Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

অপত্যস্নেহ

উৎপল চক্রবর্তী

এপ্রিল ১২, ২০২২

Trees are life force
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

অর্ক মাঝে-মাঝে অসুখে ভুগলেও খুবই ছটফটে প্রকৃতির। রম্ভার অবশ্য তেমন একটা ভোগাটোগার ব্যাপার নেই। বরং ও সব সময় বেশ চনমনে হাসিখুশিই থাকে। অবশ্য দু’জনকেই ভীষণ চোখে-চোখে রাখে বিনীতা। রাখতে তো হবেই। খোলা জায়গা দেখতে পেলে যে আর রক্ষা নেই! ওরা শুধু সেদিকেই যেতে চায়! ওদের পাম অ্যাভিনিউয়ের পুরনো ফ্ল্যাটের ব্যালকনির রেলিংগুলোর হাইটও আবার খুব কম। তাই যেখানেই যাক না কেন, সে দিনের মধ্যেই তার ফিরে আসা চাই-ই চাই। 

না এসে উপায়ও বা কী! কতক্ষণ আর অন্যের জিম্মায় রেখে থাকা যায়! শৌণকের যা চাকরি! আজ শিলং তো কাল সল্টলেক। আজ বাঁকুড়া তো কাল বনগাঁ। বিনীতা তাই কারও বাড়িতে রাত কাটায়নি আজ এক বছর হল। মেয়ের হাত কেটে গেছে বা ছেলের জ্বর হয়েছে বলে এড়িয়ে গেছে অনেক অনুষ্ঠান। প্রায় দশ বছর বাদে বিনীতার সন্তানের খবরটা ঠারে-ঠোরে অনেকেই জেনে গিয়েছিল। আর সেই খবর শুনে ওদের দেশের বাড়ির সবার মতো পাড়া প্রতিবেশীরও একই সঙ্গে বিস্ময় আর আহ্লাদের সীমা ছিল না।

সেদিন শপিং মলে এক পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা। কার ক’টা ছেলে-মেয়ে সে কথা উঠলে আনন্দে ফেটে পড়ল বিনীতা। কে-কেমন দেখতে, কে-কত বড় হয়েছে, কে-কী পছন্দ করে এসব কথা যেন তার ফুরোতেই চায় না। এক নিশ্বাসে প্রায় সে কথাগুলো বলে গেল। নিজের সন্তানদের নিয়ে এত প্রশংসা কেউ কখনও শুনেছে বলে মনে হয় না। বান্ধবীর কোনও ছেলে-মেয়ে নেই। তাই সন্তানের প্রসঙ্গ আসতেই সৌমি যেন কেমন মিইয়ে পড়েছে। সৌমি বিনীতার ছোটবেলার বন্ধু। ও ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে যে বিনি খুব চাপা স্বভাবের। কম কথা বলে। কিন্তু আজকের বিনির সঙ্গে আগের বিনিকে কিছুতেই মেলাতে পারছে না ও। তবে এ মিলটা অনেকেই কিন্তু বোকার মতো খোঁজে, কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চেহারা, মন ও কথা বলার ধরনে তো পরিবর্তন আসবেই। পরিবর্তনই তো প্রকৃতির ধর্ম। জীবনের বৈশিষ্ট্য! ওর নিজেরও কি আসেনি? তা না হলে ওর এত উচ্ছলতা আজ গেল কোথায়!

