আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮। এর ঠিক তিন বছর পর জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে বাংলার দুই দিকপাল ব্যক্তিত্বের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৮৯৯ সাল থেকে দু’জনের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হত। জগদীশচন্দ্রের অনুরোধে কবি লিখেছিলেন ‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’। সেই প্রত্রাবলীর মধ্যে থেকে একটি চিঠি এই বরেণ্য বৈজ্ঞানিকের জন্মবার্ষিকীতে প্রকাশ করা হল।
***
লন্ডন ৫ই অক্টোবর, ১৯০০
C/O. Messrs. Henry S. King & Co.
65, Cornhill, E, C.
সুহৃৎ,
অনেককাল আপনার পত্র পাই নাই। চিঠি না পাইলে কি লিখিতে নাই?
আমি কি রকম ব্যস্ত আছি, বুঝিতে পারেন। আমার অনেক নূতন বিষয় সংগ্রহ হইয়াছে। কি করিয়া লিখিয়া উঠিব, স্থির করিতে পারি না। আমি যা বলিয়াছি, তাহাতেই সকলে অত্যন্ত আশ্চর্য্য হইয়াছেন। কিন্তু আরও যাহা বলিবার আছে, তাহা আরও বিস্ময়জনক। একটা সু-খবর এই যে, আমি প্রথম প্রথম ভয় করিয়াছিলাম যে, কেহ বিশ্বাস করিবে না, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমার কার্য্যের উপর লোকের বিশ্বাস জন্মিয়াছে, কিন্তু তা বলিয়া অতি সাবধানে একটু-একটু করিয়া অনেক নূতন Experiment দিয়া আমার পথ প্রস্তুত করিতে হইবে। আমি যখন Paris-এ প্রথম বলি, তখন কাহারও মনে একটু-একটু সন্দেহ হইয়াছিল। তারপর Secretary যখন ৪ দিন সমস্ত শুনিলেন, তখন বলিলেন যে, সব সত্য, কিন্তু লোকের বুঝিতে সময় লাগিবে; একেবারে বলিতে গেলে অবিশ্বাস হইবে: আপনি জানেন এদেশে Crankএর সংখ্যা অতি বেশী; একটা বিষয় দিনরাত্রি ভাবিয়া ভাবিয়া লোকের মাথা গরম হইয়া যায়, শেষে একই ধ্যান, একই জ্ঞান। এরূপ লোকের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, সুতরাং লোকের যে সন্দেহ হইতে পারে, তাহার জন্য সাবধান হইতে হইবে। আর এখানকার বৈজ্ঞানিকেরা নানা বিভাগে বিভক্ত। Chemist and Physicist এর মধ্যে ঘোরতর সংগ্রাম, Physiologistsরাও সেইরূপ। সেদিন আমাদের Physical Section-এ Chemist দিগকে অতি সমাদরে অভ্যর্থনা করা হইয়াছিল। আমাদের President তাহাদিগের মন আকর্ষণ করিবার জন্য তাহাদিগের বিশেষ স্তুতিগান করিলেন। তাহার উত্তরে Chemist প্রবর উঠিয়া বলিলেন, “আমাদের ঝগড়া করিবার ইচ্ছা নাই, কিন্তু আপনারদের J. J Thompson* সেদিন বলিয়াছেন যে, Atom অভিভাজ্য নহে, তাহা অপেক্ষাও ক্ষুদ্র অণু আছে। যাহারা আমাদের atom-এর উপর হাত তোলে, তাহাদিগের সহিত আমাদের চির সংগ্রাম, There will be trouble if you lay your hands on our indivisible and inviolate atom.”
তারপর একজন Physiologist-এর সহিত দেখা হয়। তিনি আমার কার্য্যের বিশেষ প্রশংসা করিলেন এবং বলিলেন, “আশা করি আপনি অন্যান্য Physicist-এর ন্যায় আমাদের সুবৃহৎ Physiology-কে Physicsএর শাখা বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহেন না। একটা formula দিয়া সব explain করা, একি চালাকি? দেখুন আমি আজ দশ বৎসর যাবৎ নানা Curve সংগ্রহ করিতেছি। কখন উর্দ্ধে উঠিতেছে, কখন নিম্নে গমন করিতেছে, কি আশ্চর্য্য! কেন উঠে কেন নামে, কেহ জানে না এবং কেহ জানিবেও না। আসল কথা, ঊর্দ্ধে উঠে এবং নিম্নে নামে!” সুতরাং বুঝিতে পারিতেছেন, আমাকে কিরূপ সন্তর্পণে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে হইতেছে।
আমার দু-একজন Physicist বন্ধু বলেন, যে, Psychology Science নহে সুতরাং ও বিষয়টা বাদ দিবেন। অর্থাৎ মনে হয়ত সন্দেহ হইয়াছে যে, এ লোকটা Oriental, যদি ওদিকে একবার ঝোঁক যায়, তাহা হইলে Physics ছাড়িয়া ওদিকে চলিয়া যাইবে। Podge, Many congratulations on your very important and suggestive experiments, But go slowly, establish point by point and restrain inspiration. Lord Rayleigh লিখিয়াছেন, “বড় তাড়াতাড়ি হইতেছে, ধীরে ধীরে!” Lodge এবং Rayleighএর নিকট এখনও সব কথা খুলিয়া বলিতে সময় হয় নাই। একজনকে বলিয়াছি, তিনি বলিলেন, “How can you sleep over all this? Are you so certain of life? Write night and day and publish them at once!”
