আগের পর্ব পড়তে: [১]
দুপুরে সামনের বাড়ির পল্ আর ওর মা ড্যানিয়েল এসে রাজাকে পার্কে নিয়ে গেল। এ পাড়ার ছোট ছেলেগুলোর সঙ্গে রাজা বেশ মিশে গেছে। রোজই তার নতুন বন্ধু হচ্ছে। আজ ড্যানিয়েল ওকে ডিনার খাইয়ে পৌঁছে দিয়ে যাবে। মেহরীনের শরীরটা ভাল লাগছিল না। আবার বোধহয় জ্বর আসছে। একটু শুয়ে থাকতে পারত। কিন্তু দেবীর সঙ্গে কথা বলা দরকার। ওষুধপত্র খেয়ে নিয়ে দেবীকে নিজের ঘরে ডাকল।
বাইরে চড়া রোদ। আধো অন্ধকার ঘরে এয়ারকন্ডিশনারের মৃদু যান্ত্রিক শব্দ শুনতে শুনতে দেবীর মনে হল মেহরীন আন্টি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। মেহরীন বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবছিল। হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করছিল। দেবী যখন উঠে আসবে ভাবছে, মেহরীন জিজ্ঞেস করল—“তোমার মায়ের আমেরিকায় আসার ব্যাপারে বাবা কী বলেন?”
—“আগে বলেছিলেন বেশি দেরি হবে না। এখন বলছেন দু’বছর লাগবে। বেশি জিজ্ঞেস করলে রেগে যান। আন্টি, সত্যি কি মার আসতে দু’বছর লেগে যাবে?”
—“দেবী, তুমি প্লেনভাড়ার কথা বলছিলে। সেইটা কিন্তু আসল কথা নয়। প্রবলেমটা অন্যখানে। তোমার মা ট্যুরিস্ট ভিসায় বেড়াইতে আসতে পারেন। কিন্তু পার্মানেন্ট ভিসা পাইবেন না।”
দেবী অবাক—“কেন? আমরা যে চলে এলাম! বাবা স্পনসর করলে মা আর পাপুও গ্রিনকার্ড পেয়ে যাবে।”
দেবীর সহজ উত্তর শুনে মেহরীনের দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সামান্য নীরবতার পরে বলল—“তুমি আর রাজা ওর ছেলেমেয়ে। তাই গ্রিনকার্ড পাইয়া গেছ। কিন্তু তোমার মাকে উনি ওয়াইফ হিসাবে স্পনসর করতে পারবেন না। লিগ্যাল প্রবলেম আছে।”
দেবী হতবাক। বাবা কেন মাকে স্পনসর করতে পারবে না? লিগ্যাল প্রবলেমটাই বা কী? ওরা চলে এল। অথচ মা আর পাপুর বেলাতেই আমেরিকা ভিসা দেবে না? মেহরীনের কথাগুলো ও ঠিক বুঝতে পারছিল না।
মেহরীনের খুব খারাপ লাগছিল। অনিল যে কথা কোনওদিন তার দেশের ফ্যামিলিকে জানতে দেয়নি, আজ মেহরীনকে তাই বলতে হচ্ছে। দেবীর অসহায় মুখ দেখে মায়া হচ্ছিল। তবু ঘটনাটা ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। মেহরীন আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল—“দেবী, তুমি বড় হয়েছ। হয়তো অনেক কিছু বুঝতে পারো। আমেরিকায় আমি তোমার বাবার লিগ্যাল ওয়াইফ। দশ বৎসর আগে আমাদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হইছে। এখন তাঁর পক্ষে ইন্ডিয়াতে কাউকে ওয়াইফ হিসাবে স্পনসর করা সম্ভব নয়। তোমার মায়ের তো সেই লিগ্যাল স্টেটাস নাই।”
দেবীর বিশ্বাস হচ্ছিল না। বাবা মেহরীনের সঙ্গে থাকে বলে আসল বিয়েটা মিথ্যে হয়ে যাবে? মার সঙ্গে বাবার আর কোনও সম্পর্ক নেই? তাহলে বাবা কলকাতার বাড়িতে যায় কেন? মাকে টাকা পাঠায় কেন?
