২২ জুলাই অমৃতবেলায় আশ্রমের প্রান্তে বাবাজির প্রাচীন সাধনকুটিরে তিলক প্রথা। সকালে হিমশীতল জলে স্নান করে সেই কুটিরের সামনে দাড়াঁলাম। আমার সামনে দু’জনের একজন আশ্রমবাসী আর একজন শ্বেতাঙ্গিনী, যিনি সম্প্রতি হল্যান্ড থেকে এসেছেন। গতকাল সন্ধ্যারতির সময় হারমোনিয়ামে তাঁর দক্ষতা দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম।
এই তিলক প্রথা এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা- গৌতমী গঙ্গার তীরে ক্ষুদ্র কুটিরে গৈরিক বস্ত্র পরিহিত এক বলিষ্ঠ সন্ন্যাসী বসে আছেন। শোনা যায়, তিনি বাবাজি মহারাজের একান্ত সঙ্গী ছিলেন। তাঁকে প্রণাম করে কোলের সামনে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। তিনি কপালে চন্দন লাগিয়ে দিলেন। শরীরের সকল অণু-পরমাণু এক নাম-না-জানা অনুভূতিতে কেঁপে উঠেছিল। পরে জেনেছিলাম, এই মুনির বয়স ৯২ বছর। কিন্তু তাঁকে দেখলে তাঁর বয়স অন্তত ৫০ বছর কম বলে মনে হয়। এ যোগসাধনার এক নিশ্চিত ফলশ্রুতি।
ভোরের আলো ফুটতেই যাত্রা শুরু। গন্তব্য ছোট-কৈলাশ। প্রথমে কোমর জলে গৌতমী গঙ্গা পেরিয়ে পাহাড়ে চড়া শুরু করতে হবে। দীর্ঘ পথ আর দিনের আলো থাকতে ফিরতেও হবে। সঙ্গে পথ-প্রদর্শক কিশোর রাকেশ। আমি ট্রেকিং সাজসরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত। আর আমার অগ্রদূতের পায়ে হাওয়াই-চটি, চোখে কিশোরের চপলতা আর মুখে হাসি।
বৃষ্টি মাথায় করে আমরা রওনা হলাম। আমার রুকস্যাক সে নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। আমার হাইকিংয়ের লাঠিজোড়া তার বিশেষ পছন্দের। কিন্তু এই বয়সেই তার নেশা হল “ভোলে-কি বুটি”- সোজা বাংলায় যাকে বলে ভাঙ। যাত্রাপথে তাকে বোঝালাম এই বয়সে নেশাভাঙ করা ভাল নয়।
ট্রেকিংয়ের পথটি অতি মনোরম। চারিদিক ঘন সবুজে মোড়া উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর। কোথাও জনবসতি, নিচে বহমান গৌতমী গঙ্গা। ওঠার পথে প্রবল বর্ষণ শুরু হল। এক যাত্রায় পৃথক ফল যাতে না হয় তাই বর্ষাতি ছেড়ে আমি রাকেশের সঙ্গে ভরা শ্রাবণের ধারায় ভিজে গেলাম। কোথাও রাস্তার দুপাশে বিছুটিবন, গা বাঁচিয়ে চলতে হবে। কোথাও বা চলার পথ এত সরু, যে সে পথে চলা যাবে কিনা তাই সন্দেহ হয়। এই দুর্যোগে, তির্যক ঢালু পথে পিছলালে মৃত্যু যে অবধারিত, তাতে কোনও সন্দেহ রইল না।

রাকেশ আমার এক হাত ধরেছে আর তার আর এক হাতে আমার ট্রেকিং পোল। বলল, “সাব, আপকো জানকা খতরা হোনে সে পহলে, মেরা জান জায়েগা। আপ নিশ্চিন্ত রহিয়ে।” হাওয়াইচটি পরে হিমালয়ের বন্ধুর পথে এই অসম্ভব দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নিজের প্রাণ বিপন্ন করে এক অপরিচিতের হাত ধরে রাকেশ ছোট-কৈলাশে পৌঁছল। আপ্পালাচিয়ান হাইকিংয়ের পথে বহু বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু এমন নিশ্চিন্ত বোধ করিনি। ওই দুর্গম গভীরে শুধু অর্থের জন্য নয়, এই কিশোরের আনুগত্য আর বিশ্বস্ততার জন্ম হিমালয়ের অপরিমেয়তায়। এই বিশাল হিমালয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় আমার অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
