হাওড়াগামী বাসগুলো ব্রেবোর্ন রোডের টি বোর্ডের বাড়িটা পেরোলেই লোকজন নড়েচড়ে বসত। ব্রিজে জ্যাম না থাকলে হাওড়া আর বেশিক্ষণ নয়। আবার তাড়াহুড়ো করে বাস থেকে নামা। ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরা। ট্রেন থামার আগেই কাউকে নামতে না দিয়ে ঝাঁপিয়ে ট্রেনে ওঠা। জানালার ধারে যদি কোনওমতে একটা জায়গা পাওয়া যায়! ঘাম-শরীর-বিরক্তির সঙ্গে মাখামাখি থেকে খানিক মুক্তি। ভ্যাপসা গরমে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় বেশ খানিকটা আরাম। হুশ হুশ করে সরে যাওয়া আলো-আঁধারির সঙ্গে খানিকটা হিসেবনিকেশ। স্টেশনে নেমে ক্লান্ত পথ ধরে বাড়ি ফিরে গা-হাত-পা ধুয়ে এক কাপ গরম চা। আঃ! শান্তি। একদিন-প্রতিদিন।
নরেন্দ্রপুর থেকে ছুটি-ছাটায় বাড়ি আসতাম রাঙাদা বা ছোড়দার সঙ্গে। অটো করে গড়িয়া এসে S7, ৫ বা ৬ নম্বর বাস ধরতাম হাওড়া আসার জন্য। আমার পছন্দ ছিল দোতলা ৫ বা ৬ নম্বর বাস। দোতলার জানালার ধারে বসে কলকাতা দেখতে দেখতে যাওয়া। বাড়ি ফেরার আনন্দে, বাসের দুলুনিতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম। ব্রেবোর্ন রোডে বাস পৌঁছলে ডেকে দিত দাদা। এবার নামতে হবে। টি বোর্ডের বাড়িটা দেখে ভাবতাম, কী হয় এখানে! অনেককে জিজ্ঞেস করতাম। পরিষ্কার উত্তর পাইনি।

কেউ বলতেন এই বাড়িতে নাকি টি-টেস্টাররা বসে নামীদামি চায়ের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। এঁদের নাকি বিরাট মাইনে। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার ভীষণ কড়াকড়ি। ঝাল-মশলা খাওয়া নাকি একদম বারণ। ছোটবেলা তো অনেক কিছু হতে ইচ্ছে করত! সবার যেমন করে। পাইলট ,কমান্ডো, ফেলুদার মতো গোয়েন্দা! কিন্তু টি-টেস্টার হতে ইচ্ছে করেনি কোনওদিন। খাওয়াদাওয়ার কড়াকড়ি মেনে চলা ভারী মুশকিল। যতই মাইনে হোক।
তবে মনে মনে ভাবতাম– এত উঁচু বাড়ি শুধু চায়ের জন্য? ওই তো রাস্তার ধারে গুচ্ছের চায়ের দোকান। ফাটা কাপে বা মাটির ভাঁড়ে অসংখ্য লোক তো রোজ চা খেয়ে যাচ্ছে। অগুনতি বাড়িতে রোজ কত কত কাপ আটপৌরে চা খাচ্ছে লোকজন। সকালে উঠে। সন্ধ্যার কাজের পর বাড়ি ফিরে। ছুটির দিনে– সারাদিন ধরে দফায় দফায়। ব্রিজ খেলতে খেলতে। বা স্রেফ আড্ডা দিতে দিতে। তার জন্য এত বড়ো বাড়ি কিসে লাগে? ওই তো পাড়ার চায়ের দোকানে গেলেই সাজানো টিন থেকে লিকার-ফ্লেভার মিশিয়ে ঠোঙায় করে চা পাতা ধরিয়ে দেয়। বেশ লাগে অবশ্য চা পাতার দোকানের চা-চা গন্ধটা!