Two woman
সৌমি আর বিনীতা ছোটবেলার বন্ধু

সন্তান নেই বলেই কাউকে এমন ঝিমিয়ে যেতে হবে! আজকাল তো দত্তক নেওয়ার অপশন আছেই। কথা বলতে-বলতে ওর জানাই হয়নি বিনির ছেলে-মেয়ে দু’জনের নাম। কফি টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করতেই গলগল করে আবার কথা বেরিয়ে এল বিনির। নাম দু’টো শুনে সৌমি বলল,
বাহ। খুব সুন্দর নাম রেখেছিস তো। অর্ক আর রম্ভা দু’টো নামই দু’অক্ষরের। মনে রাখার মতো।
বিনীতাও ছেলে-মেয়েদের নামের প্রশংসা শুনে আনন্দে আত্মহারা। একটা আধুনিক নাম আর একটা একটু পুরনো হলেও এই দুটো নামের মধ্যে যেন একটা জাদু আছে। নাম দু’
টোই যেন ওদের প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য তো এখানেই। কারও কারও নাম এমন হয়, যে শুনলেই তার সম্বন্ধে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা তৈরি হয়। 

সৌমি ভাবল, কী সুন্দরী যে রম্ভা! হয়তো নাচেও খুব ভাল। আর কী যে সুন্দর তার ভাই অর্ক! হয়তো বা সূর্যের মতো তার চোখের গড়ন। কিংবা তেজ। হয়তো বা একটু রাগী সে। হা ভগবান! আমারও যদি এমন একটা সন্তান থাকত, তাহলে আমিও সুন্দর-সুন্দর নাম দিতাম। এখন তো নামেরও বই পাওয়া যায়। তার থেকে বেছে খুব সুন্দর একটা নাম পছন্দ করতাম। কিন্তু এখন আর এসব আলোচনা ওর ভাল লাগছে না। তবু বিনি বলেই চলল,
জানিস, বড় মেয়ে কথা শিখে গেছে। খিল-খিল করে হাসে আর মুখে সারাক্ষণ শুধু মা আর মা। আর জানিস রম্ভাকে কোলে নিলে ছেলের কী রাগ! কিন্তু আশ্চর্য যে অর্ক আমার কোলে এলে ওর দিদি বরং খুশিই হয়! ছেলেরা একটু হিংসুটে হয় বোধহয়।
আর শৌনক কাকে বেশি ভালবাসে? জিজ্ঞেস করে সৌমি।

Human Heart
শৌনক কাকে বেশি ভালবাসে? জিজ্ঞেস করে সৌমি

আরে ও তো বাড়িতেই থাকে না। তা আর ভালবাসবে কি! ওদের একটু বড় হতে দে! দেখবি মজা। ও আর বাড়ি ছেড়ে যেতেই চাইবে না!
সৌমি ভাবে, যাক একদিক দিয়ে ও সুখী, যে বিয়ে হওয়ার পর থেকে ওকে একা থাকতে হয়নি কখনও। রঞ্জনের চাকরিতে বদলি নেই বলে ওর সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। কিন্তু বিনীতার ছেলে-মেয়ে হয়েছে শুনে ওর কৌতূহলের সীমা নেই। একদিন যেতে হবে তো ওদের বাড়ি। দেখতে হবে ছেলে-মেয়ে দু’টোকে। তাই বলেই ফেলল,
বিনি, কবে যাব বল তোদের বাড়িতে? তোর ছেলে-মেয়ে দু’টোকে দেখার আমার ইচ্ছে খুব।
আচ্ছা আচ্ছা। যাবি রে যাবি। আর একটু বড় হোক। তোকে একদিন আসতে বলব। তাহলে আজ উঠি রে। ওদেরকে আজ একটু হালকা গরম জলে স্পাঞ্জ করে দেব। কাল যদিও শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়েছি ভালো করে। খুব চোখে চোখে রাখতে হয় বুঝলি! গিয়ে হয়তো দেখব ছেলেটা হাসছে আর মেয়েটা মন-মরা হয়ে বারান্দায় টবটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কখন আমি যাব, ওকে বসার ঘরে নিয়ে এসে কাপড় জামা চেঞ্জ করাব তারপর ও আবার খলখলিয়ে হেসে উঠে নাচের ভঙ্গিমায় স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলা করবে। ফ্যানের বাতাসে দুলতে থাকবে আর ওর মুখ দিয়ে আধো আধো কথা বেরবে।

