টাকা তো আছে, তবুও, কাল খেতে পাব তো? আজ সবজিওলা আসছে, কাল কী হবে? অদেখা শত্রু চারদিকে ঘুরছে, কোথায় কাকে আক্রমণ করবে কিছুই জানা নেই…। সামনের দিনগুলো সম্পূর্ণ অনিশ্চিত! অতএব হাতে যা আছে তার সম্পূর্ণ উপযোগ করে নিতেই হবে। এই হল করোনাকালের উপলব্ধি!
সবজির খোসায় নাকি আজকাল কেমিক্যাল থাকে, ভিটামিনের সঙ্গে সহাবস্থানে… কিন্তু যে হারে ধোওয়া, ভেজানো, পটাসিয়াম পার্মাঙ্গানেট দিয়ে, নুন দিয়ে তারপর রোদ্দুরে দেওয়া.. আর অন্তত কেমিক্যাল নিয়ে ভয় নেই। মহামারি তো চোখে দেখিনি, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই অশনির সংকেত! কাল কী হবে…! সেই থেকে শুরু। সবজি খাওয়া আর তার সঙ্গে ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়েও আরও দু’দিনের খাবার বানানো। বেঁচে থাকার লড়াই।
সবজির খোসা দিয়ে আগে কি কিছু হয়নি? বানাতাম তো। আমরা সবাই জানি, লাউয়ের খোসা, আলুর খোসাভাজা কী সুস্বাদু! কপির ওপরের পাতা বাটা? খেয়ে দেখেছ সবাই নিশ্চই? তারপর ঝিঙের খোসা বাটার চাটনি… আহা! আমার শাশুড়ি মা বাঙালবাড়ির মেয়ে। এই সব পাতা বাটার মতো নানা পদ অসাধারণ বানান। কখনও মনে হয়, ওই যে নিজের ভিটে ছেড়ে চলে আসার সংঘর্ষ, তার সঙ্গে গভীর সংযোগ খাবারেরও। কোনওকিছুই নষ্ট না করে খাওয়া, সেই স্ট্রাগলেরই একটা অংশ…

সে যাই হোক। আগে যেটা করতাম, সেটা হল সবজি আর ফলের খোসা পচতে দেওয়া হত। একটু কেঁচো আর মাটি মিশিয়ে সেই খোসা পচা অন্য রূপ নিত ফুলফল আর পাতার মাঝে। তাও বেঁচে যেত রোজকার অনেক খোসা। এই অপরিকল্পিত খাদ্যবর্জ্য বা ফুড ওয়েস্ট, আমাদের গ্রিন হাউস গ্যাসের একটা বড়সড় উৎস কিন্তু! বাড়িতে বসে মনে হল, এত বড় বড় সব শেফ, তাঁরা কিছু ভাবেননি কি? ফুড ওয়েস্ট, কিচেন ওয়েস্ট কমাতে?
ফ্রুট পিল ভিনিগার, ভেজিটেবল পিল পাকোড়া, অনেক অনেক কিছু পেলাম। নাইজেলা লসন-এর কলার খোসার তরকারি, একসময় তাঁর ফ্যানেদের পক্ষে আর বিপক্ষে দ্বিধাবিভক্ত করেছিল। কিচেন ওয়েস্ট কমাতে অনেকেরই অনেক রকম অবদান পড়লাম। নানান রকম রেসিপি…।
এইসব পড়ছি আর সাতপাঁচ ভাবছি। অমনি মা বলল, “শোন এটা টেস্ট করে দেখ তো… ! একদম নিজের মন থেকে বানানো। ওসব ইন্টারনেট ফেট বুঝি না, এত বছর রান্না করে কিছু তো নিজে নিজে এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি নাকি? খেয়ে বল, এটা কী…”
মুখে দিতেই বরফির মতো বড়াটা মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল। একদম অমৃত! নাহ, বুঝতে পারলাম না সেটা কী। শুধু স্বাদ মুখে লেগে রইল। সেই বড়া দিয়ে রান্না তরকারি পরদিন খেতে খেতে জানলাম, সবজির খোসা বাটা দিয়ে ধোকা আর তার ডালনা ওটি। তো এইরকম, কিছু ফ্যালনা দিয়ে আজ বানালাম কিছু খাবার, যেগুলো আমি স্রেফ মায়ের কাছে খেয়েছি। কয়েকটা আগে, কয়েকটা করোনা কালের এক্সপেরিমেন্ট…
খোসা বাটার বরফি মনোহরা (আর ডালনা)
১বাটি ছোলার ডালবাটা
১ বাটি খোসা বাটা ( ঝিঙে, পটলের)
২ ইঞ্চি আদাবাটা
জিরেগুঁড়ো বড় ১ চামচ
ধনেগুঁড়ো বড় ১ চামচ
টমেটো পেস্ট বড় ২ চামচ
লঙ্কাবাটা বড় ১ চামচ
টক দই ১০০ গ্রাম
নুন ও চিনি স্বাদমতো
হিং এক চিমটে
গোটা জিরে ১/২ চামচ ফোড়নের জন্য
খোসাবাটা একটু জল-জল থাকে তো, তাই কড়াতে একটু তেল গরম করে খোসাবাটা আর একটু নুন দিয়ে নেড়েচেড়ে শুকনো করে নিতে হবে। তারপর অন্য কাজ সারতে সারতে, মিশ্রণটা ঠান্ডা হলে ডালবাটার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। সঙ্গী একটু নুন, চিনি, হলুদ ও জিরেভাজার গুঁড়ো। আবার গরম কড়ায় তেল দিয়ে পুরোটা কষে কষে শুকনো করে নিলে। ব্যাস, ঠান্ডা করে দিয়ে দাও। যেখানে সেখানে দিলে হবে না! থালায় তেল মাখিয়ে বেশ চেপে চেপে সমান করে দিতে হবে। ঠান্ডা হলে, তবে একদম বরফি বরফি করে কেটে ফেল। দিয়ে বেশি গরম তেলে মুচমুচে করে ভেজে নাও…

