অসাধারণ এক জন মানুষ ডুবুরি প্রগত সিং সাঁধু। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র জেলার ডাবখেরি গ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তী তিনি। অঞ্চলের জনগণের কাছে ‘প্রগত গোতাখর’ নামে পরিচিত, যার অর্থ গভীর জল থেকে প্রাণ তুলে আনেন যে ডুবুরি। ২০০৫ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৬৫৮ জনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। জলে তলিয়ে যেতে থাকা বহু মানুষের জীবন ছিনিয়ে এনেছেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে। দিয়েছেন নবজন্ম। প্রায় ১০০০ শবদেহ উদ্ধার করে তুলে দিয়েছেন আত্মীয়দের হাতে শেষকৃত্য করার জন্য। ৯টি কুমির ধরে পাঠিয়েছেন স্থানীয় উদ্যানে। প্রায় ৮ থেকে ১০ ফিট দীর্ঘ এই কুমিরগুলো যখন তখন প্রাণ নিত মাঠে ঘাটে চরতে আসা গবাদি পশুদের, মানুষরাও কুমিরের উপদ্রবে ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত।
কোনও রকম অর্থনৈতিক প্রত্যাশা বা চাহিদা না রেখেই এ সব কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র। এত বড়সড় বিপজ্জনক প্রাণী ধরার বিধিসম্মত প্রশিক্ষণও নেই তাঁর। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি আর সাবধানতা অবলম্বন করে তিনি এই কাজে হয়েছেন সিদ্ধহস্ত। ‘কুরুক্ষেত্র জেলায় অনেক সেচের খাল রয়েছে, অনেক জলাশয়, নদী নালা রয়েছে। মানুষ ডুবে যাওয়ার ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক লেগেই থাকে। প্রায়শই সেচের কাজ করতে গিয়ে বা আত্মহত্যা করতে গিয়ে জলে ডুবে যাওয়ার কথা শোনা যায়। তার ওপর খাল বিলগুলো ভর্তি ছিল ওই সব ভয়ঙ্কর কুমিরে। স্থানীয় মানুষরা ভয়ে, আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকত। ডুবে যেতে থাকা প্রাণ বাঁচানো ছাড়াও প্রগত সিং তুলে আনেন মৃতদেহ। সলিল সমাধি হওয়া নিকট জনের শেষকৃত্যটুকু যাঁরা করতে পারেন না বলে আরও বেশি শোকের পাথারে ডুবে থাকেন, তাঁদের হাতে প্রগত তুলে এনে দেন স্বজনের তলিয়ে যাওয়া শবদেহ। যে সব পরিবারের হাতে তাদের স্বজনের মৃতদেহ তুলে দেন প্রগত, তাদের কাছ থেকে একটি টাকাও নেন না । ‘পাঞ্জাব থেকে দিল্লী অবধি শহর গ্রামের আনাচে কানাচে অসংখ্য ডুবুরির সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা অনেকেই অসাধু। ডুবে যাওয়া মানুষের টাকা পয়সার ওয়ালেট বা পরিধেয় সোনা দানা নিয়ে নেয় তারা। পরিবারের হাতে এক একটি মৃতদেহ তুলে দিতে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা দাবি করে এক একজন ডুবুরি। কিন্তু ১৪ বছর ধরে এ’ কাজ করেও এমন কখনোই করিনি আমি’ জানিয়েছেন প্রগত।
বর্তমানে তরুণ ডুবুরিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। নিজের গ্রাম ও আশেপাশের অঞ্চলের স্থানীয় তরুণ সহ তাঁর নিজের তিন কন্যাকেও দক্ষ ডুবুরি হওয়ার তালিম দিচ্ছেন প্রগত। কিন্তু এ সবই তিনি করছেন কোনও রকম অর্থ প্রত্যাশা না রেখেই। একেবারে স্বার্থহীনভাবে তিনি শুধুই দিয়ে যাচ্ছেন সমাজকে। মানুষ হিসেবে অনেক বড় মাপের তিনি’ জানিয়েছেন পুলিশ সুপারিন্টেনড আস্থা মোদি। সম্প্রতি তিনি সংবর্ধনা দিয়েছেন প্রগত সিং সাঁধুকে।
প্রগত কী ভাবে বা কেন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এ রকম কাজে? ‘আমার ঠাকুরদা ক্যানেলে ডুবে গেছিলেন। জলে তলিয়ে যেতে যেতে তিনি অসহায়ের মত ছটফট করছিলেন, সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করছিলেন, আমি তাঁকে টেনে তুলে আনার চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারিনি। চোখের সামনে মারা গেলেন আমার ঠাকুরদা। তখন আমি ভাবছিলাম, যদি আমি সাঁতার জানতাম, তা হলে হয়ত বাঁচাতে পারতাম তাঁকে। সেই দৃশ্য আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না আজও। তখন থেকেই আমার সাঁতার শিখে কিছু করার ইচ্ছে। এর পর খালের ধারে যখন গরু মোষ চরাতে যেতাম, তখন ধীরে ধীরে সাঁতার শিখে গেলাম’ স্মৃতিচারণ করেছেন প্রগত।
প্রত্যেক গ্রীষ্ম ছুটিতে গ্রামের ও আশেপাশের অঞ্চলের অন্তত ২০০ – ২৫০ কচিকাঁচাদের সাঁতার শেখান তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে আঞ্চলিক মানুষদের কাছ থেকে যেমন অনেক সাহায্য পেয়েছেন প্রগত তেমন প্রবাসী ভারতীয়রাও প্রচুর সহায়তা করেছেন তাঁকে। তাঁর এ রকম সেবামূলক কাজের কথা শুনে এক কানাডা নিবাসী ভারতীয় তাঁকে গোটা একটা ডাইভিং কিট উপহার দিয়েছেন। মৃতদেহ তুলে আনার জন্য স্ট্রেচারও পাঠিয়েছেন।
ডুবুরির কাজটি প্রগত পুরোটাই করেন দাতব্য হিসেবে। তাঁর আসল পেশা দুধ বেচা। অল্প কিছু গরু বাছুর আছে তাঁর। ‘সরকারি সাহায্য কখনও আশা করিনি। দশ বছরে তিন মাসের জন্য একটা সরকারি কাজ পেয়েছিলাম। কিন্তু তার পর কাজটা চলে যায়। জানি সরকারের থেকে কোনও কাজ বা সহযোগিতাই পাব না’ বলেন প্রগত। কেউ কেউ চেষ্টা করছেন সাহায্যের। তবে, প্রগতর মত মনের মানুষ সমাজে সত্যিই বিরল।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।