banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বাবু কোলকেতার পোষ্য বেত্তান্ত

সুপ্রিয় চৌধুরী

জানুয়ারি ৩১, ২০২০

old Kolkata pet culture
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

১৮৫৬ সালের ৬ই মে। মেটিয়াবুরুজে গঙ্গার ঘাটে অওধ (লখনউ) থেকে এসে থামল একটি জাহাজ। পিছনে আরো একাধিক জাহাজের বিশাল এক নৌবহর। প্রথম জাহাজটি থেকে নামলেন লখনউ তথা অওধের সদ্যপ্রাক্তন নবাব ওয়াজেদ আলি শা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে দখল নিয়েছে তার প্রাণাধিক প্রিয় অওধের। শোকগ্রস্ত, ক্ষুব্ধ নবাব কলকাতায় এসেছেন তাঁর প্রতি এই চরম অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করতে। প্রয়োজনে ইংল্যান্ডে রানি ভিক্টোরিয়ার কাছেও দরবার করতে যাবেন তিনি। মেটিয়াবুরুজে গঙ্গার তীরে কয়েকশো একর জমি জুড়ে নির্মিত বিশাল প্রাসাদে বাস করতে শুরু করলেন নবাব। অওধ থেকে নবাবের সঙ্গে এসেছিল অসংখ্য উজির-পারিষদ-চাটুকার-বাবুর্চি-পাচক-নোকর-নোকরানি-একাধিক বিবি-হারেম সুন্দরী-তওয়াইফ-বাঈজি মায় আস্ত একটা চিড়িয়াখানা। বাবুয়ানি বা বিলাসিতার ক্ষেত্রে নবাবের খ্যাতি ছিল প্রবাদপ্রতিম আর সর্বজনবিদিত। পোষ্যপ্রেমও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ফলে প্রাসাদের একধারে বিশাল উন্মুক্ত জমিতে অনতিবিলম্বে গড়ে উঠলো বিশাল চিড়িয়াখানা। বলতে গেলে অওধে নবাবের পুরো পশুশালাটাই উঠে এসেছিল মেটিয়াবুরুজে । আব্দুল হালিম শররের লেখায় তার বর্ণনা পাচ্ছি।

নবাবের খাস প্রাসাদ নুর-ই-মঞ্জিলের উল্টোদিকে বিশাল খাঁচায় থাকতো বড় বাঘ অর্থাৎ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কয়েক একর জোড়া লম্বা করিডরের মত জাল ঘেরা জায়গায় পালে পালে হরিণ। আর এক ভাগে অসংখ্য চিতা। আর এক বিশাল খাঁচায় আলাদা আলাদা বিভাগে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁদর। পরিখা ঘেরা জলাশয়ে প্রচুর রঙিন মাছ আর কচ্ছপ। জলাশয়ের মাঝখানে একটি দ্বীপ। দ্বীপে নকল পাহাড়ে প্রচুর সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির। 

আর একটি বিশাল জলাশয়ে পাখি। বহু ধরনের সারস, বক, হাঁস, চকোর, শুতরমুর্গ (জলপিপি বা মূরহেন), আরও একাধিক প্রজাতির জলচর পাখি। পাশাপাশি অন্যান্য ধরনের পাখির প্রতিও নবাবের আকর্ষণ ছিল অদম্য। শোনা যায় একজোড়া রেশমপাখা পায়রা কেনার জন্য ব্যয় করেছিলেন ২৪ হাজার টাকা। এক একজোড়া ‘আমরিকি তোতা’ অর্থাৎ ম্যাকাও আর সাদা ময়ূর কিনেছিলেন যথাক্রমে ২৬ হাজার এবং ১১ হাজার টাকায়। নবাবের প্রবল আকাঙ্খা ছিল দুনিয়ায় যত কিসিমের পশুপাখি আছে তার প্রত্যেকটির অন্তত এক এক জোড়া থাকবে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। এই অদম্য আকর্ষণে গোটা আরব আর আফ্রিকা ঢুঁড়ে সংগ্রহ করে এনেছিলেন দু’কুঁজওয়ালা বাগদাদি উট, জিরাফ, জেব্রা, দরিয়াই ঘোড়া (জলহস্তি)। তৎকালীন সময় প্রত্যেক জোড়ার দাম পড়েছিল আনুমানিক কমবেশি পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো। তাঁর সংগ্রহে সব ধরনের পশুপাখি যখন রয়েছে অতএব গাধা কেন থাকবে না? ফলে একজোড়া গাধাও তাঁর পশুশালায় রেখেছিলেন আলি শা। 

