(Bengali Short Story)
ডে ওয়ান
কে যেন, গভীর অবচেতনে কড়া নেড়ে চলেছে অবিরাম, সেই শক্তি চাটুজ্জের কবিতার মতো। উঠতে ইচ্ছে করে না। তবুও ঘুম ভেঙে যায় এক অসহায় অস্বস্তিতে। হৃদয়ে চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি। এয়ারকন্ডিশনের মৃদু আলোর মনকেমনকরা জোৎস্নায় কম্বল সরিয়ে উঠে পড়েন অনিকেত। বছর ছাপান্নর অনিকেত মজুমদার। পাঁচফুট দশের পেটানো জিমে যাওয়া ফরসা চেহারা। কোঁকড়া চুলে টিকালো নাকে বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থিতি। বেড সাইড টেবিল থেকে চশমা পরে মোবাইলে দেখেন রাত দুটো বেজে দশ। ব্যথাটা এখন বেশ প্রবল। (Bengali Short Story)
অনিকেতের প্রথম পরিচয় বিসনেস-ম্যান। কিছু কল কারখানার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, হাসপাতালের অংশীদারি, ডুয়ার্স এ চা- বাগানের মালিকানা এইসব নিয়ে দিন কেটে যায়। নানান সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত সে। লোকমুখে শোনা যায়, পরের বছর রাজ্যসভা কক্ষে প্রবেশ করার সম্ভাবনা প্রবল। (Bengali Short Story)
বিন্দু বিন্দু ঘাম। জল পান করেন নিঃশব্দে। সোফায় বসেন। টিশার্ট পরেন। বাথরুমে চোখে মুখে জল ছেটান। কিন্তু ব্যথার মাত্রা বেড়েই চলে।
সেই অনিকেতকে সেন্ট্রাল দিল্লীর হোটেলের বারো তলার এক্সিকিউটিভ সুইটে ঘুমের মাঝে উঠে পড়তে হয়, বুকের মধ্যে প্রবল যন্ত্রণায়। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ। বিন্দু বিন্দু ঘাম। জল পান করেন নিঃশব্দে। সোফায় বসেন। টিশার্ট পরেন। বাথরুমে চোখে মুখে জল ছেটান। কিন্তু ব্যথার মাত্রা বেড়েই চলে। রক্তে শর্করা একটু বেশি কিন্তু সংযত। প্রেসারের খবর নেই। তাহলে কীভাবে হার্ট অ্যাটাকের বার্তা? পার্স থেকে সরবিট্রেটের রাঙতা খুলে একটা ট্যাবলেট জিভের নিচে রাখেন। পঞ্চাশের পর থেকে ওষুধটা থাকে। পরিস্থিতির মোকাবিলায় সতত প্রস্তুত থাকা আর কী। শোনা যায় মাসাই যোদ্ধারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে গভীর নিদ্রা থেকে যুদ্ধের অবস্থানে যেতে সক্ষম। শৈশব থেকে স্মার্ট, মেধাবী এবং ডিটারমাইন্ড অনিকেত যেন সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকেন। যা চান তা হাসিল করে ছাড়েন, ব্যক্তি জীবনে এবং পেশাগত জীবনে। আপাতত ওষুধটা স্বস্তি দেয়। ঘুমিয়ে পড়েন। (Bengali Short Story)
আরও পড়ুন: নীরবে নিতান্ত অবনত বসন্তের সর্ব-সমর্পণ।
চিনচিনে ব্যথাটা সকাল ছ’টায় আবার অনুভবে এল। আর দেরি করা যায় না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাঁর প্রখর। সতত সে সাবধান করে। দিল্লীর নামজাদা হাসপাতালের সিইওকে ফোন করেন। তারপর ফোন করেন লিভ-ইন পার্টনার শিবানী ভোরাকে, মুম্বাইতে। বলেন যে হার্ট অ্যাটাকের সংকেত আছে, হাসপাতালে ভর্তি হবেন। চার বছর আগে এক পার্টিতে আলাপ। সিঙ্গল মল্টের দুটো লার্জ পেগ শেষ করে খোলা আকাশের নীচে ব্যালকনিতে সিগারেট জ্বালাবার সময় শিবানী এসে আলাপ করেন একটা ইন্টারভিউ করার আর্জি নিয়ে। হালকা নেশায়, নীল শিফনে, স্লিভলেস ব্লাউজে, খোলা চুলে তখন শিবানী রহস্যময়ী। পরিচয় হল দু’জনের খোলা আকাশের নীচে। আরবসাগরের নোনা হাওয়ায় নেশা। শিবানী অর্থনীতি পড়ান আর কাগজে লেখালেখি করেন। ডিভোর্সী। রাতে অনিকেতের ফ্ল্যাটে আলাপ নগ্নতায় গাঢ় হয়ে আপাতত বন্ধনহীন লিভ ইন সম্পর্কে এসে ঠেকেছে। (Bengali Short Story)
