১
কিংশুক আর শ্রেয়া এম-ফিল করার সময় আমার সহপাঠি ছিল। কিংশুক বসত আমার পিছনের বেঞ্চে ডানদিকে আর শ্রেয়া বসত ঠিক সামনের বেঞ্চটায় বাঁ দিকে। ডায়াগনালি দু’জনের মধ্যে মনের আদান প্রদান কী ভাবে হয়েছিল জানি না, কিন্ত ক্লাস শুরু হওয়ার মাস তিনেকের মাথায় একদিন টের পেলাম যে ওরা প্রেম করছে।
আমি সেদিন পুঁটিরামে কচুরি খেতে গিয়েছিলাম। আর আমাকে দেখে ওরা দু’জনই চমকে যায়। এবার পুঁটিরাম তো আর আমিনিয়া নয়, লেকের ধার নয়, গঙ্গার পাড়ও নয়। তাহলে পুঁটিরামে কচুরি খেতে যাওয়া দু’জনের তৃতীয় একজনকে দেখে চমকে ওঠার কী কারণ থাকতে পারে? ইউনিভার্সিটিতে ফিরে সর্বজিৎকে কথাটা বলতেই ও বলে দিল কারণটা কী। শ্রেয়ার প্রতি আমার হাল্কা বা গাঢ় কোনও ব্যথাই ছিল না। তাই খবরটা শুনে খুশিই হয়েছিলাম আমি। কেউই দুঃখিত হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।
ওদের প্রেম বেশ ফুলে ফলে বাড়তে লাগল এবং শ্রেয়া পড়াশোনায় দুর্দান্ত ছিল বলে কিংশুকও চাপ খেয়ে একটু সিরিয়াস হল। এর মধ্যেই এপ্রিল বা মে মাস নাগাদ শ্রেয়া ওর বাড়ির সঙ্গে কাশ্মীর বেড়াতে গেল এবং কাশ্মীরে সেনাবাহিনী আর জঙ্গিদের সংঘর্ষে শ্রেয়ার কোনও ক্ষতি হয়ে যাবে কি না, সেই প্রশ্নে সবাইকে উত্যক্ত করতে থাকা কিংশুক, শ্রেয়া ফিরে আসার পরপরই একদিন রাতে আমায় ফোন করল, উচ্ছ্বসিত হয়ে।
-আরে হয়েছেটা কী সেটা বলবি তো! বেশ কিছুক্ষণ ওর উচ্ছ্বাস হজম করে বললাম আমি।
-একদম অকল্পনীয় ব্যাপার। তোকে ডিটেলে বলতে হবে। কিংশুক গদগদ গলায় বলে উঠল।
সেই সদ্য মোবাইলের জমানায় ইনকামিং কলেও পয়সা কাটে, তাই ‘ডিটেল’টা পরদিন ক্লাসের জন্য মুলতুবি রাখতে পেরে খুশিই হলাম আমি। কিন্তু কিংশুক যে পরদিন ক্লাসে মে মাসের গরমে একটা শাল জড়িয়ে আধঘণ্টা বসে থাকবে, এটা কল্পনাও করতে পারিনি।
জিনিসটা কী? না একটা শাল। কিংশুক যাকে অনেকটা সময় নিয়ে বলছিল, ‘পশমিনা’। পৃথিবীর সবচেয়ে তরুণ ভেড়ার গা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া উল দিয়ে নাকি তৈরি ওটা। যেমন নরম, তেমন মিহি, যত মসৃণ, ততটাই চিকণ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাই বলে কেউ যে প্রেমে পাগল হয়ে বেয়াল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গায়ে পশমিনা জড়িয়ে বসে থাকতে পারে, সেটা কিংশুককে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। শুধু সে দিনই নয়, তার পরের সাত-দশদিন ওই পশমিনাই হয়ে দাঁড়াল কিংশুকের জপের মালা। যার সঙ্গে যখন দেখা হত, কিংশুক তখনই তাকে বোঝাত, কেমন করে গোলাগুলির ভেতর দিয়ে হেঁটে শ্রেয়া ওর জন্য ওই পশমিনা কিনে এনেছে।
আমি সেদিন পুঁটিরামে কচুরি খেতে গিয়েছিলাম। আর আমাকে দেখে ওরা দু’জনই চমকে যায়। এবার পুঁটিরাম তো আর আমিনিয়া নয়, লেকের ধার নয়, গঙ্গার পাড়ও নয়। তাহলে পুঁটিরামে কচুরি খেতে যাওয়া দু’জনের তৃতীয় একজনকে দেখে চমকে ওঠার কী কারণ থাকতে পারে?