চিড়িয়াখানা ছাড়াও আলি শার প্রচণ্ড নেশা বা শখ ছিল কবুতরবাজি, ভেড়ার লড়াই, মুর্গা (মোরগ) আর বুলবুলির লড়াইয়ে। বিশিষ্ট ইংরেজ রাজপুরুষেরা তাঁর প্রাসাদ আর চিড়িয়াখানা দর্শনে এলে ভেড়ার লড়াই দেখিয়ে সায়েবদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন নবাব, এরকমটাও জানা যায় শররের লেখায়। সে সময় আলিপুর আর ব্যারাকপুর লাটবাগানের চিড়িয়াখানা তৈরি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নবাবের নিজস্ব চিড়িয়াখানার তুলনায় সেগুলি ছিল একেবারেই নিরেস, লিখেছিলেন শরর। নবাবের পশুপাখি দেখভাল করার জন্যই শুধুমাত্র আটশো জন মাইনে করা প্রশিক্ষিত পরিচারক ছিল, যা বোধহয় আজকের অনেক আধুনিক পশুশালাতেও দুর্লভ।

প্রিভি কাউন্সিল আর ইংলন্ডেশ্বরীর দরবারে মাথা কুটেও তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় হৃত অওধ ফেরত পাননি নবাব। সেই শোক ভুলতে আরও বেশি করে আশ্রয় খুঁজেছিলেন তওয়াইফ, কোঠেওয়ালি আর হারেমসুন্দরীদের ঘুঙ্ঘঠের আড়ালে। বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে যেতেন আলিপুর চিড়িয়াখানা দর্শনে, দু’জন চালকে টানা বিশাল চওড়া এক রিকশায় চড়ে। সে সময় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পশুশালার প্রথম অধিকর্তা হয়েছেন তরুন পশু বিশারদ রামব্রহ্ম সান্যাল। নবাবের রিকশা সরাসরি ঢুকে পড়ত চিড়িয়াখানার মূল ফটক দিয়ে। রিকশার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন পশুপাখি সম্বন্ধে নবাবকে বোঝাতেন তরুণ অধিকর্তা। 

‘খোয়াব থা যো কুছ ভি দেখা / যো শুনা আফসানা থা…’ (যা দেখেছি সবই স্বপ্ন / শুনেছি যা কিছু সবই গল্পকথা)। ১৮৫৭। জীবনের শেষ শায়েরিটি লিখে চলে গেলেন হতাশ বিষণ্ণ নবাব ওয়াজেদ আলি শা। পিছনে পড়ে রইল তাঁর প্রবাদপ্রতিম বিলাসবৈভব, স্বপ্নের নবাবি মঞ্জিল আর চিড়িয়াখানা। কিন্তু এর ছোঁয়া, বা বলা ভালো ঢেউ গিয়ে লাগল কোলকেতার বাবুসমাজে। বেড়ালের বিয়ে, বুলবুলির লড়াই বা কবুতরবাজির পিছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করার রেয়াজ তো ছিলই আগে থেকে। এর সঙ্গে যোগ হল আরও অনেক ধরনের পশুপাখি পোষার শখ।

সেই সময় আরেকটি বিখ্যাত ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা ছিল চোরবাগানে মল্লিকদের মার্বেল প্যালেসে। অসংখ্য প্রজাতির পাখি আর রাজহাঁস তো বটেই, ময়ুর, সারস, ম্যাকাও, পেলিক্যান এমনকি বাঘ, সিংহ, শিম্পাঞ্জি, জেব্রার মতো পশুপাখিও ছিল মল্লিকদের এই ব্যক্তিগত পশুশালায়। সময়ের কাল্গ্রাসে তার পুরনো জৌলুস হারালেও আজো টিঁকে রয়েছে মার্বেল প্যালেসের চিড়িয়াখানা। বছর তিরিশেক আগে এখানেই ডিম ফুটে জন্ম নিয়েছিল পেলিক্যানের ছানা। বন্দি অবস্থায় পেলিক্যান শিশুর জন্ম এ রাজ্যে সম্ভবত সেই প্রথম। তৎকালীন কয়েকটি অগ্রণী সংবাদপত্রে বেশ গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হয়েছিল খবরটা। সংবাদ পড়ে গিয়েছিলাম মল্লিক প্যালেসে। সিংহদরজা দিয়ে ঢুকে মোরাম বেছানো পথ ধরে দু’চার কদম এগোতেই একটা গাছের নিচে দেখা হয়ে গিয়েছিল পেলিক্যান মায়ের সঙ্গে। মায়ের কোল ঘেঁষে বসে থাকা এই এতটুকু তুলোর বলের মত পেলিক্যান ছানা। বেজায় গম্ভীর এবং সন্তান গর্বে গরবিনী হয়ে বসে থাকা মা। তখন মোবাইলের নামও শোনেনি কেউ, ফলে ছবি তোলা যায়নি। কিন্তু দু’চোখ আর হৃদয়ের লেন্সে ছবিটা গাঁথা হয়ে রয়েছে আজও। প্রসঙ্গত বলি, আলিপুর চিড়িয়াখানায় প্রথম বাঘ-সিংহ রাখার এনক্লোজারটি নির্মিত হয়েছিল মার্বেল প্যালেসের মল্লিকদের অর্থানুকূল্যে। আজ সেটির অস্তিত্ব আর নেই। 