শিবানী কয়েকঘণ্টার মধ্যে এসে পড়বেন বলে জানালেন।
অ্যাম্বুলেন্স সরাসরি ইমারজেন্সিতে। তারপর অনিকেত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। মেডিক্যাল টিম ঝাঁপিয়ে পড়ে। অসহায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ঘরে শুয়ে আছেন। এখানে সফল, অসফল মানুষ সব এক হয়ে যায় প্রাকৃতিক নিয়মে। মৃত্যুতে সবাই সমান হয়ে যায়। চিতায় নগ্ন শরীর জ্বলে শেষ হয় ছাই হয়ে। (Bengali Short Story)
ডাক্তাররা রায় দিলেন যে করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং করতে হবে এএসএপি। তিনটে আর্টারিতে মেরামতি আছে। কাল হবে প্রসিডিওর। তখন বেলা একটা।
ডাক্তাররা রায় দিলেন যে করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং করতে হবে এএসএপি। তিনটে আর্টারিতে মেরামতি আছে। কাল হবে প্রসিডিওর। তখন বেলা একটা। শিবানী ভোরা এবার দেখা করার অনুমতি পেলেন। অনিকেত কে বলেন, “ইউ আর ইন সেফ হ্যান্ডস, ডিড টক টু ডক্টর রেড্ডী, এন্ড হি ইজ বেস্ট”। প্রাক্তন স্ত্রী নীপা আর কন্যা মৃদুলা আমেরিকায় থাকে। শিবানী দু’জনকে জানিয়ে দেবেন। উচ্চবিত্ত সমাজে প্রাক্তন, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবাই মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ থাকেন। মৃদুলা মুম্বাই এলে শিবানী আন্টির সঙ্গে আউটিংয়ে যায়। আপাতত দশ মিনিট বাদে নার্স এসে শিবানীকে বলে সময় হয়ে গেছে বাইরে যাওয়ার। নীপা আর মৃদুলাকে মেসেজ করে শিবানী গুরগাঁওতে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাবে উঠেছেন আর মৃদুলার কল এল। সে চলে আসছে দিল্লিতে, এএসএপি। (Bengali Short Story)
ডে টু
পরেরদিন সকাল ছ’টায় আইসিইউ থেকে অপারেশন থিয়েটারে ট্রান্সফার করা হল। অ্যানাসথেসিয়া ধীরগতিতে অনিকেতকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে দিতে থাকে। অ্যালার্ট মানুষটার খানিকটা চৈতন্য ডাক্তারদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে চলে গেল বহু বছর আগে বিয়ের দিনে, কলকাতায়। নীপা লাল বেনারসি শাড়িতে, ছিপছিপে শরীরে, সালাঙ্কারা ঝলমলে। নীপা ভট্টাচার্য। আলাপ হয় আমেরিকায়। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তখন মাস্টার্স করছেন অনিকেত। সহপাঠী শ্যামল চ্যাটার্জির প্রেমিকা নীপা ইংরিজি সাহিত্যের ছাত্রী। অনিকেতের ভাল লেগে গেল। একদিন সরাসরি নীপাকে জানিয়ে দিলেন তাঁর ভাল লাগার কথা। সুদর্শন, পড়াশোনা থেকে খেলাধূলা হয়ে নানান বিষয়ে পারদর্শী মানুষটাকে নীপা ভালোবেসে ফেললেন অনায়াসে। এক বছরের মধ্যে পড়ার পাঠ শেষ করে দেশে ফিরে নীপাকে বিয়ে করে পৈতৃক ব্যবসায় যোগ দেন। নীপা একটি বহুজাতিক ফার্মে যোগ দেন। শ্যামল কানাডায় গিয়ে এক মেমসাহেবকে বিয়ে করে সেটল করেন। শ্যামলের মুখটা আজ মনে পড়ে, এখন অপারেশন টেবিলে জ্ঞান অজ্ঞানের সীমানায় এসে। (Bengali Short Story)
