(Hilsa)
আমার দাদাশ্বশুরমশাই প্রতিবার বর্ষা এলেই তিন মরশুমি বর্ষাশস্য মানে ইলিশ, আতা আর আম নিয়ে কিঞ্চিৎ বিব্রত হতেন। ইলিশের কাঁটা, আতার বীচি আর আমের রস হাতমুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ার ভয়ে। “ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, বৈশাখ মাসের এক তারিখে আইসো আমার বাড়ি” তিনি হয়তো এই জনপ্রিয় লোকগানটি শোনেননি। বোয়াল মাছের দাড়ি থাকুক আর না থাকুক অন্যান্য মাছের তুলনায় ইলিশের কাঁটাই যে তার অহঙ্কার এবং একইসাথে অলঙ্কার, তা ইলিশপ্রেমীরাই জানেন।
গানটি শুনলেও বোঝা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য বন্ধন যে পয়লা বোশেখ নিয়ে, সেখানে বৈশাখী ইলিশ স্বাদেগন্ধে তেমন আহামরি না হলে্ও, ওপারবাংলায় পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছভাজার গাঁটছড়া সেই আদ্যিকালেরই সংস্কার। কারণ বর্ণে, গন্ধে, স্বাদে ও রূপেতে হৃদয়ে দোলা দিতে রূপোলি ইলিশের আগমন মূলত বর্ষাতেই। যদিও এপারবাংলাতে মহার্ঘ্য হোটেল রেস্তোরাঁয় পণ্যসংস্কৃতির বানভাসি জোয়ারে, পয়লা বৈশাখের মেনুতে ইলিশভাপা না রাখলে এখন যেন জাতে ওঠেনা তারা। তা সে গত মরশুমের বরফাচ্ছন্ন ইলিশ হোক বা কাঁচা কুমারী। আসলে ইলিশের স্বাদের মূলে অনবদ্য এক গাঙ্গেয় রসায়ন।

সেই যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের জাদুকরি জাগলিংয়ে ইলিশ বন্দনা?
‘হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়
ইলশেগুঁড়ির নাচ,
ইলশেগুঁড়ির নাচন দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ।’
অথবা
‘ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।’
তা বাংলাভাষার মিষ্টতায় যাদু আছে বলেই না এখানে বৃষ্টির নাম ইলশেগুঁড়ি আর সে ছড়া এখন গান হয়ে ফিরছে লোকের মুখে?
সারাবছর হাপিত্যেশ বর্ষার মরশুমি ইলিশের জন্য। মাঝে মাঝে তব দেখা পাই। সারাটিবছর পাইনা।
বৃষ্টির সঙ্গে তার যে এক প্রগাঢ় রসায়ন। ইলিশের পতিগৃহ যেন সাগরের নোনা জলে আর পিতৃগৃহ আমাদের গঙ্গা-পদ্মায়।
পুব হাওয়াতে দেয় দোলা, সবেমাত্র বঙ্গে মৌসুমিবায়ুর খেলা। তার প্রভাবে মেঘকালো দিন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিফোঁটায় সদ্য প্রাণ পেয়েছে নদীনালা। অবিরাম ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তেই থাকবে আর ঠিক তখনি ঝাঁকেঝাঁকে গভীর জলের ইলিশমাছ সমুদ্রের নোনাজল সাঁতরে, জোয়ারের আনুকূল্যে স্বল্প পরিশ্রমে, নদীর কাছে আসবে, আমাদের ধরা দিতে। বলবে, বাঙালি, তোমার জলকে নেমেছি। ঝাঁঝালো সর্ষের তেল, কালো সর্ষে আর কাঁচালংকা আছে তো ঘরে?
ঠিক যেন বিদেশের সামন মাছের মত। আলাস্কায় গিয়ে সেই গল্প শুনেছিলাম বটে। এত মিল এই দুই মাছের? হতেই হবে তো। সব রহস্য লুকোনো সেই অমোঘ রাসায়নিক পদার্থটির মধ্যে, যার নাম ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। হ্যাঁ, ইলিশের এই স্নেহপদার্থটিই হল তার স্বাদ ও ঘ্রাণের মূলে, যা শরীরের ভালো কোলেস্টেরল বাড়িয়ে আমাদের হৃদযন্ত্রটিকে সুস্থ রাখে। বলে না! স্নেহ অতি বিষম বস্তু! তাই বুঝি এত দাম আর কদর এই মাছের সারাবিশ্ব জুড়ে। (Hilsa)