দেবী প্রতিবাদ করে উঠল—“আপনি যা বলছেন, বাবা কিন্তু কোনওদিন তা বলেনি। বাবা এখানে থাকলেও মার সঙ্গে রিলেশন তো রেখেছে। মা তো এসব কথা ভাবতেও পারবে না।”
মেহরীন দেবীর উত্তেজনা লক্ষ্য করছিল। এরকম যে হবে, জানতো। ও শান্তভাবে উত্তর দিল—“প্রথম বিয়েটা তোমার বাবা ভেঙে দিয়েছিলেন। দশ বৎসর আগে এখানে রেজিস্ট্রি করার সময় নিজেকে ডিভোর্সড বলেছিলেন। তখনও কিন্তু ম্যারেডই ছিলেন। পরে ইন্ডিয়ায় যাইয়া তোমার মায়েরে দিয়া পুরানো ডেট-এ ডিভোর্সের পেপার সই করাইয়া আনলেন। এগুলি তোমার জানার কথা নয় দেবী। তোমার মাও কতদূর কী জানেন বলতে পারি না।”
ঘরের ভেতর তাপহীন নিঃঝুম দুপুর। দেবী কখন উঠে চলে গেছে। মেহরীন বলেছিল—“চাইলে তোমার মায়েরে কল করতে পারো। মনের কষ্টের কথা এদেশে শোনার কেউ নাই। নিজের জীবন দিয়া বুঝছি।”
দেবী দরজার ওপার থেকে বলে গেল—“এখন ওখানে অনেক রাত। আমাদের বাড়িতে ফোনও নেই।”
পাড়ায় কোথাও আগুন লেগেছে। দূর থেকে ফায়ার ট্রাকের হর্ন, পুলিশের গাড়ির তীব্র আওয়াজ ক্রমশ কাছে আসছে। মেহরীনের শরীর মন অবসন্ন। মাথার ভেতর দেবীর কথাটা ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে চলেছে। বাবা এখানে থাকলেও মার সঙ্গে রিলেশন তো আছে।”
রিলেশন বলতে কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেল দেবী? ওর ছোটবোনের জন্মের কথাটা বোঝাতে চাইছিল? আমেরিকায় বড় হলে দেবী সেটা মুখের ওপর বলতেও দ্বিধা করত না। অনিল মেহরীনকে বিয়ে করার চার বছর বাদে কলকাতায় দেবীর ওই বোনটা হয়েছে। যত অবহেলাই করুক, আগের সংসার তো অনিল ছাড়ল না। বউকে বলার সাহস হল না। আমি আর তোমার স্বামী নই। সে সম্পর্ক কাগজে-কলমে চুকিয়ে দিয়েছি। আজ মেহরীন সেটাই দেবীকে জানিয়ে দিল। তার জন্যে বাড়িতে অশান্তি হয় তো হোক। তবু মেয়ের সঙ্গে বাবার বোঝাপড়া হয়ে যাক। দেবীকে যত নরম-সরম মনে হয়েছিল, তা নয়। মায়ের জন্যে যেভাবে রুখে দাঁড়াল। কিন্তু কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে? অনিল হয়তো ওকে ইন্ডিয়াতেই পাঠিয়ে দেবে। সেই সম্ভাবনার কথা ভেবে মেহরীনের মন খারাপ লাগছিল। দেবীর কতই বা বয়স? তবু কীভাবে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে শিখে গেল। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। লোভ নেই, প্রত্যাশা নেই, অযথা কৌতূহল নেই। মেয়েটার এত গুণ, তবু অনিল ওকে বেশ শাসনে রাখতে চেষ্টা করে। আজকের ঘটনার জের কোথায় পৌঁছবে কে জানে? মেহরীন ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠা বোধ করছিল।
সন্ধের আগে রাজা ফিরে এল। বিকেলে কমিউনিটি পুলে সাঁতার কেটে পলের বাড়িতে ডিনার খেয়েছে। কাল থেকে সামার স্কুল। আবার পড়াশোনা মেক-আপ করতে হবে। ওদের বাড়ির কাছাকাছি একটা মুভি থিয়েটার আছে। দেবী ওকে মুভি দেখতে নিয়ে যাবে বলেছিল। কিন্তু রাজা বাড়ি এসে দেখলে দিদির মুড খুব খারাপ। ঘরে দরজা বন্ধ করে বসেছিল। রাজা ঢুকতেই রাগ রাগ গলায় জিজ্ঞেস করল—“বাবা ফিরেছে?”
—“এখনও আসেনি।”
—“এলে আমাকে ডাকবি না। খেতেও ডাকবি না।”
দেবীর স্বর কান্নায় বুঁজে আসছিল। রাজার মনে হল দিদি অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। ও তো সহজে কাঁদে না। শুধু বাবা যেদিন বলল মা আর পাপুকে এখন আনবে না, সেদিন রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে রাজা দিদির চোখে জল দেখেছিল। আজ আবার কী হল? মেহরীন আন্টি কি মুভি দেখতে যেতে দেবে না বলেছে?
প্রশ্নটা করতে গিয়ে রাজা দেবীর কাছে ধমক খেল—“সারাদিন শুধু হুজুগ। খুব মজায় আছিস না? যা, আমাকে ডিসটার্ব করবি না। আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনিবডি টু কাম…” রাজা থতমত খেয়ে দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে এল।
অনিল বাড়ি ফেরার পর মেহরীন যে অশান্তির ভয় পাচ্ছিল, দেবীর ব্যবহারে তার কোনও আভাস পাওয়া গেল না। সে নিজে থেকেই খাবার টেবিলে এসে বসল। মেহরীন আর রান্না করে উঠতে পারেনি। পাড়ার চীনে দোকান থেকে রাতের খাবার ডেলিভারি দিয়ে গেছে। রাজা আবার লোভে লোভে ডিনার খেতে বসল। দেবী থমথমে মুখে খাবার নাড়াচাড়া করছিল।
অনিল জিজ্ঞেস করল—“ঠিক করে খাচ্ছিস না কেন? চাইনিজ ভাল লাগল না?” দেবী উত্তর দিল না। প্লেট, কাঁটাচামচ তুলে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
অনিলের রাগ হচ্ছিল। মেয়েটা এত জেদি কেন? আজকাল কথায় কথায় মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। একটা কথার উত্তর দিতে কী হয়? অনিল হঠাৎ গলা চড়িয়ে ডাকল—“দেবী, এদিকে আয়। হলোটা কী?”