বেলেঘাটার আরেক বিখ্যাত বনেদি পরিবার নস্করদের খ্যাতি ছিল তাদের ম্যাকাওদের ব্যাপারে। ব্লু অ্যান্ড ইয়েলো, রেড অ্যান্ড গোল্ড, স্কারলেট, হাইসিন্থিয়ান, লেসার গ্রিন, কতরকম ম্যাকাও যে ছিল নস্করবাবুদের সংগ্রহে, তার ইয়ত্তা নেই। চোরবাগানের মল্লিকদের মতো বেলেঘাটার নস্করদের ম্যাকাওয়েরও বাচ্চা হয়েছিল বন্দি অবস্থায়। এ খবরও প্রকাশিত হয়েছিল খবরের কাগজে। আজ সময় অনেক এগিয়েছে। বহু পক্ষিপ্রেমী মানুষ বদ্রি, ফিঞ্চ, লাভবার্ড, ককাটিলের মত সহজলভ্য পাখির সীমা ছাড়িয়ে  ম্যাকাও, গ্রে প্যারট, কাকাতুয়া, লরিকিট, রেডড্রাম, অ্যামাজন প্যারট, এমনকি টোউকানের মত দুর্লভ এবং বহুমূল্য পাখি পুষছেন আকছার। বিদেশি পাখির মেলা হচ্ছে যত্রতত্র। কিন্তু নস্কররা ছাড়া পোষ্য ম্যাকাওয়ের ব্রিডিং চেন্নাই, মুম্বইয়ে শোনা গেলেও কলকাতায় বোধহয় সম্ভব হয়নি আজও। সম্ভবত আলিপুর চিড়িয়াখানাতেও নয়। 

 পাখি পোষার ব্যাপারে কলকাতার আরও তিন বনেদি পরিবারের নামডাক ছিল প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়ে। ঠনঠনের লাহাবাড়ি, সুকিয়া স্ট্রিটের শ্রীমানি বাড়ি আর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বোসবাড়ি। দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অসংখ্য প্রজাতির পাখি ছিল এই তিন পরিবারের সংগ্রহে। লাহাবাড়ি পরিচিত ছিল ‘পাখিবাড়ি’ নামে আর বোসবাড়ির দুই ভাই কার্ত্তিক বোস (সুবিখ্যাত ক্রিকেটার, কোচ ও ভাষ্যকার) ও তাঁর দাদা গণেশ বোসের শিকারি পাখির (ঈগল, বাজ, প্যাঁচা ইত্যাদি) সংগ্রহ ছিল শহরের অন্যান্য পক্ষীপ্রেমিক বনেদি পরিবারগুলোর ঈর্ষার কারণ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পক্ষীবিদ অজয় হোমের লেখা একাধিক বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে এই বোস ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা। অন্য দিকে শ্রীমানি বাড়ির কাকাতুয়ার এলাকাজোড়া খ্যাতি ছিল কাঁচা গালাগাল দেওয়ার জন্য। আজও ওই অঞ্চলে গিয়ে পঞ্চাশোত্তীর্ণ কারো কাছে জিগ্যেস করলেই এ কথার সমর্থন মিলবে।   

পক্ষীপ্রেম ছেড়ে একটু সারমেয় প্রেমের কথায় আসি এ বার। এ বিষয়ে তৎকালীন শহর কলকাতার বহু বনেদি বাবু পরিবারের খ্যাতি ছিল প্রায় গগনচুম্বী। এর মধ্যে নিজের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দু’টি পরিবারের সারমেয় সংগ্রহের কথা বলছি বলছি। 