মাসের পর মাস চলে যায়। ফোনেও মাঝে মাঝে বিনির সঙ্গে কথা যে হয় না, তা নয়। কিন্তু খুব অবাক হয় সৌমি। একদিনও আসতে বলল না তো বিনি? সৌমিকে একটা সময়ে কিছুতেই বোঝানো যায়নি যে ওদের আর সন্তান হবে না। আইভিএফের দীর্ঘ কষ্ট সহ্য করার পরেও আশা ছাড়েনি। অনেক জলপড়া খেয়ে দেখেছে, শেষে বাবার থানে দণ্ডি কেটেও কোনও সন্তানের মুখ দেখতে পায়নি। সাত আট বছর ধরে ও লাগাতার দুশ্চিন্তা করে গেছে৷ কিন্তু এখন সেসব চিন্তা ছেড়ে একটা এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মনে-মনে সন্তান অ্যাডপ্ট করার কথাও যে ভাবছে না তা নয়। তবে কাউকেই ও সেভাবে বলেনি। আপাতত একটা অনাথ আশ্রমের মেয়েদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে। এইভাবে ওর দিনও কাটছিল ভালই। কিন্তু বিনীতার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে ওর মনখারাপ। ওর মলিন মুখ দেখে একদিন রঞ্জন কত বোঝাল। বলল,
দ্যাখো, যা হবার নয় তাই নিয়ে মাথাব্যথা না করে, অনাথ আশ্রম এবং এনজিও নিয়েই থাকা ভাল। 

 

আরও পড়ুন: নন্দিনী সেনগুপ্তের ছোটগল্প: সন্ধে নামার পর

 

কিন্তু বিনীতার দশ বছর বাদে সন্তান হওয়াতে ওরও ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে প্রায় মরে যাওয়া ইচ্ছেটা যেন আবার তরতাজা হয়ে উঠেছে। ও মা হতে চায়। মা-ডাক শোনার মতো তৃপ্তি যে কোনও কিছুতেই নেই।  একদিন কেমন উচ্ছল হয়ে উঠে ও বলল,
কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দেব একেবারে? বিনির তো দশ বছর লাগল।
রঞ্জন ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও বৌয়ের কথা ভেবে শক্ত হল। বলল,
– সন্তান, সন্তান করছ। কিন্তু সন্তান যদি কু-সন্তান হয়?
মানে?
মানে, হতেও তো পারে। সব ভালো বাবা-মায়ের সন্তানই কি ভাল হয়!
সেটা অন্য কথা। কী হতে পারে সেই সম্ভাবনা নিয়ে হতাশ হয়ে তো লাভ নেই।
কিন্তু সেই সম্ভাবনার কথা ভেবেও তো আমরা নিঃসন্তান থাকার দুঃখটা ভুলতে পারি।
ওহ, তুমি তাহলে আঙুর ফল টকের গল্প শোনাচ্ছ?
না, তা ঠিক বলতে চাইনি। কিন্তু সন্তান বড় হয়ে যদি আমাদের ছেড়ে বিদেশে চলে যায়, তাহলে তো আমরা আবার সেই একাকিত্বে ভুগব।
মানতে পারলাম না। আধুনিক বাবা-মা যদি সন্তানকে আগলে রাখে, তাহলে তো তার ও দেশের কোনও উন্নতিই সম্ভব হবে না। তাছাড়া সন্তান পালনও একধরণের এনগেজমেন্ট। একটা আনন্দঘন, স্যালারিবিহীন চাকরির মতো।
যদি এনগেজমেন্টই মেন কারণ হয়, তাহলে তো আরও কত কাজ আছে!
আছে, কিন্তু সে কাজ আর এ কাজে বিস্তর তফাত। তোমরা বাবারা তা বুঝবে না।
আচ্ছা তাহলে মা তার স্বার্থেই সন্তান কামনা করে?
তা বলতে পারো। মা একটা গাছের মতো। সে চায় মাটি কামড়ে তার শিকড় চারিয়ে দিতে। কিছু ফল রেখে যেতে। সেই ফলেই তার ভবিষ্যতের বীজ লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে রাখে তার আনন্দ। বিশুদ্ধ আনন্দ।