জীবনের কথা কেহ বলিতে পারে না; নতুবা ইচ্ছা ছিল, ভারতবর্ষ হইতে এক নূতন School of Workers হইতে এক সম্পূর্ণ নূতন বিষয় প্রকাশিত হইবে। আপনারা কেন এই কার্যক্ষেত্র প্রস্তুত করিলেন না? তাহা হইলে এক বিষয়ের কলঙ্ক চিরকালের জন্য মুছিয়া যাইত। জীবন অনিত্য বলিয়াই আমাকে তাড়াতাড়ি প্রকাশ করিতে হইতেছে। আমি দেশ হইতে আসিবার সময়ও জানিতাম না, যে, কি বিশাল ও অনস্ত বিষয় আমার হাতে পড়িয়াছে। সম্পূর্ণ না ভাবিয়া যে থিওরি প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিয়াছি, তাহার অর্দ্ধপরিস্ফুটিত প্রতি কথায় কি আশ্চর্য্য ব্যাপার নিহিত আছে, প্রথমে বুঝি নাই। এখন সব কথার অর্থ করিতে যাইয়া দেখি, যে, ঘোর অন্ধকারে অকস্মাৎ জ্যোতির আবির্ভাব হইয়াছে। যে দিকে দেখি, সে দিকেই অনন্ত আলোক-রেখা। জন্ম-জন্মান্তরেও আমি ইহার শেষ করিতে পারিব না। আমি কোনটা ছাড়িয়া কোনটা ধরিব, তাহা স্থির করিতে পারিতেছি না। আবার এদিকে আমার এখানকার সময়ও ফুরাইয়া আসিতেছে। মনে করিয়াছিলাম যে, Royal Institution-এ কত দিন experiment করিব এবং সেজন্য কতকগুলি নূতন কল প্রস্তুত করিতেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাহাতে বাধা পড়িয়াছে। এখানে আসিয়া Dr. Crombieর সহিত দেখা করিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, যে, আভ্যন্তরিক কি গোলমাল হইয়াছে, শীঘ্র চিকিৎসা না করিলে আশঙ্কার কারণ। কঠিন operation আবশ্যক, তাহাতে বিশেষ ভয় নাই, তবে প্রায় ৫ সপ্তাহ শষ্যাগত থাকিতে হইবে। সুতরাং আমার কার্য্যে বড় বাধা পড়িল। এখন experiment করার আশা ছাড়িয়া দিতে হইল। যদি আমার যে-সব কার্য্য হইয়া গিয়াছে। তাহা লিখিয়া যাইতে পারিতাম, তবে কিছুই ভাবিতাম না। আমি লিখিতে চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু বেশী লিখিতে পারি না। আর ৪ টি নূতন বিষয়ে লেখা আবশ্যক, তাহার জন্য দেরী হইতেছে। দেরী করাও ভাল নয়। উপরোক্ত বিষয়টি কেবল দু-এক বন্ধুকে জানাইবেন। বৃথা চিন্তা বৃদ্ধি করিবার আবশ্যক নাই।
সর্ব্বদা পত্র লিখিবেন।
আপনার জগদীশ।
ফুটনোট:
*JJ. Thompson: আধুনিক পরমাণু বৈদ্যুতিক মতবাদ ও পরমাণু বিজ্ঞানের জনক। তিনি মাত্র ২৮ বছর বয়সে রয়্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, ১৯০৬ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানচর্চায় অগ্রগণ্য একটি নাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, একইসঙ্গে উদ্ভিদ ও জীববিজ্ঞানী। গাছের প্রাণ আবিষ্কার করার নেপথ্যের মানুষটি আজও বিশ্ববিজ্ঞানচর্চায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি কল্পবিজ্ঞানের গল্পও লিখতেন নিয়মিত। লিখতেন নিবন্ধও। আচার্যকৃত সাহিত্যের সম্ভার থেকে কিছু মণিমুক্তো তুলে এনে সাজিয়ে দিচ্ছে বাংলালাইভ। তাঁকে পুনরাবিষ্কার করতে চেয়ে বাংলালাইভের এই প্রয়াস।