ছোট-কৈলাশের মন্দিরটি অতি প্রাচীন। মন্দির চত্বরে অনেক ঘণ্টা ঝোলানো। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম মন্দির সংলগ্ন জমিতে ধুতরো ফুল দেখে। লোকমুখে কথিত, মানস সরোবরের আদলে এখানে একটি ছোট জলাশয় ছিল যা এখন লুপ্ত। তবে পর্বতশিখরে শিবপ্রিয় এই ফুলের সমারোহ অত্যন্ত আশ্চর্যের। পুরোহিত পাশেই কুটিরে থাকেন। তিনি দরিদ্র হলেও মহানুভব। বিধ্বস্ত দুই যাত্রীকে কিছু প্রসাদ ও গরম চা না খাইয়ে ছাড়েননি। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামা শুরু হল।
ঝড়ের গতি বেড়ে চলেছে আর তার সঙ্গে তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো বৃষ্টি। নামার পথ আরও বিপদসংকুল, ছুরির প্রান্তের মত দু’দিকে গভীর ঢাল, সামনের দৃষ্টিক্ষেত্র সীমিত। আমার কর্তব্যনিষ্ঠ সহচরকে অনুসরণ করে চলেছি আর সে আমাকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে নীচের গ্রামে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু শুরু হল তার অন্য বায়না। তাকে কিছু অগ্রিম দিতে হবে ‘ভোলে-কি-বুটি’ কেনার জন্য। অনেক বুঝিয়ে, জুতো কেনার জন্য দুগুণ টাকা রফা করে তাকে নিরস্ত করলাম।
যাত্রার শেষ কিস্তিতে রাকেশ মাত করে দিল। আমার ক্লান্তি আর ফিরতি পথে আবার গৌতমী গঙ্গা পেরনোর অনীহা দেখে সে আমাকে কাঁধের ওপর দিয়ে পিঠে তুলে নিল। কী আসামান্য দক্ষতায় সে আমাকে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে, এক হাতে দুই ট্রেকিং পোল আর অন্য হাতে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে, নদীতলে পিচ্ছিল নুড়িতে পা ফেলে ভারসাম্য রক্ষা করে পার হয়েছিল তা এখনও আমাকে বিস্মিত করে।

বিকালের বেশ কিছু আগে ফেরার কারণে বাবাজি মহারাজের প্রাচীন গুহার ভিতরে প্রবেশের ইচ্ছে হল। আজ যদি মন্দিরের পূজারী দ্বার খুলে দেন! পোশাক পাল্টে রাকেশকে নিয়ে আবার নদী পেরলাম। তবে এবার পিঠে চড়ে নিয়ে, নিজের পায়ে। হড়কাতে হড়কাতে। বলা বাহুল্য, আমার সহচর আমাকে শক্ত হাতে ধরে ছিল। অবশেষে প্রবেশ দ্বারে পৌঁছলাম। ভিতরে একটি মন্দির আর তারপর গুহা।
পূজারী গুহার ভিতরে যাবার সতর্কীকরণ শোনালেন- বহুদিন কেউ ভিতরে যায়নি। সেখানে ঘন অন্ধকার, বিষাক্ত সাপ, বিছের বাসা। হিমালয়ের শ্রেষ্ঠ বিস্ময়ের নিদর্শনস্বরূপ এক অবিনশ্বর মহাপুরুয এই গুহায় দু’ দু’বার প্রকট হয়েছেন। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশ মাত্র ৪৯ বছর আগে। এখনও তার বহু সাক্ষী এই হেইড্যাখানে আছেন, যাঁরা চাক্ষুষ তাঁকে গুহার সামনে মিলিয়ে যেতে দেখেছেন। প্রবাদ বলে, তিনি মাছিরূপে পাহাড়ের মধ্যে কোনও অজানা পথে উপরে ছোট-কৈলাশে অক্লেশে পৌঁছে যেতেন।
