আগের পর্ব পড়তে- [১]
জার্মানির কাফবিওর্নে জন্মগ্রহণ করেন হান্স ম্যাগনাস এনজেনৎসবার্গার (Hans Magnus Enzensberger) ১৯২৯ সালের ১১ নভেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি, দেখেছেন ফ্যাসিবাদের পতন। বামপন্থায় বিশ্বাসী এই কবি তার পর দেখেছেন পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিস্ট শাসনের আওতায় আরেকধরনের ফ্যাসিবাদ। ওদিকে পশ্চিম জার্মানিতে তিনি যখন পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় উন্নত এক জার্মানিকে দেখছেন, তখন পূর্ব জার্মানিকে দেখছেন দারিদ্র্যের ভারে বিপন্ন হয়ে যেতে। তিনি ছিলেন ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানির কবিতার অন্যতম এক স্থপতি ও প্রধান কবি। এই জার্মান কবি, লেখক, অনুবাদক এবং সম্পাদকের ছিল বহু ছদ্মনাম। পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির শাসকদের ঘেরাটোপ এড়িয়েই তিনি দুই জার্মানির মিলনের জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৬৮ সালের পশ্চিম জার্মানির ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। জীবনে প্রায় ৭০ টি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।, হান্স ওয়ের্নার হাঞ্জ-এর প্রেরণায় তিনি কিউবায় যান। বেশ কিছু লিটারারি জার্নালের সম্পাদক ছিলেন তিনি। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

মধ্যবিত্তদের পাঁচালি
আমরা অভিযোগ জানাতে পারি না
আমরা কর্মহীন নই
আমাদের খিদে নেই
তবু আমরা খাই।
ঘাস বড় হয়
সামাজিক দ্রব্য,
আঙুলের নখ
অতীত।
রাস্তাগুলো ফাঁকা।
দেনাপাওনা সমাপ্ত।
স্তব্ধ সাইরেন।
সব কিছুই মিলিয়ে যাচ্ছে।
মৃতরা তাদের ইচ্ছাপত্র তৈরি রেখেছে।
বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে।
এখনও যুদ্ধঘোষণা হয়নি।
কোনও তাড়া নেই।
আমরা ঘাস খাই।
আমরা সামাজিক দ্রব্য খাই।
আমরা নখ খাই।
খাই অতীত।
এমন কিছুই নেই যা আমরা ঢেকে রাখব।
আমাদের হারিয়ে ফেলারও কিছু নেই।
বলার কিছু নেই।
আমাদের তবু কিছু আছে।
ঘড়িটি বন্ধ আছে,
বিলের টাকা দেওয়া হয়নি।
কাচাকাচি হয়ে গেছে।
শেষ বাস চলে যাচ্ছে।
ফাঁকা।
আমাদের কোনও অভিযোগ নেই।
কার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা?

যারা জানে তাদের জন্য একটি গান
কিছু একটা এখনই করে ফেলতে হবে
এইটুকুই আমরা জানি
কিন্তু কিছু করার সময় এখনও আসেনি
আবার অনেক সময় পেরিয়েও গেছে
আমরা এসব জানি
আমরা জানি যে খুবই ভালো রয়েছি আমরা
আর এভাবেই কেটে যাবে দিন
আর এও জানি, জীবনটা নিয়ে খুব একটা কিছু
করে ফেলতে পারব না
জানি
আমরা জানি নিজেদেরই দোষ দিতে হবে
আর নিজেদের দোষ দিলে তা
আমাদের ত্রুটি নয়
আমরা এসব নিয়ে খুবই বিধ্বস্ত হয়ে আছি
আমরা জানি খুব বেশিদিন আমরা চুপ করে থাকতে পারব না
জানি
জানি
হয়তো মুখ বন্ধ রাখাই সবচেয়ে ভালো এখন
কিন্তু হয়তো মুখ বন্ধ করে রাখতে পারব না বেশিদিন
আর এও জানি আমরা কাউকেই খুব একটা সাহায্য করতে পারব না
আর কেউই আমাদেরও সাহায্য করতে পারবে না
আহ আমরা জানি
আমাদের মতো প্রতিভাবান আর কোথাও নেই
চায়ে দু চামচ চিনি ছাড়া হয় না আমাদের
অথচ আমরা
জানি
জানি
শোষণের সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই আমাদের নখদর্পণে
শূন্যতা এবং শূন্যের মধ্যে পার্থক্য আমাদের জানা
আমরা শোষণের বিরুদ্ধে এটুকু তো জানিই
এও জানি আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে চূড়ান্ত সমস্যার দিকে
আহ আমরা জানি আমরা জানি না
আমরা জানি সমস্ত পূর্বাভাস মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে এখন
আর তাদের কোনও কাজেই ব্যবহার করা যাবে না
আর আমরা জানি যে আমরা এও জানি
যে এসব কোনওকিছুর মধ্যেই আর নতুন কিছু নেই
আর তা সত্যিই ভালো
আর বিস্ময়কর এই, তা আমরা জানিও বটে
আর এদের প্রত্যেককেই আমরা ভালোভাবেই চিনি
আহ আমরা জানি এসব কিছুই
জানি জানি জানি
আমরা সত্যিই জানি