কৈলাস বোস স্ট্রিটের লাহাবাড়ি আর বেহালার রায়বাহাদুর রোডে রায়বাহাদুর বীরেন রায়ের বাড়ি। দু’টি বাড়ির সামনেই বিশাল লোহার নকশাকাটা সিংহদরজা। আজও মনে আছে, কিশোর বয়সে ওইসব রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার পথে চোখে পড়ত সিংদরজার ভিতরে বিশাল বাগানে, লনে আর গাড়িবারান্দার নিচে শুয়ে বসে রয়েছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে কমপক্ষে দশ-বারো প্রজাতির বিদেশি কুকুর। ছেলেবেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম, ওই লাহাবাড়ির এক কর্তার শখ হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর ছোট কুকুর রাখবেন নিজের সংগ্রহে। ফলে কৈলাস বোস স্ট্রিটের লাহাবাড়িতে পোষ্য হিসেবে এসেছিল মাঝারি বাছুরের সাইজের বিশাল গ্রেট ডেন আর মিনিয়েচার মেক্সিকান চি-হুয়া-হুয়া। যাকে সারমেয় বিশারদরা ‘পকেট ডগ’ নামে উল্লেখ করে থাকেন তার অতি ক্ষুদ্র আকৃতির জন্য। যেহেতু এই অধমের আদি বাসস্থান ছিল কৈলাস বোস স্ট্রিট লাগোয়া গড়পারে আর মাতুলালয় বেহালায়, ফলে সিংদরজার এ পারে দাঁড়িয়ে সারমেয় দর্শনের অভিজ্ঞতাটা আজও স্মৃতিতে জীবন্ত। 

কলকাতা শহরের পোষ্যপ্রেমী বনেদি বাবুদের বাড়ির ইতিহাস আলাদা আলাদা ভাবে বলতে গেলে শুধু এই বিষয়টা নিয়েই থান ইটের সাইজের একটা বই হয়ে যাবে, তাই বর্ণনা দীর্ঘায়িত না করে মাত্র গোটা কয়েক ঘটনার উল্লেখ করছি। 

বাবার বন্ধু ছিলেন কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত গ্র্যান্ডফাদার ক্লকওয়ালা লাহাবাড়ির বড়কর্তা সুধাংশু লাহা ওরফে হাঁদুজেঠু। লাহাবাড়ির একতলায় বিশাল একটা ঘর। আসলে মজবুত লোহার রড লাগানো বিশাল একটা খাঁচা। সেই খাঁচা থুড়ি ঘরে বাঘ পুষেছিলেন হাঁদুজেঠুর স্বর্গীয় পিতৃদেব। তখন বন্যপ্রাণী আইন ফাইনের বালাই ছিল না। এক বেদের থেকে সেই বাজারে নাকি আড়াইশো টাকায় কিনেছিলেন ব্যাঘ্রশাবকটিকে। বৃদ্ধবয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় বাঘটি। যত দিন বেঁচে ছিল, অসম্ভব শ্বাসকষ্টে ভুগত বেচারা। প্রতিদিন খাঁচায় ঢুকে নিজে হাতে সন্তানসম প্রিয় বাঘের বুকে কবিরাজি তেল মালিশ করে দিতেন হাঁদুজেঠুর বাবা। প্রিয় মালিককে কোনও দিন আঁচড়টুকু কাটেনি পর্যন্ত। অতঃপর এক প্রবল শীতের রাতে চুপিসাড়ে চলে গিয়েছিল মালিক থুড়ি বন্ধুকে ছেড়ে। আজ তেষট্টি-উত্তীর্ণ এই প্রতিবেদক সেদিন ক্লাস থ্রি কি ফোর। আজও মনে আছে, বাবার পাশে বসে হাঁদুজেঠুর নিজের মুখে সেই কাহিনি শুনে যথার্থ শিশুর মতোই সে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। সেই বহু পুরনো চোখের জল আজ এই মুহূর্তে ফের একবার জমা হতে শুরু করেছে চোখের কোণে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে এ প্রসঙ্গে ইতি টানলাম।  