মেহরীন বাধা দিল—“থাক না। হয়ত শরীর ঠিক নাই। জোর কইরেন না। কাল সকালে স্কুল আছে।”
পাড়ায় কোথাও আগুন লেগেছে। দূর থেকে ফায়ার ট্রাকের হর্ন, পুলিশের গাড়ির তীব্র আওয়াজ ক্রমশ কাছে আসছে। মেহরীনের শরীর মন অবসন্ন। মাথার ভেতর দেবীর কথাটা ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে চলেছে। বাবা এখানে থাকলেও মার সঙ্গে রিলেশন তো আছে।” রিলেশন বলতে কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেল দেবী? ওর ছোটবোনের জন্মের কথাটা বোঝাতে চাইছিল? আমেরিকায় বড় হলে দেবী সেটা মুখের ওপর বলতেও দ্বিধা করত না। অনিল মেহরীনকে বিয়ে করার চার বছর বাদে কলকাতায় দেবীর ওই বোনটা হয়েছে। যত অবহেলাই করুক, আগের সংসার তো অনিল ছাড়ল না। বউকে বলার সাহস হল না আমি আর তোমার স্বামী নই।
রাজা ভয়ে ভয়ে খবর দিল—“দিদি কাঁদছিল। বলছিল, কলকাতায় চলে যাবে। পরে বলল নেক্সট ইয়ারে যাবে। আমি ‘থার্ড অফ দ্য রিং’ দেখব ভেবেছিলাম। রাগ করে নিয়ে গেল না।”
অনিল মেহরীনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল—“তুমি আজ বাড়িতে ছিলে তো? কখন থেকে রাগারাগিটা হল?”
মেহরীন রুক্ষ গলায় জবাব দিল—“আমার সঙ্গে আপনার মেয়ের কোনও ঝগড়া নাই। কার উপর অভিমান কইরা আছে, নিজে বুঝেন না? সামান্য কারণে মাথা গরম করেন। মেয়েটার মন বুঝার চেষ্টা করেন। বয়সটা ভাল নয়।”
মেহরীন আর কথা বাড়াতে দিল না। খাওয়ার পরে রাজাকে শুতে পাঠিয়ে দিল। রাত দশটা নাগাদ টিভির খবর শুনতে শুনতে অনিল টের পেল মেহরীন দেবীর ঘরে ঢুকেছে। একটু পরে দুজনে কিচেনে গেল। ফ্রিজ বন্ধ করার শব্দ, মাইক্রোওয়েভের আওয়াজ। তার মানে দেবীর জন্যে আবার খাবার গরম করা হচ্ছে। অনিল আর আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে না। মেহরীন লেকচার মেরে গেল মেয়েটার মন বোঝার চেষ্টা করেন। দেবীর মন কী চাইছে, অনিল কি তা বোঝে না? কিন্তু সত্যি যদি জবাকে এখানে এনে হাজির করে, মেহরীন সহ্য করবে? শুধু থিয়েটারের ডায়ালগ ঝেড়ে যাচ্ছে। নিজের ছেলের কাছে শিখছে বোধহয়। সে তো আবার নাট্যকার! ভাগ্যিস অনিল চাপ দিয়ে সোহেলকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ড্রামা নিয়ে পড়তে দেয়নি। তখন সায়েন্স পড়েছিল বলে, পাশ করে পাওয়ার কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল। সোহেলের ব্যাপারে মেহরীন অন্ততঃ একথাটা স্বীকার করে।
বসার ঘরে টিভির রিমোট, ঘরের আলো পটাপট নিভিয়ে দিতে দিতে মেহরীন প্রায় হুকুমের গলায় বলল—“আর নয়। অনেক রাত হইছে। শুইতে আসেন। কাল আমারে তাড়াতাড়ি দোকানে যাইতে হবে। ফারুক যে কী করতেসে, আজ মাল ডেলিভারি হয় নাই।”
অনিল হাই তুলে বলল—“বামুন গেল ঘর, তো লাঙল তুলে ধর। তুমিও তো এখন বামুন? মেহরীন চক্রবর্তী।”
মেহরীন হাসল—“আমার নিজেরই খেয়াল থাকে না। আপনার পদবীটা আমার প্রয়োজনও ছিল না। এখনও সেই আজম্ লিখি।”
মেহরীন কি অনিলকে বিদ্রূপ করে গেল? অনিলের পরিচয়ে ও আমেরিকায় আসেনি। ঢাকা থেকে আসিফ আজমের বউ হয়ে এসেছিল। এখনও সেই পরিচয়টাই ধরে রেখেছে। আর, ওই প্রয়োজনের কথাটা ইচ্ছে করে বলে গেল। অনিল ওকে বিয়ে করে গ্রিনকার্ড পেয়েছিল। অনিলকে অপমান করার জন্যে ওই একটা কথাই অনেক।
অনিলের কান, মাথা গরম হয়ে উঠছিল। নেহাত ছেলে, মেয়ে দুটো বাড়িতে আছে। নয়তো অনিলও চুপ করে থাকত না। আর এখন তো ওরা যেন মেহরীনেরই দলের লোক।
—“অন্ধকার ভূতের মতো বইসা আছেন! এত রাগ কীসের? ঘরে চলেন।”
মেহরীনের কথায় দুজনে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। রাত ঘন হয়েছে। জানলার ব্লাইন্ডস-এর ফাঁকে স্ট্রিট লাইটের অস্পষ্ট আলোর উঁকিঝুঁকি। একরাশ খোলা চুলে শ্যাম্পুর মৃদু গন্ধ নিয়ে মেহরীন কাছে এসেছে। শরীর ঘিরে আলো-আঁধারির মায়া। অনিল মুহূর্তের মধ্যে ওকে কাছে টেনে আনল। আহত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল—“বারবার শুধু আমার স্বার্থ আর প্রয়োজনের কথাটা বলো। সেদিন তোমার কোনও প্রয়োজন ছিল না? সোহেলের তখন তেরো বছর বয়স। আমি তোমাদের জন্যে কিছুই করিনি?”