দুরুদুরু বুকে একা গুহামন্দিরে বসে রইলাম। ভাবছি আমার সাধনলব্ধ কিছুই নেই। প্রবেশিকা পরীক্ষার একটা ব্যবস্থা যদি বাবাজি মহারাজ রাখতেন তবে এই দোলাচলতা থেকে মুক্তি পেতাম। হঠাৎ একটা বড় মাছিকে গুহায় সেঁধোতে দেখে ভাবলাম নিশ্চয় দিবাস্বপ্ন দেখছি। যাইহোক, মাছিটিকে ছাড়পত্রের প্রতীক মেনে মহাসাধককে স্মরণ করে ঢুকে পড়লাম। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে চোখ সইতে সময় লাগল। গম্বুজাকৃতি গুহাটি সত্যিই অদ্ভুত। পাহাড়ের মধ্যে এমন নিখুঁত আকৃতি, যাকে ইংরিজিতে ‘কাস্টম-বিল্ট’ বলে। একটি বেদিতে বাবাজি মহারাজের পাথরের মূর্তি, একটি মোমবাতি আর দেশলাই। জানি না, কতদিনের পুরনো। অনেক চেষ্টা করেও জ্বালাতে পারলাম না। অগত্যা তমসাই ভাল।

অন্তরের আলোকে আলোকিত করে কিছুক্ষণ ধ্যানের প্রচেষ্টা করলাম। কিন্তু আদিম গুহার ভিতরের নীরবতা আমাকে অস্থির করে তুলল। বুঝলাম এ গুহায় ধ্যানমগ্ন হওয়া সহজ নয়। কিছুক্ষণ মন্ত্রগীতির পর মন অনুপম শান্তিতে ভরে উঠল। নীরবে ফিরে এলাম আশ্রমে। সন্ধ্যারতির পর আশ্রমের সান্ধ্যকালীন ভান্ডারা।
প্রথাগত রীতি মেনে, মাটিতে বসে কাঁসার থালায় নির্বাক ভোজন। পরিশেষে সে থালাকে স্বহস্তে মৃত্তিকামার্জন- আত্মনির্ভরশীলতার চরম দৃষ্টান্ত। আসার দিন রাকেশ আমাকে ছাড়তে চাইছিল না। সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আমি হেইড্যাখানের পাহাড়ে থেকে গেলে, সে আমার জন্যে বাড়ি বানিয়ে দেবে। বাগানের ফসল, তাদের ক্ষেতের ধান ভেঙে চাল আর বাড়িতে তৈরি ঘি দিয়ে আমার বেশ চলে যাবে।
২৩শে জুলাই হেইড্যাখান থেকে কুমায়ুনের উত্তরে যাত্রা করলাম। হল্দওয়ানি শহরের কাছে একটি ছোট জনপদ, কাঠঘড়িয়া। এখানে একটি প্রাচীন আশ্রম, যা আদি বাবাজি মহারাজের নামে উৎসর্গীকৃত। এখানে ঘটে যাওয়া কিছু অপ্রাকৃতিক ঘটনার বর্ণনা পুরনো বইতে আছে। তবে একটি অভিজ্ঞতার উল্লেখ না করে পারছি না।

এই আশ্রমের বাইরে ও ভিতরের অনুকম্পন সম্পূর্ণ আলাদা যা আমি বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করে অবাক হয়েছিলাম। আশ্রমের চৌহদ্দির মধ্যে আনন্দের আবহ, যা বাইরে গেলেই মিলিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে আশ্রমের অঙ্গনে পা দিলেই। এখানেই হিমালয় একক এবং অদ্বিতীয়, আর তা নাহলে এটি অন্য যেকোনও পর্বতমালার মতোই শুধু এক ভৌগোলিক বিস্ময়।
*ছবি সৌজন্য: pithoragarh.nic, rishikeshdaytour.com, euttaranchal.com
*আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১]
সৌমেন চট্টোপাধ্যায় পেশাগতভাবে অর্থায়ন ও বিনিয়োগ বিভাগের সঙ্গে জড়িত। নেশা বেড়ানো ,পাহাড়ে চড়া ও ছবি তোলা। হিমালয়ের প্রতি আকর্ষণ আশৈশব। বর্তমানে কাজের সূত্রে শিকাগোয় বসবাস।