-শ্রেয়া যখন শালটা কিনতে যাচ্ছিল তখনই গোলাগুলি চলছিল? ও তো শ্রীনগরের একটা এম্পোরিয়ামে ঢুকে শালটা কিনে এনেছে। আমার তো ওর সঙ্গে কথা বলে তাই মনে হল। আমি একদিন থাকতে না পেরে বলে ফেললাম।
-তুই এইসব প্যাশন, ইমোশন বুঝবি না। চলতে থাকা সন্ত্রাসের মধ্যে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে শালটা নিয়ে আসা… আমি শ্রেয়ার থেকে গল্প শুনেছি। তখন কাছে দূরে সমস্ত জায়গায় গ্রেনেড ফাটছিল। তার মধ্যেও ও যেভাবে আমার জন্য…
কিংশুকের মনে কে ব্যথা দেবে? আমি চুপ করে গেলাম। কিংশুক আর শ্রেয়ার প্রেম পর্বত পেরিয়ে আকাশ ছুঁতে লাগল।
দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে। এম-ফিলের পার্ট চুকল। আমি একটা স্কুলে পড়াতে ঢুকলাম। শ্রেয়া একটা কলেজে পেয়ে গেল। আর কিংশুক কোনও একটা এনজিওতে। যোগাযোগ কম হয়ে গেলেও বছর দেড়েকের মাথায় কিংশুক আর শ্রেয়ার বিয়েতে নেমতন্ন পেয়েছিলাম ঠিকই। শ্রেয়ার তরফ থেকে নয় অবশ্য, কিংশুকের দিক থেকেই।
কিংশুক একটা নীল রঙের স্যুট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বৌভাতের দিন। আমি গিয়ে বললাম, “পশমিনাটা গায়ে জড়িয়ে নিলে ভাল হত না?”
কিংশুক হেসে ফেলল আমার দিকে তাকিয়ে।
২
বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই কিংশুক মফসসলের একটা কলেজে চাকরি পেয়ে গেল। যোগাযোগ কমতে কমতে নেইই হয়ে গেল একটা সময়। তবু ভীষণই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন বছর পাঁচ-ছয় বাদে একদিন শুনলাম কিংশুক আর শ্রেয়ার নাকি ডিভোর্সের মামলা চলছে।
ডিভোর্সের মামলা? কিংশুক আর শ্রেয়ার? যে কিংশুক পুঁটিরামের দোকানে বসে হাতে করে কচুড়ি ছিঁড়ে ডালে চুবিয়ে শ্রেয়াকে খাওয়াচ্ছিল আর শ্রেয়া পাল্টা ল্যাংচা খাওয়াচ্ছিল কিংশুককে, তারা এখন বিচ্ছেদের মামলা লড়ছে? সত্য সেলুকাস!
কিংশুকের পুরনো নম্বর চালু ছিল না। আর নতুন নম্বরের হদিশ ছিল না আমার কাছে। অবশ্য থাকলেই বা ফোন করে কী বলতাম? “হ্যাঁ রে তোর আর শ্রেয়ার শুনলাম ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে?” বলা যায়?