ইলিশ মানেই মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম ইলিশমাছ। ইলিশ মানেই মেঘলাদিনের একলা ঘরে, মন খারাপের অবসান ঘটিয়ে ইলিশের ডিম ভাজা মুখে চালান। অতি আদরের এই রূপোলি সজীব শস্য ঘরে এলে আজকাল ভাতের হাঁড়িতে দুমুঠো চাল হয়তো ফেলতে বলিনা ননদিনীকে, কারণ আমাদের ভাতের পোর্শন আজ পরিমিত। কিন্তু ইলিশে তো আর লাগাম নাই। অতএব খাও খাও বুঁদ হয়ে ডুবে যাও। তেলের সঙ্গে একপিস ভাজা, ডিম, একপিস ভাপা আর ল্যাজামুড়ো দিয়ে ছ্যাঁচড়ার নাম শুনলেই আমার মতো ইলিশপ্রেমী বাঙালির স্যালাইভারি গ্ল্যান্ড সক্রিয় হয়ে ওঠে বৈকি। (Hilsa)

ছোটবেলায় আচমকা স্কুলে রেনিডে হলে খুব মজা হতো। গঙ্গার ধারেই বাড়ির কাছ দিয়ে এক দশাশয়ী হিন্দুস্তানী ইলিশমাছওয়ালা হেঁকে যেত “হিলিশ মাছ গোঙ্গা” বলে। আর মা হয়তো সেদিন তার কাছ থেকে একটা ইলিশ কিনেই ফেলেছেন। বাড়ি ফিরে অপ্রত্যাশিত ছুটির দুপুরে বৃষ্টি আর হঠাৎ ইলিশপ্রাপ্তির অনুষঙ্গে মন তখন কানায় কানায় !
মায়ের সারপ্রাইজ। (Hilsa)
উনুনপিঠে হাঁড়ির মধ্যে গরম ভাত আর তার মুখে চাপা দেওয়া একটা টিফিনকৌটোর মধ্যে বন্দী ইলিশমাছের ভাতে বা ভাপা। হলুদ পড়বেনা এই পদে। টাটকা মাছের গন্ধ নষ্ট হয়ে যাবে। কৌটোর মধ্যেই নুন মাখানো ইলিশের গাদা-পেটি সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বাটা, কাঁচা সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কার সঙ্গে জারানো জ্যান্ত ইলিশ ভাপার স্বাদই ছিল আলাদা। আর মায়ের কিচেন টিপস হলো, শিলে যেন সর্ষে অল্প অল্প জল দিয়ে একবাটা হয় আর তা অবশ্যই চন্দনের মত। ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে ৫ মিনিট রেখে দিলেই এই অমূল্য পদ তৈরি। (Hilsa)

আমার রন্ধন পটিয়সী দিদিমা আবার বড় সংসারে ভাত ফোটাবার সময়, বিশাল এক কচুপাতার মধ্যে মাছগুলিকে ম্যারিনেট করে পাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে বিরাট হাঁড়ির মুখে বসিয়ে দিতেন। মা বলত, সে ভাপা ইলিশের নাকি অন্য স্বাদ। দিদিমার নাতনি, মানে এহেন আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে এই কায়দাটি করি লাউ বা কুমড়ো বা পুঁইপাতায় মুড়ে এবং ননস্টিক প্যানে, অর্থাৎ পাতুড়ির স্টাইলে। কাঁচা তেলঝাল, ভেজে পাঁচফোড়ন দিয়ে ঝাল, গায়ে মাখামাখা হলুদ সর্ষেবাটার ঝাল, বেগুন দিয়ে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বাংলাদেশের পাতলা ঝোল…সবই যেন এই বর্ষায় দৌড়ায় গরম ভাতের সঙ্গে।
তাবে আমি বাপু রসুন-পেঁয়াজ-আদা সহযোগে ইলিশমাছের স্বাদ ও গন্ধ কোনোটাই পাইনা। এমনকি আমার দাদাশ্বশুরের মত কাঁটা বেছে খেতে যারা ভয় পান, তাঁদের স্মোকড হিলসা অথবা ইলিশ বিরিয়ানির ফিউশনের স্বাদ নিতে আমি অক্ষম। (Hilsa)

