কোনও কোনও বই হাতে নিয়ে পাতা ওলটালে বাঙালি হিসেবে বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। ‘পঞ্চাননের হরফ’ সেই জাতের বই।
কেউ বলতেই পারেন, হরফ মানে বুঝলাম। লিপি। কিন্তু পঞ্চানন কে মশাই? দেবাদিদেব মহাদেবের কথা বলছেন?
তাঁদের কাছে পঞ্চানন কর্মকারের নাম বললে কোনও পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায় থেকে নামটুকু ভেসে উঠতে পারে। এইমাত্র। এর বাইরে ‘পঞ্চানন কর্মকার’ মানুষটা কে, আমরা অনেকেই জানি না। উইকিপিডিয়ায় যেটুকু আছে সেটুকু মন্দ নয়। তাতে পঞ্চানন কর্মকার সম্বন্ধে লেখা আছে– ‘বাংলা মুদ্রণাক্ষরের স্রষ্টা ও মুদ্রণশিল্পের প্রযুক্তিবিদ।’ কিন্তু এটুকু বললে মানুষটার ওজনের তল পাওয়া যায় না।
মুদ্রণশিল্প এখন যে উচ্চতায় পৌঁছে গেছে তাতে পছন্দসই ফন্ট আর ফন্ট সাইজ় নিয়ে কম্পোজ় করে পেজ মেক-আপ করে নিলেই সিধে মেশিনে ছেপে বই বেরিয়ে আসছে। এর দরুন এই সেদিন আমাদের হাতে এসে পড়া ফটোটাইপ প্রযুক্তি এখন সেকেলে হতে বসল, লেটারপ্রেসের কথা তো বলাই বাহুল্য! কাজেই যদি বলি যে পঞ্চানন কর্মকার বাংলা ভাষায় প্রথম মুভেবল টাইপ তৈরি করেছিলেন, তবে ‘মুভেবল টাইপ’ বা সচল হরফ খায় না মাথায় দেয়, এ প্রশ্ন অনেকেই তুলতে পারেন।
অবিশ্যি তাদের দোষ আর ধরি কী করে? আমাদের ইতিহাসচেতনা এমনিতে ফেলে দেবার মতো না হলেও আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে, যখন সাহেবদের তাঁবে থাকা বাংলায় বাংলা ভাষাতে বই ছাপানোর তোড়জোড় চলছিল, তখন পঞ্চানন কর্মকারের মতো মানুষ যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, চট করেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়। ইদানীং ‘হিস্ট্রি অফ দ্য বুক’ নিয়ে অভিজিৎ গুপ্ত, স্বপন চক্রবর্তীরা কিঞ্চিৎ নাড়াচাড়া করলেও সারস্বত মহলেও এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক কম।
তবু যদি বলা হয় যে, বাংলা ভাষায় ছেপে বেরনো প্রথম বই হিসেবে প্রসিদ্ধি পাওয়া ‘আ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ’-এর সব কটা বাংলা হরফ পঞ্চাননের তৈরি, তাতে কালি লেপেই বাংলা আখরের ছাপ তোলা হয়েছিল কাগজে, কেউ কেউ নড়েচড়ে বসতে পারেন। যদি বলি যে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরির হাতে গড়া শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে বেরনো বাইবেলের বাংলা তর্জমা– যে বই এই উপমহাদেশের প্রকাশনা ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা– সেই বইয়ের সব হরফ পঞ্চাননের হাতে কাটা, তবে পঞ্চাননকে নিয়ে কৌতূহল দেখাতে পারেন অনেকে।

এই কৌতূহল নিরসনের কোনও সোজা রাস্তা আমাদের জানা ছিল না। এবারে মিলেছে। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার তরুণ প্রকাশক ‘পার্চমেন্ট’ থেকে রজত চক্রবর্তীর লেখা ‘পঞ্চাননের হরফ’ বেরিয়েছে সবে। কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের সেকেন্ড ওয়েভে সারা দেশ কাত হচ্ছে, এমন সময়। পড়ে আমাদের মনে হচ্ছে – আহা, এই বইটা আগে কেউ লেখেননি কেন?
