বেশ ছিলাম, মাছে ভাতে বাঙালি। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো আমারও কলকাতার দুপুরগুলো বেশ রসেবসে কাটত। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, রুই মাছের তেলে পুঁইশাকের ছ্যাঁচড়া, লোটে শুঁটকি, মাছের পুরভরা পটলের দোরমা প্রভৃতি নানান মাছের পদে তৃপ্তির ঢেকুর। কিন্তু, মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।
ছেলের উচ্চশিক্ষার কারণে পুব ছেড়ে পাড়ি দিলাম পশ্চিমে। রাজস্থানে তিন বছরের অস্থায়ী ঠিকানা। আমি এখন জয়পুর স্টেশন থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে ‘বড় কে বালাজী’ নামে একটা ছোট্ট জায়গার বাসিন্দা। পঞ্চায়েত এলাকা। এখানে আমিষ শুধু অচ্ছ্যুৎ নয়, আমিষ খানেওয়ালাও অচ্ছ্যুৎ। তাই প্রথমদিকে বাড়ি পেতে বেশ সমস্যা হয়েছিল। বাঙালির গায়ে ‘মাছ-ভাত’ ট্যাগ লেগে থাকে— কেউ আর তাকে বাড়িভাড়া দিতে চায় না। শেষমেশ মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় রইল না। ‘আমিষ খাই না’ – একথা নিশ্চিত করে মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা মিললো।
স্থানবদলে খাদ্যাভ্যাসের পটবদল। এই শুখা দেশে শুধু মাছ নয়, বাঙালির যেকোনও সুস্বাদু খাবারই দুর্লভ। স্ট্রিটফুড বলতে আমরা কলকাতাবাসী যা চাই তাই পাই। এখানে সেটাও নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটা জায়গায় শুধু পনিরের কাবাব, কিছু চাট আর পানি পতাসে (ফুচকা)। সেগুলো তবু মোটামুটি চলে।

আমাদের বাড়িটা জয়পুর-আজমের হাইওয়ের উপর ছোট্ট টাউনশিপে। নাম ওমেক্স সিটি। এখানে শুধু সোমবার করে সবজি মান্ডি (সবজি বাজার) বসে। হাতে গোনা কয়েক রকমের সবজি পাওয়া যায়। আলু, ঢ্যাঁড়শ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ছোট বেগুন, গাজর, ক্যাপসিকাম, কাঁঠাল, টিন্ডা, লাউ, পুদিনা পাতা, ধনেপাতা, কারিপাতা…ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এগুলোই। বাজারে মোচা, থোর, চিচিঙ্গা, পটল, পেঁয়াজকলি, রকমারি শাক (পালংশাক বাদে) কদাপি এসব সবজির দেখা মেলে না। আবাসনের উঠোনে বড় একটা সজনে গাছ আছে। সজনে গাছের ফুল, ডাঁটা, পাতা প্রাণভরে খাই। তবে কাঙ্ক্ষিত খাবারগুলো না মেলায়, মাঝেমধ্যেই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
শুরুতে রোজ ডিম খেতাম। ডিম ফাটলে রক্ত বেরোয় না, তাই ডিমে কারোও কোনও আপত্তি নেই। লোকাল দোকানগুলোতেও খোলামেলাভাবেই ডিম বিক্রি হয়। একটা বাঙালি বাজার আছে যদিও, কিন্তু সেটা আমার বাড়ি থেকে গাড়িতে দু’ঘণ্টার পথ। তাই কখনোই যাওয়া হয় না। এদিকে আমার তো মাছ বিনে প্রাণ বাঁচে না। মেনুতে মাছের গন্ধটুকু থাকলেও, তা যেন অমৃত। অগত্যা অনলাইন ভরসা। তাতেও সব রকমের মাছ পাওয়া যায় না। রুই, কাতলা, বোয়াল, চিংড়ি, ভেটকি, বাসা এই কয়েকটা মাত্র মাছ মেলে। অনলাইনে কেনা মাছের স্বাদ থাকে না। তবু এটুকু দিয়েই রসনাতৃপ্তি।

