(Village Fish Recipe)
শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্র এল। বহু বছর পর এমন করে আষাঢ়-শ্রাবণ ধরা দিল। কদমের ডালে ডালে ফুল এল, ভিজে মাটিতে বনজ ঘাসপাতারা অকাতরে ভিজল। ভিজে একসা হতে হতে কত মানুষের কত যে বীজতলা ভেসেই গেল তার ঠিক নেই। কেবল যেসব জমিতে পাটের চাষ! তারা হেঁটোজলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এই পৃথিবীটা তো কেবল মানুষের নয়! জমা জল নিয়ে আপিস আদালতের জীবন নাজেহাল হয়ে যায়। হবে নাই বা কেন! কিন্তু চাষিজীবনের নাজেহাল হলেই বা উপায় কী আর! আকাশের দেবতা চেয়েছেন বলেই না এমন বর্ষা! গাঁ-গেরামের মানুষ এখনও তাই বিরক্ত হয় না সহজে। হতাশ হয়, ক্লান্ত হয়। জল নেমে গেলে আবার মাঠে মাঠে চাষ শুরু হয়। (Village Fish Recipe)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫]
শামুকখোল আর মদনটাকেরা তখন ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক। যাদের পুকুর উপচে গিয়েছিল, তারা পুকুর পাড়ে ঘুরে ঘুরে জালের বেড়া দেয়। এইসব মিলিয়েই আমার কেবলই মনে হয় শ্রাবণ পেরিয়ে আসা ভাদ্রদিন একই সঙ্গে কড়ি ও কোমলের আশ্চর্য সুরে বাঁধা। একদিকে তার মেঘনীল রঙা আকাশ, মেঘের রূপোলি পাড়, জলের আয়নায় গাছেদের ছবি। অন্যদিকে, সংসারী মানুষের স্বভাবে কেজো গার্হস্থ্যকে ভুলে গেলে তার চলে না। বানভাসি বীজতলা থেকে উপচে পড়া ডোবা পুকুর, বেড়ে যাওয়া শাকসবজির দাম, খোড়ো চাল মেরামতের হাজারো চিন্তা… এই সবটা নিয়েই শ্রাবণের দিন। (Village Fish)

আর ভাদ্রের আকাশ কী আশ্চর্য রঙে ঔদাসীন্যের ডালিখানা সাজিয়ে তুলেছে যেন। যাঁরা বৈষ্ণব পদাবলীর নিবিড় পাঠক তাঁরা জানেন, বর্ষাকে মহাজন পদাবলী এক ভাবে চিনেছিল। সেই বর্ষা মানুষকে করে তুলতে পারে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। সেই বর্ষা বিরহের সুরটিকে চিনে নেয় ডাহুক আর ব্যাঙেদের সুরে ও স্বরে। অথচ, একদিকে এই শরতের মধ্যে গার্হস্থের সুর যেন অপার্থিব জীবনকেই ছুঁতে চায় বারে বারে। (Village Fish Recipe)
হাটবারে হাটবারে আমাদের চারঘাটের হাটে ইলিশ উঠত, সেই কাঁচা ইলিশের স্বাদ গন্ধ ছিল একরকম। কিন্তু ইলিশ তো আর রোজ আসে না! গেরস্তের ভাতের পাত আলো করে থাকে কতসব সাধারণ স্বাদ। বনজ কুসুমের মতো তারা নির্ভার, তারা সুন্দর।
অন্যদিকে পার্থিব ইন্দ্রিয়চেতনার মধ্যে কোন সে অপার্থিব সত্তাকে যেন সে খুঁজে ফেরে। এই খোঁজ কি কেবল রসিকজনের? এই খোঁজ কি পার্থিব জীবনের নয়! রান্নাঘর একভাবে চিনেছিল বর্ষা আর শরতের সুরকে। মেঘে ঢাকা খারকোল পাতা থেকে গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠা পিপুলের শরীর, ইলিশের রূপোলি মেদুরতা দিয়ে গড়ে ওঠা এ যেন এক অন্য রান্নাঘর। পৃথিবীরই গন্ধ দিয়ে ঘেরা।মাছ আর অ-কর্ষণজাত গাছপালাদের সান্নিধ্যকে রান্নাঘর আবিষ্কার করেছিল নিজের মতো করে। কাঁঠালদানায়, কচুরশাকে, শুকনো মাছের মরিচবাটা চচ্চড়িতে বর্ষা ধরা দিয়েছিল হয়তো বা! (Village Fish Recipe)

কিন্তু শরতের মেঘে ডানকানা মাছেদের জলপাই উজ্জ্বলতা! সে কি কম হল! কেউ বা বলবেন, তা কেন! সেই আমাদের ঘুনি পেতে মাছ ধরা, ছিপ হাতে নালার পাশটিতে গিয়ে বসা! সেসব কি সত্যি নয়! কী ভীষণ ব্যক্তিগত এই ভাতের থালার নির্মাণ। হয়তো প্রতিটি ঋতুতেই এমন করে ঘরে ঘরে ভাতের থালারা সেজে ওঠে। শরৎ আর বর্ষাকে সে নিবিড়ভাবে পায় আসলে। এই নিবিড় নির্জনতাকে রান্নাঘর অর্জন করেছে নিজের গৌরবেই। (Village Fish Recipe)