কিন্তু কিংশুকই আমাকে খুঁজে বের করল ফেসবুকে। লম্বা লম্বা দু’তিনটে মেসেজ করল, ফোন নম্বর দিয়ে। আমি কিংশুককে ফোন করলাম পালটা। একদিন দু’জনের দেখা হল। আমি একটা কফিশপেই বসতে চেয়েছিলাম, কোলেস্টেরল হাই তো। কিন্তু কিংশুক নিয়ে গেল একটা বারে। সেখানে তিন পেগের পরেই ওর কান্না উঠে এল। শ্রেয়া নাকি শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দারুণ খারাপ ব্যবহার করে। কিংশুকের বাবা যে দুম করে মারা গেছেন, তার দায় পুরোটাই শ্রেয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল কিংশুক।
শ্রেয়া এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। “কিছুতেই কনসিভ করতে চাইল না জানিস! বাচ্চা হলে নাকি ওর কেরিয়ারের ক্ষতি হবে! আমার মা কয়েকবার বলতে গিয়ে যা অপমানিত হয়েছে, বলতে পারব না তোকে। ওর দাবি, ছেলেরা যা করবে, মেয়েদেরও তাই করতে দিতে হবে। আচ্ছা তুই বল তো, সব সমান সমান হয়? আমি কি শ্রেয়ার হয়ে কনসিভ করে দেব?”
-সারোগেট মাদার ভাড়া নিতে পারতি। তোদের তো পয়সার অভাব নেই। আর সেই সময় তো খুব ফেমিনিজম নিয়ে ঝড় তুলতি। জীবনেও সেটা মেনে চলা উচিত ছিল।
কিংশুক আমার কথার উত্তর না দিয়ে বড় বড় চুমুক দিতে থাকল গ্লাসে। খারাপ লাগল। মনে হল, একটি আহত প্রেমিক সত্ত্বা, বাবা হতে না পারার ব্যকুলতা বুকে চেপে কষ্ট পাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কোনও সলিউশন বেরল না?”
-না রে। বেরল না। শ্রেয়া অসম্ভব অ্যাডামেন্ট হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে থাকতে গেলে হয় ওর চাকর হয়ে থাকতে হবে, নয়তো ঝগড়া করতে হবে, প্রতিমুহূর্তে। কাঁহাতক কন্টিনিউ করা যায় বল, বল তো? তার চেয়ে ডিভোর্সই ভাল।
-তুই কন্টেস্ট করিসনি?
-করেছিলাম বলেই তো মামলা চলছে। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করছে না। হয়ে যাক খেল খতম। পয়সা হজম তো হয়েই গেছে। হেসে উঠল কিংশুক।
-এখনই হাল ছেড়ে দিস না। দ্যাখ না, শ্রেয়ার মন তো পাল্টাতেও পারে।
-তুই বিয়ে-থা করিসনি তো; অবশ্য করিসনি বলেই ভাল আছিস। তাই এভাবে ভাবতে পারিস। দাম্পত্য ব্যাপারটা অনেকটা মাছ কিংবা সবজির মতো। একবার পচে গেলে পরে ফ্রিজেই ঢোকা কিংবা গ্যাসেই চাপা, লাভ হয় না কিছু।
কিংশুকের ওই কথার পর আর কিছু বলার ছিল না। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, যে শ্রেয়ার সঙ্গে কথা বললে হয়তো একদম অন্য কিছু শুনতাম। প্রত্যেকটা গল্পেরই তো দু’টো দিক থাকে। আর সত্যিটা মাঝামাঝি কোথাও থেকে যায়।
কে জানে, সেটা কী?
৩
দেখা হওয়ার পনেরো দিনের মাথায় কিংশুকের ফোন এল একদিন মাঝরাত পেরিয়ে।
-বল। আমি ঘুম জড়ানো গলায় বললাম।
-সর্বনাশ হয়ে গেছে রে।
-নতুন করে কি সর্বনাশ হল? শ্রেয়া ডিভোর্স না চেয়ে আবার সংসার করতে চাইছে তোর সঙ্গে?
-না না সেসব কিছু নয়। আমার বাড়িতে চুরি হয়ে গেছে! মায়ের কাছে তো একটা আয়া থাকে। আমি তো উইকেন্ডে আসি। সেই আয়াই মনে হয় সাঁট করে করিয়েছে। মায়ের দুটো গয়না চুরি গেছে। হাজার দশেক টাকাও; কিন্তু সেগুলো নিয়ে আমি বদারড নই। আমার বুকটা জ্বলে যাচ্ছে, কারণ শ্রেয়ার দেওয়া সেই পশমিনাটা চুরি হয়ে গেছে! আমি সহ্য করতে পারছি না রে, কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। তুই যে ভাবে পারিস পশমিনাটা উদ্ধার করে দে আমায়। আমি মরে যাব নইলে।
-তুই শান্ত হয়ে ঘুমো আজকের রাতটা। আমি কাল সকালে কথা বলছি কী করা যায় তাই নিয়ে।
-না রে, ওই পশমিনাটা না পেলে আমার জীবনে আর সকাল আসবে না। আমার তিন-চারটে নতুন শার্টপ্যান্ট চুরি হয়ে গেছে। কুছ পরোয়া নেই। কিন্তু আই ওয়ান্ট দ্যাট পশমিনা ব্যাক। সেই মে মাসের গরমে আমি ওটা গায়ে দিয়ে বসেছিলাম, তোর মনে নেই?