মাছ-চিকেন যখন ডেলিভারি দিতে আসে, খুব সুন্দরভাবে প্যাক করা থাকে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। প্রতিবেশীদের লুকিয়ে কেনা তো হল, এবার মূল সমস্যা লুকিয়ে আড়াল করে রান্না করা। যেন নিষিদ্ধ কাজ করার মতো অবস্থা। রান্না করার সময়ে গন্ধ বেরোবে, সেই ভয়ে জানালা-দরজা সব বন্ধ রাখি। বাড়ির পরিচারিকা (স্থানীয়রা ‘বাঈ’ বলে) ‘মছলি খাতা হ্যায়’ জানলে আর আমার বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোবে না। সারা এলাকা রাষ্ট্র হয়ে যাবে। সে শুধু ঝাড়ু-পোছা করে। বাসন পরিষ্কারের কাজটা আমি নিজেই সেরে নিই, সে আসার আগে।
রাজস্থানে বসে মাঝে মাঝেই আমার লুকোচুরির ‘মাছ রান্না’ অ্যাডভেঞ্চার চলে। এখানে যা পেয়েছি, তাই দিয়েই বানানো কিছু মাছের পদের রেসিপি (fish recipes) সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। আপনারাও বানিয়ে দেখতে পারেন।
চিংড়ির পুরভরা আলুর দম
উপকরণ: মাঝারি মাপের চিংড়ি মাছ ৩০০ গ্রাম, বড় আলু ৩টে, হলুদ ১ চা চামচ, লংকা গুঁড়ো ১চা চামচ, কাজুবাদাম ১৫-১৬ টা, কিশমিশ ১ টেবিল চামচ, চারমগজ হাফ চামচ, টকদই ১/২ কাপ, পেঁয়াজ মাঝারি মাপের ২টো, কাঁচালংকা ৯-১০ টা, আদাবাটা হাফ চা-চামচ, চিনি সামান্য, ধনেপাতা কুচি, নুন স্বাদমতো, সাদা তেল ৫ টেবিল চামচ, ময়দা ১ টেবিল চামচ, পরিমাণ মতো জল।

প্রণালী: চিংড়ি মাছ ছাড়িয়ে ভালো করে ধুয়ে নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। আলু গুলো মাংসের আলুর মতো মাঝখান দিয়ে দু-টুকরো করে নিয়ে চামচ দিয়ে কুড়ে ভেতর থেকে বের করে নিতে হবে।
কড়াইতে ১ টেবিল চামচ তেল দিয়ে তাতে মাছগুলো ভেজে নিয়ে ঠান্ডা করে মিক্সিতে বেটে নিতে হবে। আবার কড়াইতে অল্প তেল দিয়ে তাতে ১টা পেঁয়াজ কুচি করে কেটে ভাজতে হবে, পেঁয়াজ ভাজা হলে ওর মধ্যে বেটে রাখা চিংড়ি ও কুড়ে রাখা আলু দিয়ে সামান্য হলুদগুঁড়ো ও নুন দিয়ে ভালো করে নেড়ে নামিয়ে নিতে হবে। অন্য দিকে বাকি পেঁয়াজ, আদা, কাঁচা লংকা একসঙ্গে বাটতে হবে, আলাদাভাবে কাজুবাদাম, কিশমিশ, চারমগজ ও দই একসাথে বেটে রাখতে হবে। কড়াইতে তেল দিয়ে তাতে আলু ভালো করে ভেজে তুলে নিয়ে বাকি তেলে পেঁয়াজ, আদা, কাঁচালংকা বাটা দিয়ে নাড়তে হবে (কাঁচা গন্ধটা না যাওয়া পর্যন্ত)। ওর মধ্যে হলুদগুঁড়ো, লংকাগুঁড়ো দিয়ে ভালো করে কষিয়ে তাতে কাজু, কিশমিশ, চারমগজ আর দইয়ের মিশ্রণটা দিতে হবে। স্বাদমতো নুন, চিনি, সামান্য জল দিয়ে ভালো করে মাঝারি আঁচে ঢাকনা দিয়ে রান্না করতে হবে। এবার আলুগুলোর মধ্যে অল্প অল্প করে চিংড়ি মাছের পুরটা ভরতে হবে। সামান্য ময়দা জলে গুলে মুখের দিকে আটকে দিতে হবে (যাতে পুর বেড়িয়ে না যায়)। কড়াইতে মশলা থেকে তেল ছেড়ে দিলে পুরভরা আলুগুলো দিয়ে সামান্য জল দিয়ে আলু সেদ্ধ হওয়া অবধি ঢাকা দিয়ে রান্না করতে হবে ও নামানোর সময় ধনেপাতা কুচি দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।