Mother and Child
সন্তান পালনও একধরণের এনগেজমেন্ট। একটা আনন্দঘন, স্যালারিবিহীন চাকরির মতো

রাতে শুতে যাওয়ার আগে সৌমি খুব ভাল করে সাজল। গায়ে পারফিউম ছড়াল। ধ্যান করল ঠাকুরঘরে বসে অনেকক্ষণ। তারপর রঞ্জনকে টেনে নিল কাছে। এই টেনে নেওয়ার মধ্যে যেমন জড়িয়ে স্নেহ-ভালবাসা-মমতা, তেমনি এক অব্যক্ত আকুতি, এক পুষ্পিত মন, দর্শন। রঞ্জন কিছু বুঝে ওঠার আগেই চুমুতে-চুমুতে ভরিয়ে দিল ওর সমস্ত শরীর। মরুভূমির মতো শুকনো কাঠামোয় ও যেন আজ প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবেই। ধীরে ধীরে সৌমি তার সব কিছু ছেড়ে রেখে সঁপে দিল নিজেকে। এভাবে সম্পূর্ণ সমর্পণ কত বছর আগে যে শেষ করেছে, তা ওর মনে নেই। পঞ্চান্ন বছরের একজন পুরুষের মধ্যেও এত তৃষ্ণা যে লুকিয়ে ছিল, ও নিজেই জানত না সেটা। অনেকদিন পর, রঞ্জন যেন আজ জ্বলন্ত লাভা। ওর সব উষ্ণতা যেন আজ জড় হয়েছে শরীর ও মনের এক বিশেষ অংশে। ঝড় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক হয়ে যাওয়া দুটো শরীরে। একই সঙ্গে, একই ছন্দে। সৌমিরও যেন আজ ওর সবটাই চাই। সবটাই। না একটুও জমি, একটুও বৃষ্টির কণাও আজ ছাড়তে রাজি নয়। কতক্ষণ যে ওরা সেদিন একাত্ম হয়ে কাটিয়েছিল, কখন যে ওরা ঘুমিয়েছিল কে জানে! 

পরদিন স্বাভাবিকভাবেই বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল। গত রাতের স্মৃতিতে মন ভরে আছে দুজনেরই। এসবের জন্য কার দান সবচেয়ে বেশি? বিনির নিশ্চয়ই। মনে মনে সৌমি ধন্যবাদ জানাল বিনীতাকে। আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করা গেছে তাহলে। সন্তান নেই তো কী! জীবনের আনন্দ, শান্তি তো ওদের কেউ কেড়ে নেয়নি! নতুন এক বোধের সম্পাতে সৌমি আজ উজ্জ্বল। আর সেই আনন্দে এ মাসের প্রথম দিনেই ও পৌঁছে গেল অনাথ আশ্রমে। আজ ও আশ্রমের সব ছাত্রীদের খাওয়াবে নিজের হাতে। কুড়িজন মোট ছাত্রী। ওদের জন্য ও নিজের হাতে তৈরি লুচি, চিলিচিকেন রান্না করে এনেছে। সঙ্গে এনেছে দুতিন রকম মিষ্টি। আর এসব কাজে ওকে সাহায্য করেছে রঞ্জন। ও-ই গাড়ি করে ওকে আজ পৌঁছে দিয়ে গেছে, সবকিছু ভালভাবে প্যাকিং করে। সৌমির মন বরাবরই ফুরফুরে হয়ে যায় এইসব ছেলেমেয়েদের খুশি দেখলে। আজকে সেই খুশিটা যেন আরও বেশি। হ্যাঁ অনেকটাই বেশি। এবারে পুজোয় ওদের সবাইকে ভালো ভালো চুড়িদার কিনে দেবে ঠিক করল মনে মনে।