দ্বিতীয় কাহিনিটি হাঁদুজেঠুর কাছে শোনা হলেও সেটা তাঁর বা তাঁর পরিবারের নয়। অন্য আর এক পরিবারের। তবে তার আগে তাঁর নিজের পোষ্য তালিকা এবং তাদের অবস্থানের ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ বর্ণনা করা দরকার। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগেকার কথা। তবু বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছি সাধ্যমতো। মেডিক্যাল কলেজের উল্টোদিকে বিশাল গাড়িবারান্দার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে বিশাল খাঁচা বা অ্যাভেরি। ভিতরে গাছপালা, বড় বড় গাছের ডাল আর অসংখ্য প্রজাতির লাভবার্ড এবং তাদের সম্মিলিত কিচিরমিচির কলতান। প্রাকৃতিক পরিবেশের হুবহু এক রেপ্লিকা যেন। বারান্দার সামনের ঘর পেরিয়ে বাড়ির ভেতর দিকটায় এলে জাফরি নকশাকাটা রেলিংওয়ালা বারান্দার দু’পাশে দুটো বড় বড় খাঁচায় আসামিজ হিল ময়না আর আফ্রিকান গ্রে প্যারট। দুই মহাশয়ই কথা নকল করবার ওস্তাদ। ‘কেক চাই’ ‘মা দু’টি ভিক্ষে হবে’ ‘কে এলো’ ইত্যাদি বুলিতে গোটা বাড়ি মাতিয়ে রাখত সারাদিন। দোতলার সিঁড়িতে ওঠার মুখেই হাতপাঁচেক লম্বা অ্যাকোয়ারিয়ামে প্রচুর রঙিন মাছ আর বাড়ির সর্বত্র বিচরণকারী ভয়ঙ্কর টেঁটিয়া ধরনের একরত্তি পিকিনিজ কুকুর মিকি। তার তীব্র খোউ খোউ চিৎকারে কান পাতা দায় ছিল লাহাবাড়িতে। এহেন ‘পেট ক্রেডেনশিয়াল’ যাঁর, সেই হাঁদুজেঠুর কাছে শোনা গল্পটাই তুলে দেবার চেষ্টা করছি এখানে। 

হাঁদুজেঠুর ঠাকুরদা তখনও বেঁচে। এক দোভাষী তাঁর কাছে নিয়ে এল এক ফরাসি সায়েবকে। সায়েব গন্ধদ্রব্যের ব্যবসায়ী। সুদূর ফ্রান্স থেকে দুষ্প্রাপ্য একটি সেন্ট নিয়ে এসেছেন। এতটুকু ছোট একটা শিশির দাম হাঁকছেন এক হাজার টাকা (প্রিয় পাঠক, সেই বাজারে টাকার অঙ্কটা চিন্তা করুন একবার!) একে তো আতরপ্রিয় বাঙালিবাবুরা সে সময় সেন্ট বস্তুটির সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নন। তার ওপর দাম বলে কিনা হাজার টাকা! স্বভাবতই চোখ কপালে উঠেছিল ঠাকুরদার মত রইস বাবুরও। দোভাষীর মাধ্যমে ঠাকুরদাকে সায়েব বলেছিল, এর আগেও সে কলকাতার অনেক বাবুর দরবারে গিয়েছিল। কিন্তু দাম শুনে সব্বাই পিছিয়ে গিয়েছে। শোনার পর ঠাকুরদা সায়েবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, কোলকেতায় বাবুর বাবু হলেন দর্জিপাড়ার ছাতুবাবু-লাটুবাবুরা। এ জিনিস কেনার মতো বুকের কলজে একমাত্র তাদেরই আছে। সায়েব যেন সেখানে একবার ভাগ্য পরীক্ষা করে।

পরদিন সন্ধেবেলা। ইয়ার-পারিষদ নিয়ে বৈঠকখানায় আড্ডা মারছেন ছাতুবাবু-লাটুবাবু। সায়েব সেখানে হাজির হয়ে তার আসার উদ্দেশ্য জানালো বাবুদের কাছে। শোনামাত্র পাশে দাঁড়ানো খাজাঞ্চি বাবুর চোয়াল ঝুলে পড়ল। বলে কী সায়েব! একরত্তি একটা শিশির দাম হাজার টাকা! সেটা নজর এড়ায়নি সায়েবের। দোভাষীর কাছে কারণটা শোনার পর হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, “এখানে আসাটাই ভূল হয়েছিল আমার। কলকাতার এইসব বাবুদের কারও ক্ষমতাই নেই এ জিনিসের মূল্য বোঝার।” সায়েবের শরীরী ভাষা নজর এড়ায়নি ছাতুবাবুর। “সায়েব কী কইলে?” অনুনকরণীয় উত্তর কোলকাত্তাইয়া উচ্চারণে প্রশ্ন করেছিলেন দোভাষীকে। জবাব শোনার পর একটা মুচকি হাসি চোখের কোণে। “সায়েবকে ট্যাকাটা দিয়ে ওই শিশিটা কিনে ন্য়ান সরকারমশাই। ওনার জন্য একটু জলখাবারের ব্যাওস্তা করুন আর সইসকে বলুন বিলেত থেকে নতুন কেনা ওয়েলার ঘোড়াটাকে এক্ষুনি একেনে নিয়ে আসতে।” 