ছিনিয়ে নিজের করে নেওয়ার সেই আদিম প্রয়াসে অনেক বন্ধু, স্বজনকে হারিয়েছেন অনিকেত। বাইরের চাকচিক্য বেড়েই চলেছে।
ছিনিয়ে নিজের করে নেওয়ার সেই আদিম প্রয়াসে অনেক বন্ধু, স্বজনকে হারিয়েছেন অনিকেত। বাইরের চাকচিক্য বেড়েই চলেছে। বহুগামী মানুষটির সাথে নীপার কয়েক বছরের মধ্যে সম্পর্কের ভাঙাচোরা শুরু হয়। সম্পর্কের ইতি হল, যেদিন মনীষা আগরওয়ালের সঙ্গে হাতে নাতে ব্যাঙ্গালোরের এক হোটেলে ধরে ফেলেন। মনীষা মডেল এবং সাউথ ছবিতে অভিনয় করেন। মৃদুলা তখন আট বছরের। নীপা বিচ্ছেদ ঘটিয়ে কন্যাকে নিয়ে আমেরিকায় সেটেল করেন। (Bengali Short Story)
আদতে অনিকেত মানুষটা নিষ্ঠুর, উদাসীন। আদিম আলফা মেল। নিজের পথ করে এগিয়ে চলেন। শুধু একমাত্র মেয়ের ওপর টান অনুভব করেন। আপাতত, গভীর অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে, ডাক্তারদের অস্পষ্ট কথায় বুঝলেন যে অপারেশান শুরু হয়েছে। একটুও নড়ার ক্ষমতা নেই। অপরিসীম ব্যথায় বোধহয় শরীরটাকে চেরা হচ্ছে। কথা বলার ইচ্ছে নেই। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে একবার মনে হল আর ফেরা হবে না। আবার একটু ফেরা চেতনার জগতে। চাইছেন গভীরতম ঘুমে তলিয়ে যেতে। (Bengali Short Story)

মানুষটা রুথলেস। আইন আর বেআইনের মাঝের বিস্তীর্ণ গ্রে এরিয়ায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেন। নৈতিক আর অনৈতিক ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনার ধার ধারেননি কোনওদিন। অনেক বেআইনি কাজের সাগরিদ আশীষ সাহা লরীর চাকায় পিষ্ট হয়েছিল। অনিকেতকে ব্ল্যাকমেইল করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। বেঁচে থাকার অধিকার হারায় সেদিন। এখন সে ব্যাটা কোথা থেকে সামনে এসে ফিকফিক করে হাসে। লোকটাকে তাড়ানোর এনার্জি হারিয়ে ফেলেছেন অনিকেত। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। (Bengali Short Story)
ঘুম ভাঙে ডাক্তারদের কথায়, মনে হয় অপারেশন শেষ হল। এবার বাহাত্তর ঘণ্টা অবজার্ভেশন। জীবনে প্রথম এত অসহায় অনিকেত। এত ভালনারেবল। অতীত নিয়ে মাথা ঘামাননি কোনওদিন। সেই অতীত অবচেতনে ফিরে আসছে। অনিন্দ্য সেনগুপ্ত ব্যাটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখের সামনে। প্রথম নিজস্ব উদ্যোগের ইকোয়্যাল পার্টনার ছিল ব্যাটা। বেনিয়মের ফাঁদে জেলে যায় এবং আত্মহত্যা করে। অনিকেতের বিরুদ্ধে অনেক তদন্ত করেও কিছু প্রমাণ করা যায়নি। সে ব্যাটা ফিসফিস করে কিছু বলছে। (Bengali Short Story)
আবার তলিয়ে যান গভীর কালো অতলে প্রচন্ড যন্ত্রণায়। হয়তো এবার চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবেন। ডাক্তারদের কথা ভেসে আসে অনেক দূর থেকে।
