৬ই জুন, ২০২৩। নিউ ইয়র্ক শহর। সন্ধে হতে তখনও বেশ বাকি। অফিস-ফেরত মানুষের চোখে বিস্ময়। আকাশ কালো, গগনচুম্বী ঝকঝকে বাড়িগুলো যেন ধূসর ছবি। কিছুক্ষণ আগের গনগনে সূর্য যেন আকাশের গায়ে একটা লাল বিন্দু। এরকম কিছু তো আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ছিল না। কিছু মানুষ দেখি আড়চোখে নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দিকে দেখছেন। একে রাশিয়ার যুদ্ধ। তার ওপরে চিনের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। আমার কলকাতাবাসী মন অবশ্য বলছে, এ নিশ্চয়ই কালবৈশাখী, যথারীতি গুলিয়ে ফেলেছে এদের আলিপুর অফিস। কিন্তু বাতাসে এত পোড়া পোড়া গন্ধ কেন? কোনওক্রমে পাতাল রেলে বাড়ি ফিরে টিভি খুলে বসে পড়লাম। আসল কারণ বলছে দাবানল। তাও নিউ ইয়র্ক থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো মাইল দূরে কানাডার নোভা স্কটিয়া (Nova Scotia) রাজ্যে। আগুন ছড়িয়েছে প্রায় তেইশ হাজার হেক্টর বনভূমি জুড়ে। যা আরও ছড়িয়ে পড়ছে কিউবেক প্রদেশ ও অন্যত্র। নিউ ইয়র্ক শহর-এর দূষণের মাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

নোভা স্কটিয়া। এই নামটাই যথেষ্ট। কিন্তু বারবার প্রাকৃতিক বা মানুষের তৈরি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে কেন কানাডার উত্তরপূর্ব প্রান্তে অতলান্তিকের বুকে প্রায় ঝুঁকে থাকা এই ছোট্ট অঞ্চল! দক্ষিণ-পূর্বের অতলান্তিক ছাড়া এর বাকি তিন দিকেও জল। উত্তরে সেন্ট লরেন্স উপসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে মেইন উপসাগর আর পশ্চিমে রহস্যময় বে অফ ফান্ডি, যার প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
মনে পড়ে গেল ঠিক এক বছর আগের কথা। হাতে কয়েকটা দিন ছুটি। কিছুদিন আগেই অতিমারির কোপে সব ব্যবস্থা করেও স্কটিশ হাইল্যান্ড দেখার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ভাবলাম, তার বদলে যদি নতুন স্কটল্যান্ড দেখা হয়, তাই বা মন্দ কী! স্কটল্যান্ডের ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য থাকায় ১৬২১ সালে রাজা প্রথম জেমস এর নাম রেখেছিলেন নোভা স্কটিয়া বা নতুন স্কটল্যান্ড।

আমার নিউ জার্সির আস্তানার কাছেই কেপ লিবার্টি সমুদ্রবন্দর। টিকিট কেটে চেপে পড়লাম রয়্যাল ক্যারিবিয়ান-এর জাহাজে। কেপ লিবার্টি বন্দর থেকে উত্তরপূর্ব দিকে মোটামুটি ৪৫ ডিগ্রি কোণে প্রায় সাড়ে ছ’শো নটিক্যাল মাইল গেলে পরে নোভা স্কটিয়ার হ্যালিফাক্স বন্দর। প্রথম দিন বিকালে জাহাজ ছাড়ল প্রায় সাড়ে চারটে। তার পর একটা গোটা দিন সমুদ্রে কাটিয়ে তৃতীয় দিন সকাল নটা নাগাদ পোঁছলাম হ্যালিফাক্স বন্দরে। দূর থেকে যখন দেখলাম হ্যালিফাক্স বন্দর, নিজের অজান্তেই চোখ চলে গেল ঘড়ির দিকে,আর একটু হলেও বুকটা কেঁপে উঠল।
সেদিনও ছিল এমনই এক সুন্দর সকাল। ৬ ডিসেম্বর, ১৯১৭। ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তেজনা তুঙ্গে। হ্যালিফাক্স বন্দর ছিল মিত্রশক্তির ব্রিটিশ ও ফরাসিদের অন্যতম ঘাঁটি। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রচুর বিস্ফোরক সামগ্রী নিয়ে ফ্রান্সে যাওয়ার পথে সেসময় হ্যালিফাক্স বন্দরে এসেছে এস এস মঁ ব্লাঁ জাহাজ। জার্মানির সাবমেরিনের ভয়ে বন্দরে বিস্ফোরক সামগ্রী নিয়ে না ঢোকার নিয়ম আপাতত স্থগিত। অন্যদিকে বেলজিয়ামের জন্য নিউ ইয়র্ক থেকে ত্রাণসামগ্রী নিতে মাঝপথে হ্যালিফাক্স বন্দরে এসেছে নরওয়ের জাহাজ এস এস ইমো। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে অস্বাভাবিক বেগে সেও এগিয়ে চলেছিল বন্দর থেকে বেরোবার রাস্তায়। কোনোরকমে মুখোমুখি সংঘর্ষ থামানো গেলেও শেষরক্ষা হোল না। মঁ ব্লাঁ জাহাজে আগুন লেগে গেল। সকাল তখন পৌনে নটা। বন্দরের আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে বহু মানুষ সেই দৃশ্য দেখছিলেন। কিন্তু কিছু অভিজ্ঞ চোখে বিপদ ধরা পড়ল। তাঁদেরই একজন ছিলেন বদের-সংলগ্ন স্টেশনের রেলকর্মচারী প্যাত্রিক ভিন্সেন্ত কোলম্যান। পাগলের মতো তিনি একের পর এক মেসেজ পাঠাতে থাকলেন পরবর্তী স্টেশনগুলিতে, যাতে কোনও ট্রেন বন্দরের কাছে আসতে না পারে। অবশেষে নটা পাঁচ নাগাদ ঘটে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। আশেপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার জায়গা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষ হতাহত হন। যারা সরাসরি সেই দৃশ্য দেখছিলেন অনেক দূর থেকে, তারাও অন্ধ হয়ে যান এই বিস্ফোরণের অভিঘাতে। প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূরেও মাটি কেঁপে ওঠে। শহরের মাঝে সিতাদেল পাহাড় থাকায় অবশ্য অন্য পাশের জনবসতি কিছুটা হলেও রক্ষা করে। পরমাণু বোমার কথা বাদ দিলে এটাই মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।

হ্যালিফাক্স শহরে পৌঁছে আমরা প্রথমেই এই সিতাদেল পাহাড় ও তার উপরে ১৭৪৯ সালে ব্রিটিশদের তৈরি দূর্গ দেখতে যাই। হালিফাক্স বিস্ফোরণের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ৬ ডিসেম্বর এই দূর্গ থেকে সকাল নটা চার নাগাদ কামান দাগা হয়। এই দূর্গের অদূরে রয়েছে শহরের আর এক দ্রষ্টব্য ঘড়িঘর। ১৮০০ সাল নাগাদ এই ঘড়িঘর তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ সেনাদের সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা দিতে। শহরের আশেপাশে আর একটা চোখে লাগার মতো বিষয় হল, কানাডার পতাকার পাশাপাশি নোভা স্কটিয়ার নিজস্ব পতাকা। স্কটল্যান্ডের পতাকায় যেমন নীলের মধ্যে কোনাকুনি সাদা দাগ, নোভা স্কটিয়ার পতাকায় সাদার মধ্যে কোনাকুনি নীল দাগ, আর মাঝে স্কটল্যান্ডের রাজকীয় সিলমোহর। বন্দরের কাছেই আর এক দ্রষ্টব্য পয়েন্ট প্লেজান্ত পার্ক। সমুদ্রের ধারেই গাছের ছায়াঘেরা সুন্দর এই পার্কটির একটি বিশেষত্ব হল যে, এটি এখনো ব্রিটিশ সরকারের অধীন, প্রতি বছর যার জন্য প্রতীকী এক শিলিং কর দিতে হয়।

হ্যালিফাক্স শহরের অদূরে আর এক বিপর্যয়ের সাক্ষী ফেয়ারভিউ লন সমাধিক্ষেত্র। টাইটানিকের একশো একুশ জন এখানে সমাধিস্থ। অনেকের নাম খোদাই করা দেখলাম পাথরের গায়ে, কেউ আবার শুধুই দেহ উদ্ধারের ক্রমিক সংখ্যা মাত্র। সবচেয়ে বিখ্যাত হল সেই জ্যাক ডসন-এর সমাধি, টাইটানিক ছবির নায়কের চরিত্র যার আদলে তৈরি।
বিপর্যয়ের গল্প যখন বলতে বসেছি, সুইস এয়ার ১১১-র কথা বাদ দিই কী করে! হ্যালিফাক্স থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে জেলেদের গ্রাম পেগিস কোভ দেখতে যাবার পথে স্কটল্যান্ডের জাতীয় পোশাক পরা আমাদের গাইডের মুখে শুনলাম সেই গল্প। দেখলাম সেই মার্গারেটস বে, যার কাছে ২২৯ জন যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়েছিল নিউ ইয়র্ক থেকে জেনেভাগামী সেই বিমান। দিনটা ছিল ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৯৮। এর সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে গেছিল পাবলো পিকাসোর অন্যতম সেরা ছবি ‘Le Peintre’।
পেগিস কোভ ভারী সুন্দর এক জেলেদের গ্রাম, যাদের মূল জীবিকা লবস্টার শিকার। নোভা স্কটিয়ার লবস্টার পৃথিবী বিখ্যাত। এখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টন লবস্টার ধরা পড়ে প্রতি বছরে। আর আছে অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো ভূপ্রকৃতি, দারুণ সুন্দর একটা লাইটহাউস, যা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিবার ছবি তোলা লাইটহাউস। আর দেখলাম আপন মনে বাগপাইপস আর একরডিয়ান বাজানো স্কটল্যান্ডের জাতীয় পোশাক পরা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে।

নোভা স্কটিয়ার পূর্ব প্রান্তের গ্লেস বে অঞ্চলের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ইতালিও বিজ্ঞানী মারকনির কথা আমরা সবাই জানি বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে তথ্য আদানপ্রদানের আবিষ্কর্তা হিসাবে। এই গ্লেস বে অঞ্চল থেকেই ১৯০২ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি প্রথম পরীক্ষামূলক বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন ইউরোপের উদ্দেশে। যদিও তার অনেক আগে ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৬ সালের মধ্যে আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস বেতার তরঙ্গের ব্যবহার হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন।
নোভা স্কটিয়ার পশ্চিম দিকে বে অফ ফান্ডি বিখ্যাত পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জোয়ারের জন্য। দিনে দুবার এখানে জোয়ারের উচ্চতা হয় প্রায় ৫২ ফুট। এই সময়ে যে পরিমাণ জল ঢোকে এই অঞ্চলে, তা নাকি সেই সময়ে পৃথিবীর সব নদীগুলির মিলিত জলরাশির সমান। এই প্রসঙ্গে বলি, ইউরোপিয়ানরা যখন এই অঞ্চলে প্রথম পা রাখেন, অর্থাৎ ১৪৯৭ সালে, তার প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেও এখানে জনবসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। মিকম্যাক নামে এক উপজাতি এখানে বাস করত মূলত মাছ ও পশু শিকারের ওপরে নির্ভর করে। মিকম্যাক হাইরোগ্লিফিক্স আজও বিস্ময়কর, যদিও এর উৎস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। এদের নানা উপকথার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল গ্লুস্কাপ দেবতার গল্প, যিনি ছিলেন সৃষ্টির প্রতীক। এই দেবতার স্নানের সময় হলেই নাকি বে অফ ফান্ডিতে জল আসে।

অনেক অভিজ্ঞতা আর আবার ফিরে আসার ইচ্ছে নিয়ে আরও দুদিন সমুদ্র যাত্রা করে পৌঁছাই কেপ লিবার্টি বন্দরে। এটা ঠিক সাধারণ বেড়াতে যাবার মতো অভিজ্ঞতা নয়, মন তাই একটু ভারাক্রান্ত। কিন্তু এত দুর্ঘটনা, এত মৃত্যু, বিপর্যয়ের কাহিনির পরেও কেন কানে লেগে থাকে লাইটহউসের সামনে আপন মনে বাজিয়ে চলা সেই বৃদ্ধ মানুষটির বাগপাইপসের সুর, সেই সুরে কোথায় যেন মিশে যায় রবিঠাকুরের গান—
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে” ।।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons
লেখক সরিৎ চ্যাটার্জি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র, পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় হিমালয়প্রেমী ও পর্যটক। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক এ কর্মরত।