অনিলের উত্তেজনা, অভিমান মেহরীনকে স্পর্শ করল। দেবীর ঘরের দরজার দিকে খেয়াল রেখে, সে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছিল। অনিলের বুকে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল—“আমি তো কেবল আপনার পদবী নিয়া রসিকতা করছিলাম। সেদিনের প্রয়োজনের কথা যদি বলেন তখন কিন্তু আমার চাইতে আপনার তাগিদই বেশি ছিল। আজ আর তা বুঝি না…।”
—“সব সময় এক কথা। আর কি চাও তুমি?” অনিলের উদ্ধত ভঙ্গি দেখে মেহরীন থমকে গেল। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে—“আমি চাই আপনি ছেলেমেয়েকে সত্য কথা বলেন। কেন তাদের মায়েরে ডিভোর্স করছিলেন, সে কথা ওদেরও জানা দরকার। কেন ওদের মিথ্যা আশা দেন?”
অনিলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। মেহরীন ঘর ছেড়ে চলে গেছে। দেবীর ঘরের দরজা খোলার শব্দ হল। দেবী, রাজা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে।
আপাতদৃষ্টিতে একদিনের অশান্তির ঢেউ এক সপ্তাহেই মিলিয়ে গেল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চারজনের বাঁধাধরা রুটিন। স্কুল ছুটির পরে রাজা আর দেবী অনেকক্ষণ বাড়িতে থাকে। অনিল ফেরে প্রায় সাতটায়। মেহরীন সারাদিন জ্যাকসন হাইটস্-এর দোকানে।
ওই রাতের ঝগড়ার পর অনিল বেশ সতর্ক হয়ে আছে। মেহরীনের সঙ্গে মিটমাট করে নিয়েছে। দেবী কিন্তু ওর কাছে কিন্তু জানতে চায়নি। সে এক রকম সোয়াস্তি। কিন্তু কলকাতায় নিজের মাকে কিছু জানিয়েছে কিনা কে জানে? এমনিতে অনিল দরকারি কথা ছাড়া জবার সঙ্গে ফোনে বেশি কথাবার্তা বাড়ায় না। মাসে দু-একবার ওদের পাশের বাড়িতে ফোন করলে জবাকে ডেকে দেয়। অন্যসময় জবা ফোনবুথ থেকে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলে। অনিলের সঙ্গে জবার সম্পর্ক ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। দীর্ঘদিন জবা বিচ্ছিন্ন জীবনে অভ্যস্ত। তবু ডিভোর্সের খবর পেলে কী ঘটবে বলা যায় না। হয়তো ছেলেমেয়েকে ফিরিয়ে নিতে চাইবে। কিন্তু ওরা যেতে না চাইলে অবশ্য জবা কিছু করতে পারবে না। আইনের ব্যাপার-স্যাপার জীবনে অনেক মোকাবিলা করেছে। তবু, অশান্তি এড়াতে পারলেই ভাল।
মেহরীন ভেবেছিল, দেবী এবার সাহস করে বাবার কাছে পুরনো ঘটনা জানতে চাইবে। মেয়েটা বোধহয় ভয় পাচ্ছে। নিজের ভবিষ্যৎ, রাজার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপস করে নিচ্ছে। ওদের জীবন যে বদলে যাচ্ছে, সে তো সত্যি। এ বাড়িতে মা না থাক, সচ্ছলতা আছে, নিরাপত্তা আছে। কেউ দুর্ব্যবহার করে না। দেবী হাইস্কুল পাশ করে আমেরিকায় কলেজে পড়বে। গান শিখছে। সাঁতার শিখেছে। এরপর ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে। গাড়ি চালাবে। এদেশে থাকতে গেলে নিজেকে তো তৈরি করা দরকার। ওরা সে সুযোগও পাচ্ছে। এর মধ্যে নিজের মাকে আনার জন্যে জেদ ধরলে, দেবী বোধহয় অশান্তির ভয় পাচ্ছে। দেবী একদিন মেহরীনকে বলেও ছিল—আগে তো জানতাম না মার ভিসার প্রবলেম হবে। তাই আপনাকে প্লেনভাড়ার কথা বলেছিলাম। এখনও বুঝতে পারছি না বাবা মাকে ডিভোর্স করল কবে? মা তো কোর্টেও যায়নি।
মেহরীন প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে ইতস্তত করেছিল, একদিন ওর ছেলে সোহেলের কাছে দেবী তার উত্তর পেল। সোহেল নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে থাকে। পাওয়ার কোম্পানির নতুন চাকরি আর নাটকের দলে ঢুকে তার সময়ের খুব টানাটানি। এ বাড়িতে কমই আসে।
মাঝে মাঝে মার সঙ্গে দেখা করতে উইক এন্ডে জ্যাকসন হাইটস্-এর দোকানে এসে হাজির হয়। এরকম এক শনিবারের দুপুরে “কবুতর হালাল ‘মীট’, গ্রোসারী স্টোরে” সোহেলের সঙ্গে দেবীর প্রথম দেখা হয়েছিল। দেবী মেহরীনের শোবার ঘরের টেবিলে সোহেলের ছবি দেখেছিল। সামনে দেখে মনে হল সোহেল ছবির চেয়ে বেশি সুন্দর। মেহরীন আন্টির সঙ্গে মুখটা মেলে। কি লম্বা! দেবীর সঙ্গে প্রথম আলাপেই ঠাট্টা শুরু করল—“উইক এন্ডে এটা তোমার বেড়ানোর জায়গা? মা লইট্যা শুঁটকি সেল করতে বসিয়ে দিয়েছে?”
