banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কিস্তি: ছোটগল্প

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

illustration by sankha karbhaumik

একমাসের ছেলেকে কোলে নিয়েই হাসপাতালের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে রুমকি। ছেলেটা এক্কেবারে কান্না থামাচ্ছে না। খানিক আগেই বুকের দুধ খাওয়াল। নিজের শরীরটাও এখনো সারেনি। সেই কখন থেকে একভাবে বসে আছে। পায়ে ব্যথা করছে। কয়েক পা হাঁটতেই হাসপাতালের এক আয়ামাসি বলে উঠল, ‘তোমাকে যে এক জায়গায় বসতে বললাম? এই রাতের বেলা এখানে সবাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, তার মধ্যে যদি তোমার বাচ্চা এমন চিৎকার করে, কার ভাল লাগবে শুনি?’ রুমকি আর কোনও উত্তর না দিয়ে আয়ামাসির কাছে গিয়েই জিজ্ঞেস করে, ‘ও দিদি, আর একবার একটু জিজ্ঞেস করে দিন না।’ 

— আহ বড্ড বিরক্ত কর তো… এই তো মিনিট দশেক আগে বললাম। জ্ঞান এলে তোমাকে ঠিক জানিয়ে দেওয়া হবে। এখন পিছন দিকে ওই চেয়ারে চুপচাপ বসে থাক। 

রুমকি এক পা এক পা করে পেছনের দিকে গিয়ে মেঝেতেই বসে পড়েযাক। ছেলেটা একটু ঘুমিয়েছে। কিন্তু বড়টা কেমন আছে কে জানে? ওরা খেতে দেবে তো? কিছুই তো বলে আসা হয়নি। পুলিশ এসে খবর দিল। ওমনি এক কাপড়েই বেরিয়ে পড়ল। বেরুবার সময় শুধু পাশের ঘরের টিঙ্কুর মাকে বলে এল, ‘মেয়েটাকে তোমাদের ঘরে একটু রাখ না গো, আমি হাসপাতালে যাচ্ছি, ওর বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’ অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে পাড়ার অনেকেই সঙ্গে যাবার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। রুমকি তাদের সবাইকে বলেছে ‘আমার কাছে টিঙ্কুর মায়ের ফোন নম্বর আছে, দরকার লাগলে আমি ফোন করে দেব।’ বেশি কিছু বলাও যাচ্ছিল নাওদিকে পুলিশ তাড়া দিচ্ছিল। সব কিছু ছেড়েই বেরিয়ে পড়তে হল।

 এক একটা দিন যেন কোথা থেকে কী হয়ে যায়। বেশ খেয়ে দেয়ে মানুষটা কাজে বেরল। একজন পাইকারের কাছে মার্কেটিংয়ের কাজ করে।ওরাই একটা পুরনো বাইকের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেটা নিয়েই এ দোকান সে দোকান করে বেড়ায়। রাস্তায় কার কী হবে কে বলতে পারে? এই তো মেয়েটার মোটে তিন বছর বয়স, আর ছেলেটা এক মাস। এরই মধ্যে আবার হাসপাতালে চলে আসতে হল। আত্মীয় বলতে এখানে কেউ থাকে না, থাকলেও এই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াত কিনা তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। 

রুমকি আর ভাবতে পারছে না। সেই সকাল সাড়ে দশটায় এখানে এসেছে, এখনও পেটে কিছু পড়েনি। পাশে দাঁড়িয়ে খাবার কথা বলবার মতোও কেউ নেই। হাসপাতালের লোকজন অনেকক্ষণ আগেই কমে গেছে। এখন যারা আছে, তারা সবাই তাদের পেশেন্টের জন্যে রাতে থাকতে এসেছে। রুমকি একবার চারদিকটা দেখে নিয়ে দেওয়ালে মাথা হেলান দিয়ে বসে থাকে। হঠাৎ মাইক গমগম করে ওঠে — ‘পেশেন্ট পার্টি নম্বর সেভেন বাই এইট হান্ড্রেড টুয়েনটি সেভেন, এক্ষুনি রিসেপশনের পাশের রুমে দেখা করুন।’ 