আর বাবার মুখে শুনেছি আরেক গল্প। কিশোরবেলায় আড়িয়াদহের গঙ্গায় সাঁতার কেটে ওপারে উত্তরপাড়ায় দিদির বাড়ি যেতেন তিনি। যাবার আগে আমার ঠাম্মা দুটো আধুলি পকেটে বেঁধে দিয়ে বলতেন, ভালো ইলিশ পেলে কিনে আনতে। দিদির বাড়ি মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিকেলে বাবা আবার নৌকা করে বাড়ি ফিরতেন আর তখনই এক টাকায় গোটা এবং জ্যান্ত ইলিশ কিনে মায়ের হাতে তুলে দিতেন। আর তারপরেই শুরু হত আমার ঠাম্মার ডানহাতের খেল। মাছ কোটা থেকে শিলে মশলা পেষা…এসব ছিল খুলনার ভূমিকন্যার দস্তুর মতো হাতের কারসাজি। আর রান্নার তরিবৎ কী আর বলি? বড় সংসারে অর্দ্ধেক মাছ সেদিন রাতে হবে আর পরদিনের জন্য তোলা থাকবে ভাজা। পুঁইশাক, কুমড়ো, মুলো এলে হবে মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়া। (Hilsa)
আমার ছোটোপিসিমার বিয়ে হয়েছিল বিহারের দ্বারভাঙায়। সেখানে কলকাতার স্বাদের ইলিশ মেলেনা। অতএব প্রতিবার বাপের বাড়ি এলেই বাবা আদরের বোনের জন্য দুটো ইলিশ কিনে আনতেন। সেই মাছ ধুয়ে-কেটে নুন, হলুদ আর সর্ষের তেল দিয়ে জারিয়ে মুখবন্ধ মাটির হাঁড়ি করে পিসিমা নিয়ে যেতেন রাত্রিব্যাপী রেলযাত্রায়। নোনা ইলিশের স্বাদ নাকি আরও ভালো। (Hilsa)

