চিঠি রেখে আসা হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। এখন আর কিছুই ভাল লাগছে না, শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বিছানায় পিঁপড়ে হয়েছে খুব, কুটুস করে কামড়ায়, ছটফটিয়ে উঠতে হয় তখন। না শুয়ে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে, ঘর থেকে বারান্দা, সিঁড়ি, আবার ঘর। নীচের অন্ধকার মাঠে অনেকগুলো টর্চ সন্ধানী চোখ মেলে আতিপাতি খুঁজে বেড়াচ্ছে, চিহ্নের সন্ধানে। এগুলো পুলিশের ভারী টর্চ, বাঘের মাথার মত মুন্ডু, মনে হয় একটা ঘা খেলে চোয়াল গুঁড়িয়ে যাবে। মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে টুকরো টাকরা কথা–
‘সাসপেক্টেড সবাইকেই তো থানায় ডেকে আনা হল। এর থেকে বেশি কী করব!’
‘বড়বাবুর বাড়াবাড়ি যত! বাগালিদের বাচ্চার জন্য এত কিছু! ওরা এমনিতেই গণ্ডায় গণ্ডায় হয় আর পিলপিল করে মরে।’
‘দেখ লাহিড়িদা, ঘাসের ওপরেও কোনও হ্যাঁচড়ানোর দাগ নেই। ধস্তাধস্তি কি রক্ত, কিস্যু না। ক্লু না থাকলে কি হাওয়া থেকে বার করে আনব নাকি!’
‘কী মশা রে বাবা! শালারা বাড়ি বানাবারও জায়গা পায়নি!’
নিঝুম বাড়িতে আজ কেউ দালানগুলোতে আলো জ্বালাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। দিদা এক ঠায় বসে আছে তো আছেই। রিনামামিমাকে ডাক্তার দেখে গেছে, আর বিশ্বমামা দৌড়ে বেড়াচ্ছে এখান থেকে ওখান। দিদার কি মাথাটাই খারাপ হয়ে যাবে এবার? কারও সঙ্গে কথা বলছে না, কাঁদছেও না। যদিও টুনু চিঠিতে লিখেছে যে দিদা কাঁদছে, কিন্তু সে শুধুই কথার কথা। আসলে তো দিদা জানালার ধারেও আর দাঁড়িয়ে নেই, যেন তার জন্য কেউ কোথাও সামান্যতম প্রত্যাশা রাখার সুযোগটুকুও দিল না।
কিন্তু কারও মাথাতেই তো ওই পাগলটার কথা আসল না, সে যতই মেলায় রিনামামিমা বলে থাকুক না কেন, যে এর আগেও পাগলটা একবার বাড়ির ভেতর ঢুকে গুবলুকে দেখছিল। একটা পা নেই, তাকে পাগল বল অথবা একানড়ে, যাই বল না কেন, টুনু সকালবেলা স্পষ্ট দেখেছে পাগলটা তালগাছ বেয়ে ওঠবার চেষ্টা করছিল। একটা পা রাখল, তারপর ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে উলটে পড়ে গেল।
দিদা ভাত রেখে আসে তালগাছের নীচে, সে কি তাহলে এই পাগলটার জন্যেই? কিন্তু সে তো ভাত খায় না! অন্তত টুনু দেখেনি কখনও। নাহ, বিশ্বমামা যেমন বলেছে, তালগাছে ছোটমামা আছে, তাই দিদা ভাত রেখে আসে। কিন্তু তালগাছে যে একানড়েও থাকে, আর মাঝে মাঝে পাগল সেজে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়, সেটা আর ক’জন জানবে! দিদা আজ আর ভাত রাখেনি, তার মাথাতেই হয়তো নেই ওসব। সেইজন্য মনে হয় পাগলটা খাবার সন্ধানে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিস্বাদ লাগছে সব। কী বিষণ্ণ এই বাড়ি– টুনু দোতলা বারান্দার প্রাচীন দেওয়াল খুঁটে নখ ভেঙে ফেলল। তার পা বেয়ে দুটো লাল পিঁপড়ে উঠে আসছিল, তাদের ছেঁচড়ে দিল দেওয়ালের গায়ে। গুবলু এ বাড়ির সমস্ত আনন্দকে নিজের ডানায় লুকিয়ে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেছে, আর নিয়ে গেছে দিদার বুকজোড়া স্নিগ্ধ করুণাকে, তার জানালা ধরে পথ ভুল দাঁড়িয়ে থাকা। টুনু একদিন দেখেছিল, সুতোকাটা একটা ঘুড়ি গম্ভীর কালো মেঘের ভেতর দিয়ে টাল খেতে খেতে হাওয়ার উজানে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এ বাড়ির ঔজ্জ্বল্যটুকু সেভাবেই যেন তালগাছের মাথায়, দুঃখিত এই সন্ধেবেলাগুলোয়, ছাতার মতো ঝোপের ভেতর অণু পরমাণু হয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু কারও মাথাতেই তো ওই পাগলটার কথা আসল না, সে যতই মেলায় রিনামামিমা বলে থাকুক না কেন, যে এর আগেও পাগলটা একবার বাড়ির ভেতর ঢুকে গুবলুকে দেখছিল। একটা পা নেই, তাকে পাগল বল অথবা একানড়ে, যাই বল না কেন, টুনু সকালবেলা স্পষ্ট দেখেছে পাগলটা তালগাছ বেয়ে ওঠবার চেষ্টা করছিল।
এবং যথারীতি আজও ছোটমামার ঘরের দরজা খোলা আছে।
টুনু থেমে গেল। একটু অবাকও। কারণ সে যদিও জানত যে দরজা খুলে যাবে, যেহেতু চিঠি পাঠিয়েছে, কিন্তু সন্ধেবেলাই খুলবে, বোঝেনি। যদিও সন্ধেবেলায় ওপরে কেউ ওঠে না, কিন্তু তাও– দরজা আসলে কবে খুলবে, সেটা তুমি ঠিক করে দিতে পার না।
ঘরের দেওয়ালের সেই ছোপটা, যেন মরা মরা। আগেকার ঔজ্জ্বল্য ফিকে। টুনু হাত দিয়ে বুঝল, খসখস করছে। ধকধকে ব্যাপারটা আর নেই। মরা চামড়া? সেটাই বা কই! যেন এই ঘরে যে ছিল, সে চলে গিয়েছে পত্রপাঠ গুটিয়ে। শুধু পচা গন্ধটা আছে। যেন আর একটু তীব্র। যে চলে গেল, অবশেষ রেখে গেল কি? টুনু চোখ বন্ধ করে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে। যদি কেউ এসে দাঁড়ায় পেছনে। কেউ আসল না। কেউ যে আসলে কোথাও নেই, হয়তো কখনও ছিলও না, যেন কতকালের একটা মরা গুহার ভেতর কিছু অনর্থক হাড়গোড় সাজিয়ে রাখা অর্থহীন প্রতীক্ষায়।
টুনু একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তাহলে কি এই ঘরে যে থাকত, ছোটমামা হোক বা অন্য কেউ, তার কাজ ফুরিয়েছে? তাই ছেঁড়া কাপড়ের মত অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে গেছে, দূরে, অন্য কোথাও। গম্বুজে। অথবা তালগাছের মাথায়। বা হয়তো আরো দূরে।
গুবলু এ বাড়ির সমস্ত আনন্দকে নিজের ডানায় লুকিয়ে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেছে, আর নিয়ে গেছে দিদার বুকজোড়া স্নিগ্ধ করুণাকে, তার জানালা ধরে পথ ভুল দাঁড়িয়ে থাকা। টুনু একদিন দেখেছিল, সুতোকাটা একটা ঘুড়ি গম্ভীর কালো মেঘের ভেতর দিয়ে টাল খেতে খেতে হাওয়ার উজানে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
টেবিলের ওপর বইখাতাগুলো সাজানো গোছানো। টুনু আগের দিনকার খাতা নিয়ে অন্যমনস্কের মত ওলটাল। এখানে তার জন্য ছবি এঁকে গিয়েছিল। অথচ আজ কোথাও কিছু নেই। ঝকঝকে প্রতিটা পাতা। তার নামটাও, পরিপাটি।
হঠাৎ জানালার নীচে বাগানে একটা পায়ের খচমচ আওয়াজ, যেন দৌড়ে গেল কেউ। টুনু গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। পুলিশ তাহলে এখন কুয়োর ভেতর নামবে! বলেছিল সেরকম একবার। পুলিশ নয়, একটা ছেলে, হয়তো তারই বয়সী। বাগানে ঘুমিয়ে পড়া কাপাস, আমের ডালে লেগে থাকা ছেঁড়া ঘুড়ির ল্যাজ, যার পেছন দিয়েই উঠেছে এক প্রাচীন বেলগাছ, ভাঙা পাঁচিলে পা দিয়ে দিয়ে তার শ্যাওলাটে বাকলে হাত বোলালে আরাম লাগে।
বেলগাছের নিচে বিশ্বমামার ঘর নিস্তব্ধ শুনশান, তাকালে গা ছমছম করে। সেই ঘরের পেছনের ভাঙা পাঁচিলের ওপর বসে আছে ছেলেটা, তার মাথার ওপর ছাতার মতো ঘিরে ধরেছে বেলছায়া। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না ভাল, খালি অবয়ব। মাঠে যে ছেলেগুলো খেলতে আসে, তাদেরই কেউ হতে পারে। তার দিকে একপাশ করে আছে বলে মুখটা বুঝতেও পারছে না।
তখন ছেলেটা আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরাল জানালার দিকে। এই ভঙ্গিটা টুনুর খুব চেনা, কোমরে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলার মাঠে রেফারির দিকে এভাবেই ঘাড় ঘুরিয়ে থাকত, যখন সিনিয়ার কেউ ফাউল করে দিত আচমকা।
সুতনু সরকার।