আবার তলিয়ে যান গভীর কালো অতলে প্রচন্ড যন্ত্রণায়। হয়তো এবার চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবেন। ডাক্তারদের কথা ভেসে আসে অনেক দূর থেকে। মেয়ে মৃদুলা গতবছর স্টানফোর্ড থেকে পোস্টগ্রাড করে এখন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। সপ্তাহে দু’বার কথা হয়। তিন বছর বাদে বাবার কোম্পানিতে জয়েন করবে। মেয়েকে ব্যবসার দায়িত্ব ছেড়ে অনিকেত, গরীব মানুষের কল্যাণ কাজে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করবেন। (Bengali Short Story)
সেভেন্টি টু আওয়ার্স
ফোর্টি এইট আওয়ার্স অতিক্রান্ত হল। মেয়ে চলে এসেছে দিল্লিতে। মিনিট পাঁচেকের জন্য ভেতরে এসে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পিতাকে দেখেছে। কপালে স্পর্শ করে জানান দেয় উপস্থিতি। অনিকেত বুঝতে পারেন মেয়ের স্পর্শ। ঠোঁট নড়ে ওঠে কিছু বলার জন্য। বলতে পারেন না। আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। কতক্ষণ এভাবে উজান ভাঁটা চলে কে জানে। এবারে ধীরে ধীরে চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। (Bengali Short Story)
মনে পড়ে অরুণিমা সান্যালের মুখ। জীবনানন্দের কবিতার নয়। বটানি পড়ত। ছিমছাম। সুন্দর কথাবার্তা। হাঁটাচলা। ক্লাস ইলেভেন থেকে অরিত্র নিয়োগীর সাথে প্রেম। অরিত্র তখন সেকেন্ড ইয়ার ইলেকট্রনিক্স। সেকেন্ড ইয়ারের মেকানিকালের অনিকেত অরুণিমাকে প্রপোজ করে। সুন্দরভাবে প্রত্যাখান করে দিল সেই মেয়ে। সে অরিত্রকে নিয়ে ভাল আছে। অরিত্রকে বিয়ে করবে। অনিকেত বন্ধু হতে পারে। বন্ধু হওয়া হল না। জীবন এগিয়ে চলে নিজের ছন্দে। আজ ঘুমের ঘোরে তাকে মনে পড়ে। ভীষণভাবে মিলিত হওয়ার লিবিডো চেতনা জেগে ওঠে। যদি ঘুম থেকে ওঠা হয়, তবে খোঁজ করতে হবে। কোথায় আছে সে। (Bengali Short Story)
ঘুমের মাঝে, ব্যথার মাঝে বুঝতে পারেন অনেকের উপস্থিতি, অনেকের আনাগোনা। শিবানী বলেন যে মৃদুলা আসছে দু’দিনের মধ্যে। সম্ভব হলে ক’দিন বাবার সঙ্গে সময় কাটাবে।
ঘুমের মাঝে, ব্যথার মাঝে বুঝতে পারেন অনেকের উপস্থিতি, অনেকের আনাগোনা। শিবানী বলেন যে মৃদুলা আসছে দু’দিনের মধ্যে। সম্ভব হলে ক’দিন বাবার সঙ্গে সময় কাটাবে। মৃদুলা স্পর্শ করছে। ডাক্তার বলছেন কাল সকালে কত ঘণ্টা যেন শেষ হবে। কিন্ত এই ব্যাথায় আরও ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। উঠে কী হবে? এইভাবেই লুপ্ত হয়ে গেলে ভাল হয়। অনিকেত অর্থ গৃহহীন। আজ ঘুমের মধ্যে যেনো গৃহ খুঁজে পেয়েছেন। এই আরাম থেকে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। সব ক্লান্তি, সব অতৃপ্তির, সব বেদনার শেষ, মৃত্যুতে। (Bengali Short Story)
ত্রিশঙ্কু