একটু ভুল হল। লেখা যে একেবারে হয়নি, তা নয়। সাহেবরা কিছু লিখে গেছেন। তার কোনওটায় পঞ্চাননের নাম আছে, কোনওটায় নেই। প্রথমনাথ বিশীর ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ (১৯৫৮ খ্রি) অনেকেই পড়েছেন। তার থেকে তৈরি বিকাশ রায়ের ছায়াছবি দেখেছেন। শ্রীরামপুর মিশনের কাজে উইলিয়াম কেরির ডানহাত রামরাম বসুকে আমরা চিনেছি। সুধীরকুমার মিত্রের মতো আঞ্চলিক ইতিহাসবিদের হাতযশে হুগলি জেলার অনেক হারানো কাকাতুয়া খাঁচায় ফিরেছে।
এই সেদিনও শ্রীরামপুর কলেজের কেরি লাইব্রেরিতে সুনীল চট্টোপাধ্যায় নামে এক পণ্ডিতের দেখা মিলত, রেললাইনের ধারে এক প্রাচীন বাড়িতে তিনি থাকতেন। শ্রীরামপুর মিশনের নানান দিক থেকে তাঁর গবেষণা ছিল গভীর। নানান রকম তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে পঞ্চানন কর্মকারকে নিয়েও বই লিখেছিলেন। সে বই জনসমাদর পেয়েছে এমন নয়। তাছাড়া ইতিহাসের উপদান সংগ্রহ করাই সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। পঞ্চাননের হরফের লেখক রজত চক্রবর্তী সেইসব উপদানকে ষোলো আনা ইস্তেমাল করেছেন। একেবারে হালে বেরনো উইলিয়াম ডালরিম্পলের ‘দ্য অ্যানার্কি’ বা অ্যান্ড্রু ওটিসের ‘হিকি’জ় বেঙ্গল গেজেট’-এর দৌলতে ইতিহাস ও আখ্যানকে মিলিয়ে মিশিয়ে উপাদেয় এক গদ্য রচনার কায়দা রপ্ত করেছেন। ক’বছর আগে ‘গৌরপ্রাঙ্গণে গোরা’ লিখে আমাদের চোখ টেনেছিলেন রজত। ‘পঞ্চাননের হরফ’-এ এই চন্দননাগরিক আরও ফুরফুরে মেজাজে ধরা দিলেন।
বইয়ের প্রথম কয়েক পাতা কিঞ্চিৎ শুষ্কং কাষ্ঠং। তথ্যভারে ন্যুব্জ। রমেশ-শরদিন্দু-সুনীল বা একালের শাহীন আখতার যেভাবে আখ্যানের ফাঁকফোকরে কালচিহ্ন গুঁজে দেন, রজত সে পথে এগোননি। পটভূমি সাজিয়ে গুছিয়ে গল্প বলতে বসেছেন।
তার দরকার ছিল বইকি! আজকাল কাঁসা-পেতলের ঘটি-বাটি-থালায় নকশা তোলার কারিগর খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ তিনশো বছর আগে এটাই যে কর্মকার বা কামার ঘরের জীবিকা হতে পারত, কামারশালা থেকে বেরনো অস্ত্রশস্ত্রের ওপর বাহারি নকশা ফুটিয়ে তুলে ইনাম হিসেবে রাজা কিংবা নবাবের কাছ থেকে ‘মল্লিক’ উপাধি পাওয়া যেত, সেই পটভূমি সবিস্তারে না বললে বর্গি হানার রাতে জন্মানো পঞ্চাননকে চিনতে আমাদের অসুবিধে হত।
কেন ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে দুই ছেলে পঞ্চানন আর গদাধরকে নিয়ে জিরাট থেকে বংশবাটি (আজকের বাঁশবেড়িয়া) চলে এলেন শম্ভুচরণ কর্মকার, হুগলি নদীর দু’ধারে ইয়োরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের হিড়িক কীভাবে কলকাতায় এসে সাম্রাজ্যবাদী চেহারা নিল– তার রূপরেখা ছোটো করে লিখে না দিলে পঞ্চাননের মতো কুশলী খোদাইকারের বাজার কেমন করে তৈরি হল বুঝতে পারতাম না। সাম্রাজ্যবাদের বাড়বাড়ন্তর সঙ্গে সেই বাজার কোন সুতোয় বাঁধা তাও স্পষ্ট হত না।

রজত সে সব যথেষ্ট দক্ষতা নিয়ে করেছেন বলে ১৭৭৬ থেকে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ– এই সময়সীমায় পঞ্চাননের কেউকেটা হয়ে-ওঠার পর্ব আমাদের মর্মে পশেছে। তাঁকে নিয়ে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর শ্রীরামপুর মিশনের দড়ি টানাটানি চলেছিল, যার জের আদালত অবধি গেছিল, তাও লিখেছেন। তবে ডালরিম্পল বা অমিতাভ ঘোষ এ ধরনের লেখার জন্য বিলেত-আমেরিকার সব লেখ্যাগার ঢুঁড়ে ছানবিন করেন। রজতের ভরসা সেকেন্ডারি মেটিরিয়াল। তা সত্ত্বেও তাঁর সিদ্ধি প্রশংসনীয়। ইচ্ছে করেই ‘সাঁকরাইলে’র বদলে ‘শাঁখরাইল’ লিখেছেন রজত। স্থাননামের বৈষ্ণব সূত্রের দিকে ইশারা করেছেন। কাশিমবাজার না লিখে ফিরে গেছেন ‘কাশেমবাজার’-এ।