আমার মায়ের বরাবর সুন্দর করে গুছিয়ে চা-পানের খুব শখ ছিল। সুন্দর কাপ-ডিশ, টি-পট, মিল্ক-পট, সুগার-পট– আরও কত সরঞ্জাম ছিল চায়ের। মা নিজের হাতে এমব্রয়ডারি করে নানা রকম টি-কোজি তৈরি করতেন। চা-পাতা আসত ভাল দোকান থেকে। কিন্তু যা ছিল না, তা হল সময়। বাবা ব্যস্ত চিকিৎসক ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোনওরকমে তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপ শেষ করতেন। সঙ্গে থাকত কয়েকটি বিস্কুট।
আমাদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল বরাবর। আদুরে কুকুরদের এই সময় বাবার কাছে বসে দু’টি বিস্কুট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। মায়ের অনেক শখ থাকা সত্ত্বেও এই ব্যস্ততার ভেতর সাজিয়ে গুছিয়ে চা খাওয়া আর হয়ে উঠত না। মা বলতেন, শুনেছি বিলেতে আমাদের দেশের সব ভাল চা চলে যায়। তুই বিলেত গেলে তোর ওখানে গিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে বসে ভাল ভাল চা খাব।
পরে জেনেছিলাম টি বোর্ডের বাড়িটি থেকে নামীদামি চা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কলকাতায় এর হেড অফিস। ভারত সরকারের এই সংস্থার শাখা আছে লন্ডনে, মস্কোয় আর দুবাইতে। লন্ডনের শাখাটি অল্ডউইচের ইন্ডিয়া হাউজ়ে। বিদেশের চা-প্রেমীদের পেয়ালা যাতে আটপৌরে চা দিয়ে দূষিত না হয়, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখাই টি-বোর্ডের মূল কাজ। বিদেশি রসনার তুষ্টি সুনিশ্চিত করে বিদেশি মুদ্রার গতিপথ সুগম করা।
***
আমরা প্রায় কুড়ি বছর যাবৎ উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডের লিংকন শহরের বাসিন্দা। লন্ডন থেকে ১২৫ মাইল দূরে লিংকন। ট্রেনে করে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট মতো লাগে। লিংকনশায়ার কাউন্টির সদর শহর এই লিংকন। এই কাউন্টি বা শহরটির কথা ভারতের অনেকেই হয়তো জানেন না। হয়তো লিংকনশায়ারের কোনও কাউন্টি ক্রিকেট টিম নেই বলে বা লিংকন সিটি প্রিমিয়ারশিপ ফুটবলে খেলে না বলে এই অপরিচিতি। কিন্তু শহরটা ভারী সুন্দর।

শহরের মাঝখানে পাহাড়ের ওপর সু-উচ্চ লিংকন ক্যাথিড্রাল। তার আশপাশে নানা রকম অসাধারণ দোকান বহু বছর ধরে তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছে। একঘেয়ে সুপারস্টোরের বুলডোজ়ার এদের এখনও ছুঁতে পারেনি। এখানেই আছে জু’স হাউজ় (Jews House)। প্রায় হাজার বছরের পুরনো দোকান। ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম দোকানের একটি। আছে রেডহিল ফার্ম শপ। এখানে জেবরা থেকে শুরু করে উটের মাংস পর্যন্ত পাওয়া যায়। কোনওদিন খিচুড়ির সঙ্গে পঙ্গপাল ভাজা খেতে চাইলে আপনাকে এই দোকানেই যেতে হবে।
আর আছে ইম্পিরিয়াল টি’জ় অফ লিংকন (Imperial Teas of Lincoln)। লিংকন ক্যাথিড্রাল থেকে একটি ঢালু রাস্তা নেমে যায় সিটি সেন্টারের দিকে। এই সরু রাস্তার নাম স্টিপ হিল (Steep Hill)। এই রাস্তার একপাশে এই দোকানটি। ১৯৯১ সালে বেন আর জেনির পরিবার এই দোকানটি চালু করেন পৃথিবীর নামজাদা চা আর কফির পসরা নিয়ে। দার্জিলিং, আসাম, শ্রীলঙ্কা ছাড়াও পৃথিবীর নানা দেশের ব্যতিক্রমী চা পাওয়া যায় এঁদের দোকানে। কফির সম্ভারও এঁদের বিরাট। সুমাত্রা জাভার স্বনামধন্য কোপি লুয়াক বা জামাইকার ব্লু মাউনটেন কফি এখানে পাবেন। কফির কথা অন্য একদিন হবে। আজ বরং চায়ের কথাই হোক।