ভীতু হলেও কোনও এক দুর্মর জেদের জোরেই যে টুনু গম্বুজে গিয়েছে অথবা তালগাছের গোড়ায়, তার যত্নে সাজানো বূহ্যগুলো এখন ফ্যাঁসা কাপড়ের মতো, সামান্য হাওয়াতেই ওলটপালোট খেয়ে কাটা ঘুড়ির মতো এদিক ওদিক পালিয়ে যাচ্ছে, যাদের গেঁথে ফেরাবার মতো কোনও তীরই আর টুনুর আস্তিনে নেই। একটা প্রবল শ্বাসরোধী ভয় টুনুর গলা চেপে ধরল, শুকিয়ে এল বুকের ভেতর, যেন সমস্ত রক্তকে স্ট্র দিয়ে চোঁ মেরে টেনে নিয়েছে ভয়ানক এক রাক্ষসে, কানের কাছে ভোঁ ভোঁ করতে থাকল, মনের ভেতর দুলে উঠল রিনামামিমার ঝুমঝুমির মতো ফর্সা বুক। শিউরে হাত মুঠো করল টুনু, এ সব ভাববে না কিছুতেই। নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে এল।

সুতনু তার দিকেই তাকিয়ে আছে, নিষ্পলক ও স্থির।
আগের দিন ক্যালকুলাস, আজ সুতনু, যে ঘাড়ভাঙা পুতুল হয়ে দুমড়ে ছিল স্কুলবাড়ির উঠোনে। ঘ্যাঙ আওয়াজটা উঠেছিল কারণ বাথরুমের ছাদে পাতবার জন্য উঠোনে এনে শুইয়ে রাখা হয়েছিল টিনের চাল, তার ওপর পড়েছিল। একটু পরে টুনু সেখানে পৌঁছয়, তখন সুতনুকে তোলা হচ্ছে ধরাধরি করে, মাথাটা অবহেলার সঙ্গে ঝুলছে, যেন কিছুই এসে যায় না কিছুতে। নাক দিয়ে রক্ত।
আর এখন সুতনুর নাকে রক্ত কিনা দেখা না গেলেও মাথা স্বাভাবিক, ঘাড় ভাঙার চিহ্নটি নেই। টুনুর মনে হল তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে, হয়তো পড়েই যেত মেঝের ওপর, যদি না সুতনু পাঁচিলের ওপর উঠে দাঁড়াত।
পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে সুতনু, টুনুর মনে হল হাত নেড়ে চিৎকার করে বলে ‘পড়ে যাবে’, কারণ ভাঙা পাঁচিল। তবু সে সাবধানবাণী তার শুকনো গলা দিয়ে বেরল না। সুতনু তার দিকে তাকিয়ে থাকল একটু। তারপর বেলগাছের ডালে হাত দিল। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল কয়েকটা পাতা, যেন গুনছে, এই প্রাচীন গাছটা কতটা ভরন্ত হল। হাত বোলানো শেষ করে বেলগাছের ডালে একটা পা রাখল সুতনু। পলকা ডাল কি ভেঙে পড়বে শরীরের ভারে? ও কি উঠে যেতে চায় ডাল বেয়ে, গাছের মাথায়? কেন?
হঠাৎ দরজার কাছে শব্দ হতে টুনু চমকে পেছন ফিরল। কেউ দোতলায় এসেছে। ছোটমামার ঘরে ঢুকেছে জানলে তুমুল বকবে তাকে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছুটে গেল দরজার কাছে, এবং পাল্লার আড়ালে নিজের রোগা শরীরটাকে দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারলে বাঁচে, এমন ভঙ্গিতে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
একটা প্রবল শ্বাসরোধী ভয় টুনুর গলা চেপে ধরল, শুকিয়ে এল বুকের ভেতর, যেন সমস্ত রক্তকে স্ট্র দিয়ে চোঁ মেরে টেনে নিয়েছে ভয়ানক এক রাক্ষসে, কানের কাছে ভোঁ ভোঁ করতে থাকল, মনের ভেতর দুলে উঠল রিনামামিমার ঝুমঝুমির মতো ফর্সা বুক।
দাদু। বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেল একবার নিজের ঘরের দিকে, সঙ্গতে গলা খাঁকরানি। পায়ের আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে, ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে পারলে হয়তো ধরতে পারবে না কারণ দাদুর ঘর দোতলার একদম শেষ প্রান্তে।
ঘরের চৌকাঠে পা দিয়েও থেমে গেল, কেন জানে না, এবং ধাপে ধাপে পিছতে লাগল। নিজেকে যখন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করছে, কেন সে পিছচ্ছে, তখন কুয়াশাজারিত বোধ তাকে এলোমেলো যে উত্তরটা দিয়েছিল– হঠাৎ করে জানালার কাছ থেকে শব্দ থেমে গিয়েছে, সবই আগের মতো নির্জন। জানালায় এসে দাঁড়াল টুনু। আবার গ্রিলের গায়ে চেপে ধরল গাল। পচা গন্ধ যেন বাড়ছে!
বাগানে কেউ নেই। বেলগাছও নির্জন থমথমে। অফলা আকাশ থেকে নেমে আসা গর্ভথোড়ের দুধের মতো জ্যোৎস্না তার পেটের ভেতর কোন রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, টুনু বুঝতে পারল না।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।