যাদের টেলিফোন আছে
কিছু একটা আছে, যার কোনও রং নেই, কিছু একটা
যার গন্ধ শূন্যতার মতো, কিছু একটা রয়েছে
যা ঘোষণা প্রচারের থেকে চুঁইয়ে পড়ছে
ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যাচ্ছে সময়ের বন্ধনে
ওক গাছগুলি থেকে বেরিয়ে ভাসছে
ডিভিডেন্ট এবং রক্তাক্ত জাহাজের পাল
ওয়েন ব্রিজের মতো কম্পমান হাসপাতালের ন্যায়
কানাকানি এবং গুজগুজ ফুসফুসের মধ্যে ঢুকে পড়ছে
হাসি কান্নার মধ্যে ঢুকে পড়ছে
আবেশে আদুরে প্রেমের মধ্যে ঢুকে পড়ছে
কুচকাওয়াজের মধ্যে ঢুকে পড়ছে
কিছু একটা যা মেরে ফেলছে স্যামন মাছগুলিকে
কিছু একটা যা মেরে ফেলছে পাতাগুলিকে
নদীতে, বাতাসে মিশে যাচ্ছে রং নেই যদিও
নদীতীরের সব পাড়গুলিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে
সংখ্যালঘুদের আছে সংখ্যাগুরুরা
মৃতদের জন্য কোনও ভোট নেই
রাজ্যে প্রিন্টিং-এর দোকানগুলিতে
এমন কেউ রয়েছে যা আমাদের ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছে
মন্ত্রীসভাগুলি ঝুলে আছে বাদুড়ের মতো
পচা গন্ধ বেরোচ্ছে সকলের গা থেকে
যেন মৃতরা উঠে এসেছে কবর থেকে
চারিদিকে মাকড়সার জাল
তৈরি করছে অদ্ভুত এক জাল
এখনই ট্যাঙ্কারগুলি নেমে পড়েছে রাস্তায়
পাইলট আসার আগেই তারা তাদের কাজ শুরু করে দেবে
আর এই জালের ভিতর নিঃশব্দে
শীত ঢুকে পড়ছে অলংকৃত কফিনের ভিতর
কিছু আছে এমন কিছু আমাদের শ্বাসের ভিতর ঢুকে পড়ছে
আর কেউ তার গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছে না
জ্বলন্ত শার্টের মধ্যে তার মুখ পর্যন্ত দেখা যায় না আর
রক্তহীন ফ্যাকাশে মানুষের মুখে
সে আসছে, যাকে তুমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছ না

ছায়ারাজ্য
১.
এমনকী এখানেও আমি একটা জায়গা দেখি
একটা মুক্ত জায়গা
এখানে, ছায়ার মধ্যে
২.
এই ছায়াটি
বিক্রির জন্য নয়
৩.
সমুদ্রও হয়ত
একটি ছায়া ফেলে
তেমন ছায়া পড়ে
সময়েরও
৪.
ছায়াযুদ্ধগুলি
খেলার মতো
কোনও ছায়া
একে অপরের আলোকে বাধা দেয় না
৫.
ছায়ার মধ্যে যারা থাকে
তাদের মেরে ফেলা যায় না
৬.
কিছুক্ষণের জন্য
আমি ছায়ার বাইরে পা রাখি
কিছুক্ষণের জন্য
৭.
যারা আলো দেখতে চান
যেভাবে তা আছে
তা দেখার জন্য,
তাদের লুকোতেই হবে
ছায়ার ভিতরে
৮.
ছায়া
সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল
মুক্তির ঠান্ডা ছায়া
৯.
ছায়ার মধ্যে সম্পূর্ণ
আমার ছায়া আত্মগোপন করে
১০.
ছায়ার মধ্যে
এমনকী সেখানেও আছে ঘর

