পুজোতে গুলাবজামুন খেত রে! এই সব সমালোচনার বুনুনিতে হয়তো কোথাও লুকনো থাকে এই কথাটা – টাকা যে রকম নিচ্ছে অর্গানাইজেশনগুলো, সার্ভিস তেমন পাচ্ছি তো? খাওয়া হয়ে গেলে রোদ্দুর ভরা দুপুরের ব্যাকড্রপে আরও একপ্রস্থ ছবি তোলা। আরও উজ্জ্বল আরো রঙিন -মাথার ওপর তোলা সানগ্লাসগুলো চোখের ওপর নেমে আসে।
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু , Diva রূপেণ সংস্থিতা….
সন্ধ্যেবেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মুখ্য আকর্ষণ। প্রথমে লোকাল প্রোগ্রাম অবশ্যই -অনেক কষ্ট করে ব্যস্ত রুটিন থেকে কী ভাবে কী জানি সময় বার করে নাচ, গান, নাটক আবৃত্তি করে, প্রত্যেক বছর..প্রজাপতির মতো বাচ্চাদের রঙে ভরে যায় স্টেজ। মোটামুটি বেশ কিছু ধরাবাঁধা মানুষরাই অবশ্যই থাকেন প্রতি বছর যারা অংশগ্রহণ করে, পরিচালনা করে, স্টেজের পিছনে থেকে সব রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কম সময়ের মধ্যে এই প্রোগ্রামগুলো দাঁড় করিয়ে দেন। তার মান হয়তো তেমন উন্নত যদি না-ও হয়, প্রচেষ্টায় অবশ্যই আন্তরিক । না অবশ্যই আমি এর মধ্যে থাকি না| আমি, আমরা আধমনস্ক হয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে প্রোগ্রামগুলো দেখি এবং অপেক্ষা করতে থাকি কখন কলকাতা থেকে আসা বড় শিল্পীরা (অনেক সময়ই সেটার ওপরই নির্ভর করে, ঠিক কোন অরগানাইজেশনের পুজো দেখতে যাব) অনুষ্ঠান শুরু করবেন। তার পর যদি দেশ থেকে আশা এই শিল্পীরা গান গেয়ে জমিয়ে দেন, তা হলে তো সোনায় সোহাগা। উদ্দাম নাচের সঙ্গে রাত গড়ায়। আবার সোমবারের মোনোক্রোমাটিক রুটিন বাঁধা জীবনে ফেরার আগে এক বার মন খুলে বেঁচে নেওয়া…সিঁদুর খেলার রেশ আর নাচের আনন্দে লাল আমাদের মুখ..আসছে বছর আবার হবে ।
তোমরা
এই বছর-আসছে বছর আবার এবং বারবার হওয়াটা করে কে? -তোমরা।
পুজো কোথায় হবে কিভাবে হবে সব ঠিক করা, আগের দিন বিকেলে পৌঁছে কাস্টোডিয়ানকে দিয়ে দরজা খুলিয়ে ঠিক মতো জায়গায় প্রতিমাকে এনে প্রতিষ্ঠা করে সাজিয়ে গুজিয়ে তোলা।পুজোর সমস্ত আয়োজন গুছিয়ে নিয়ে পুজোর জায়গায় পৌঁছোও অনেক সকালে; আমরা পৌঁছতে পৌঁছতে তোমরা তৈরি। দুপুরবেলা বিপুল সংখ্যক ক্ষুধার্ত লোকের খাবার বানানো, পরিবেশন, অপ্রত্যাশিত অতিরিক্ত লোক এলে তৎক্ষনাৎ ব্যবস্থা করা ..দেশ থেকে আসা শিল্পীদের আদর আপ্যায়ন থাকার ব্যবস্থা। তোমাদের হাত ধরে একটা সম্পূর্ণ প্রোগ্রামের আয়োজন হয়, সবাই যখন চলে যায়, সমস্ত কিছু গুছিয়ে, পরিষ্কার করে যে অবস্থায় স্কুল ছিল সেই অবস্থায় কর্তৃপক্ষের হাতে যেন ফেরত যায় তার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত তোমরা পালন করে যাও, সেটা না করলে পরের বার সেই স্কুলে পুজো করার আর সম্ভাবনা থাকে না। গত বছরের পুজোর কথা মনে এলো হঠাৎ -ঝিমিয়ে যাওয়া দুপুরে, একটু নির্জন হয়ে যাওয়া স্কুল ক্যাফেটেরিয়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। দেখতে পেলাম আমার এক বন্ধু মণি বড়ো ট্রে বয়ে নিয়ে চলেছে রান্নাঘরের দিকে। সামনে দেখে, হাত লাগলাম। আমার এই বন্ধু বছরের পর বছর সম্পূর্ণ ভার নিয়ে পুজোর সময় বাচ্চাদের খাবার ব্যবস্থা করে…তার সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেটা আমি জানি বহু বছরই, কিন্তু এই সময়টাতে ওকে একান্তে সন্ধ্যের প্রস্তুতি নিতে দেখে আমার দেখার চোখটাই কেমন বদলে গেল, মনে হলো খেয়াল করি না তো এভাবে? বাইরে বেরিয়ে পুজোর জায়গায় দু’জন দিদি- বহুবছর ধরে দেখি যাদের এই এখানে এমনভাবেই-একমনে পুজোর জায়গা পরিষ্কার করে যাচ্ছেন। শুরু হবে সন্ধ্যের পুজোর প্রস্তুতি। বাইরে দাঁড়িযে ফোনে কথা বলছে আমাদের আর এক কর্মকর্তা বন্ধু সোমেন, উত্তেজিত গলায় খবরাখবর নিচ্ছে অন্য শহর থেকে আসা শিল্পী ঠিকঠাক হোটেলে পৌঁছেছে কি না। সে দিন সন্ধ্যেবেলায় ছোটদের-বড়দের নিয়ে প্রোগ্রাম করানো এক জন বন্ধু পূর্বা শেষ মুহূর্তে প্র্যাক্টিস করাচ্ছে, প্রত্যেক বছরই যে করায় -ধরেই নি একটা হালকা সুন্দর প্রোগ্রাম হবে।
এগুলো দেখি তো প্রত্যেক বছর, কিন্তু কেমন একটা ফেডেড ব্যাকড্রপের মতো…আছে-থাকবে-এরকমভাবেই। হয়তো কখনও,যখন দেখি স্টেজে হতে থাকা বাচ্চাদের প্রোগ্রাম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে- সেই সময় উইংস এর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রোগ্রাম ডিরেক্টরের মুখে এসে পরে এক ঝলক আলো-গর্ব, আশংকার, আনন্দের গর্জন তেল মাখানো মুখ-সম্পূর্ণ পুজো যেন কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় একটা মূহুর্তে, ওই একটা মুখে। কিন্তু, ওই মুহূর্তটার পিছনে আছে অনেক উইকেন্ড, অনেক কর্মক্লান্ত স্কুল, অফিসের দিনের পরের রিহার্সাল, অনেক শেষ মুহূর্তের টেকনিক্যাল সমস্যা..সেগুলো দেখা যায় না।
এই লেখায় আমাদের, যাদের কথা বলছি তারা প্রবাসে যেকোনো জায়গার পুজোতে সংখ্যায় অনেক বেশি; আর তোমরাও আছো প্রবাসে প্রত্যেক জায়গায় যেখানে বাঙালিরা পুজো করেন। আমরা যারা গিয়ে পুজো উপভোগ করি তারা সচেতন ভাবে উপলব্ধি করি না সব সময় ; আশ্চর্যজনক ভাবে তোমরাও হয়তো করো না যে তোমরা কতটা শ্রম, সময় দিচ্ছো নিঃস্বার্থে। জানিনা তোমাদের ভাগ্যে কোনটা বেশি জোটে ধন্যবাদ না সমালোচনা। শুধু এটুকু জানি যখন থেকে মহালয়ার গান বেজে ওঠে, রোদের রং পাল্টে যায়, ঝকঝকে নীল আকাশে তুলোটে মেঘ, হাওয়ায় শিরশিরানি..সকালে হাইওয়ে ধরে কাজে যাওয়ার সময় হাওয়ার সাথে মনটাও কেমন যেন হুহু করে..এখনও পুজোয় ঘরের ছেলেমেয়ে ঘরে ফিরছে এমন কোনও বিজ্ঞাপন দেখলে গলায় কিছু একটা আটকে যায়, তখন তোমরাই তোমাদের জাদুকাঠি ঘুরিয়ে একটা স্কুল, একটা চার্চ, একটা হলকে বানিয়ে দাও আমাদের নিজস্ব ফিরে যাবার জায়গা..আমাদের হাতে তুলে দাও শিকড় ছুঁয়ে আসার কয়েকটা দিন,পাশাপাশি বসে উপভোগ করা নির্ভেজাল আনন্দের দিন।
তাই এই লেখার নিরাভরণ অক্ষরগুলোয় রইলো তোমাদের জন্য অনেক অনেক কুর্নিশ।
জন্ম, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। গত একুশ বছর ম্যাসাচুসেটস,আমেরিকা প্রবাসী। বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। এখন পর্যন্ত লেখা বেরিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন পরবাসে এবং আনন্দবাজারে।