কালো জিরে বাটা বোয়াল মাছ
উপকরণ: বোয়াল মাছ ২ টুকরো, কালোজিরে ১ চা চামচ, গোলমরিচ ১/২ চা চামচ, কাঁচালংকা ৭টা, ১ কোয়া রসুন, ধনেপাতা ১/২ কাপ, হলুদ গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, সরষের তেল ২ টেবিলচামচ, নুন স্বাদ মতো।
প্রণালী: মাছের টুকরোগুলো ভালো করে ধুয়ে নুন-হলুদ মাখিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিতে হবে। মিক্সিতে কালোজিরে, গোলমরিচ, ৪টে কাঁচালংকা, রসুন, ধনেপাতা একসঙ্গে বেটে নিতে হবে। এবারে কড়াইতে তেল গরম করে তাতে মাছের টুকরোগুলো হালকা করে ভেজে তুলে নিয়ে ওই তেলে বেটে রাখা মশলা, হলুদগুঁড়ো ও স্বাদমতো নুন দিয়ে গ্যাসে অল্প আঁচে বসিয়ে দিতে হবে। মিক্সিতে লেগে থাকা মশলা সামান্য জল দিয়ে ধুয়ে মাছের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে ও বাকি কাঁচালংকা চিরে দিয়ে ঢাকা দিতে হবে। মাঝে একবার মাছটা উল্টে দিতে হবে। তেল ছেড়ে মশলাটা একটু মাখা মাখা হয়ে গেলে মাছটা নামিয়ে নিতে হবে। ব্যস, তৈরি কালোজিরে বাটা বোয়াল মাছ।

রুই মাছের বাটি চচ্চড়ি
উপকরণ: রুই মাছ ৩০০ গ্রাম, মাঝারি মাপের ৩টে পেঁয়াজ কুচি করা, বড় ১টা টমেটো ছোট টুকরো করা, কাঁচালংকা চেরা ৫/৬টা (ঝালটা নিজের স্বাদ বুঝে), ধনেপাতা কুচি ১/২ কাপ, হলুদ গুঁড়ো ১/৩ চা চামচ, লংকা গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, নুন স্বাদ মতো, সরষের তেল ১/৩ কাপ, সামান্য জল।
প্রণালী: মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। এবার কড়াইতে মাছের টুকরোগুলো দিয়ে তার মধ্যে একে একে পেঁয়াজ কুচি, টমেটো কুচি, চেরা কাঁচালংকা, হলুদগুঁড়ো, লংকা গুঁড়ো, ধনেপাতা কুচি, নুন, সরষের তেল ও সামান্য জল দিয়ে একসঙ্গে ভালো করে মেখে গ্যাসে অল্প আঁচে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রান্না করতে হবে। মাঝে মাঝে একটু মাছটা নাড়াচাড়া করতে হবে। মাছের থেকে তেল ছেড়ে দিলে গ্যাসটা বন্ধ করে দিতে হবে। সবার শেষে উপরে একটু ধনেপাতা ছড়িয়ে দিলেই তৈরি রুই মাছের বাটি চচ্চড়ি।

দক্ষিণী কারি চিংড়ি
উপকরণ: চিংড়ি মাছ ৫০০ গ্রাম, সাদা তেল ২ টেবিল চামচ, কারিপাতা ৩৫-৪০ টা, ২ টো বড় মাপের কুচানো পেঁয়াজ, আদা-রসুন বাটা ২ টেবিল চামচ, ২টো মাঝারি মাপের কুচানো টমেটো, চেরা কাঁচালংকা ৩-৪ টে, ধনেপাতা কুচি ২ টেবিল চামচ, শা-মরিচ গুঁড়ো ১ টেবিল চামচ, গোলমরিচ গুঁড়ো ১ টেবিল চামচ, লংকা গুঁড়ো ১ চা চামচ, হলুদ গুঁড়ো সামান্য, নুন স্বাদমতো, সামান্য জল।
প্রণালী: চিংড়ি মাছগুলো খোসা ছাড়িয়ে ভালো করে ধুয়ে রাখতে হবে। কড়াইতে তেল দিয়ে তাতে ২০টা মতো কারিপাতা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজকুচি, আদা-রসুন বাটা দিতে হবে। পেঁয়াজ হালকা খয়েরি রং ধরা অবধি ভেজে তাতে টমেটো কুচি, সামান্য হলুদগুঁড়ো, লংকা গুঁড়ো ও চেরা কাঁচা লংকা দিয়ে কষতে হবে। কষা হয়ে গেলে ওর মধ্যে ধুয়ে রাখা মাছ , নুন, শা-মরিচ গুঁড়ো, গোলমরিচ গুঁড়ো, ও ধনেপাতা কুচি দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। তেল ছাড়তে শুরু করলে তাতে বাকি কারিপাতা ও সামান্য জল দিতে হবে। ফুটে উঠলে নামিয়ে নিতে হবে। তৈরি দক্ষিণী কারি চিংড়ি।

মালাই ভেটকি
উপকরণ: ভেটকি মাছ ৪ টুকরো, পেঁয়াজবাটা ১/২ কাপ, আমন্ড বাদাম ৮-১০ টা, দুধ ১কাপ, গোলমরিচ গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, লবঙ্গ ১টা, ছোট এলাচ ২টো, ছোট ১টুকরো দারচিনি, আদা বাটা ১/২ চা চামচ, ধনে গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, কাঁচা লংকা ৬-৭ টা, কসুরি মেথি ১/২ চামচ, ফ্রেশ ক্রিম ২ চা চামচ, চিনি সামান্য, নুন স্বাদমতো, ঘি ২ টেবিল চামচ।
প্রণালী: মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে নুন ও গোলমরিচ গুঁড়ো মাখিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিতে হবে। কড়াইতে ঘি গরম করে তাতে মাছের টুকরোগুলো হালকা করে ভেজে তুলে নিয়ে ঘিতে এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ ও আদা বাটা দিতে হবে। (মিক্সিতে আমন্ড আর কাঁচা লংকা বেটে রাখতে হবে)। পেঁয়াজে হালকা সোনালি রং ধরলে ধনেগুঁড়ো দিয়ে কষে তাতে আমন্ডবাটা ও দুধ দিতে হবে। দুধ ভালো করে ফুটে উঠলে ওর মধ্যে স্বাদমতো নুন ও সামান্য চিনি দিয়ে মাছের টুকরোগুলো দিয়ে দিতে হবে। ভালো করে সব মিশিয়ে নিয়ে উপর থেকে ফ্রেশ ক্রিম আর কসুরি মেথি দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে। তৈরি মালাই ভেটকি। এক্ষেত্রে বলে রাখি, রাজস্থানের দুধ খুব খাঁটি। মোটা সর পড়ে। মালাই ভেটকি বানানোর জন্য আমি দুধের সর ব্যবহার করেছি। আপনারা বাজার থেকে কেনা ফ্রেশ ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন।
নৃত্যশিল্পী- ছোটোবেলায় তনুশ্রী শঙ্কর ও পরে মমতা শঙ্করের কাছে তালিম নিয়েছেন। প্রধান শখ রান্নাবান্না, অন্দরসজ্জা আর পোশাক পরিকল্পনা।
2 Responses
রেসিপি গুলো খুব ভালো লাগলো। আরো ভালো ভালো রান্না করে। Best wishes from Me
All these are one of the best recipes she can make. There are lot more interesting and tasty unique dishes in her mind.