ছেলেটা একটু ঘুমিয়েছে। কিন্তু বড়টা কেমন আছে কে জানে? ওরা খেতে দেবে তো? কিছুই তো বলে আসা হয়নি। পুলিশ এসে খবর দিল। ওমনি এক কাপড়েই বেরিয়ে পড়ল। বেরুবার সময় শুধু পাশের ঘরের টিঙ্কুর মাকে বলে এল, ‘মেয়েটাকে তোমাদের ঘরে একটু রাখ না গো, আমি হাসপাতালে যাচ্ছি, ওর বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’

কথাগুলো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকের চেয়ার থেকে এক ভদ্রমহিলা এক্কেবারে হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছুটে গেলেন। পিছনে আরও দু’টি কমবয়সি মেয়ে। খানিক পরে তিনজনেই কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসে। বয়স্ক মহিলা কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকেন ‘সব শেষ, আমার সব শেষ।’ ভদ্রমহিলার কাছে জমা হয় আরও জনাকয়েক লোক। মেয়ে দুটো ভদ্রমহিলাকে ধরে বসাবার চেষ্টা করলেও উনি ছটফট করতে থাকেন। রুমকি বসে বসে সব কিছু লক্ষ করে যায়, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করলেও তার সামনের লাইনের চেয়ারের একজন ভদ্রলোক আর একজনকে বলেন,‘গতকাল রাতে অ্যাডমিট হয়েছিলেন। ট্রাকের নীচে চলে গেছিলেন। সিরিয়াস হেড ইনজুরি ছিল। আমিও তখন এমার্জেন্সিতে ছিলাম।’

 রুমকির হাত- পা ঠান্ডা হয়ে যায়। ওর মানুষটারও তো অবস্থা ভাল নয়! ‘ডান পায়ের ওপর দিয়ে গাড়িটা চলে গেছে, মাথাতেও লেগেছে। আটচল্লিশ ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। আগে জ্ঞান ফিরুক, তারপর বাকি ট্রিটমেন্ট আরম্ভ করা যাবে।’ ডাক্তারবাবুর বলা কথাগুলো এখনও রুমকির কানে ভাসছে।

***

মানুষটা ফিরবে তো? এই ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, কিছু হলে এক্কেবারে রাস্তায় নামতে হবেরুমকির ভিতর থেকে কান্না ছিটকে আসে। একবার টিঙ্কুর মাকে ফোন করলে হত। মাথাটা তুলে সামনে টাঙানো ঘড়িটার দিকে চোখ ফেলে সে। সাড়ে দশটা। থাক, ওরা হয়তো শুয়ে পড়েছে। কোলের বাচ্চটাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে খাবার আর জল আনতে যায় রুমকি। দেখতে হবে বাইরে কিছু পাওয়া যায় কিনা। কিছু না পেলে এক প্যাকেট বিস্কুট অন্তত। এর বেশি কিনে খাবার মতো টাকাও নেই। এই যা হাসপাতাল, কত টাকা লাগবে কে জানে? এখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাবার মতো অবস্থাও নেই। কিছু আবার না খেলেও নয়, এই দুধের ছেলেটা আছে। এমনিতেই ডাক্তারবাবু খুব যত্ন করে রাখতে বলেছিলেনসাড়ে সাত মাসে ডেলিভারি হলে ওরকম তো হবেই।

 রাতে হাসপাতাল থেকে সব সময় বেরনোও যায় না। পিছন দিকে এমার্জেন্সির একটা মাত্র দরজা খোলা থাকে। সেখান দিয়ে বেরিয়ে বাইরে দু’প্যাকেট বিস্কুট কিনে ভিতরে ঢুকতেই দেখে তার ছেলেটার পাশে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, আর ছেলেটা তারস্বরে কেঁদে যাচ্ছে। রুমকি যেতেই ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিতভাবে বলে ওঠেন, ‘আপকা হ্যায়? ইতনে ছোটে বাচ্চে কো ছোড়কে চলি গয়ি থি?’ রুমকি জবাব না দিয়ে আগেই ছেলেকে কোলে তুলে আবার দুধ খাওয়াতে আরম্ভ করে। ছেলেটা চুপ করতেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই যে এক প্যাকেট বিস্কুট আনতে গেছিলাম। সকাল থেকে কিছু খাইনি তো, শরীর খারাপ লাগছিল।’ 

রুমকি আর ভাবতে পারছে না। সেই সকাল সাড়ে দশটায় এখানে এসেছে, এখনও পেটে কিছু পড়েনি। পাশে দাঁড়িয়ে খাবার কথা বলবার মতোও কেউ নেই। হাসপাতালের লোকজন অনেকক্ষণ আগেই কমে গেছে। এখন যারা আছে, তারা সবাই তাদের পেশেন্টের জন্যে রাতে থাকতে এসেছে। রুমকি একবার চারদিকটা দেখে নিয়ে দেওয়ালে মাথা হেলান দিয়ে বসে থাকে।

ভদ্রলোক ভাঙা বাংলায় প্রশ্ন করেন, ‘অঔর কেউ সাথে আসে নাই?’
– না, আমি একাই আছি।
– কাউকে বোলকর যেতে পারতেন।
– কাকে বলব, আর যখন বেরই তখন তো ঘুমোচ্ছিল।
– এত ছোটা বাচ্চাকে তো গোদমে লেনাও মুশকিল হ্যায়। রোতে দেখে আমি পাশে বসে চেষ্টা করছিলাম, যাক আপনি চলে এসেছেন।

রুমকি ছেলে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়ানোর সময় নিজেও প্যাকেট থেকে দুটো বিস্কুট বের করে মুখে দেয় ভদ্রলোক তার পাশেই বসে থাকলেন। খানিক পরে ওঁর মোবাইলে একটা ফোন এল। ভদ্রলোক পাশের চেয়ারে উঠে আস্তে আস্তে কথা বললেও রুমকি শুনতে পায় ভদ্রলোক কাউকে বলছেন, ‘না, আভি নেহি হুয়া। হোনেসে ফোন কর দেঙ্গে।’ ফোনটা রেখে ভদ্রলোক চুপ করে বসে থাকলেন। রুমকি দেখছিল। হাসপাতালের প্রায় সব বড় আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছেছোট ছোট আলোর নীচে ক্লান্ত পেশেন্ট পার্টিরা শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। রুমকি চোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ করতে পারল না। খালি মনে হচ্ছে, এই বুঝি সেই ভদ্রমহিলার মতো রিসেপশন থেকে মাইকে দেখা করতে বলবে। 

– কৌন অ্যাডমিট হ্যায়?
ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে এসে বসেন। খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো জিজ্ঞেস করেন। রুমকিও খুব আস্তে আস্তেই কী এবং কীভাবে হয়েছে, সেই সময় কী অবস্থা, সব জানিয়ে দেয়। অন্তত সে নিজে যেটুকু জানতে পেরেছে। অ্যাক্সিডেন্টের সময় তো সে নিজে ছিল না। এমনকী ওখানকার কোনও লোকের সঙ্গেও দেখা হয়নি। পুলিশের মুখে যেটুকু শুনেছে সেটুকুই বলতে পারল। সঙ্গে ডাক্তার যে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছে, সে কথাটাও জানিয়ে দেয়। শেষ কথাগুলো বলবার সময় চোখে জল এসে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। 

মানুষটা ফিরবে তো? এই ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, কিছু হলে এক্কেবারে রাস্তায় নামতে হবেরুমকির ভিতর থেকে কান্না ছিটকে আসে। একবার টিঙ্কুর মাকে ফোন করলে হত। মাথাটা তুলে সামনে টাঙানো ঘড়িটার দিকে চোখ ফেলে সে। সাড়ে দশটা। থাক, ওরা হয়তো শুয়ে পড়েছে। কোলের বাচ্চটাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে খাবার আর জল আনতে যায় রুমকি। দেখতে হবে বাইরে কিছু পাওয়া যায় কিনা।

ভদ্রলোক রুমকির ফোঁপানোর আওয়াজ শুনে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলেন, ‘ভগওয়ানের উপর ভরসা রাখুন, সোব ঠিক হোয়ে যাবে।’ তারপর নিজেই বলতে আরম্ভ করেন, ‘ইধার দেখিয়ে, এই নিয়ে মিসেস দো’বার প্রেগন্যান্ট হল, দো’বারেই লড়কি। ইখন মাম্মি আর পাপাজি তো ইধারমে থাকে না। ইসবারও যদি লেড়কি হয় তবে ঘরসে বিবিকো একদম বের করে দেবে। উ বেচারির কী কসুর আছে বলুন। ইতনা বড়া কারোবার কৌন সামহালেগা?’ তারপর একটু থেমে আবার বলেন, ‘অসলমে ইসবার ভি লডকি হি হুয়ি। ঘর সে ফোন এসেছিল, আমি তো ঝুট বলে দিলম, যে কি ইখোনো কুছু হয়নি। নেহি তো একদম পরিশানিমে পড়ে যেতাম। শালা কত হাসপাতালে এই রকম বাচ্চা বদলে যায়, ইখানে ইমন কুছু হলেও তো হত। সোচকে একটা মতলব বের করতে হোবে

 ***

রুমকি সব শুনে গেলেও কোনও উত্তর দেয় না। শুধু তাদের জীবনে আসা সন্তানের কথা মনে করে। অন্য একটা পাড়াতে সেই সময় ভাড়া থাকত। সেখানে প্রায় সবাই অবাঙালি। যে ক’টা বাঙালি পরিবার ছিল, তারাও নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলত। সামনে একটা পাটের কল ছিল। মানুষটা তখন সেখানে কাজ করত। প্রতিদিন সকালে কাজে বেরিয়ে সন্ধে পেরিয়ে অন্ধকার গায়ে মেখে ফিরত। একদম ভাল লাগত না। রাতে শুয়ে শুয়ে প্রায়ই সেসব কথা রুমকিকে বলত। কিন্তু কিছুই করবার নেই। পড়াশোনায় ভাল হলেও মাধ্যমিকের পর আর বেশিদূর পড়তে পারেনি। সব ছেড়ে কমবয়সেই কাজে ঢুকে যেতে হয়েছিল। রুমকি মানুষটার কথা শুনে বুঝতে পারে মিথ্যা বলছে না। হাতের লেখা দেখলেই ভক্তি আসে। শুধু কলেই নয়, আশপাশের কোথাও কোনও সার্টিফিকেট লেখার জন্য মানুষটাকে ডেকে নিয়ে যেত। রুমকির বুকটা সেই সময় গর্বে ভরে উঠত। 

কিন্তু কলটা বন্ধ হয়ে যেতেই রুমকিরা সে পাড়া ছেড়ে নতুন পাড়ায় চলে আসেমানুষটা কয়েক মাস খুব কষ্ট করেছেএখানে ওখানে কাজের জন্যে ছুটে বেড়িয়েছে। অনেক চেষ্টার পর এই মালিকের কাছে একটা কাজ জোগাড় করে। খুব ভাল কিছু কাজ নয়, সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে অর্ডার নিতে হয়, বিকেলের পর খাতাপত্র হিসেবনিকেশ মিলিয়ে অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। তাও কোনও দিন তেমন ভাবে রেগে যায়নি, নেশা করে মারধোর করেনি। মেয়ে হবার পরেও নতুন পাড়ায় ঘরে ঘরে মিষ্টি দিয়ে এসেছিল। রুমকি বলেছিল, ‘এবার থেকে অল্প অল্প করে টাকা জমাতে হবে। পড়াশোনা, বিয়ে সবের ব্যবস্থা তো করতে হবে।’ দেখতে দেখতে মেয়েটা তিন বছরের হতে একরাতে রুমকিকে বলে, ‘তোমার অসুবিধা না হলে আর একটার জন্যে চেষ্টা করা যায় না?’  

অ্যাক্সিডেন্টের সময় তো সে নিজে ছিল না। এমনকী ওখানকার কোনও লোকের সঙ্গেও দেখা হয়নি। পুলিশের মুখে যেটুকু শুনেছে সেটুকুই বলতে পারল। সঙ্গে ডাক্তার যে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছে, সে কথাটাও জানিয়ে দেয়। শেষ কথাগুলো বলবার সময় চোখে জল এসে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। 

নতুন পাড়াটা এমনি ভাল, প্রায় সবাই বাঙালি। তবে একটাই সমস্যা, এখানে সবাই খুব হাঁড়ির খবর নেয়। রুমকি সরকারি কলে জল ধরতে বেরলেও সবাই জিজ্ঞেস করে, ‘সুখবর আছে নাকি? মেয়েটা তো বড় হয়ে গেল।’ সেই মুহূর্তে এসবের উত্তর না দিলেও রাতে শোওয়ার আগে মানুষটার সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। পুচকুটা পেটে আসে। পেটে থাকবার সময় কী একটা ঝামেলা হয়ে যাওয়ায় সাড়ে সাত মাসেই ডেলিভারি করাতে হয়। একমাসের মধ্যে আবার এই অবস্থা।

***

এক একটা সকাল কেমন যেন সব কিছু তোলপাড় করে এক মানুষ থেকে আর একটা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সকালে উঠে একটা মৃতদেহকে হাসপাতাল থেকে বের করতে দেখে রুমকির এই কথাগুলোই মনে হল। মৃতদেহটার সঙ্গে একই গাড়িতে আরও তিনটে মেয়েকে উঠতে দেখল সেসঙ্গে অবশ্য লোক আছে। সবাই এই সকালেই বাইক বা চারচাকা নিয়ে চলে এসেছেদেখতে দেখতে রুমকির চোখেও জল এসে গেল। তার কোলে দেড় মাসের ছেলে, কিন্তু পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। এদিকে ভোর বেলাতেই রিসেপসন থেকে ডাক এসেছিল। আঁতকে উঠেছিল রুমকি, ভাল করে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেনি। সারাটা রাত আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। এ যেন এক অদ্ভুত অবস্থা।

 — আপনার স্বামীর মাথায় খুব তাড়াতাড়ি একটা অপারেশন করতে হবে। দেরি করলে কিন্তু বিপদ হয়ে যেতে পারে। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন টাকার ব্যবস্থা করুন।

কথাগুলো একনিশ্বাসে বলে যায় নার্স। রুমকি পাথরের মতো শুনে যায়টাকা কোথায় পাবে? তারপরে যে অঙ্কের টাকা বলল, সেটা শুনেই ভিরমি যাবার জোগাড়। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, কোনও রকমে অল্প কিছু টাকা মাইনে। তার থেকে ঘর ভাড়া দিয়ে কোনও মতে সংসারটা চলে। তার মধ্যে এই কয়েকদিন আগে রুমকির নিজের জন্যেও অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন এই মানুষটা ঠিক হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও কীভাবে চলবে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। হয়তো রুমকিকেই কোনও জায়গায় কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। মালিক অবশ্য সব শুনে একজন লোকের হাতে হাসপাতালেই তিরিশ হাজার টাকা জমা করে গেছে। হয়তো পরে মাইনে থেকে কাটবে। কিন্তু তারপরেও তো কোনও ফোন করেনি, কাল সারা দিনের মধ্যে একবারের জন্যেও আসেনি। আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই। রুমকির খুব অসহায় লাগে। 

সকালে একবার টিঙ্কুর মাকে ফোন করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু লাইন পায়নি। ভিতর থেকে একটা কষ্ট উপচে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কান্না চাপতে পারে না। কিন্তু কেঁদেই বা কী করবে? ঘরে গিয়ে যা সামান্য গয়না আছে বিক্রি করে কিছু করা যাবে? নাহ। সে দিকেও খুব একটা আশা নেই। গয়না বলতে তো এক জোড়া কানের আর একগাছা চুড়ি। বাবার অবস্থাও তো খুব একটা ভাল ছিল না, না হলে মাধ্যমিক পাশ করতেই কেন এই রকম একটা চটকলের মজুরের সঙ্গে…। বাকি দিদিদের অবস্থাও একই। সাহায্য চাইবার মতো অবস্থা কারও নয়। পাড়ার লোকেদের কাছে গিয়ে যে কিছু কিছু করে দিতে বলবে, কিন্তু ওরাও বা আর কত দিতে পারবে? মালিকের কাছে? সে তো ঠিকানাটাও ভাল করে জানে না। মালিক আবার তিরিশ হাজার টাকা দিয়েছে আগেই। 

টাকা কোথায় পাবে? তারপরে যে অঙ্কের টাকা বলল, সেটা শুনেই ভিরমি যাবার জোগাড়। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, কোনও রকমে অল্প কিছু টাকা মাইনে। তার থেকে ঘর ভাড়া দিয়ে কোনও মতে সংসারটা চলে। তার মধ্যে এই কয়েকদিন আগে রুমকির নিজের জন্যেও অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন এই মানুষটা ঠিক হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও কীভাবে চলবে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই।

টাকা, টাকা,টাকা। এখন শুধু টাকার কথাই মনে আসছেমেঘের মতো আকাশে টাকা ভেসে বেড়ায় না? রুমকি আর কিছুই ভাবতে পারে না। শুধু মনে হয় একসঙ্গে সবাইকে ঠাকুর নিয়ে নিলেই সব থেকে ভাল হবে। 

—কিচু খোবর পেলেন? 

রুমকি ঘাড় ঘুরিয়েই দেখে সেই অবাঙালি ভদ্রলোক। গতকাল রাতে এই অচেনা ভদ্রলোক সব কিছু শুনে তার জন্যে খাবার এনে দিয়েছিলেন। এই মুহূর্তে রুমকির ওঁকেই খুব আপনার মনে হল। ভোরে রিসেপশনে শোনা কথাগুলো একটার পর একটা বলে গেল। ভদ্রলোক চুপচাপ একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন, ‘হামি কি কুছু করতে পারব? যদিও বলতে খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু দেখুন ভেবে, এতে দু’জনারই লাভ হোবে।’

  রুমকি কথাগুলো শুনেই চমকে ওঠে। না না। এ অসম্ভব।
– ঠিক আছে আপনি ভাবেন। হামি তো আপনার কাছে রিক্যোয়েস্ট করতে পারব, জোর করে তো কেড়ে লিতে পারব না।
রুমকি ছেলেটাকে বুকে চেপে আস্তে আস্তে হাসপাতালের ভিতরে ঢোকে। রিসেপশনের এক্কেবারে পিছনের লাইনে একটা চেয়ারে বসে। শরীর আর যেন চলছে নাহাত-পা কাঁপছে, চলতে গেলেও টলে টলে যাচ্ছে। চোখ দুটো বন্ধ করে বসে থাকে। মাথার মধ্যে আকাশ পাতাল ভাবনা ভর করে। সব সামলাবে কীভাবে? মাইকের আওয়াজে হঠাৎ চমকে তাকায়। রুমকি শুনতে পায় রিসেপশন থেকে তার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। ছেলেকে চেয়ারের উপর শুইয়ে রেখেই ছুটে যায়। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে বলে নার্সদিদি। রুমকি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতেই উনি সাফ বলে দেন, ‘ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অপারেশন না করলে পেশেন্টকে আর বাঁচানো যাবে না।’ 

রুমকি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওই অবাঙালি ভদ্রলোককে খুঁজতে থাকে। এবার ওঁকে বলতে হবে, ‘আমি আপনার কথায় রাজি।’ 

***

সাতদিন রুমকিকে হাসপাতাল আর বাড়ি করতে হয়েছে। মানুষটার অপারেশন হবার পর কয়েকটা দিন কী যেন সিসিইউ না কোথায় একটা রেখেছিল। এখন অনেকটাই বিপদ কেটেছে। আজ রুমকির সঙ্গে দেখা করানোর কথা। আর ক’দিন রেখে পায়ের অপারেশনটাও করে দেবেন বলেছেন ডাক্তারবাবু। সব খরচ সেই অবাঙালি ভদ্রলোকই দিয়েছেন। সেদিন গাড়ি করে রুমকিদের পাড়াতেও গেছিলেন। রুমকিকে অল্প একটু অভিনয় করতে হয়েছে। তবে আগে থেকেই ছোট্ট শরীরটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল, বোঝা যায়নি। পাড়াতেও বেশি সময় থাকেনি। সদ্যোজাত মেয়ের দেহটা একবার ঘুরিয়ে নিয়েই সোজা শ্মশানসেখানে গিয়ে সমস্ত কাজ শেষ করে আবার হাসপাতালসব ব্যবস্থা ওই ভদ্রলোকই করে দিয়েছেন। রুমকিকে কিচ্ছু চিন্তা করতে হয়নি। 

রুমকি ছেলেটাকে বুকে চেপে আস্তে আস্তে হাসপাতালের ভিতরে ঢোকে। রিসেপশনের এক্কেবারে পিছনের লাইনে একটা চেয়ারে বসে। শরীর আর যেন চলছে নাহাত-পা কাঁপছে, চলতে গেলেও টলে টলে যাচ্ছে। চোখ দুটো বন্ধ করে বসে থাকে। মাথার মধ্যে আকাশ পাতাল ভাবনা ভর করে। সব সামলাবে কীভাবে?

চিন্তা শুধু মানুষটাকে নিয়ে। একটা হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা মনে পড়লেই সারাটা শরীর তোলপাড় করে উঠছে। সারাদিন ছেলেটার কথা মনে আসছে। রাতেও ঘুম আসছে না। পাশে মেয়েটা শুয়ে থাকলেও চমকে উঠছে। দেওয়ালের ভিতর থেকে ছেলেটার কান্নার আওয়াজ আসছে। রুমকি বিছানায় উঠে বসছে, দরজা খুলে রাতের বেলায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকছে, জানলার ধারে দাঁড়াচ্ছে। আর কি কোনও দিন দেখতে পাবে? ওই ভদ্রলোক অবশ্য বলেছিলেন, ‘হামরা এই শহর থেকে চলে গেলে আপনার সাথে দেখা করিয়ে দেব। ইখন আমার ওয়াইফ উয়ার মায়ের কাছে থাকবে। তবে আপনার কুনো চিন্তা নেই। আমি হাসপাতালের সাথে কথা বলে নিয়েছি। টাকা লাগলেই আমি ফান্ড ট্রান্সফার করিয়ে দিব।’

রুমকি আজকেও মেয়েটাকে টিঙ্কুর মায়ের কাছে রেখে এসেছে। তবে আজকে আর পিছনের দিকে বসেনি। একটু পরে ভিজিটিং আওয়ার। অনেকদিন পর মানুষটাকে দেখতে পাবে। যদিও ডাক্তারবাবু বলেছেন, ‘ এখনও ভাল করে জ্ঞান আসেনি।’ ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে এগিয়ে চলছে। হঠাৎ রুমকির শরীরটা কেঁপে ওঠে। আচ্ছা, মানুষটার যেদিন ভাল করে জ্ঞান আসবে, সেদিন রুমকির চোখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু ধরে ফেলবে না তো? চেপে ধরলে যদি সব সত্যি বলে ফেলে সে?

লেখালেখির সূত্রপাত ছোটবেলায়। বর্তমানে শিক্ষকতার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতা ও গল্প লেখেন তথ্যকেন্দ্র, গৃহশোভা, নবকল্লোল দৈনিক স্টেটসম্যান, সুখবর, সাতসকাল, দেশ, আনন্দবাজার রবিবাসরীয়, এই সময়-সহ আরো বহু বাণিজ্যিক পত্রিকায়। এই পর্যন্ত ইংরেজিতে লিখিত কবিতা ও গল্প ভারত-সহ বহু দেশে প্রকাশিত। নিবন্ধ ও ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভ, মহানগর, দ্য ওয়াল-সহ বহু অনলাইন ম্যাগাজিনে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাত।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com