যে মানুষ উবু হয়ে বসে বসে হাট করে শ্রাবণের দিনে, দর করেও ইলিশ কিনতে অসমর্থ হয়! শরতের উপচে পড়া নদীনালা কিন্তু তাকে ফেরায় না। ঘুনির মাছে, কচুর শাকের মোলায়েম হয়ে আসা ব্যঞ্জনে সে ভাতের থালাখানি ভরিয়ে দেয়। আমরা যারা গাঁয়ে গঞ্জে বড় হয়েছি, জীবনকে তারা এভাবেই পেয়েছি নিরন্তর। আধভিজে কাঠ, কাঠের উনোনের ধোঁয়া আর রোদ্দুর উঠলেই গুল দেওয়ার ছবি মনের মধ্যে আলপনা এঁকে গেছে অনবরত। (Village Fish Recipe)

হাটবারে হাটবারে আমাদের চারঘাটের হাটে ইলিশ উঠত, সেই কাঁচা ইলিশের স্বাদ গন্ধ ছিল একরকম। কিন্তু ইলিশ তো আর রোজ আসে না! গেরস্তের ভাতের পাত আলো করে থাকে কতসব সাধারণ স্বাদ। বনজ কুসুমের মতো তারা নির্ভার, তারা সুন্দর। আর কেউ না জানুক, গার্হস্থ্য মন তাদের একভাবে চিনেছে ঋতুতে ঋতুতে। জীবন আসলে অনেক রকম।
একেকদিন তাই হাঁটু ডোবানো জলে, এই কাদায় ডোবা গোড়ালি পেরিয়ে কলমির ডগা তুলতে সাধ হয়। সাধে আর কিছু না হোক, সাধ্যকে মনে রাখতেই হয়। সেই তো সংসারের নিয়ম। শ্রাবণের জলে শরতের পৃথিবী শাকপাতায় কন্দে সেজে উঠছে। এই সজ্জায় চমক নেই, লাবণ্য আছে। ভাতের থালায় সেই লাবণ্যেরই ছায়া পড়ে। ছায়া অবশ্য মায়াও সৃজন করতে পারে মেঘমেদুরতায়। (Village Fish Recipe)
পাঁকাল মাছের তেল ঝাল
উপকরণ: পাঁকাল মাছ, সর্ষের তেল, পেঁয়াজ বাটা, এক-দুই কোয়া রসুন কুচানো, কাঁচালঙ্কা কুচানো, কাশ্মীরী লঙ্কাবাটা, অল্প তেঁতুলের মাড়ি, হলুদের গুঁড়ো, নুন এবং সামান্য মিষ্টি।

পদ্ধতি : পাঁকাল মাছগুলো খুব ভালো করে পরিষ্কার করে নুন হলুদ মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিন। কড়াইতে অল্প জল দিয়ে এক চামচ তেল ও নুন হলুদ দিয়ে মাছ সেদ্ধ হতে দিন। মাছ সেদ্ধ হবে কিন্তু অটুট থাকবে, জলও শুকিয়ে যাবে- সেই আন্দাজে জল দেবেন। আবার পরিষ্কার কড়াই বসিয়ে সর্ষের তেল দিন। তেল গরম হলে কুচানো রসুন ও লঙ্কা দিন। সুন্দর গন্ধ উঠলে পেঁয়াজ বাটা দিন। সময় নিয়ে কষিয়ে নিন।
কাঁচা গন্ধ চলে গেলে কাশ্মীরী লঙ্কাবাটা, হলুদের গুঁড়ো ও নুন দিন। মশলা তেল ছেড়ে দিলে মাছ দিন। নরম আঁচে মাছ মশলায় মেখে যেতে দিন। অল্প জল দিন। বেশ ভালো মতো রান্না হলে তেঁতুলের মাড়ি দিন। স্বাদমতো মিষ্টি দিন। আরেকটু কাঁচা তেল ও কাঁচা লঙ্কা ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। টক-ঝাল স্বাদের এই রান্না খেতে বেশ ভালো। (Village Fish Recipe)

কচু পাতা দিয়ে চেলা মাছের চচ্চড়ি
উপকরণ: চেলা মাছ, দুধ কচুর পাতা, নুন, সর্ষের তেল, কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা।
পদ্ধতি: চেলা মাছগুলো পরিষ্কার করে নুন হলুদ মাখিয়ে ভেজে নিন। দুধ কচুর পাতাগুলো কেটে জল ঝরিয়ে ভাপিয়ে নিন। জল ঝরতে দিন, যতটা সম্ভব জল বের করে নিন চেপে চেপে। কড়াই বসান। তেলে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিন। সামান্য কাঁচালঙ্কা বাটা (ইচ্ছে হলে) দিয়ে কষিয়ে নিন। এবারে ভাপিয়ে রাখা কচুপাতা দিন। নুন আর খুব সামান্য হলুদ দিয়ে রান্না হতে দিন। চাইলে এক চামচ নারকেল বাটাও দিন। ভাজা মাছ মিশিয়ে চাপা ঢাকা দিয়ে রান্না হতে দিন। বেশ মিলেমিশে গেলে কাঁচালঙ্কা ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। (Village Fish Recipe)
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, Wikimedia Commons, Fishigo, ChatGPT, YouTube
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।