বাংলার মৎস্যগন্ধী সাহিত্যসাগরে ইলিশ এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস। মাছের মধ্যে ইলিশ নিয়ে একটু বেশিই পক্ষপাতদুষ্ট যেন বাংলার কবি সাহিত্যিকরা। বিদগ্ধজনের মতে নাটক বিনে যেমন ইংরেজি সাহিত্য অন্ধ, তেমনি ইলিশ বিনে বাংলাসাহিত্য। তবে তা অনেক যুগ পরে। (Hilsa)
মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ইলিশের নাম অন্যান্য মাছের তুলনায় কম। সর্বানন্দের ‘টীকাসর্বস্ব’ বইতে তার উপস্থিতি ‘ইল্লিষ’ রূপে। দিগেন বর্মণের ‘ইলিশ পুরাণে’ দ্বাদশ শতকের জীমূতবাহনের লেখায় ইলিশের তেলের ব্যাবহার রয়েছে। সেই সঙ্গে লখীন্দরকে সর্ষে শাক দিয়ে ইলিশ রেঁধে খাওয়াচ্ছেন বেহুলার ভ্রাতৃবধূ তারকা। এমনকি বেহুলার বাবা পাত্রপক্ষকে যে ১৫ রকম মাছের পদ দিয়ে আপ্যায়ন করছেন সেখানে ইলিশভাজার উল্লেখ আছে। পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে লখিন্দর জন্মাবার আগে সনকার সাধ ভক্ষণে নানাবিধ পদের সঙ্গে দক্ষিণ সাগরের কলা দিয়ে ইলিশের ঝোলের কথা রয়েছে – “আনিয়া ইলিশ মত্স্য/ করিল ফালাফালা/ তাহা দিয়ে রাঁধে ব্যঞ্জন/ দক্ষিণসাগর কলা”। (Hilsa)
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে যে “পাঙ্গাস ইলিশা”র কথা আছে সেই পাঙ্গাসের অর্থ অনেকের মতেই বৃহৎ। ১৮২২ সালে হ্যামিল্টন বুকানন নামে এক সাহেব বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে গবেষণার সময় “হিলসা” শব্দটি জুড়ে দেন। আর সেই হিলসা ও ইলীশা মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
অতএব উচ্চকোটির জীবনযাত্রায় শুভকাজে ইলিশের গতায়ত যে অনায়াস ছিল তা বোঝাই যায়। আমরা ইলিশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাকে মাছের রাজা বা রাণীর আদর দিই না কেন অথবা বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে ইলিশের স্থান সর্বোচ্চে বলে দাবী করি না কেন, শাস্ত্রকারেরা কিন্তু রুই বা রোহিতকেই মৎস্য শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন। প্রবাদেও বলে “মাছের সেরা রুই, শাকের মধ্যে পুঁই”। (Hilsa)
আর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে যে “পাঙ্গাস ইলিশা”র কথা আছে সেই পাঙ্গাসের অর্থ অনেকের মতেই বৃহৎ।
১৮২২ সালে হ্যামিল্টন বুকানন নামে এক সাহেব বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে গবেষণার সময় “হিলসা” শব্দটি জুড়ে দেন। আর সেই হিলসা ও ইলিশা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। ইলিশ যে সে যুগেও মহার্ঘ্য ছিল, তার প্রমাণ ময়মনসিংহ গীতিকা। সেখানে মাছের রাণী ইলিশের স্থান, এক অমূল্য পণ্য হিসেবে – ‘সেই ইলিশের দাম হইল সোনায় একুশ ভরি মাছ ইলিশারে’। (Hilsa)

তবে সৈয়দ মুজতবা আলী আমার মত অনেকের সঙ্গেই রীতিমত বায়াসড ছিলেন তাই বলেছিলেন, বেহেশতের খাবারের বর্ণনায় যদি ইলিশের কথা উল্লেখ থাকত, তাহলে কেউই পাপ করে নরকে যেত না। আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কতয় হল” গল্পটি সবাইকে বেশ কয়েকটি গোল দিতে পারে অনায়াসে। লেকমার্কেট থকে ইলিশ কিনে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্রামে, সাইকেল রিকশায় এবং সবশেষে বাড়িতে ঢোকামাত্রেই সবার মুখে এক কথা “কতোয় হল?” অর্থাত মাছটির দাম কত শুনতে শুনতে থকে যেতে হয়েছিল। সবশেষে তাঁর প্রশ্ন, যদি ভদ্রলোক অন্য কোনো মাছ ঝুলিয়ে নিয়ে এভাবে আসতেন তবে কি কেউ তাঁকে এমন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতো? (Hilsa)
বাঙালি লেখকদের লেখায় যুগে যুগে এই ইলিশ বিলাসিতা তাঁদের অকুন্ঠ ইলিশ প্রীতি থেকেই। বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে ইলিশের স্থান সর্বোচ্চে থাক বা সংস্কৃতের প্রাচীন শ্লোকের প্রামাণ্য দলিল রূপে ইলিশের উপস্থিতি থাকুক, “সর্বেষামেব মতস্যেনাম ইল্লিশ শ্রেষ্ঠ উচ্চতে”, অর্থাৎ মাছের মধ্যে সেরা হল ইলিশ… এই বলেই আপাতত শত্রুমুখে ছাই দিক এহেন ইলিশায়ন। (Hilsa)
ছবি সৌজন্য: অন্বেষা চট্টোপাধ্যায়
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।