-স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তখন সেই পাগলামির একটা কারণ ছিল। এখন কেন এই খ্যাপামি করছিস, আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।
-আরে শ্রেয়া আমার কাছে নেই বলেই তো ওই পশমিনাটাই শ্রেয়ার স্মৃতি এখন। বলতে পারিস ওর প্রেমের স্মৃতি। যে শ্রেয়া আমাকে অপমান করে, যে শ্রেয়া আমাকে কুকুরের মত লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতে চায়, এই পশমিনাটা সেই মেয়েটার নয়। এই পশমিনাটা সেই শ্রেয়ার, যে সারাদিন না খেয়ে বসেছিল, আমি এগারোটায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে সাড়ে চারটে পর্যন্ত বেরতে পারিনি বলে। এইটা সেই মেয়েটার যে আমার পক্স হওয়ার পর আমার মুখে ডাবের জল মাখিয়ে হাত বুলিয়ে দিত গোটা মুখে। আমি ভুলব কী করে বল তো? শোন এই পশমিনাটা আমার চাই। তোর এখন অনেক চেনাজানা আছে, তুই বড় সাহিত্যিক হয়েছিস… তোকে এটা ফিরিয়ে দিতে হবে আমাকে।
-আমি কিচ্ছু বড় সাহিত্যিক হইনি। দু’চার জায়গায় দু’একটা লেখা ছাপা হয়। আমার কোথাও কোনও বিরাট কানেকশন নেই, বিলিভ মি। আমি কিংশুককে নিরস্ত করার চেষ্টা করলাম।
কিছুতেই কনসিভ করতে চাইল না জানিস! বাচ্চা হলে নাকি ওর কেরিয়ারের ক্ষতি হবে! আমার মা কয়েকবার বলতে গিয়ে যা অপমানিত হয়েছে, বলতে পারব না তোকে। ওর দাবি, ছেলেরা যা করবে, মেয়েদেরও তাই করতে দিতে হবে। আচ্ছা তুই বল তো, সব সমান সমান হয়? আমি কি শ্রেয়ার হয়ে কনসিভ করে দেব?
কিন্তু কিংশুক ধরেই নিল যে আমার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি ছাড়া বাকি সবারই যোদাযোগ আছে এবং আমি চাইলেই ওর পশমিনা উদ্ধার করে দিতে পারব। ওর দিনের পর দিন ফোন, এবং ফোনের কান্না, মাঝেমাঝেই নেশা করে উত্তর কলকাতার বাড়ি থেকে দক্ষিণে আমার ফ্ল্যাটে চলে আসা, আমাকে বাধ্য করল যে দু’একজন মেজপুঁটিকে আমার মতো চুনোপুঁটি চেনে, তাঁদের ফোন করে কিছু করা যায় কিনা বলতে। ওর সঙ্গে বার দু’য়েক থানাতেও গেলাম উপায়ান্তর না দেখে। সেখানে অজস্র লোক, অজস্র ধান্দায় এসেছে। ‘আপনাদের কী হারিয়েছে?’, ‘আচ্ছা খবর পেলে খবর দেওয়া হবে’ এর বাইরে কোনও রকম আশার বাক্য শুনতে পেলাম না।
-তুই ওই পশমিনার কথা ভুলে যা কিংশুক। ফালতু হ্যাজার্ড নিস না আর। আমি একদিন বললাম।
কিংশুক একটু চুপ করে গিয়ে বলল, “মা যখন বিয়ে হয়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল, বরিশালের ভাষায় বলত বলে অনেকে টিটকিরি পাড়ত, আমি ছোটবেলায় মাকে জিজ্ঞেস করেছি, যে কেন ওই ভাষাটা আঁকড়ে আছে? মা উত্তরে বলত যে, দেশের তো ওইটুকুই আছে। জমি নেই, পুকুর নেই, নারকেল গাছ নেই, সুপুরি গাছ নেই, বাড়িটা নেই, শুধু ওই ভাষাটা জিভের সঙ্গে লেগে আছে। ওইটুকু হারিয়ে ফেললে থাকবে কী? আমারও সেরকম ওই পশমিনাটুকুই আছে রে। শ্রেয়া নেই, শ্রেয়ার আদর নেই, প্রেম নেই, আছে শুধু ওই শালটা। কী ভাবে ভুলি বল?”