ইম্পিরিয়াল টি-তে আসাম আর দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত বাগানের চা আলাদা করে পাওয়া যায়। সুদৃশ্য কৌটোয় তাকে সাজিয়ে রাখা থাকে। বাগানের নাম লেবেল করা থাকে কৌটোর গায়ে। দোকানে ঢুকলেই বেনের সদা হাসিমাখা মুখ। কুশল বিনিময়। তারপর চায়ের গল্প। একের পর এক কৌটো খুলে চায়ের আঘ্রাণ। পছন্দ হলে তার একটি প্যাকেট সংগ্রহ করা।
আমার পছন্দ আসাম। বৈশালীর দার্জিলিং। আমি জীবনটা একটু তীব্রভাবে বাঁচতে পছন্দ করি। আসামের সুতীব্র তাম্রাভ দুধ দেওয়া চা আমার দারুণ লাগে। আর তার সঙ্গে নানা স্তরের সুগন্ধ। দার্জিলিংয়ের নাজুক চা থেকে আমি একটা শ্রদ্ধাপূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখে চলি। আসামের চায়ের গাঢ় রসে মজেছি এই বেনের দোকান থেকেই।
বেনের দোকান থেকে কিনেই আস্বাদন করতে পেরেছি বিখ্যাত মকালবাড়ি বাগানের আসাম চা। দার্জিলিংয়ে মকাইবাড়ির চা খেয়েছি দেশে থাকতেই। মকালবাড়ির কথা জানা ছিল না। বেন জানাল। পরখ করেছি কেহুঙ বাগানের চা বা বিখ্যাত আসাম মঙ্গলম গোল্ড। দার্জিলিং চায়ের মধ্যে হিমালয়ান প্রাইড সেকেন্ড ফ্লাশ। এদের সবার স্বাদগন্ধ অতুলনীয়। দামও আকাশছোঁয়া। রোজকার খাওয়ার জন্য এই চা নয়, অন্ততঃ আমাদের আর্থিক সামর্থ্যে। এক একটি চায়ের দাম ১৪-১৫ হাজার টাকা কেজি পর্যন্ত হয় (বিল এর ছবি দ্রষ্টব্য)।

বছর দুয়েক আগে আসামের বেশ কিছু বাগানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। ব্রিটিশ টেলিভিশনে দেখানো হয় আসামের চা-শ্রমিকদের দুরবস্থা। তার ফলে ব্রিটেনে অনেক বাগান থেকে চা আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। বেন আমাদের আশ্বস্ত করেন, যে বাগান তাঁদের শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতি দায়িত্বশীল, শুধু সেই বাগানের চা তাঁদের দোকানে রাখা হয়। বিবেকহীন, মুনাফাখোরদের শরিক হতে একেবারেই নারাজ বেন ও তাঁর পরিবার।
সপ্তাহান্তে অবসর বেশি থাকে। থাকে আয়েশ করে চা খাওয়ার সময়। এই মহার্ঘ্য চা তোলা থাকে সেই সময়টুকুর জন্য। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ভাবি, কেন কলকাতার সেই বিশাল টি-বোর্ডের আপিসের প্রয়োজন হয়। আসাম-দার্জিলিংয়ের দুর্গম চা বাগান থেকে ব্রেবোর্ন রোডের টি-বোর্ড ঘুরে উত্তর ইংল্যান্ডের ইম্পিরিয়াল টি-এর দোকান হয়ে লিংকনের এক বাঙালির চায়ের পেয়ালায় পৌঁছনো– কত পথ না পেরতে হয় এই চা-পাতাকে।
মা লিংকনে এসেছিলেন। তখন আমরা সবে এই শহরে এসেছি। এই দোকানটির খোঁজ তখনও পাইনি। মাকে সুপারমার্কেটের চা খাওয়াতাম। দার্জিলিং-আসাম আলাদা করে পাওয়া গেলেও আলাদা বাগানের চা পাওয়া যেত না। সেই চা স্বাদে খারাপ না হলেও, অসাধারণ কিছু নয়। এই দোকানটির খোঁজ যখন পাই, মায়ের অসুস্থতার কারণে তখন আর বিলেতে আসা সম্ভব নয় | তাই দেশে যাবার সময় খুব ভালো চা মায়ের জন্য নিয়ে যেতাম।
সবাই মিলে বসতাম চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে। যেমন চাইতেন মা। বহুদিন ধরে। বাবা ততদিনে চলে গিয়েছেন। চায়ের আসরে আর সময় নিয়ে যোগ দেওয়া হয়নি বাবার। এক কাপ চায়ে মানুষের কত কি চাওয়ার থাকে। শেষ পর্যন্ত তার কতটুকুই বা পাওয়া যায়….
ছবি – লেখকের তোলা
দু দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনে প্রবাসী পাঞ্চজন্য পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট। অবসর সময়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন।
One Response
খুব ই ভালো লাগলো