রজতের জন্যই ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে থাকা কত চরিত্রকে জ্যান্ত দেখলাম আমরা। ‘বাংলা ভাষার প্রথম অক্ষরশহিদ’ উইলিয়াম বোল্টস-কে চিনিয়েছেন তিনি। দেখিয়েছেন খুশমত মুন্সিকে, যাঁর আরবি ছাঁদের বাংলা হাতের লেখা থেকেই হালেদের বইয়ের বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন পঞ্চানন। চিনিয়েছেন কালীকুমার রায়কে, যাঁর হাতের লেখা থেকে শ্রীরামপুর মিশনের বইয়ের হরফ বানিয়েছিলেন তিনি।

কোথাও কোথাও লেখার মধ্যেই পৃষ্ঠা ক্রমাঙ্ক সমেত সূত্রনির্দেশ দিয়েছেন রজত। নেহাত নাচার হলে লেখার শেষে পরিচ্ছদ অনুযায়ী এসব সূত্র সাজিয়ে দেওয়াই দস্তুর। সেটা রজত মানেননি। তাছাড়া মানবেনই বা কী করে, কোনও এক অজানা কারণে পরিচ্ছেদ বিভাজনই তো করেননি তিনি! অথচ স্থান-কাল-পাত্র মোটেই স্থানু হয়ে নেই তাঁর লেখায়। চেষ্টা করলে পাঠক আলাদা করে নিতে পারেন। তাঁদের না-খাটিয়ে আলাদা করে দেওয়াটাই রজতের পক্ষে বিধেয় হত। গ্রন্থনির্মাণেও ঢের বেশি যত্ন দেখাতে পারতেন পার্চমেন্টের তরুণ তুর্কিরা। তবে পঞ্চাননের খোদাই করা-ঢালাই করা হরফের ধাঁচে মৃণাল শীলের নকশা করা মলাট বেশ নজরকাড়া।
এমনিতে আখ্যানভাগে রজতের গদ্য তরতরে। সংলাপ তৈরিতে তাঁর বড় আগ্রহ নেই। কুশীলবদের মনস্তত্ত্ব নিয়েও নয়। তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রচনায়। এত অনুপুঙ্খে সময়কে চেনাতে চেনাতে চলেছেন, যে পড়তে গিয়ে কেবল ছবি তৈরি হচ্ছে মনে। একটা নমুনা রইল –
হঠাৎ কেরি পঞ্চাননের হাতটা ধরলেন, পঞ্চানন আমাদের টাকা পয়সার অবস্থা ভালো নয়, যা সঞ্চয় ছিল, আর ধার করে এই বাড়িটা কিনেছি, আশা করি ইংরেজি বাংলা বাইবেল বিক্রি করে এবং স্কুল চালিয়ে আমরা শীঘ্রই টাকা-পয়সার সুরাহা করতে পারব, তখন তোমাকে, তবে তোমাকে অবশ্যই পারিশ্রমিক দেব, এক দু’টো মাস যদি …
সাহেব, কাজের জায়গাটা একটু দেখিয়ে দিন, চলুন …
চলো চলো … আমার পরিকল্পনায় আছে, এরপর দেবনাগরী, ওড়িয়া, উর্দু এই হরফগুলি তৈরি করে বাইবেলের অনুবাদ ছাপাব …
হরফগুলি নির্মাণ করা কি খুব কঠিন কাজ হবে!
সাহেব, আমার হাতে যতক্ষণ ছেনি আর হাতুড়ি চলবে ততদিন পৃথিবীর যে-কোনো হরফ এনে দাও, পাঞ্চ কেটে কাস্টিং করে দেব …
বাড়ির ভেতর থেকে ঘণ্টা বেজে উঠল। লাঞ্চ টাইম।
পড়তে পড়তে মনে হয়, যে পঞ্চানন কর্মকারের হাতে গোটা পূর্ব ভারত জুড়ে পাঞ্চ কেটে কাস্টিং করে মুভেবল টাইপের জন্ম হল, তাঁকে ভুলে থাকা কি ঠিক হল? ভাগ্যিস রজত লিখলেন বইটা!
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia এবং লেখক
গ্রন্থ: পঞ্চাননের হরফ
লেখক: রজত চক্রবর্তী
প্রকাশক: পার্চমেন্ট
বিনিময়: ৩৬০ টাকা
অংশুমান ভৌমিকের জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। ছেলেবেলা কাটিয়েছেন মামারবাড়ি নবদ্বীপে। গত চার দশক কলকাতার বাসিন্দা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজির এমএ হলেও বাবার 'দেশ' বরিশাল আর মায়ের 'দেশ' নদিয়ার মধ্যে দোদুল্যমান তাঁর অস্তিত্ব। পেশায় শিক্ষক, নেশায় কালচারাল কমেন্টেটর। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি করছেন দু'দশকের বেশি। দেশবিদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারো। 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও কৃত্তিবাস-এর নাট্যসমালোচক হিসেবে ইদানীং থিতু।
One Response
হুগলী জেলার ইতিহাস লিখেছেন সুধীর কুমার মিত্র। মৈত্র নয়।