এই যে ভাজাটা হল, কতগুলো যে ভাজতে ভাজতে অদৃশ্য হয়ে যাবে, বলতে পারছি না! কিছুটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে কিন্তু, তরকারি করতে হবে তো!
আবার তেলে জিরে হিং ফোড়ন দিয়ে, আদা, জিরে, ধনেবাটা, টমেটো পেস্ট, লঙ্কাবাটা দিয়ে কষে, তারপর দই দিয়ে আবার কষে, নুন মিষ্টি টেস্ট করে, বা কনফিডেন্টলি নুন মিষ্টি দিয়ে খানিক ফুটিয়ে ধোঁকার ওপর ঢেলে একটু মজতে দাও, ব্যাস রেডি। আচ্ছা এই গ্রেভিটা কিন্তু নিজের মনের মতো মশলা দিয়েও করা যায়। ধরা যাক কাজু কিশমিশবাটা দিয়ে, বা ফ্রেশ ক্রিম দিয়ে। আমি স্রেফ মায়ের আইডিয়াটা শেয়ার করলাম।
ওহ, এটা দিয়ে একটা স্টার্টার প্লাস তরকারি হয়ে গেল, আর একটা বলি…
তরমুজের খোসার চিংড়ি বাহারি
তরমুজের খোসার ওপরের ওই সবুজ ছিলকা খুব পাতলা করে বাদ দিয়ে বাকি সাদাটা ছোট্ট ছোট্ট কুচি করে কেটে নাও, আর কুকারে তিন চারটে সিটি দিয়ে রাখ। তারপর ওই যেমন লাউ চিংড়ি করে, সেই রকম করে রান্না। বিস্তারিত বলতেই হবে? সবার জানা তো… তবু বলি:
খোসা সেদ্ধ দু’বাটি
চিংড়ি অল্প ভাজা ছোট্ট এক বাটি
ফোড়নের জন্যে জিরে, তেজপাতা, শুকনোলঙ্কা
পেঁয়াজকুচি বড় দুটো
টমেটো পেস্ট এক কাপ
ধনে-জিরেগুঁড়ো এক চামচ করে
আদারসুন বাটা বড় এক চামচ
ঘি, গরমমশলা শেষে দেবার জন্য

গরম সর্ষের তেলে ফোড়ন দিয়ে দারুণ ঝাল ঝাল গন্ধ বেরলে পেঁয়াজকুচি দিয়ে দাও। বেশ হালকা বাদামি করে ভেজেও নাও। তারপর ওই পরপর, যথাক্রমে, আদারসুন বাটা, টমেটো পেস্ট, জিরে-ধনেগুঁড়ো, অল্প জলের ছিটে দিয়ে কষতে হবে। তেল ছাড়লে তাতে সেদ্ধ তরমুজের খোসা মেশাও আর চিংড়ি ভাজাটাও। ভালো করে ওদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা হয়ে গেলে, ঢাকা দিয়ে রেখে দাও অল্প আঁচে। শেষে ঘি গরমমশলা দিয়ে নামিয়ে দাও। বাই দ্য ওয়ে, নুন মিষ্টি যেন ঠিক হয়।
ব্যাস রেডি! (এইটে নিরামিষ আদা জিরে মুগ ডাল দিয়েও করা যায়। অথবা, চারমগজ, কাজুবাটা দিয়েও, চিংড়ি ছাড়াই হয়। মাশরুমও দিতে পারো, চিংড়ির বদলে। সবটাই স্বাদ অনুযায়ী আর মুড অনুযায়ী আর কি)
অপরিচিত পরমান্ন
তরমুজের খোসার সাদা অংশ গ্রেটারে মোটা মোটা করে ঘষে নিয়ে কুকারে তিন চারটে সিটি দিয়ে রাখতে হবে। অতিরিক্ত জল দেওয়া যাবে না। তরমুজের অনেক জল থাকে তো। তবে জলটাও ফেলব না। ওই সেদ্ধ জলটা ছেঁকে নিয়ে তাতে বেশ গাঢ় করে দুধ গুলে রাখব।

এবার কড়ায় একটু ঘি দিয়ে সেদ্ধ তরমুজটা ভালো করে নেড়ে নিতে হবে চিনি দিয়ে। এই নাড়ার সময় অল্প সুজিও মেশানো যায়, চিনি দেবার আগে। জাস্ট একটা আইডিয়া। গাঢ় হলে দুধটা মিশিয়ে দাও আর ফোটাও। ঘন হয়ে এলে এলাচগুঁড়ো, ঘি, কাজু, কিশমিশ সব দিয়ে নামিয়ে দাও। নিজের ইচ্ছে মতো সাজিয়ে নাও!
দেখো তাহলে, একদিন ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে আহার সারতে কেমন লাগে! স্টার্টার থেকে ডেসার্ট সবটাই! আমি নিশ্চিত, বারবার খেতে ইচ্ছে হবেই!
*প্রধান ছবি সৌজন্য: totka24X7
*বাকি ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।
One Response
Aaha darun..koto rokomari notun notun ranna..