Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

প্রবাসীর নকশা- পর্ব: ১

সিদ্ধার্থ দে

জুলাই ২৬, ২০২২

Sketches of NRI Life
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বাঙালিদের নিয়ে একটা প্রচলিত ধারণা আছে– পরিভাষায় যেটা stereotype– যে বহু বাঙালির মধ্যেই কবিতা বা গল্প-উপন্যাস লেখার কিছুটা সহজাত, কিছুটা পরিবেশ-অনুপ্রাণিত প্রবণতা আছে। শ্যামবাজারে জন্ম, গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বাঙালি যৌথ পরিবারে বড় হয়ে ওঠার ফলে একসময়ে আমারও যে কবি বা গল্পকার হয়ে ওঠার সুপ্ত বাসনা ছিল, সেটা অস্বীকার করব না। তবে অনেক দোষ বা খামতি সত্ত্বেও বাল্যকাল থেকেই নিজের দক্ষতার মূল্যায়ন করতে পারতাম। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ছোটদের বিভাগ ‘হাত পাকাবার আসর’-এ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হলেও বুঝতে পেরেছিলাম ছন্দ মিলিয়ে কবিতা, বা কল্পনাপ্রসূত গল্প লেখার ক্ষমতা আমার নেই। তাই বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছনোর আগেই কবি-সাহিত্যিক হবার আকাঙ্ক্ষা অন্তরালে চলে গিয়েছিল। 

যে সময়টার কথা বলছি সেটা ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। বর্তমান যুগের স্বচ্ছল ‘ডিস্ক’ (Double Income Single Kid অর্থাৎ DISK) পরিবারের ছেলেমেয়েরা আন্দাজও করতে পারবে না সেই সময়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের জীবনসংগ্রামের কথা। হারপার লি তাঁর ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ উপন্যাসে একটি ছোট শহরের জীবনযাপনের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন : “… there was nothing to buy and no money to buy things with…” গড়পড়তা বাঙালি পরিবারের সেই অবস্থাই ছিল সে যুগে। গ্রাসাচ্ছদনের পিছনেই জীবনীশক্তির অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে যেত। হাই স্কুলে পড়তে পড়তেই বুঝে গিয়েছিলাম ভদ্রভাবে বেঁচে থাকতে গেলে ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে হবে। লেখালেখির ইচ্ছেটা কখন যেন উবে গেল।

কবি-লেখকরা সে যুগে অনেক দূরের মানুষ ছিলেন। আজকের মতো সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। কলকাতার প্রকাশনা জগৎ নিয়ে বেশ কয়েকটি উপভোগ্য বই পড়েছি। বাদল বসুর ‘পিয়ন থেকে প্রকাশক’, সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের তিন খণ্ডের ‘কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর’ এবং সাগরময় ঘোষের ‘রচনা সংগ্রহ’। প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে নানা কৌতূহলোদ্দীপক কথা জেনেছি বইগুলি থেকে। এই ‘প্রতিষ্ঠিত’ সাহিত্যিকদের লেখা চালু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত, বা পুস্তকাকারে কিনতে পাওয়া যেত। উপরোক্ত বইগুলি পড়ে মালুম হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা সহজ ছিল না। উঠতি সাহিত্যিকদের বহু লেখা সম্পাদকের পছন্দ না হওয়ার ফলে প্রেস অবধি পৌঁছত না। সত্যি মিথ্যে জানি না, শুনেছি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থটি নাকি ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক পূর্বোক্ত সাগরময় ঘোষের প্রত্যাখ্যাত এক গোছা কবিতার সংকলন! এক কিংবদন্তি সাহিত্যিকের যদি এই দশা হয়, হাজার হাজার খুচরো লেখকদের পরিণতির কথা অনুমান করা কঠিন নয়। বাস্তব বড় কঠিন ঠাঁই! 

