(Winter Recipe)
শীত আসছে। আজকাল আর কদিনই বা শীত থাকে! তার মধ্যেই ঘোরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া, পিকনিক, স্পোর্টস সব মিলিয়ে যেন একটা মাস নিমেষে কেটে যায়। কার্তিক মাসে ঘাসের ডগায় হিম পড়ে, আর সেই সঙ্গে আবহাওয়ার পরিবর্তন। জ্বরজারি লেগেই থাকে ঘরে ঘরে। বড়মাকে দেখতাম এই সময় পাচন বানিয়ে রাখতেন, রোজ সকালে হালকা গরম করে চায়ের মতো খেতে দিতেন। (Winter Recipe)

গরম জল ফুটিয়ে তাতে তুলসীপাতা, বাসক পাতা, তাল মিছরি, মধু, লবঙ্গ আর গোল মরিচ, সব ফুটে অর্দ্ধেক হলে ছেঁকে রাখতেন, এতে নাকি কফ-কাশি দূর হয়! আবার শীত পড়লেই কাঁচা তেঁতুল পুড়িয়ে পায়ের গোড়ালি আর ঠোঁটে মাখাতেন, বলতেন এতে ফাটবে না। এখন বুঝি, এগুলো সবই আমাদের প্রাকৃতিকভাবে ভাল থাকার উপায়। ওষুধ যাতে কম খেতে হয়, রোগবালাই কম হয়। (Winter Recipe)

আমার জ্যেঠা ছিলেন সেই বাঙালি, যাদের কাছে শীতকাল মানে মাঙ্কি ক্যাপ, মাফলার, খুব বেশি আয়েশের জীবনযাপন ছিল না। শীতের দিনে সকালে রোদে রাখা জলে স্নান করতেন সরষের তেল মেখে, তারপর মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে, টিফিনের চৌকো বাক্সটা নিয়ে পড়িমরি ছুটতেন ট্রেনের উদ্দেশ্যে। তিনি শীতকালে মাঝেমধ্যেই বলতেন, বউমা “আজ বড় ঠান্ডা পড়েছে, একটু চালে ডালে চড়িয়ে দাও”। (Winter Recipe)

সেই চালে ডালে, ফুলকপি, নতুন আলু, মটরশুঁটি, টমেটো আর ঘি মিশে তৈরি হতো এক অপূর্ব স্বাদের খিচুড়ি, সঙ্গে আলু বা বেগুন ভাজা, মাম্লেট। খিচুড়ি হতো নতুন ওঠা চালে, একটু আঠা আঠা ভাব, তাতে শীতের সবজি অবশ্যই থাকতো। আর সকালের ফ্যানা ভাত, তাও ওই চালে। তাতে থাকতো নতুন আলু, কুমড়ো, পেঁপে ইত্যাদি সবজি। ইতু পুজোর ব্রত পালনের দিনগুলোতে হতো মুঠো ভাত বা জাউ ভাত। মুঠো ভাতে মটর ডাল বেটে তাতে মুঠ করে ফ্যানা ভাতের গরম জলে ফেলা হতো, আর জাউ ভাত অনেকটা ফ্যানা ভাতের মতোই। (Winter Recipe)
সময় যেন মুঠোয় ধরা ধুলোর মতো বেরিয়ে যায়। এই তো সেদিনের কথা, দুর্গা পুজোর শেষে লাল, সবুজ টিনের তোরঙ্গ থেকে বড়মা আর মা দুজনে মিলে বের করতো ভারি কাঁথা আর পুরীর কটকি চাদরগুলো, আর আমাদের জন্য হাতে বোনা হাফহাতা সোয়েটার। খুব সুন্দর ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা তোরঙ্গের ভেতরটা। তারপর মাদুর বিছিয়ে সব রোদে দেওয়ার পালা। (Winter Recipe)

শীতের রোদ আসলেই সাজো সাজো রব। বিউলি, মটর, মুসুর ডাল ভেজানো, তারপর বড়ি দেওয়ার উৎসব। সেদিন সক্কালবেলায় ছোটদের খাইয়ে গুছিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে, মা বড়মা শিলে ডাল বাটতে বসতেন। শুধু বাটা তো নয়, তারপর তা ফেটানো, মশলা, চালকুমড়ো মেশানো। সবশেষে বড়ির টোপর বানিয়ে তার বিয়ে দিয়ে শুরু হতো বড়ি দেওয়ার পালা। দিনমান থাকতে সঠিকভাবে ভাঁজ করে বড়ির চাদর তোলা, আবার পরের দিন তা রোদে দেওয়া। (Winter Recipe)