অভ্যেসের শক্তি
১.
সাধারণ মানুষ সাধারণভাবেই
সাধারণ মানুষকে খুব একটা পাত্তা দেয় না
উল্টোটাও সত্যি।
সাধারণ মানুষ মনে করে
মানুষ তাদের অসাধারণ বললে
এই বলাটাই হল অসাধারণ।
আর সঙ্গে সঙ্গেই তারা সাধারণ হয়ে যায়।
উল্টোটাও সত্যি।
২.
একজন যদি সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়—
তাতেও সে অভ্যস্ত হয়।
আমরা সাধারণভাবে বিষয়টিকে বলে থাকি
শিক্ষার পদ্ধতি
৩.
এটা যন্ত্রণার
যখন অভ্যেসের যন্ত্রণা আদৌ কোথাও নেই।
জীবন্ত মন কী ক্লান্ত
নিজের জীবন্ত সত্তাটিকে নিয়ে!
একজন সহজ মানুষ
সহজ হওয়ার জন্য নিজেকে জটিল করে ফেলে।
আর সেই জটিল মানুষ নিজের
জটিল সত্তার উপর হেঁটে যায়
এই শাশ্বত শিক্ষার্থীরা
যারা বহু আগেই শেষে পৌঁছে গেছে, জানে
ঘৃণা করাটাও এক দামি অভ্যেস।
৪.
সত্যি সত্যিই অবাঞ্ছিত-
আমরা তাদের বলি
যাদের প্রতি আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।
আত্মীয় মনে হয়
আমাদের সমস্ত অভ্যেস।
৫.
শক্তির অভ্যেস যা সমস্যায় পড়ে না, তা
অভ্যেসের শক্তির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।

কাচের টুকরো
যা বিঁধে আছে তা তোমার অস্তিত্ব নয়
এ কথা জেনেও, অস্তিত্ব তোমার সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে না
এক একটা সুর বেজে ওঠে ফাঁকা কবরখানায়
আর মৃতদের ইচ্ছাশক্তি থেকে জন্ম নেয় প্রতিশোধ
যা তোমার জীবন নয়
তার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে যখন আগ্নেয়গিরির মতো প্রতিভা
তখন
তুমি তোমার অস্তিত্ব নও
অস্তিত্ব নয় তুমি
কড়া নাড়া
দরজায় আত্মবিশ্বাস দেখিও না
কারণ সেই প্রথম বন্ধ হয়ে যায় তোমার সামনে
তুমি তাকে খুলে দিলেও
সে তোমার সামনেই বন্ধ হয়ে যায়
যেন তুমি বাইরের লোক
দরজার সামনে
প্রতিবার
অনুমতি প্রার্থনা করবে
সে বন্ধ করে ফেলেছে নিজেকে।
যুদ্ধবার্তা
আমি তোমার কাছে গেলাম
তুমি আমার কাছে এলে
আর আমরা সহমত হলাম
যে আর কোনও বিষয়েই আমরা
সহমত হতে পারব না
এমনকি ভিন্নমত নিয়েও
সহমত হওয়া আর সম্ভব নয়

দুঃখ
দুঃখ নিয়ে আর কবিতা লেখার কথা ভাবতে পারি না
ওসব ভাবে তারাই
যারা দুঃখের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে
দুঃখ নিয়ে দুঃখ কবিতা লেখে না
তাকে পোড়ায়
আর তাই ছাই মেখে
কবরের উপর
রচনা করে
একটাই কথা—
আমি দুঃখ নিয়ে কবিতা লিখিনি
সমুদ্রের দিকে যারা গিয়েছিল
সমুদ্রের দিকে যারা গিয়েছিল
বা সমুদ্র তাদের টেনে নিয়েছিল তার দিকে
তাদের মধ্যে রয়েছে
একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তা
যেখানে পাখিদের ছায়া পড়ে না
তুমি সেখানে যেতে চাও বা না চাও
একদিন তোমাকে যেতেই হবে
কারণ সমুদ্রের ঢেউ
তোমাকে ছাড়া সম্ভব নয়
সমুদ্রের দিকে যারা গিয়েছিল
তাদের চোখে জেলিফিশ
ঠোঁটে সাপের ছায়া
আর বুকের ভিতর অক্টোপাস
এমন সঙ্গম
আর কেই বা অস্বীকার করতে পারে বলো
*কবিতাগুলি অনুদিত হয়েছে মূল জার্মান ভাষা থেকে…
তথ্যসূত্র—
১) জার্মান পোয়েট্রি ১৯১০-১৯৭৫ (সম্পা- মাইকেল হ্যামবার্গার)
২) https://www.goodreads.com/author/show/1045397.Karl_Mickel
৩) https://www.jstor.org/stable/487696?seq=1
৪) https://www.goethe.de/ins/in/lp/prj/ptp/mag/en14937144.htm
৫) https://www.theguardian.com/books/2010/may/15/hans-magnus-enzensberger-interview
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।
One Response
অসাধারণ লাগলো। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য যেভাবে কবিতাগুলোর অনুবাদ করেছেন যে অনুভূতি দিয়ে তা এক কথায় অসাধারণ। ধন্যবাদ কবিকে এভাবে বিশ্ব সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।