রাজকীয় খানা আর হাতেগরম নগদ পেয়ে একই সঙ্গে প্রচন্ড তৃপ্ত আর খুশিতে ডগমগ ফরাসি ব্যবসায়ী। বাবুদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেবার মুখে দোভাষীর মাধ্যমে সায়েবকে থামতে বললেন ছাতুবাবু। ততক্ষণে সহিস দরবারে নিয়ে এসছে ওয়েলার ঘোড়াটিকে। “ওই সেন্ট ঘোড়ার গায়ে ঢেলে দে!” জলদগম্ভীর গলায় সহিসকে আদেশ দিলেন বাবুর বাবু ছাতুবাবু। আশা করি এরপর আর একটি মন্তব্যও নিষ্প্রয়োজন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ছাতুবাবুদের ঘোড়ার সংগ্রহ তখনকার দিনে শহরের অন্যান্য বাবু তো বটেই, বহু ইংরেজ রাজপুরুষের কাছেও ছিল ঈর্ষনীয়। হাঁদুজেঠুর কাছেই শুনেছিলাম আরবি আর অস্ট্রেলীয় মিলিয়ে নাকি আড়াইশোরও বেশি ঘোড়া ছিল দর্জিপাড়ার ছাতু মিত্তির-লাটু মিত্তিরদের আস্তাবলে।

 এ প্রতিবেদনের শেষ গল্প দু’টি শুনেছিলাম বিজয়াদির মুখে, আলিপুরে তাঁর বেকার রোডের বাড়িতে বসে। বিজয়াদি মানে বিজয়া গোস্বামী। ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্যর পুত্র পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল স্নেহাংশু আচার্যর কন্যা। যদিও কলকাতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তবুও বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভেবে লিখে দিলাম এখানে। 

শশীকান্তবাবুদের জমিদারিতে হাতিশালে প্রচুর হাতি ছিল। শশীকান্তর তীব্র বাসনা ছিল তাঁর হাতিশালে একশোটি হাতি থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! কাঙ্খিত সংখ্যায় পৌঁছনোর আগেই কোনও না কোনও কারণে একটি হাতি মারা যেত প্রত্যেকবার। ফলে ৯৯টির বেশি হাতি কোনও দিনই পোষা হয়নি মহারাজার! হাঁদুজেঠুর বাবার মতো বাঘ পুষেছিলেন বিজয়াদির জ্যাঠামশাই শ্রী সুধাংশুকান্ত আচার্য, তাঁর রাঁচির বাড়িতে। তবে বাঘ নয়, বাঘিনী। আদর করে নাম রেখেছিলেন – শ্রীমতি শিখারানি বাগ। পূর্ণ যৌবনে একবার তার পরিচারককে বিচ্ছিরি ভাবে কামড়ে দিয়েছিল শিখারানি (প্রেমিকের অভাবে মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল কিনা কে জানে?) বাধ্য হয়ে তাকে পাঠাতে হয়েছিল ওড়িশার নন্দনকাননে। আর সেখানেই ঘটে গিয়েছিল সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি! শিখারানীর প্রেমের টানে পাশের জঙ্গল থেকে পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ বাঘ বেরিয়ে এসে লাফ দিয়ে পড়েছিল শিখার পরিখার মধ্যে। অতঃপর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সুখি দম্পতির মতই কাটিয়ে গেছিল দু’জনে। পর্যটকরা নন্দনকানন দর্শনে গেলেই গাইডরা তাঁদের কাছে বর্ণনা করে থাকেন অমর এই প্রেম কাহিনিটি। লাফ দিয়ে পড়ার সময় পরিখার দেয়ালে দেগে যাওয়া প্রেমিকপ্রবরের থাবা থুড়ি পদচিহ্নটি আজও সযত্নে রক্ষা করে চলেছেন নন্দনকানন কর্তৃপক্ষ। 

 

 

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com