রাত বাড়তে থাকে। চেতনায় নানান চিত্র আসে আর যায়। আবার ঘুম আসতে চায়। তখনই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটে। শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অনিকেত। ভেসে বেড়ান আইসিইউ-র আকাশে। এক এক করে দেখেন একুশ জন রোগী। অনেকেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনেকে যন্ত্রণায় শব্দ করছে। নার্সরা ঘুমে আচ্ছন্ন এই ভোর তিনটের সময়। রুম থেকে বেরিয়ে দেখেন পাশের রুমে দুজন জুনিয়র ডাক্তার পা টেবিলে তুলে নাক ডাকাচ্ছে অকাতরে। চেয়ারে সিকিউরিটি ঘুমে কাতর। দুটো রুম বাদে আবার ফিসফাস শব্দ। কৌতুহলে ভেতরে দেখেন এক রমণী এক পুরুষের কোলে চেয়ারে সঙ্গমে লিপ্ত। হয়তো প্রেমিক প্রেমিকা। হয়তো নয়। নিতম্বের উচ্চগ্রামের দোলনে বোধহয় চরম আনন্দের সংকেত। একদিকে মৃত্যু আর একদিকে সম্ভোগ। সৃষ্টি বয়ে চলে অদ্ভুত নির্লিপ্ততায়। ফ্লোর থেকে বেরিয়ে অনিকেত একেবারে খোলা আকাশের নীচে। (Bengali Short Story)
হঠাৎ মনে হয় তাহলে কি মৃত্যু হয়েছে? দেহ পড়ে আছে আইসিইউতে। নীচের রাস্তায় সামান্য যানবাহন। অনিকেত ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। পৃথিবী ছোট হতে থাকে।
এই কি সেই অনিকেত, যা সনাতন ধর্মচেতনায় আত্মা বলে পরিচিত। যার জন্ম নেই। মৃত্যু নেই।
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি।” (Bengali Short Story)
পৃথিবীর থেকে অনেক ওপরে এসে আবার শরীরের ওপর গভীর টান অনুভব করেন। অনেক কিছু বাকি আছে। শিবানীর সাথে কিছু কথা বলার আছে। মেয়ের নামে দুবাইতে বাড়ি কিনেছেন, তার কাগজপত্রে সইসাবুদ বাকি আছে।
না শুধু দেহবোধ লুপ্ত হয়েছে? তন্ত্র সাধকদের সমাধির মতো? যেকোনও সময় দেহে প্রবেশ করা যাবে।
পৃথিবীর থেকে অনেক ওপরে এসে আবার শরীরের ওপর গভীর টান অনুভব করেন। অনেক কিছু বাকি আছে। শিবানীর সাথে কিছু কথা বলার আছে। মেয়ের নামে দুবাইতে বাড়ি কিনেছেন, তার কাগজপত্রে সইসাবুদ বাকি আছে। রাজ্যসভার সদস্যপদ বড় গৌরবের। অনেক ডোনেশন করেছেন তার জন্য। নীচে নামতে নামতে আবার আইসিইউতে। ভোর সাড়ে চারটে। পাঁচটা থেকে আবার সব উঠে পড়বে। অনিকেতের দেহ নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। মনিটরে দেখেন ভাইটালস কাজ করছে। অর্থাৎ মৃত্যু হয়নি। শরীরে প্রবেশ করার পূর্বমূহূর্তে মনে হল অষ্টম ফ্লোরের একটি রুমে কিছু একটা ছায়ার মতো দেখেছেন। একবার দেখে আসা যাক। কৌতূহলী মন। (Bengali Short Story)
অষ্টম ফ্লোরে, রুগির শয্যার পাশের সোফায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন অরুণিমা। অসুস্থ অরিত্র শুয়ে আছেন একেবারে স্থির হয়ে। ক্লান্ত অরুণিমা এই মধ্য চল্লিশের শেষে আরও সুন্দর। পরিপূর্ণ এক নারী। যাকে প্রথম যৌবনে অনিকেত কামনা করেছিলেন সম্পূর্ণ পৌত্তলিকতায়। ভালোবেসেছিলেন। তারপর স্মৃতি মুছে গেছে। আজ দেহহীন চেতনায়, কামনা জাগে নিবিড়ভাবে। আবার ছিনিয়ে নেওয়ার আদিম হান্টার গ্যাদারর জেগে ওঠে শরীর বিহীন চেতনায়। আদিম আলফা মেল। অরুণিমাকে স্পর্শ করার জন্য এগিয়ে গেলেন। অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন। অরুণিমা কি অস্ফুটে কিছু উচ্চারণ করলেন?