শীত আসছে, আসছে ফ্যানা ভাত খাওয়ার পালা, রোদে পিঠ দিয়ে ঘি মেখে কনকচূড় চালের ফ্যানা ভাত। এই সুগন্ধি চালের খই দিয়ে তৈরি হয় খাঁটি জয়নগরের মোয়া। শীত মানেই নতুন শাকসব্জির মেলা- লাউ, কপি, শিম, মুলো, গাজর, বীট। যে কটা দিন খেতে পারা যায়। আজ শীতের সবজির কিছু পদের কথা বলি। (Winter Recipe)
সবজির স্টু
উপকরণ: ফুলকপি ১টা, গাজর ৩টে, শিম ২০০ গ্রাম, নতুন আলু ৩টে, লাউ ২০০ গ্রাম, টমেটো ২টো, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা

প্রণালী: কড়াইতে তেল গরম করে তাতে পাঁচ ফোড়ন দিয়ে কপি, শিম, গাজর, আলু, লাউ সাঁতলাতে হবে। নু্ন, হলুদ, চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে আঁচ কম করে হালকা ভাজা হলে জল পরিমাণ মতো দিয়ে সেদ্ধ হতে দিন। সেদ্ধ হয়ে এলে টমেটো ঝিরিঝিরি কেটে দেবেন। একটু মিষ্টি আর গোলমরিচ গুঁড়ো দিন। সব মজে এলে কাঁচালঙ্কা আর অনেকটা ধনেপাতা দিয়ে নামাতে হবে।
পালং বড়ির ঘন্ট
উপকরণ: পালং শাক, আলু, কুমড়ো, শিম, বেগুন, মুলো, গাজর, বড়ি

প্রণালী: এও এক পাঁচমিশালি সবজি। তেল গরম হলে বড়ি ভেজে তুলে নিতে হবে। তাতেই পাঁচ ফোড়ন বা কালোজিরে দিয়ে সব সবজি দিয়ে ভাজতে হবে। নুন, হলুদ, আদা বাটা, লঙ্কা দিয়ে সবজি ঢেকে প্রায় সেদ্ধ হয়ে এলে শাক দিতে হবে। আগে শাক দিলে তার রঙ নষ্ট হয়ে যায়। শাক আর সবজি মজে গেলে কয়েক ফোঁটা তেল আর বড়ি ভাজা ছড়িয়ে আবার একটু মিশিয়ে নামাতে হবে।
এক একদিন আমাদের বেশি রান্না করতে ইচ্ছে করে না। সেদিন একটা চিকেন বা মাছের ঝোল যা সহজে হয়, এমন বানালে রান্নার ঝামেলা থাকে না।
সবজি দিয়ে মাছের ঝোল
উপকরণ: তাজা মাছ ২৫০ গ্রাম, বেগুন, বড়ি, শিম, টমেটো, ধনেপাতা

প্রণালী: রুই বা কাতলা মাছ নুন হলুদ দিয়ে ভেজে নিতে হবে। সেই তেলেই আলু, বেগুন, শিম, বড়ি হালকা ভেজে, তাতে একটা ছোট টমেটো কেটে আদা বাটা, জিরে গুঁড়ো, হলুদ, নুন, চেরা লঙ্কা দিয়ে একটু জল দিয়ে মশলা মজতে দিতে হবে। মশলা থেকে তেল বেরোলে দু কাপ গরম জল দিয়ে ফুটতে দিতে হবে। ঝোল ফুটে গেলে মাছ ছেড়ে ঝোল আরো ৫-৭ মিনিট ফুটিয়ে গ্যাস বন্ধ করুন। এইবার কয়েকটি চেরা লঙ্কা, কালোজিরে আর ধনেপাতা কুচি দিয়ে কড়াই ঢেকে ৫-১০ মিনিট রেস্টিং টাইম দিলেই রেডি সুস্বাদু ঝোল। বড়ি ভেজে দেওয়া যায়। আবার ইচ্ছে হলে আদা বাটাও দিতে পারেন। রুই, কাতলা ছাড়াও যেকোনো তাজা মাছে এই ঝোল হয়।
ছবি সৌজন্য: লেখক
নিবাস গুরগাঁও। পেশায় বাবুর্চি। নিয়মিত রান্না বিষয়ক লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এছাড়া স্কুলছুট বাচ্চাদের স্কুলে ফেরানোর কাজ করেন শমীতা।