সহস্রাব্দের শুরুর দিকে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। তখনও ফেসবুকের জন্ম হয়নি, কিন্তু বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিনা খরচে নিজেদের লেখালেখি প্রকাশ করার একটা অভূতপূর্ব সুযোগ এসে গেল। ২০০৪ সালে এল ফেসবুক। আমি মোটামুটি ‘আর্লি অ্যাডপটার’দের মধ্যেই ছিলাম। সামাজিক জীবনে এই মাধ্যমটির বর্তমান প্রভাব সম্পর্কে বেশি কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের আদব কায়দার সঙ্গে পরিচিত হতে হতেই বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম, কিছু মানুষ বাংলায় পোস্ট করছেন। বিশেষ কাঠখড় না পুড়িয়েই বিদ্যেটা আয়ত্ত করে ফেললাম। শুরু করেছিলাম transliteration দিয়ে– মানে টাইপ করতাম ইংরেজিতে, সেটা ফুটে উঠত বাংলা হরফে। খটমট শব্দ (যেমন কুজ্ঝটিকা) বা যুক্তাক্ষরে কিছুটা অসুবিধা হলেও মোটামুটি সহজেই বাংলায় লেখা যেত। এখন তো স্মার্টফোনেই বাংলা কিবোর্ড ব্যবহার করে অনায়াসে বাংলা লেখা যায়। 

About-australia
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর কলমে আঁকা ছবি

এই লেখার শুরুতে কবুল করেছিলাম কবিতা লেখার ক্ষমতা নেই, কল্পনার ডানা মেলে বানানো গল্পও লিখতে পারি না। সামাজিক মাধ্যমে বছর দশেক আগে হঠাৎই কী মনে করে কিছু বাল্যস্মৃতি পোস্ট করেছিলাম। একদমই জীবন থেকে নেওয়া। অপ্রত্যাশিতভাবে বেশ কিছু ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেলাম। কয়েকজন আত্মীয়বন্ধু অনুপ্রেরণা দিলেন আরো লিখতে। সেই শুরু। তারপর থেকে লেখালেখিটা কিছুটা অভ্যাসের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। কয়েকজন পাঠক মোটামুটি নিয়মিতভাবে আমার লেখা পড়েন, মন্তব্য রাখেন ও নানাভাবে উৎসাহ দেন। 

হালে বেশ কয়েকটি পত্রিকা থেকে লেখার আমন্ত্রণ পাচ্ছি। যে ধরনের বিষয়ে লিখি সেগুলি অনেক সময়েই কিছুটা গবেষণা নির্ভর। নিদেনপক্ষে তথ্য যাচাই করে নিতে হয়– কেবল স্মৃতির উপর নির্ভর করে লেখা যায় না। তাই লিখতে লিখতে নানা বিষয়ে জ্ঞানবৃদ্ধিও হয়। গোধূলিবেলার দিনগুলি বেশ কাটছে এই নতুন নেশায়। কেবল মাঝে মাঝে হাসি পায়। নিজেকে কেঠো ইঞ্জিনিয়ার বলেই ভাবতাম বছর দশেক আগে পর্যন্ত। সেই আমিই লিখছি মনের আনন্দে!

মাসখানেক আগে বাংলালাইভ ডট কম পত্রিকার তরফ থেকে একটা কলাম লেখার আমন্ত্রণ পেলাম। বিষয়ও সম্পাদকরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমার প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা। একদিক দিয়ে লেখাটা খুবই সহজ। যা দেখেছি, যা শুনেছি, যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে তিনটি মহাদেশের ৩৫ বছর বাসের ফলে, সেগুলি ধারাবাহিক ভাবে লিপিবদ্ধ করা। অন্যভাবে দেখলে কাজটা অতটা সহজ নয়। বিগত সিকি শতাব্দতে বিশ্বায়নের প্রভাবে দূর প্রবাস মানুষের অনেক কাছে চলে এসেছে। বিদেশের কোনও ছোটখাট ঘটনারও তথ্য, ছবি ও ভিডিও টাটকা টাটকা সংবাদ তথা সামাজিক মাধ্যমে চলে আসে। অনেক পরিবারেই কেউ না কেউ বিদেশে থাকেন, তাই প্রবাসজীবন আগের মতো রহস্যময় নয় আর। সেইজন্য কিছুটা অস্বস্তি আছে, পাঠকের উৎসাহ জিইয়ে রাখতে পারব তো? 