একটা চেতনা বলে যে অরিত্রের শরীরে অনায়াসে প্রবেশ করা সম্ভব। তিনি অরিত্র হয়ে মিলিত হবেন প্রিয় নারীর শরীরে। অন্য চেতনা সাবধান করে- “আননোন টেরিটরি, মূর্খের মতো কাজ হবে”। আত্মার কি লিবিডো থাকে? জানা নেই। তবুও একবার অরুণিমাকে স্পর্শ করতে মন উচাটন হল। একবার মাত্র। তারপর বেরিয়ে গিয়ে প্রবেশ করা যাবে নিজের শরীরে। বুদ্ধিমান মানুষটি সেই স্পর্শের ইচ্ছায় প্রবেশ করে যান আরিত্রের দেহে। সহজে। অবলীলায়। কোনও বাধা নেই। প্রতিরোধ নেই। (Bengali Short Story)

দীর্ঘসময় কেটে যায়। অনিকেত একসময় বুঝতে পারেন যে অরিত্র নেই। তিনিই একমাত্র তার শরীরে আছেন। আর এভাবেই থাকতে হবে কারণ এখান থেকে বের হওয়ার কৌশল অজানা। (Bengali Short Story)
অরিত্র পনেরো দিন আগে ম্যাসিভ অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। আপাত দৃষ্টিতে কোমা মনে করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন নরওয়েতে, সুইডেনে কাজ করা ডাক্তার শ্রীনিবাস বলেছেন যে ডাক্তারি পরিভাষায় এই অবস্থাকে বলে “লকড- ইন সিনড্রোম”। আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্ত ঐচ্ছিক মাসল প্যারালাইজড হয়ে যায়। একমাত্র চোখের মাসল কাজ করে। রোগী কন্সিয়াস থাকে, এলার্ট থাকে, জ্ঞান চেতনা কাজ করে। কিন্তু কথা বলতে, চলাফেরা করতে, মুখে এক্সপ্রেশন আনতে পারে না। শুধু চোখের পাতা দিয়ে কমিউনিকেট করতে পারে। নরওয়ে, সুইডেনে শ্রীনিবাস দেখেছেন ধীরে ধীরে চোখের পলকের ইশারায় রোগী কেআর গিভার এর সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারেন। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা আর কী। (Bengali Short Story)
তাড়াহুড়ো করে না জেনে অনিকেত প্রবেশ করে গেছেন সেই স্টেটে। অরিত্রকে হয়তো তিনিই মুক্ত করেছেন দেহ থেকে। এটা কি একরকম মার্ডার? জানা নেই।
তাড়াহুড়ো করে না জেনে অনিকেত প্রবেশ করে গেছেন সেই স্টেটে। অরিত্রকে হয়তো তিনিই মুক্ত করেছেন দেহ থেকে। এটা কি একরকম মার্ডার? জানা নেই। রাজ্যসভার মেম্বার হলে হয়তো কিছু আইন প্রণয়ন করা যেত। এখন উপায়… চিরদিনের স্মার্ট, ড্যাশিং মানুষটি আজ অসহায় অন্য লোকের শরীরে নিজের ইচ্ছেতে প্রবেশ করে। কী করা উচিৎ এখন?
তখনই অরুণিমার ঘুম ভাঙে। উঠে আসেন অনিকেতের চৈতন্যকে তোলপাড় করে। অন্যের শরীরে অনিকেত। সেন্স আছে পুরোমাত্রায়। কিন্তু শরীর অসাড়। (Bengali Short Story)
অরুণিমা জানেন যে মানুষটির সেন্স আছে পুরো মাত্রায়, এবং ডাক্তার বলেছেন যে চোখের মুভমেন্টে ভাবপ্রকাশ করা যেতে পারে। অরুণিমা জানেন সামনে দীর্ঘ পথ, কিন্তু যথেষ্ট সম্পন্ন হওয়ায় ভাল কেয়ার গীভার পেতে অসুবিধা হবে না। (Bengali Short Story)
অলংকরণ – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কাজের ক্ষেত্র তথ্যপ্রযুক্তি। কিছুদিন স্মার্ট সিটিতে কাজ করেছেন। আড্ডাবাজ মানুষ। বইপড়া আর সিনেমা দেখা নেশা। কাজের সুত্রে সলিউশন ব্লুপ্রিন্ট, স্পেক্স, প্রপোজাল ইত্যাদি অনেক লিখেছেন। ইদানিং বাংলায় প্রবন্ধ, গল্প, ফিল্ম রিভিউ লেখার একটা চেষ্টা চলছে।