বিনীতাও ছেলে-মেয়েদের নামের প্রশংসা শুনে আনন্দে আত্মহারা। একটা আধুনিক নাম আর একটা একটু পুরনো হলেও এই দুটো নামের মধ্যে যেন একটা জাদু আছে। নাম দু’টোই যেন ওদের প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য তো এখানেই। কারও কারও নাম এমন হয়, যে শুনলেই তার সম্বন্ধে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা তৈরি হয়। 

সত্যি কী বিচিত্র এই দেশ! কেউ সন্তানের জন্য পাগল, কেউ আবার সদ্যোজাতকে ডাস্টবিনে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ জন্মানোর আগেই তার সন্তানকে হত্যা করছে। থাইল্যান্ডে এখন নাকি সন্তান মানুষ করার জন্য আলাদা হোমই তৈরি হয়েছে। বাবা-মা লিভ-ইন সম্পর্কে থেকে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করছে আর সন্তানের দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে হোমের হাতে। টাকা পয়সা সবই ঢেলে দিচ্ছে ওদের জন্য। দূরে থেকে দেখেও আসছে ওরা। কিন্তু বাবা-মায়ের পরিচয় জানতে পারছে না ওদেরই ছেলেমেয়েরা। এরা টাকা পাবে, সম্পদ পাবে, কিন্তু আসল বাবা-মা কোনওদিনই পাবে না। এটা কি শুধু তাদেরই দুর্ভাগ্য? বাবা-মায়ের নয়? দেশের নয়? কে জানে! হয়তো পশুপাখির মতোই আমাদের ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে!

বিনীতার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রায় ছমাস কেটে গিয়েছে। সৌমির আজ নিমন্ত্রণ রঞ্জনের এক অফিস কোলিগের বাড়ি। ওরা একটা পুরনো ফ্ল্যাট কিনেছে ২৫ নম্বর যদুমিত্তির লেনের এ ব্লকে। ওই ফ্ল্যাটটাকেই রেনোভেট করে ওরা ওখানে গিয়ে উঠেছে। সালিম-রোকেয়া, তাদের আদরের একমাত্র মেয়ে সালেহাকে নিয়ে থাকে ওখানে। আজ ওদের মেয়ের জন্মদিন। ঈদও একই দিনে পড়েছে। ফলে আজকের আনন্দের সঙ্গে অন্যদিনের তুলনাই হবে না। হালিম থেকে লাচ্চা পরোটা, চিকেন বিরিয়ানি থেকে ক্ষীরের মিষ্টির গন্ধে ম-ম করছে সারা বাড়ি। ‘যদুনাথ মিত্তির লেন’, ‘যদুনাথ মিত্তির লেন’ কথাটা কয়েকবার বিড়বিড় করল সৌমি। অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মনে হল কোথায় যেন নামটা আগে শুনেছে! ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল আচমকা। আরে! এখানেই কোথাও বিনি থাকে! রোকেয়ার বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ কাটানোর পর সৌমি বলল,
আচ্ছা রোকেয়া, তুমি বিনীতা নামে কাউকে চেনো?
হ্যাঁ চিনি তো। এই বাড়িরই পাশের ফ্ল্যাটের ছ’তলায় থাকে। সুইমিং পুলে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
খেয়েদেয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় সৌমি রঞ্জনকে বলল,
তুমি একটু বসো তো এখানে। আমি বিনির সঙ্গে চট করে একবার দেখা করে আসি। 

Dying Plant
ছোট অর্কিড গাছটা কেমন মিইয়ে পড়েছে। যদি গাছটা মারা যায়?

