ভোপালে তো দীর্ঘদিন মহিলারা রাজত্ব চালিয়েছেন, সেই রকম ব্যক্তিত্বেরই মানুষ ছিলেন আম্মা (সাজিদা সুলতান)। দক্ষ প্রশাসক, কর্তৃত্ব সব সময় নিজের হাতে, কিন্তু গলা কখনওই এতটুকু চড়বে না। কম ছিল না তাঁর অনুগামীর সংখ্যা। এদিকে মুক্তমনা। নইলে অভিনেত্রী পুত্রবধূকে মেনে নিলেন কী করে? কাজটা খুব সহজ ছিল না, আম্মার দ্বিধাও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু বুঝেছিলেন, ছেলে মন স্থির করে নিয়েছে। সব দ্বিধা কাটিয়ে একবার যখন বিয়েতে সম্মতি দিলেন, তখন থেকে তিনি কিন্তু অকুণ্ঠ। অনেক উপহার পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে, অনেক গয়না, অনেক শাল, আরও অনেক কিছু। তার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে দামি আম্মার নিজের বিয়ের জোড়। হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এটা পরে বিয়ে করবে আর যত্ন করে রেখে দেবে। তাই রেখেছিলাম। সইফের বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে করিনার হাতে দিয়ে বললাম, এটা পরে বিয়ে করবে আর যত্ন করে রেখে দেবে।

আম্মা পোলো খেলতেন, শিকার করতেন, দারুণ উৎসাহ ছিল নানা রকম খেলাধুলোয়। বাবা এবং স্বামী দু’দিকেই পেয়েছেন দক্ষ খেলোয়াড়। পোলো আর শিকারের জন্যে যথেষ্ট সুনাম ছিল আম্মার বাবা নবাব হামিদুল্লার। অন্যদিকে স্বামী নবাব ইফতিকার আলি খান পটৌডি, বডিলাইন সিরিজের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ডের হয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। পরে ভারতের ক্রিকেট ক্যাপ্টেন হয়েছেন, হকিতেও অলিম্পিক খেলেছেন ভারতের হয়ে। ক্রিকেটের সঙ্গে বিলিয়ার্ডও খেলতেন অক্সফোর্ডের হয়ে। আর মারা যান পোলো খেলতে খেলতে হার্ট অ্যাটাকে। সরকার তখন ৪২, আর আম্মা মাত্র ৩৭। সেটা ছিল টাইগারের ১১ বছরের জন্মদিন।

আমি যখন আম্মাকে প্রথম দেখছি, খুব ফর্সা আর সুন্দরী তখন তিনি। অনুগামীদের বাদ দিলে অল্প কয়েক জনই বন্ধু-বান্ধবী ছিলেন আম্মার। সামাজিকতা করতে আমি খুব একটা দেখিনি আম্মাকে। গাড়ি চালাতেন খুব। ভালো মতোই চিনতেন নিজের স্পোর্টস জাগুয়ার গাড়ির এঞ্জিন। ছোটখাটো মেরামতি নিজেই করে নিতেন। মেকানিক এলেও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নির্দেশ দিয়ে যেতেন, কী করতে হবে, না হবে। নানা রকম যন্ত্রপাতি থাকত তাঁর টুল রুমে। অবাক হয়ে দেখতাম কী ভাবে সেই সব যন্ত্র ব্যবহার করে নিজের হাতে কাঠের কাজ করছেন!
[the_ad id=”266918″]
সবচেয়ে অবাক হতাম ঝাড়বাতির মেরামতি দেখে। ভাঙা ঝাড়বাতি জুড়ে জুড়ে নতুন ঝাড়বাতি তৈরি করার আশ্চর্য দক্ষতা ছিল আম্মার। তাছাড়া এমব্রয়ডারি জানতেন, সেলাই জানতেন, রেজাই বানাতে দেখেছি আমি। গোলাপের কলম করার কথা তো আগেই বলেছি। বাগান সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ছিল তাঁর। পটৌডিতেও খুব সুন্দর গোলাপ বাগান করেছিলেন আম্মা। আর, ক্রসওয়র্ড সলভ করতে পারতেন চমৎকার, নেশাটা ওঁর কাছ থেকেই পেয়েছি আমি।

আরও একটা নেশা ছিল আম্মার, সেটা পানের নেশা। পান আসত বেনারস থেকে, ‘কথথা’ বা খয়ের তৈরি হত ভোপালে। আর, ছালিয়া বা সুপুরি আসত মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি থেকে। একজন কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে আম্মা নিজেই সেই সুপুরি কাটতেন। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমি চেষ্টা করেছিলাম এই পানদানের রেওয়াজটা চালু রাখতে। কিন্তু আম্মা আর তাঁর বন্ধুরা ছাড়া আমাদের চেনাশোনা কেউই তো পান খায় না। তাহলে কার জন্যে আর করা? সরকার, মানে আম্মার স্বামী ভালো হারমোনিয়াম বাজাতেন। টাইগারও বাজাত বাঁশি, হারমোনিয়াম আর তবলা। সেকালে সঙ্গীতের একটা ‘মাহোল’ লেগে থাকত ওঁদের বাড়িতে। আমি আম্মাকেও দেখেছি মুশায়রা আর গান শুনতে যেতে।
[the_ad id=”266919″]
আম্মা খেতে খুব ভালোবাসতেন আর অতি কেতাদুরস্ত আয়োজন ছিল তাঁর খাওয়াদাওয়ার। বাগানে বসে খেতে পছন্দ করতেন, আর শীত-গ্রীষ্মে আবহাওয়া বুঝে বুঝে খাওয়ার জায়গা বেছে নিতেন। কি দুপুরে, কি রাতে। ব্যাপারটা ছিল এইরকম, উনি যেদিন বাগানের যে জায়গাটায় বসবেন, সেখানেই খাবার সাজিয়ে দিতে হবে। খাবার মানে শুধু খাবারই তো আর নয়, টেবিল চেয়ার থেকে সমস্ত বাসন-কোসন, মায় উগলদান মানে পিকদানি পর্যন্ত স-ব! তার সঙ্গে ছিল ছিলমচি, যাদের কাজ খাওয়ার আগে এবং পরে সকলের হাত ধুইয়ে মুছে দেওয়া।

উগলদান বলতেই একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল। আম্মার বাতিল করা খুব সুন্দর একটা রুপোর পিকদানি বেশ কিছুদিন ধরে পড়ে থাকতে দেখে আমি সেটা আমাদের বম্বের বাড়িতে এনে তার মধ্যে ফুল সাজিয়ে রাখতে শুরু করি। সেটা হঠাৎ একদিন আম্মার চোখে পড়তেই কী ভয়ানক কাণ্ড! ছি ছি, কী করেছ তুমি! উগলদানকে ফুলদানি বানিয়েছ! যতই বলি, আরে ওটা তো আর কেউ পিকদানি হিসেবে ব্যবহার করছে না, সে কথা কানেই তুলবেন না। ঘেন্নায় আর তাকাতেই পারছেন না সেদিকে। রান্নাও করতেন ভালোই, যদিও রান্না করতে তেমন ভালোবাসতেন না।
[the_ad id=”270084″]
ভোপালে আম্মার রসোইয়ের দস্তুরটা একটু বলি। একজন শুধু চাপাটি তৈরি করবে, একজন শুধু কাবাব, আরও একজন শুধুই মিঠাই। অন্যান্য পদের জন্যে আরও আরও লোক। তেল নয়, রান্না হবে শুধু ঘি দিয়ে। তার মধ্যে হয়ত একদিন আম্মা তৈরি করছেন মালাই। বিশাল বড় ডেকচিতে দুধ ফোটানো হচ্ছে, ফুটে যাওয়ার পর ঠান্ডা করে আবার আস্তে আস্তে ফোটানো হচ্ছে, তার সঙ্গে চলছে ‘উছালো’, মানে বাংলায় যাকে বলে সাঁতলানো। প্রায় আধঘণ্টা ধরে এই কাণ্ড চলার পর উনুন থেকে নামিয়ে ডেকচির মাথায় জালিকা পরিয়ে মালাই জমতে দেওয়া হবে। খুব ভালোবাসতেন এই মালাই, প্রতিদিনই চাই দুপুরে এবং রাতে।

দিল্লির বাসিন্দা হওয়ার পর ১৯৮৬ সালে আম্মার যখন শরীর খারাপ হল, টাইগার বলল আম্মাকে আর একা রাখা ঠিক হবে না। ততদিনে টাইগার খেলা ছেড়েছে, আমারও কাজ অনেক কম। আমরা বম্বের পাট তুলে পাকাপাকি দিল্লি চলে এলাম। ডাক্তারের পরামর্শে বন্ধ হল আম্মার জন্যে ঘিয়ের রান্না, দু’বেলা মালাই, সব। আম্মা তখন সকলের কাছে নালিশ করতেন, ছেলের বউ আমাকে না খাইয়ে রাখছে।
[the_ad id=”270085″]
আম্মার কথা শেষ করার আগে একটা কথা বলা দরকার। আম্মা কিন্তু কখনও আমার কোনও স্বাধীনতা বা ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করেননি। কখনও আমাদের শোবার ঘরে পা রাখেননি। কখনও কোনও ধর্মাচরণের নির্দেশ দেননি। উল্টে আমারই মনে হয়েছে, যে পরিবারের বউ হয়ে এসেছি, সেই পরিবারের রীতি-রেওয়াজ যদি শিখে না নিই, তবে ছেলেমেয়েদের শেখাব কী করে!
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।