মেহরীন হেসে উঠল—“ফাইজল্যামি করস্ না। দেবী তো গানের স্কুল ফেরৎ নিজেই এখানে আসছে।”

সোহেল উৎসাহ দেখালো—“গানের স্কুল? ভাল গান করো নাকি?”
দেবী লজ্জা পাচ্ছিল—“না, না। মেহরীন আন্টি ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। জাস্ট কয়েক মাস হল শিখছি।”
সেদিন মেহরীনের কথায় সোহেল দেবীকে বাইরে লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। এ বাড়িতে রোজ মাছ-মাংস খাওয়া। দেবীর মাঝে মাঝে দোসা খেতে ইচ্ছে করে। একা একা আর কোথায় খেতে যাবে। সোহেল যখন রেস্টারেন্টের কথা জিজ্ঞেস করল দেবী বলেছিল—“আপনি সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার লাইক করেন? তাহলে উডুপীতে যেতে পারি।”
—“সেই জয়কিষণ হাইটস্-এর দোসা আর বড়া? নাকি ম্যানহ্যাটনে যাবে? লাঞ্চের পরে আমার সঙ্গে ব্লিকার স্ট্রিটে নাটকের রিহার্সালেও যেতে পার।”
দেবী মাথা নাড়ল—“আজ বেশি সময় নেই। এখানেই কোথাও চলুন।”
উডুপীতে বসে দোসা খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। সোহেলের বাংলা উচ্চারণে ওর মার মতো কোনও বাঙ্গাল টান নেই। সারাক্ষণ ইংরিজিও বলে না। অনেকদিন পরে দেবী কারওর সঙ্গে একটানা বাংলা বলার স্বাধীনতা উপভোগ করছিল। সোহেল জানতে চেয়েছিল আমেরিকার দেবীর কেমন লাগছে। স্কুলে বন্ধু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করায় দেবী ন্যান্সি, কার্লিন আর প্যাট্রিশার কথা বলেছিল।
সোহেল একবার কলকাতার খবর জিজ্ঞেস করল। দেবী প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েছিল। কী লাভ? ওর নিজের বাবাই ওদের মনের কষ্ট বুঝছে না। বাইরের লোককে জানিয়ে কী হবে? মার পক্ষে ব্যাপারটা এত অপমানের যে, কারওর সঙ্গে আলোচনা করতেও ইচ্ছে করে না। দেবী বলেছিল—“কলকাতার জন্যে মন কেমন করবে না? আমি তো আপনার মতো এদেশে বড় হইনি। ওখানে আমার কত বন্ধু ছিল। এখনও কয়েকজনকে চিঠি লিখি। মুশকিল হচ্ছে, ওদের কারওরই ই-মেল অ্যাড্রেস নেই।”
সোহেল কফির কাপ নামিয়ে রাখল—“আমার ই-মেল অ্যাড্রেসটা রেখে দাও। কোনও দরকার হলে কনট্যাক্ট কোর। চলো, ওঠা যাক। সময়মতো রিহার্সালে পৌঁছতে হবে।”
—“কী থিয়েটার করছেন আপনারা?”
—“পাঞ্চিং অ্যাট দ্য সান। পাকিস্থানী ইমিগ্র্যান্ট ফ্যামিলির স্টোরি। আমাদের জেনারেশনেরই একটা সেকশন কিভাবে বড় হচ্ছে, তাদের হার্ডশিপ, সোশ্যাল আইডেনটিটি ক্রাইসিস, ফ্রাস্ট্রেশন নিয়ে লেখা।”
দেবী যে খুব মন দিয়ে শুনছিল তা নয়। এটুকু বুঝতে পারছিল, সোহেল বেশ ব্যস্ত লোক। তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে উঠে পড়ল। দেবীকে সাবওয়ে স্টেশনের সিঁড়ির মুখে হাত নেড়ে সোহেল নীচে নেমে গিয়েছিল।
দেবী একটু দাঁড়িয়ে থেকে দোকানের দিকে হাঁটতে লাগল। সোহেল ওকে ‘আপনি’ বলতে বারণ করেছে। নাম ধরে ডাকতে বলেছে। সোহেল ওর চেয়ে অনেক বড়। দেবী কি নাম ধরে ডাকবে? নাকি সোহেল ভাই বলবে? বাংলাদেশি আর গুজরাটিরা খুব ভাই ভাই করে। কিন্তু ও হঠাৎ সোহেলভাই ডাকতে যাবে কেন? সম্পর্কটাই বা কী? সোহেল কি ওর স্টেপব্রাদার? কিন্তু ওদের বাবা কিংবা মা, কেউ তো এক নয়? দেবীর হঠাৎ হাসি পেল। কলকাতায় থাকতে “সৎ ভাই” নামে একটা বোকা বোকা বাংলা সিনেমা দেখেছিল। সোহেল মোটেই ওর সৎ ভাই নয়। দাদা, ভাই কেউ নয়। পথে যেতে যেতে দেবী নিঃশব্দে উচ্চারণ করল—সোহেল, সোহেল…
বছর ঘুরে গেল। আবার শীতকাল। ক্রিসমাসের কদিনের ছুটি। পরপর দুদিন বরফ পড়ল। টিভিতে শহরতলির যা অবস্থা দেখাচ্ছিল, কুইনস্-এর রাস্তাঘাটে অতক্ষণ বরফ জমে থাকল না। রাজারও আর বরফ নিয়ে খেলার বয়স নেই। একদিন বিকেলে দেবী আর রাজা রকিফেলার সেন্টারে আইসস্কেটিং রিংকে গেল। রাজা দু’হাত ডানার মতো ছড়িয়ে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত স্কেটিং করছিল। ওর বেশ প্র্যাকটিস আছে। দেবী পায়ের চাকা উল্টে দুবার বরফে আছাড় খেল। এরপর হাত-পা ভাঙলেই হয়েছে! রাজাকে তাড়া দিয়ে খানিকক্ষণ বাদে দুজনে বড় রাস্তায় উঠে এল। কনকনে হাওয়ায় প্রচণ্ড শীত ধরে গেছে। ভেন্ডারের ঠেলাগাড়ি থেকে গরম প্রেটজেলের ধোঁয়াটে গন্ধ ভেসে আসছে। ওপারে দাঁড়ানো চশমা পরা মোটা স্যান্টাক্লজ। সাদা দাড়ি হাওয়ায় উড়ছে।
দেবী চলমান জনস্রোত দেখছিল। কত ছেলেমেয়ে দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে। দেবীর কোনও দল নেই। স্কুলের দু-তিনটে বন্ধু ক্রিসমাস নিয়ে ব্যস্ত। তারা রোজ রোজ মার সঙ্গে শপিং-এ যাচ্ছে। আত্মীয়দের বাড়ি নেমন্তন্নে যাচ্ছে। ন্যান্সিরা রেডিও সিটি মিউজিক হলে ‘শো’ দেখে এল। দেবীর কোথাও যাওয়ার নেই। চার্চের ঘণ্টার শব্দ, স্কেটিং রিংকের বাজনার গমগমে আওয়াজ ছাপিয়ে রাজার কথা শুনতে পেল—“দুটো ক্রিসমাস চলে গেল। মা এখনও আসতে পারল না। পাপুকে কতদিন দেখিনি। তোর কি মনে হয় নেক্সট সামারে ও আমাদের ইন্ডিয়া যাওয়া হবে না?” দেবী উত্তর দিল—“বাবা এখন তো হ্যাঁ বলছে। দ্যাখ্, শেষ পর্যন্ত কী করে? না হলে মেহরীন আন্টি আর সোহেল আমাদের দুজনের প্লেন-ফেয়ার দেবে বলেছে। কে জানে? ওরা বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে পারবে নাকি?”
দেবী রাজার জ্যাকেটের কোণা ধরে হাঁটছিল। সন্ধে হয়ে গেছে। মাথার ওপর বরফের ঝিরঝিরে বৃষ্টি। দেবী প্রেটজেল খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল—“সেন্ট প্যাট্রিকস্ চার্চে যাবি? কোনওদিন তো ভেতরে যাইনি।”
দেবী একটু দাঁড়িয়ে থেকে দোকানের দিকে হাঁটতে লাগল। সোহেল ওকে ‘আপনি’ বলতে বারণ করেছে। নাম ধরে ডাকতে বলেছে। সোহেল ওর চেয়ে অনেক বড়। দেবী কি নাম ধরে ডাকবে? নাকি সোহেল ভাই বলবে? বাংলাদেশি আর গুজরাটিরা খুব ভাই ভাই করে। কিন্তু ও হঠাৎ সোহেলভাই ডাকতে যাবে কেন? সম্পর্কটাই বা কী? সোহেল কি ওর স্টেপব্রাদার? কিন্তু ওদের বাবা কিংবা মা, কেউ তো এক নয়?
রাজা রাজি হল না। ওরা সাবওয়ে দিয়ে কুইনস্-এ ফিরে গেল। বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেবী যেন চেনা গলার আওয়াজ শুনল। ডোরবেল বাজাতে দরজা খুলে দিল সোহেল। লাল সোয়েটার পরলে ফর্সা ছেলেদের খুব হ্যান্ডসাম লাগে। দেবীর মনে হল ভাগ্যিস ওরা চার্চে গিয়ে বসেনি। তাহলে হয়ত আর সোহেলের সঙ্গে দেখা হত না। সারাদিনের একঘেয়েমি, একাকিত্বে পরে এমন কেউ বাড়িতে এসেছে, যাকে দেখলে দেবীর মন ভাল হয়ে যায়। আজ সোহেল কি অনেকক্ষণ থাকবে?
টেবিলে কয়েকটা ক্রিসমাসের উপহারের বাক্স। অনিল গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছে। ওদের দেখে ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল—“কখন বেরিয়েছিলে? এত ঠাণ্ডায় বাইরে ঘুরছ। অসুখ বাধাবে নাকি?”
দেবী কাঁধ নাচালো—“কি আবার হবে? বাড়িতে ভাল লাগছিল না। তাই ঘুরে এলাম?” সোহেল তুমি কখন এলে?”
—“কখন এলাম? আধঘণ্টা হবে। মার সঙ্গে দেখা করে যাব।”
ঠিক তখনই মেহরীন বাড়ি ঢুকল। মাথায় জড়ানো কালো স্কার্ফের ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা বরফ। ওভারকোট খুলতে খুলতে হাসি মুখে বলল—“আজ যে দেখি হাউস ফুল! আমি আরও আগেই আসতে পারতাম। রাস্তাঘাটে কি ভিড়!”
সোহেল হঠাৎ মেহরীনকে জড়িয়ে নেচে নেচে গান ধরল—
মাইসোর মসালা, শাহীনের রেজালা
বাবা বিশ জর্দা, মরে কাঠ পাবদা
অপূর্ব গিরিজা শাড়ি কিনে বাড়ি যা
লইট্টা শুঁটকি, শাহী পান, ভেটকি
লইট্টা শুঁটকি, গুটখা গুটখি…
রাজা আর দেবী হেসে অস্থির। মেহরীন ছেলেকে ঠেলে দিয়ে বলল—“নাটক কইরা মাথাটা গ্যাছে? এইটা তোদের নাটকের গান নাকি?”
সোহেল হাসল—“এটা তোমাদের জয়কিষণ হাইটস্-এর টাইটেল সং। সব দোকানীরা মিলে প্যারেডের দিন গাইতে গাইতে যাবে।”
রাজাও মজা পেয়ে কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে গাইতে শুরু করল—“লইট্টা শুঁটকি, গুটখা গুটখি…।”
—“তোরা কেবল শুঁটকি আর ভেটকি দেখিস! ভাল নামগুলি দেখিস না? একটা বাংলা বই-এর দোকান খুলসে। নাম দিসে—‘ভাতার জন্য ভালোবাসা’। দোকানে সারাদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজায়।”
দেবী আর রাজার জন্যে সোহেল দুটো ক্রিসমাস গিফট এনেছে। ওদের একটু খুলে দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল। অনিলের মেজাজ বুঝে সাহস পেল না। আজ সন্ধ্যে থেকে তার রাগ রাগ ভাব। রাগটা দেবীদের ওপরে না সোহেলের ওপরে, দেবী বোঝার চেষ্টা করছিল।
ডিনার খেতে বসে অনিল রাজাকে লেখাপড়ার জন্যে লম্বা লম্বা উপদেশ দিচ্ছিল। যেন দেবীর চেয়ে রাজাই আগে কলেজে যাবে! রাজা এখনও হাইস্কুলে পৌঁছয়নি। ক্রিসমাসের ছুটিতে এত পড়াশোনার কি আছে? হোমওয়ার্কও থাকে না।
রাজা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিল। মেহরীন ওর প্লেটে বিরিয়ানি দিতে দিতে বলল—“ছুটি তো ছুটির জন্যই। ক্লাস শুরু হইলে, তখন আর সময় পায় কোথায়?”
—“অত সময় দিয়ে হবেটা কী? হাইস্কুলে ভাল গ্রেড না পেলে, স্যাট্-এর রেজাল্ট খারাপ হল কোন কলেজে ঢুকবে? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এদেশে নিয়ে এসেছি। রাজাকে সেটা বুঝতে হবে।”
সোহেল দুম করে বলে বসল—“রাজাকে মানে? দেবীকে কলেজে পড়াবেন না? ওর গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজও ভাল হওয়া দরকার। দেবী, স্যাট্-এর জন্যে কোচিং নিও। ক্যাপল্যান থেকে কোচিং ক্লাস হয়।”
দেবী বুঝতে পারছিল সোহেলের কথাগুলো বাবার পছন্দ হচ্ছে না। ঘরে ফোন বাজছিল। মেহরীন বিরক্ত মুখে রান্নাঘরে গিয়ে ফোন ধরল। অনিল ঠক্ করে জলের গেলাস টেবিলে রেখে সোহেলকে বলল—“এখন কলেজ টিউশন কত বেড়ে গেছে জানো? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? দুজনেক পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়. আই ক্যান্ট অ্যাফোর্ড দ্যাট।”
—“সো, ইউ আর গোইং টু ডিপ্রাইভ দেবী?”
অনিল চিৎকার করে উঠল—“দেন, হোয়াই ডোন্ট ইউ হেলপ মি? টেক্ সাম্ ফাইন্যান্সিয়াল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড…”
মেহরীন প্রায় ছুটে এল—“না। সোহেলের কোনও দায় নাই। আপনি ওরে কলেজে পড়ান নাই। নিজে লোন নিয়া পড়ছিল। বাকি খরচ আমি দিসিলাম।”
সোহেল উঠে দাঁড়িয়ে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল—“প্লিজ, তোমরা ঝগড়া বন্ধ করো। আমি বাবুজীর ডিফিকাল্টি বুঝতে পারছি। আমার কমেন্ট করা ঠিক হয়নি। দেবী, আ অ্যাম রিয়েলি সরি…”
দেবী মাথা নিচু করে বসেছিল। সোহেলের এত খারাপ লাগছিল। অনিলের দুর্ব্যবহারের জন্যে তো বটেই, সোহেলের আরও রাগ হচ্ছিল নিজের মার অ্যাটিচিউড দেখে। কিভাবে কিচেন থেকে ছুটে এল! সোহেলের কোনও দায় পড়েনি বলে শুধু শুধু মেয়েটাকে অপমান করল। অথচ ও মাকে কত রেসপেক্ট করে। মা নিজেই সে-কথা বলেছে। আজ আর সে কথা ভাবল না। এখন শোবার ঘরে গিয়ে গুম হয়ে বসে আছে! সোহেল একটা বয়সে বাড়িতে অনেক ঝগড়া, অশান্তি দেখেছে. আজকাল বিরক্ত লাগে। বিশেষ করে ক্রুয়েলটি ব্যাপারটা সহ্য করা যায় না। দেবীর সঙ্গে অনিল সেরকমই করছে। নিজের বাবা কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? দেবীর জন্যে সত্যিই ওর দুঃখ হচ্ছিল।
সোহেল রান্নাঘরে গিয়ে দেখল দেবী বাসনপত্র ধুয়ে রাখছে। ওকে দেখে কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল—“মেহরীন আন্টি কি শুয়ে পড়েছেন? খুব রেগে গেছেন না? বাবা যে কেন তোমার কাছে কলেজের টাকা চাইতে গেল।”
সোহেল দেবীর পিঠে হাত রাখল—“ফরগেট অ্যাবাউট ইট। তুমি কলেজে ফাইন্যান্সিয়াল এইড-এর জন্যে অ্যাপ্লাই করবে। ইনফ্যাক্ট, আমি সেটাই বলতে চাইছিলাম।”
“প্লিজ ডোন্ট ট্রাই টু ডু দ্যাট। আমি এখানে থাকব কিনা তারই ঠিক নেই। হাইস্কুল শেষ হলে ফিরে যাব ভাবছি।”
—“তোমার পড়াশোনার কী হবে?”
—“ওখানে পড়ব। টিউশন করে খরচ চালাব। কলকাতার কলেজে তো হাজার হাজার ডলার লাগবে না।”
ওদের কথার মাঝখানে মেহরীন রান্নাঘরে এল। সোহেলকে বলল—“ওয়েদার ভাল না। বরফ নেমে এখন আবার বৃষ্টি নামছে। আজ আর ব্রুকলিনে যাস না।”
সোহেল একটু পরেই বেরিয়ে পড়ল। কাল সকালে উঠে অফিস আছে। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে না ফিরলে অসুবিধা হয়।
মাঝে মাঝে উইক-এন্ডে সোহেলের সঙ্গে দেবীর দেখা হয়। একদিন মেহরীনের সঙ্গে দেবী আর রাজা ডাউন টাউনের ছোট থিয়েটার হলে গিয়ে সোহেলদের ইংরিজি নাটক দেখে এল।
এভাবেই দেখাশোনা হতে হতে দেবী একদিন সোহেলের কাছে ওর বাবার পুরনো ঘটনাগুলো শুনছিল। নতুন করে আর কত দুঃখ হবে? তবু নিজের বাবার ওপরে বিতৃষ্ণা যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল। দূর থেকে মাকে সব কথা জানানো যায় না। কলকাতা যাওয়ার জন্য মন অস্থির হচ্ছিল।
তিন বছর পর গরমের ছুটিতে দেবী রাজাকে নিয়ে কলকাতায় এল। মা আর পাপুকে কাছে পাওয়ার আনন্দ, ঠাকুমার আদর, কৃত্তিবাস লেনের পুরনো বাড়িটার উঠোনে সন্ধেবেলায় বেলফুলের চেনা গন্ধ—দেবী যেন স্বপ্ন দেখছিল। প্রথম ক’দিন প্রায় ঘোরের মধ্যে কাটল। দেবী মাকে একটু একা পাওয়ার চেষ্টা করছিল। বুকের ভেতর অনেক কথা জমে আছে। তিন বছরের অজস্র মুহূর্তের অনুভূতি। যা শুধু মাকেই বলা যায়।
জবা ক’দিন টেলারিং শপ থেকে ছুটি নিয়েছিল। ছেলেমেয়েদের জন্যে নানারকম রান্না করছে। সময়-অসময় নেই, পাড়ার লোকজন আত্মীয়স্বজন চলে আসছে। জবাকে নিরিবিলিতে একা পেতে হলে সেই রাত দশটা। কখনও দুপুরের অবকাশে, কখনও রাতের নির্জনতায় দেবী মাকে পুরনো ঘটনাগুলো বলেছিল। ওর ধারণা, মা হয়তো অনেক কিছুই অনুমান করে। তবু, সব কথা তো জানে না।
দেবী জিজ্ঞেস করেছিল—“বাবা কেন নিউইয়র্কে আবার বিয়ে করেছিল তুমি কিছু জানো? কী বুঝিয়েছিল তোমাকে?”
—“বিয়ের কথা তো পুরো অস্বীকার করে গেছে। বলত মুসলমান বিয়ে করে ধর্ম ছাড়ব নাকি? ওকে মিসট্রেস রেখেছি।”
দেবী প্রতিবাদ করে উঠল—“মেহরীন আন্টি ওরকম মানুষ নয়। বাবা বিয়ে করতে চেয়েছিল বলে রাজি হয়েছিল। তখন দু’বছর হল ওর হাজবেন্ড মারা গেছে। সোহেলকে নিয়ে একাই থাকত। জ্যাকসন হাইটস্-এর জুয়েলারি স্টোরে চাকরি করত।”
জবা বিদ্রূপের ভঙ্গিতে বলল—“হ্যাঁ, তারপরেই আমার সংসার ভাঙলো! অত বড় ছেলে নিয়ে একটা লোকের সঙ্গে থাকতে লজ্জাও হল না!”
দেবী একটু চুপ করে থেকে বলল—“মেহরীন আন্টি তখন উইডো। কিন্তু বাবা কী করে পারল? আসলে বাবা তখন জাহাজ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ভিসা নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে বাংলাদেশী রেস্টোরেন্টে কাজ করত। ধরা পড়লে ডিপোর্টেশন। গ্রিনকার্ড পাওয়ার জন্যে প্রথমে একজন পর্টুরিক্যান মেয়েকে অ্যাপ্রোচ করেছিল। তাকে পাঁচ হাজার ডলার দিতে হবে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ-এর পরে দু’বছর একসঙ্গে থেকে সে বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। ইমিগ্রেশন পাওয়ার জন্যে কয়েকজনের বুদ্ধিতে বাবা সেই প্ল্যানই করেছিল। কিন্তু পাঁচ হাজার ডলার পাবে কোথায়? বিয়েটা হল না।”
আগামী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৪ মার্চ ২০২৩।
ছবি সৌজন্য: Flickr
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।