বিনীতার বাড়ির দরজায় গিয়ে বেল বাজাল সৌমি। দরজা খুলে সৌমিকে দেখেই বিনীতার মুখে কেমন একটা কালো ছায়া পড়ল। যেন একটুও আনন্দ নেই সেখানে। সৌমি ভেতরে ঢুকল। বিনির যেন কথা বলারও আগ্রহ নেই। সৌমি অর্ক আর রম্ভার সঙ্গে দেখা করার কথা বলতেই বিনি নানাভাবে সে প্রসঙ্গ এড়াতে চাইল। এদিকে পাঁচ সাত মিনিট অপেক্ষা করে খুঁজে খুঁজে রঞ্জনও এসে হাজির হল। ওদের দুজনের মিলিত অনুরোধে বিনীতা এবার না করতে পারল না। কিন্তু এ কী! ওর চোখে জল কেন? সৌমি বিনীতাকে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
– এই বিনি তুই কাঁদছিস কেন? আমি তোর ছেলে-মেয়েদের দেখতে চেয়েছি বলে?
বিনীতা উত্তর না দেওয়ায় অগত্যা সৌমি বলল,
আমরা দেখলে তোর ছেলেমেয়েদের নজর লাগবে ভাবছিস? ঠিক আছে রে। আমরা চলে যাচ্ছি। সৌমি চলে যেতে উদ্যত হলে, বিনি ওকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল। ঠিক সেই সময়ে ওদের পরিচারিকা গৌরী এসে হাজির। বিনীতার কান্নার কারণ সে জানে। তাই অপরিচিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
আপনি বোধহয় একটা কথা জানেন না, মাসিমা। ছোট অর্কিড গাছটা কেমন মিইয়ে পড়েছে। যদি গাছটা মারা যায় তাই কাকিমাও খুব ভেঙে পড়েছে।
সৌমি শুনে তাজ্জব।
– আরে, তুই একটা গাছের জন্য কাঁদছিস?
অমন করে বলিস না ভাই! ও-ই তো আমার ছেলে রে! ওকে কত যত্নই যে করি! তাও দেখ, বাঁচাতে পারব কিনা জানি না।
সৌমি তবুও হতভম্ব। বিনীতা একটু সামলে নিয়ে বলল,
চল, ওদের দেখবি।
সৌমি ওর ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল এক আশ্চর্য দৃশ্য।

Orchid with White Flower
ফুলটা দেখলে মনে হবে স্বর্গের অপ্সরা নাচের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে আছে

বিনির খাটের মাথার দিকে একটা ছোট্ট টি টেবিলে রাখা একটা অপূর্ব ডিজাইনের ফাইবারের টব। তাতে একটা অর্কিড। একটু শুকনো চেহারার। দুচারটে পাতা খসে গেলেও তাতে একটা হালকা সাদা রঙের ফুল ফুটে আছে। ফুলটাকে দেখলে মনে হবে শিশু যেন আদুড় গায়ে খেলা করছে। অর্কিডের পাশেই বেডের একটু উপরে একটা বড় তাক। সেই তাকের উপর একটা পোর্সিলিনের সুন্দর টব। তাতে বেড়ে উঠেছে ছিপছিপে সুন্দর তাজা আর একটা বিদেশি অর্কিড। সেখানে তিন ইঞ্চির মতো লম্বা যে ফুলটা ফুটে আছে, দেখলে মনে হবে স্বর্গের অপ্সরা নাচের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে তার দিব্য জ্যোতি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বিনীতা সৌমিকে বলল,
দ্যাখ সৌমি, আমার মেয়েটা কেমন কাঁদছে?