আমার চোখে জল এসে গেল শুনতে শুনতে। কিন্তু আমিই বা কী করতাম? কিংশুককে ছাড়া একাই একদিন থানায় গেলাম। কেউ পাত্তাই দিল না। একজনের সোর্সে এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে ফোন পর্যন্ত করলাম, তিনি কথা বলতে বলতেই ‘হোল্ড’-এ দিয়ে দিলেন ফোনটা। আসলে ওদেরও দোষ নেই। ভিনরাজ্য, ভিনদেশ থেকে এসে ডাকাতরা সোনার দোকানের মালিককে মেরে তিরিশ ভরি সোনা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন তিন-চারটে করে মার্ডার হচ্ছে, অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি একদম, সেখানে কার কোথায় একটা শাল চুরি হয়েছে তাতে কার কী এসে যায়?
৪
মনে হচ্ছিল কিংশুকও হাল ছেড়ে দিয়েছে। প্রায় মাসখানেকের উপর হল, ওর ফোন আসেনি আর। মনটা খারাপ লাগলেও কিংশুক শান্ত হয়েছে ভেবে একটু শান্তি-শান্তি লাগছে। তখনই কিংশুকের ফোন।
সেদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি কলকাতা শহরে। কিংশুক পাগলের মত ফোনে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠল, “পাওয়া গেছে রে, পশমিনা পাওয়া গেছে। থানা থেকে ফোন করেছিল। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”
– কাল সকালে যা। আজ ভয়ংকর বৃষ্টি।
– তাতে কী? সাইক্লোন হলেও আজ আমায় বেরতেই হত।
– তুই তো মদ খেয়ে আছিস, যা বুঝছি। নিজে ড্রাইভ করিস না যেন।
– আমি ফোনে গাড়ি ডেকে নিয়েছি। আমার তো কাছেই। তুইও যা হোক একটা কিছু ধরে চলে আয়। জানি তোর অনেকটা দূর হবে, তবু আজ এই পশমিনা ফিরে পাওয়ার মুহূর্তটায় তোকে পাশে চাই।
আমার একজন চেনা ট্যাক্সিচালক আছে। আপ-ডাউন এবং ডবল ভাড়ার কড়ারে সেই রাজি হল যেতে। গা কষকষ করছিল কিন্তু কিংশুকের ডাক ফেরাতে পারলাম না। থানার সামনে গিয়ে দেখলাম কিংশুক দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েও আনন্দে ফুটছে। নাচার ভঙ্গিমায় হাঁটছে। হাবভাব এমন, যেন আজ ওর বিয়ে। আমি চিমটি কেটে শান্ত হতে বললাম ওকে। কিন্তু কিংশুক শুনলে তো।
থানায় ঢুকে মেজবাবুর সামনে গিয়ে যখন বললাম কেন এসেছি, ভদ্রলোক আমাদের বসতে বললেন সামনের চেয়ারগুলোতে। কিংশুক পাঁচ মিনিট বসেই আবার গেল ওঁর সামনে। দশ মিনিটের মাথায় আবার। মেজবাবু বিরক্ত হয়ে উঠলেন, “আপনাকে ফোন করে ডাকা হয়েছে বলে ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছেন নাকি? মনে হচ্ছে যেন কোহিনূর ডায়মন্ড ভারতবর্ষে ফিরে এসেছে! অদ্ভুত লোক তো!”
কিংশুক উত্তরে বলল, “যেটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি, আমার কাছে সেটা কোহিনূরের থেকেও দামি।”
– আপনার কাছে হতে পারে। আমাদের কাছে নয়। এই রামলাল, ওনাকে স্টোর রুমে নিয়ে যাও তো।
কিংশুক আমাকে ইশারা করল। মেজবাবু বললেন, “আপনি একাই যান।”
– প্লিজ আমার বন্ধুকেও সঙ্গে যেতে দিন।
-বেশ যান। জলদি ফিরবেন। আর এখানে সই করে যাবেন। জ্বালাতন যত!
মেজবাবুর শেষ কথাগুলো শুনেও শুনল না কিংশুক। সাত-আটটা সিঁড়ি নেমে, আবার চারটে উঠে আমরা স্টোর রুমে গেলাম। ঘরটা প্রায় অন্ধকার। একটা ডিম আলো জ্বলছে কেবল। প্রথমে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মোবাইলের আলোটা জ্বালতেই সামনে থেকে কে একটা যেন ‘কে বে’ বলে চিৎকার করে উঠল।
-আমরা পশমিনার জন্য এসেছি। কিংশুক বলল।
-কোনও মিনা-ফিনা নেই এখানে। একটা লোক চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গের দু’তিনজন হেসে উঠল।
কিংশুক মোবাইলের আলো নিভিয়ে দিয়েছিল। ওই আধো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমরা অ্যাকচুয়ালি একটা শাল ফেরত নিতে এসেছি।”
– এখানে আসার কী দরকার? আমরাই ওপরে দিয়ে আসতাম। এবার অন্য একটা গলা।
– আমাদের তাড়া আছে। যদি প্লিজ দিয়ে দেন…
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ওই গলাটা বলে উঠল, “ঝামেলা হটা। শালটা দিয়ে দে।”
তৎক্ষণাৎ বড়ো আলো জ্বলে উঠল ঘরে। আলোটা জ্বলে উঠতেই বোঝা গেল কেন নেভানো ছিল। ওই স্টোররুমে বসে একটা শালের উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে কতকগুলো লোক পরোটা মাংস আর মদ খাচ্ছিল। বোতলটা হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। গ্লাসগুলোও সরে গেল মুহূর্তে। খাওয়া প্রায় শেষের দিকেই বোধহয়। প্লেটগুলো সমেত খবরের কাগজটা সরিয়ে নিয়ে মোটা গোঁফওয়ালা একটা লোক কিংশুকের দিকে শালটা ছুঁড়ে মারল।
– এটা কী করছেন আপনারা? ইউ স্কাউন্ড্রেলস। এটা কী করেছেন? হাতে পশমিনাটা নিয়ে চিৎকার করে উঠল কিংশুক।
আমি থানার সামনে গিয়ে দেখলাম কিংশুক দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েও ও তখন আনন্দে ফুটছে। নাচার ভঙ্গিমায় হাঁটছে। হাবভাব এমন, যেন আজ ওর বিয়ে। আমি চিমটি কেটে শান্ত হতে বললাম, কিন্তু কিংশুক শুনলে তো।
আমি দেখলাম কিংশুকের হাতে ধরা পশমিনা, ধবধবে সাদা নেই আর। তার উপরে ছোপ ছোপ মাংসের দাগ, পরোটার তেলের দাগ।
– এই হারামজাদাটাকে এক লাথ মেরে বার করে দে তো। একজন চেঁচিয়ে উঠল।
আর একজন হাসতে হাসতে বলল, “লন্ড্রিতে দিয়ে একটা ড্রাইওয়াশ করিয়ে নিলেই আগের মতো হয়ে যাবে একদম।”
– ইউ ডেভিলস, হোয়াই ডিড ইউ ডেস্ট্রয় দ্য থিং? আমার উত্তর চাই। চিৎকার করে উঠল কিংশুক।
আরও উঁচুতে গলা তুলে গোঁফওয়ালা পুলিশটা বলে উঠল, “চুপ শুয়োরের বাচ্চা। শালটা উদ্ধার করে দিয়েছি, তার জন্য কোনও কৃতজ্ঞতা নেই। ওটা কি ওবামার বউয়ের গাউন, যে ওটা বিছিয়ে খাওয়া যাবে না? বেরো শালা এখান থেকে, নইলে ওই শাল নিয়ে নর্দমায় ফেলে দেব।” কিংশুক মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। আমি একহাতে ওই পশমিনা আর অন্য হাতে ওকে ধরে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে দিয়ে উঠে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। একবার ভাবলাম, মেজবাবুকে গিয়ে বলি। তারপর মনে হল, কী লাভ? কিংশুক সই করার অবস্থাতে ছিলও না। আর ওই মাংসের ছোপ লাগা পশমিনার জন্য আবার সই কীসের?