উঠতি সাহিত্যিকদের বহু লেখা সম্পাদকের পছন্দ না হওয়ার ফলে প্রেস অবধি পৌঁছত না। সত্যি মিথ্যে জানি না, শুনেছি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থটি নাকি ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক পূর্বোক্ত সাগরময় ঘোষের প্রত্যাখ্যাত এক গোছা কবিতার সংকলন! এক কিংবদন্তি সাহিত্যিকের যদি এই দশা হয়, হাজার হাজার খুচরো লেখকদের পরিণতির কথা অনুমান করা কঠিন নয়। বাস্তব বড় কঠিন ঠাঁই ! 

অস্ট্রেলিয়ায় হেমন্তের বিদায় ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। পয়লা জুন থেকে সরকারিভাবে শীতের শুরু। অনেক গাছেরই পাতা ঝরে গেছে। বাড়ির সামনেটা বেশ বেআব্রু। লেখাটার মাঝপথে দীপেশদার ফোন পেলাম। দীপেশদা মানে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী– আমার প্রায় তিরিশ বছরের অগ্রজ বন্ধু। আপাতত ক্যানবেরায় পুত্রের কাছে আছেন। বিশ্রী মেঘলা মনখারাপ করা দিনে একটা জটিল প্রবন্ধে মনোঃসংযোগ করতে পারছিলেন না ঠিকমতো। প্রস্তাব দিলেন ঘণ্টাখানেক চা খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার। হাতে চাঁদ পেলাম। দীপেশদার মতো মজলিশী মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতে আমি সবসময়েই এক পায়ে খাড়া। 

একটা সমস্যা কেবল ভাবাচ্ছিল। লেখা শুরু করেছি, কিন্তু কলামটির কোনও জুতসই নাম মাথায় আসছিল না। কারণ কেবল নিজের অভিজ্ঞতা নয়–  যে সব দেশে বাস করেছি সেগুলির ইতিহাস, প্রকৃতি, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়েও লেখার ইচ্ছে আছে এই কলামে। ইচ্ছে আছে চলার পথে দেখা সাধারণ মানুষজনকে নিয়েও লেখার। তাই ‘প্রবাসের দিনগুলি’, ‘প্রবাসের বা প্রবাসীর চিঠি’ বা ‘প্রবাসজীবনের টুকিটাকি’ কোনও নামই মনে ধরছিল না। তাছাড়া নামগুলি এই ধরনের লেখায় বহু ব্যবহৃত। সুপণ্ডিত দীপেশদাই সমস্যার সমাধান করে দিলেন। বললেন: ‘প্রবাসীর নকশা’ কেমন? নামটির প্রেক্ষাপটও বুঝিয়ে দিলেন। এখানে ‘নকশা’ হল ‘sketch’ ওঁর মতে, যা লিখব তা হবে এক প্রবাসীর আঁকা কিছু স্কেচ। দেখা, শোনা, পড়ার ভিত্তিতে। 

নামটা মনে ধরল। তবে সহৃদয় পাঠক পাঠিরাদের কাছে অনুরোধ, লেখাগুলিকে নানা ত্রুটি সমেত অপটু হাতে আঁকা ছবি হিসাবেই ধরবেন। নিখুঁত ফোটোগ্রাফ খুঁজবেন না।

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১০ অগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Bloomberg, Studiesinaustralia
Author Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

Picture of সিদ্ধার্থ দে

সিদ্ধার্থ দে

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।
Picture of সিদ্ধার্থ দে

সিদ্ধার্থ দে

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস