দার্জিলিং-এ বহুবার গিয়েছি, রবুদার সঙ্গে দেখা হবার আগে এবং পরে, সব মিলিয়ে অন্তত ৮/১০ বার। কিন্তু সব ছাপিয়ে ওই ১০ দিন চিরকাল মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করবে। তখন সত্যি পণ্ডিতজীর (Pt. Ravi Shankar) বিশ্বজোড়া খ্যাতি বা সেতারের দুনিয়ায় তাঁর অবদান, ভারতবর্ষকে বিশ্বের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করা— এসব বুঝতাম না। বোঝার বয়সও নয় সেটা। উনি যে কত বড় মানুষ এবং দুনিয়ায় আমাদের দেশের নাম কীভাবে সাধারণ-অসাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন, তার একটা ছোট্ট নমুনা দিই। প্যারিসে যখন থাকতাম, আমি সবসময় শাড়ি পরা পছন্দ করতাম। হাতে নোয়া, শাঁখা, সিঁথিতে সিঁদুর ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করতাম। আমি যে ভারতীয়, ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে গর্বিত, সেই সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী— এই সব খুব স্পর্শকাতর সম্পদগুলি সবার সামনে আনার চেষ্টা করতাম। আমি ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম, বিদেশি বা ফরাসিরা খুব সসম্ভ্রমে আমায় দেখে, কথা বলে। আমি ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারি, সেটাও ওদের বিস্মিত করে। আমার ব্যক্তিত্বের কাছে ওরা নতিস্বীকার করে। আমার দেশের সম্বন্ধে ওদের অনেকরকম ভ্রান্ত ধারণা, আমার সঙ্গে আলোচনায় আমি শুধরে দিয়েছি। বিস্তারিত এ প্রসঙ্গে পরে অবশ্যই জানাব সবাইকে। যে কথা বলার জন্য এ প্রসঙ্গের অবতারণা, তাতে ফিরি। তখন বিয়ের পর পর, তাই নানারকম দামি শাড়ি আমার আলমারিতে, তার কয়েকটাই বিদেশে নিয়ে গিয়েছিলাম। যদিও সবারই মতামত ছিল ট্রাউজার, শার্ট ছাড়া বিদেশে daily wear-এ কিছু ব্যবহার করা যায় না, শাড়ি উড়ে যায়, ওখানে খুব হাওয়া সর্বত্র— এইসব। কোনওদিনই বিলিতি পোশাক আমার ভালো লাগে না, তাই শাড়ি কিছু সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। দুটো-তিনটে শার্ট, প্যান্ট অবশ্য ছিল, তৈরি করিয়েছিলাম। কিন্তু প্যারিসে পৌঁছে দেখলাম শাড়ি পরতে কোনও সমস্যা নেই। দিব্যি হাঁটাচলা করছি। শহরের মধ্যে শাড়ি হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার মতো কোনও অঘটনও ঘটেনি কখনও।

একদিন আমি আর শঙ্কর হেঁটে কোনও একটা রেস্তোরাঁতে যাবার জন্য বেরিয়েছি। যথারীতি প্লেন গোল্ডেন জমি কালো মিনে করা রেশমি পাড়ের একটা খুব দামি কাতান বেনারসী পরেছি। শাঁখা, নোয়া, সিঁদুর এবং লম্বা মোটা বিনুনিতে সজ্জিত আমি typical ভারতবর্ষের বাঙালি নন্দিনী। হঠাৎ রাস্তায় যেতে যেতে এক ফরাসি উচ্ছ্বসিত, উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে তার সঙ্গিনীকে বলে উঠল— ‘আ…! রাভিশঙ্কর! রাভিশঙ্কর!’ আমি মুগ্ধ হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘উই, উই মসিয়ঁ! রাভিশঙ্কর। ইন্ডিয়া, উই নু ভেনো দ্য ল্যান্দ্, পেয়ি দ্য রাভিশঙ্কর।
ওরা তো ওদের বিস্ময় কোথায় রাখবে বুঝতেই পারছিল না। শাড়ি পরা ভারতের এক যুবতী ওদের ভাষায় উত্তর দিচ্ছে! এর পরের ঘটনা তো সবাই বুঝতেই পারছ।
এই হল রবিশঙ্করের image— বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত রবিশঙ্কর। পৃথিবীজোড়া খ্যাতি। ভারতবর্ষকে তিনি বিশ্বের দরবারে এনেছেন, ভারতবর্ষকে বিশ্বখ্যাত করেছেন।

এবারে আসি দার্জিলিং-এ রবুদা, কমলাদির সেই দিনগুলিতে।
উইন্ডামেয়ার হোটেলের দুটো আলাদা কটেজে আমাদের দুই যুগলের ক্ষণিক সংসার। সন্ধ্যাবেলা কাজকর্ম সারা হলে কোনও একটা কটেজে বসত আমাদের গানের আসর, আড্ডা। মোমবাতিও থাকত, কারণ অনেক সময়েই তখন লোডশেডিং হত এবং তখনও জেনারেটরের চল খুব বেশি ছিল না। আমি লক্ষ্য করছিলাম, কাজ করার সময় লোডশেডিং হলে রবুদা মোমবাতির আলোয় কাজ করতেন। এতই ডিসিপ্লিন্ড ছিলেন তিনি। কাজে ফাঁকি নৈব নৈব চ। এই রবুদার আড্ডার সময় আবার অন্য চেহারা। নানান গল্পের ঝুলি, বাজনা, ক্যারিকেচার, গান, সব…সবকিছুতেই তিনি এক নম্বর।
একদিন রবুদা বললেন, “আজ কমলা, ইন্দ্রাণী তোমাদের একটা রাগ শেখাব। ইমন রাগ। সংগীতশিক্ষা শুরু হল। আমি দারুণ রোমাঞ্চিত। রবুদা গান শেখাচ্ছেন, শুধুমাত্র তানপুরা বাজিয়ে। তখন তো মোবাইল ছিল না। ক্যানন ক্যামেরা আমার ছিল। কিন্তু কেন যে কোনও ছবি তুলিনি, জানি না। এখন খুব আফশোস হয়। কেন এই সমস্ত অমূল্য সম্পদ ধরে রাখিনি! ধরে রেখেছি, শুধু মনের ক্যামেরায়। তবে সেই সংগীতশিক্ষা রবুদা আমাকে ক্যাসেটে রেকর্ড করে দিয়েছিলেন। আমাকেই দিয়েছিলেন। ভুটানদা (রবুদার কলকাতার সেক্রেটারি) একদিন আমাদের বাড়ি এসে ক্যাসেটটা ধার চাইল, আর একটা কপি করে ফেরত দেবে। সেই ফেরত আমি আজও পাইনি। এখন বুঝি ফেরত দেবার জন্য নয়, কপি করার জন্যও নয়, ওই অমূল্য সম্পদ আমার কাছে যাতে প্রমাণ হিসেবে না থাকে তার জন্যই ওটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, চিরকালের জন্য।

তা যা বলছিলাম, রবুদা ইমন রাগ শেখাচ্ছেন, শুধু দুটো শব্দ। সরস্বতী! সরস্বতী! শুধু এই দুটো শব্দের ওপর পুরো ইমন রাগটার চরিত্র পণ্ডিতজী বুঝিয়ে দিলেন। মরমে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। টেপ করেছিল শঙ্কর, আমি আর সব কিছু ভুলে গেলেও জীবনে রবুদার শেখানো ওই ইমন রাগ কোনওদিন ভুলব না। কী অপূর্ব, অসাধারণ ওই শেখাবার ধরন! ওইরকম বিশ্বজোড়া খ্যাতি একজন মানুষের কি শুধু শুধু হতে পারে? শতগুণে গুণী মানুষ এঁরা। ভগবানের অপার সৃষ্টি! অনেকক্ষণ ধরে ওই রাগ আমরা তিনজন— রবুদা, কমলাদি, আমি গেয়ে চললাম, গেয়ে চললাম, গেয়েই চললাম। ইমন রাগ কল্যাণ ঠাটের অন্তর্ভুক্ত একটি সম্পূর্ণ রাগ। গাইবার সময়- বিকেল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সাধারণত। বলা হয়, ইমন ইয়েমেনর খুব জনপ্রিয় সুর। দক্ষিণ ভারতে এই ইমন ‘কল্যাণ রাগ’ নামে পরিচিত। মুসলিম শাসনকালে পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বহু সুর আমাদের ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। আর যতদূর জানা যায়, এই রাগটির ভারতবর্ষে প্রচলনের মূলে আছেন আমীর খসরু। এইসব সুন্দর করে রবুদা আমাদের গানের তালিমের মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিলেন। আস্তে আস্তে আমাদের ইমনের সুরে সন্ধে, রাত নেমে এল উইন্ডামেয়ারের কটেজে।
আমি রাগ সংগীতের মাঝে উপলব্ধি করলাম কাচের জানলার বাইরে পাহাড়, জঙ্গল, ছোট ছোট পাহাড়ি কাঠের বাড়ি, আকাশের তারা সবাই গাইছে, প্রার্থনা করছে—নি রে গা ̅মা পা ধা নি সা সা নি ধা পা ̅মা গা রে সা… আমি নিঃশব্দে ইমন-এর সরগম করে যাচ্ছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি, আরও আরও দীর্ঘ কর আজকের রজনী।
কমলাদি আমার গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বললেন, “ইন্দ্রাণী তুমি খুব কপাল করে এসেছ। রবু তোমায় গান শেখাল, রাগ বোঝালো। ও নিজের ছাত্রছাত্রী ছাড়া কাউকে এ স্বীকৃতি দেয় না। আজ থেকে তুমিও ওর কাছে গান্ডা বাঁধলে।”
আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়লাম।
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Britannica
*আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে জানুয়ারি, ২০২৪
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
2 Responses
বাহ!! অপূর্ব লাগছে এই অসাধারণ ঘটনা পড়তে, জানতে। যতই পড়ছি ততই ভালোলাগায় আপ্লুত হয়ে যাচ্ছি! যেমন সুন্দর এবং স্বর্গীয় ঘটনা, তেমনই সাবলীল এবং সুন্দর লেখা! দারুন!!
Thanks a lot