আমার ট্যাক্সিটা বাইরেই ছিল। আমি ড্রাইভারকে বললাম যে আগে কিংশুককে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তাপর বাড়ি ফিরব। কিংশুকের অবস্থা দেখেই হয়তো ড্রাইভার গাঁইগুঁই করল না বেশি।
ট্যাক্সিতে উঠেই কিংশুক জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বমি করল অনেকটা। তারপর ড্রাইভারের জলের বোতল দিয়ে মুখ ধুয়ে কেমন আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, “তুই ওটা নিয়ে যা। ফেলে দিস চাইলে। আমার ওটাতে আর কোনও প্রয়োজন নেই।”
কিংশুককে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আবার ট্যাক্সিতে উঠে পশমিনাটা হাতে করে বসে রইলাম আমি। ফেলে দিতে পারলাম না জানলা দিয়ে। উলটে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া মুখটা মুছলাম শালটা দিয়েই। মুছতে মুছতে মনে হল, পশমিনার গায়ে লেগে থাকা ওই মাংস পরোটার ছাপগুলোই আসলে নিষ্ঠুরতা। পৃথিবীর যে-কোনও প্রেমকে খুন করার পরও যারা বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকে।
পেশায় শিক্ষক | মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা | পেয়েছেন কৃত্তিবাস ও বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার | ‘নেহাত গরিব নেহাত ছোটো’, ‘দাঁড়াচ্ছি দরজার বাইরে’, ‘যতটুকু মেনে নিতে পারো’, ‘পতাকা নয় দিগন্ত’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি |
5 Responses
ভীষণ সুন্দর গল্প। গল্পের শেষটুকু অনবদ্য উপলব্ধির বৈচিত্র্যময়তায় ভাস্বর হয়ে উঠলো যেন, “পশমিনার গায়ে লেগে থাকা ওই মাংস পরোটার ছাপগুলোই আসলে নিষ্ঠুরতা। পৃথিবীর যে-কোনও প্রেমকে খুন করার পরও যারা বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকে।”
কথাগুলো বহুকাল থেকে যাবে অন্তরে… অনুরণনে।
“পশমিনা” গল্পটি দারুণ লাগলো। সাবলীল গতি আর চমৎকার শেষ। লেখককে অভিনন্দন জানাই।
গল্পটি চমৎকার হয়েছে। খুবই সাম্প্রতিক প্রেক্ষিতে ঘটনধারা এগিয়েছে সাবলীল ভাবে। লেখার ভাষায় যে অতি-সাম্প্রতিক বাংলা কথ্য ঢং ব্যবহার করা হয়েছে , তাও মানানসই হয়েছে। এই লেখকের কোনো রচনা আগে পড়ি নি। ‘পশমিনা’ প’ড়ে মনে হচ্ছে উনি একজন পাকা লেখক, যিনি গল্পের ঘটনাধারাকে ঠিক খাতে বইয়ে নিয়ে যেতে জানেন এবং সঙ্গের ভাষার সাযুজ্যও রক্ষা করতে দক্ষ।।prith
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময়ের প্রথম সারির লেখকদের মধ্য়ে একজন। গল্প, কবিতা ও উপন্যাস এই তিন ধারাতেই তিনি নিজের মুনসিয়ানা দেখিয়েছেন। আমাদের পোর্টালে ওঁর আর একটি গল্প আছে – সহযোদ্ধা। পড়ে দেখতে পারেন। https://banglalive.com/short-story-by-eminent-poet-novelist-binayak-bandyopadhyay/
অসাধারণ গল্প, অসামান্য ভাবনা।