সৌমির আজ নিমন্ত্রণ রঞ্জনের এক অফিস কোলিগের বাড়ি। ওরা একটা পুরনো ফ্ল্যাট কিনেছে ২৫ নম্বর যদুমিত্তির লেনের এ ব্লকে। ওই ফ্ল্যাটটাকেই রেনোভেট করে ওরা ওখানে গিয়ে উঠেছে। সালিম-রোকেয়া, তাদের আদরের একমাত্র মেয়ে সালেহাকে নিয়ে থাকে ওখানে। আজ ওদের মেয়ের জন্মদিন। ঈদও একই দিনে পড়েছে। ফলে আজকের আনন্দের সঙ্গে অন্যদিনের তুলনাই হবে না। হালিম থেকে লাচ্চা পরোটা, চিকেন বিরিয়ানি থেকে ক্ষীরের মিষ্টির গন্ধে ম-ম করছে সারা বাড়ি। 

সৌমি কাছে গিয়ে ব্যালেরিনাকে চুমু খেল, আদর করল। একদম বিনির মতো সেও রম্ভার চোখে যেন দেখতে পেল জলের ফোঁটা। একটু  পিছিয়ে এসে অর্কর গায়ে হাত বোলাতে-বোলাতে সে বন্ধুকে বলল,
তোর ছেলে ভাল হয়ে যাবে দেখিস। আমাকে একটু সময় দে। আমার পরিচিত একজন প্ল্যান্টেশন নিয়ে ডক্টরেট করেছে। সে নিজের বাড়িতে এইসব বিদেশি অর্কিডের চাষ করে। ওকে ফোন করলে একটা না একটা বিহিত হবেই হবে। আমি নিশ্চিত। তুই ভাবিস না। আমি তোকে কালকের মধ্যেই জানাব কী করতে হবে। 
বিনীতাকে বুঝিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সৌমি রঞ্জনকে বলল
কী সুন্দর! তাই না রঞ্জন
হ্যাঁ তাই তো। চোখের সামনেই সমাধান। শুধু খুঁজে পেতেই কেউ কেউ একটা জীবন কাটিয়ে দেয় বৃথা। বিনীতা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে

বলে রঞ্জন ওকে জড়িয়ে ধরল। ওরা তখনই ঠিক করে ফেলল অনাথ আশ্রমকে সাহায্য করার পাশাপাশি ওরাও দুটো হোম সাকুলেন্ট কিনবে। আর তাদের অনাথ হতে দেবে না কখনও। কক্ষনও না।

 

*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Saatchiart, Bored Panda, Facebook

উৎপল চক্রবর্তী ইংরেজি ভাষার শিক্ষক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি। ২০১৭ সালে প্রথম দেশ পত্রিকায় ওঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। সিগনেট থেকে প্রকাশিত কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'উড়ন্ত ডলফিন' এবং শাম্ভবী থেকে প্রকাশিত প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ, 'দ্যা মার্ক'। কলকাতার নবোদয় পাব্লিকেশন থেকে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ওঁর দশটিরও বেশি বই।

Picture of উৎপল চক্রবর্তী

উৎপল চক্রবর্তী

উৎপল চক্রবর্তী ইংরেজি ভাষার শিক্ষক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি। ২০১৭ সালে প্রথম দেশ পত্রিকায় ওঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। সিগনেট থেকে প্রকাশিত কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'উড়ন্ত ডলফিন' এবং শাম্ভবী থেকে প্রকাশিত প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ, 'দ্যা মার্ক'। কলকাতার নবোদয় পাব্লিকেশন থেকে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ওঁর দশটিরও বেশি বই।
Picture of উৎপল চক্রবর্তী

উৎপল চক্রবর্তী

উৎপল চক্রবর্তী ইংরেজি ভাষার শিক্ষক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি। ২০১৭ সালে প্রথম দেশ পত্রিকায় ওঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। সিগনেট থেকে প্রকাশিত কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'উড়ন্ত ডলফিন' এবং শাম্ভবী থেকে প্রকাশিত প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ, 'দ্যা মার্ক'। কলকাতার নবোদয় পাব্লিকেশন থেকে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ওঁর দশটিরও বেশি বই।

5 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস