পুজো শেষ। আবার হবে আসছে বছর। আমিও আমার গল্পের ঝুলি নিয়ে বসলাম আবার রবুদাকে (Ravi Shankar) নিয়ে। কতটা যেন বলেছিলাম? আমি, কমলাদি, শঙ্কর, রবুদা বাগডোগরা বিমানবন্দর নামলাম। ওরে বাব্বা! কত মাথা! অজস্র মহিলা, পুরুষ। সবাই রবুদার দিকে ছুটছে। হাতে ফুলের তোড়া, মালা, ডায়েরি, খাতা। আট থেকে আশি। আমাদের খুবই হতচকিত অবস্থা। আর ঠিক ওই সময়ই রূপকথার ঘোড়সওয়ার পৃথ্বীরাজের মতো এক সুদশর্ন যুবক এসে আমাদের উদ্ধার করল। শান্তনু বিশ্বাস। আর সেই ব্রাহ্ম মুহূর্ত থেকেই শান্তনু আমাদের সব দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল। আমরা চারজন একটা মার্সিডিজ বেনজ্-এ উঠলাম। আমার জীবনে দ্বিতীয় মার্সিডিজ ভ্রমণ। তখন মার্সিডিজ আসত সোজা জার্মানি থেকে। এখন তো এখানে পয়সা ফেললেই সব হাতের কাছে— মার্সিডিজ এবং আরও অন্যান্য বিদেশি গাড়ি। তবে এই সমস্ত জাগতিক সুখে আমি একেবারেই বিচলিত হতাম না। আমি অপার বিস্ময়ে বাগডোগরা থেকে দার্জিলিং যাওয়ার নৈসর্গিক দৃশ্যে নিমজ্জ তখন। খুব আবছা শুনলাম কেউ যেন বলছেন, “ইন্দ্রাণী ‘জয়যাত্রা যাও গো’ গানটা জানো? আমি সম্মোহিতের মতো গাইতে শুরু করলাম, এবং কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরলে চমকিত হলাম! রবুদা আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে দুর্দান্ত, উদাত্ত কণ্ঠে গাইছেন…“ওঠো ওঠো জয়রথে তব…জয়যাত্রায় যাও গো…”
দুজনের সম্মিলিত সংগীতে পাহাড়, জঙ্গল, মেঘ, আকাশ, ঝরনা সবাই ঝলমল করে আমাদের আদাব জানালো! ওরাও গেয়ে উঠল,
মোরা আঁচল বিছায়ে রাখি,
পথধূলা দিব ঢাকি
ফিরে এলে হে বিজয়ী
তোমায় হৃদয়ে বরিয়া লব…

এই কীর্তনের সুরে সুরে আমরা পৌঁছে গেলাম দার্জিলিঙের উইন্ডামেয়ার হোটেলে। মলের ওপর, ভারী সুন্দর পরিবেশ। দুই দম্পতির জন্য দুটো আলাদা কটেজ। একদম সাহেবি স্টাইল। কী যে ভালো লাগছে! চারিদিকে শুনতে যেন পাই, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি… নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ…
রবুদা বলে উঠলেন, “ও শঙ্কর, এতদিন কেন এখানে আসিনি গো। আহা! আহা! কী অপূর্ব স্বর্গীয় পরিবেশ! ইন্দ্রাণী চলো চলো।” চললেন মলের সিঁড়ি বেয়ে কটেজের দিকে—
“নব বসন্তশোভা এলো এ কুঞ্জবনে
তোমার সোনার প্রদীপে জ্বালো
আঁধার ঘরের আলো,
পরাও রাতের ভালে
চাঁদের তিলক নব…”

আমি, কমলাদি, রবুদা, শঙ্কর, শান্তনু সারাক্ষণ ঝরনার মতো ঝরঝর করে যেন বয়ে চলেছি।
রবুদা শঙ্করের সঙ্গে তাঁর আত্মজীবনী রাগ-অনুরাগের কাজ করছেন। আমি আর কমলাদি শুধু কথা, কথা, কথা। আমি তো শ্রোতা, কথা একেবারেই বলি না, কিন্তু কমলাদি মনে হয় অনেকদিন পর একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা পেয়েছেন, যে কিনা বিনা প্রতিবাদে শুনেই যায়। নির্বাক শ্রোতা। বিস্মিত হয়ে ভাবি রবুদার বউ কী ছেলেমানুষ! অথচ রবুদার প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি, সুবিধে-অসুবিধের দিকে কত নজর। রবুদা খুব সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবি পরতেন। আমি জানতে চাইলাম, কোন দোকানে পাওয়া যায়। ইচ্ছে, বাবা, শঙ্কর, ভাই, দাদু সবারই জন্য কিনব। তখন ওইরকম বাহারি ছেলেদের পোশাক সত্যিই অমিল ছিল। কমলাদি হেসে বললেন, “ওগুলো আমার ডিজাইন। আমিই টেলর দিয়ে তৈরি করাই রবুর জন্য।”

কাজের সময় প্রচণ্ড সিরিয়াস, আড্ডার সময় তুখোর রসিক, গপ্পবাজ— এই হলেন রবুদা, আমার দেখা, আমার চেনা বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত রবিশঙ্কর (Ravi Shankar)। রবুদার কাজের বাইরে আমরা সবসময়ই ঠাট্টা, ইয়ার্কি, আড্ডা, বেড়ানো— এই নিয়েই আছি। উইন্ডামেয়ারের প্রশস্ত ডাইনিং হল একটা মিটিং পয়েন্ট। সব বোর্ডারদের সঙ্গে ওইখানেই দেখাসাক্ষাৎ হয়। আমরা খাবার সময় প্রচুর গল্পগুজব করতাম। আর খাবারের যা এলাহি আয়োজন, তা শেষ করতে সত্যি খুউব বেশি সময় লাগত। তবে আমি প্রধানত শ্রোতা, বয়সটাও খুবই কম, তার সঙ্গে লজ্জা, সংকোচ সব মিলিয়ে আমি বেশ অস্বস্তির মধ্যেই থাকতাম। আর কথা তো কালেভদ্রে বলতাম। রবুদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতেন। আমার পড়াশোনা, গানবাজনা, ভালোলাগা, খারাপলাগা।

শঙ্কর বলল একদিন, “ইন্দ্রাণী ফরাসি জানে।”
উনি চমৎকৃত হয়ে বললেন, “পার্লে ভু ফ্রাঁসে…? ইন্দ্রাণী তুমি ফরাসি জানো?”
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, “উই আমপতিপো”… হ্যাঁ একটু একটু।
—“শঙ্করলাল কোথায় পেলে গো একে?” —সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
আমি মনে মনে শঙ্করের ওপর খুব রেগে গেলাম। মনে মনেই বললাম, “কী দরকার ছিল আপনার, রবুদাকে এইসব বলার!” হ্যাঁ, তখনও শঙ্করকে আমি ‘আপনি’ই সম্বোধন করি। বুঝেই উঠতে পারতাম না এতদিন ‘আপনি’ বলে হঠাৎ কিছু মন্ত্র পড়ার পর একটা মানুষকে তুমি কী করে বলব! শাশুড়ি মা খুব রাগ করতেন, বারবার বলতেন, “আপনি কেন, তুমি বল…”
পাশ থেকে শঙ্কর বলত, “না, না, থাক। তুমি বলতে হবে না। আপনিই বলুক…”
সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে তখনও ‘আপনি’তেই আছি।
হ্যাঁ, আমি তখনও পার্কস্ট্রিটের আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে ফরাসি শিখছি। এবং তার কিছুকাল পরেই সোজা উড়ে গেলাম প্যারিস। প্যারিসে থাকার দু’বছরের কাহিনিতে পরে আসব।

হোটেলের ডাইনিং হলের দেওয়াল ছিল কাচের। চারপাশের মনোরম পাহাড়, মেঘ আমাকে আবিষ্ট করে রাখত। খাবার এলে রবুদা ভাত, রুটি, সবজি, ডাল— এইসব সাধারণ খাবার খুবই অল্প পরিমাণে খেতেন। যদিও এলাহি আয়োজন থাকত। শঙ্কর খুব তারিয়ে তারিয়ে সবকিছুরই আস্বাদ নিত। আর আমি তো ভীষণ কম খাই। আবার সামনে কেউ থাকলে আরও কম। সব ব্যাপারেই ভীষণ লাজুক ছিলাম। রবুদার মেনুতে সবই হালকা রান্না। অবশ্যই থাকবে বিনস, ব্রকোলি, মাছ বা মাংস। ব্রকোলি সেই প্রথম দেখলাম। ভাবছি এ কেমন ফুলকপি! একেবারে সবুজ! পরে কমলাদিকে প্রশ্ন করাতে উনি আমার ভুল ভাঙিয়ে বুঝিয়ে দেন— ওটা আসলে একটা বিদেশী সবজি —ব্রকোলি। এখন তো এখানে যখন তখন পাওয়া যায়। এখানেই চাষ হয়। খুবই স্বাস্থ্যকর সবজি। রবুদার খাওয়ার সময় কমলাদি যত্নের সঙ্গে সবকিছুর তদারকি করতেন। আমার স্বল্পাহার দেখে রবুদা ঠাট্টা করতেন— “শঙ্কর, ইন্দ্রাণীর জন্য তো খরচাই নেই। ও তো কিছু খায়ও না।”
কমলাদি কপট বকুনি দিতেন, “আহা বাচ্চা মেয়েটার পেছনে কেন লাগছ?”
—হ্যাঁ সে তো প্রায় ৪৩-৪৪ বছর আগের ঘটনা। বাচ্চাই ছিলাম তখন, ইনোসেন্ট বাচ্চা।
(চলবে)
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
One Response
আপনার লেখার গুনে সবকিছুই যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। অপূর্ব। পরের ঘটনাগুলো পড়বো বলে অপেক্ষায় থাকলাম।