banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ১৫

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

নভেম্বর ৩০, ২০২২

Novel Akashpradip part 15
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪]

২৭)

আলো সেনের একটা ই-মেল অ্যাড্রেস যোগাড় করতে পেরে রোহিণী একেবারে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো একটা চিঠি লিখে ফেলেছিল ভদ্রমহিলাকে৷ মনে মনে একটা সন্দেহ দানা বাধছে৷ ওর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ভদ্রমহিলার নিশ্চয়ই কোনও সম্বন্ধ আছে৷ কোথায় যেন ঘটনাগুলো মিলে যাচ্ছে৷ ও যা ভাবছে এই মহিলা কি তিনিই? কিন্তু তাহলে নামটা মিলছে না কেন? তাই রোহিণী একটু কায়দা করে জানিয়েছিল সব তথ্য৷ একটু সতর্ক হয়ে লিখেছিল চিঠিটা৷ নিজের পরিচয়, এখন আমেরিকায় থাকে এবং দেশভাগ-পরবর্তী সময় নিয়ে ওর গবেষণা আর ও কলেজে পড়ায় এসব তথ্যের পাশাপাশি জানাতে ভোলেনি যে বিবাহসূত্রে ও এখন একটি পরিবারে, যে পরিবারের আদি বাস ছিল খুলনার সেনহাটি৷ ‘আমার দাদাশ্বশুরের নাম ছিল জ্যোতির্ময় সেন৷ আর তিনি যাঁকে বিয়ে করেন, তিনি শান্তিনিকেতনের মেয়ে৷ নাম অরুণলেখা৷ জ্যোতির্ময় কয়েক বছর হল মারা গেছেন৷ অরুণলেখা, আমাদের দিদান জীবিত৷ তবে বেশিরভাগ সময়ই স্মৃতি ঠিকঠাক কাজ করে না৷ আপনার ব্লগগুলো অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে দেখছি৷ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের শরণার্থী জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন আপনি, আপনার ব্লগ থেকেই জেনেছি৷ খুলনায় আদি বাড়ি, শান্তিনিকেতনে পড়াশুনো, এসব দেখে মনে হল জ্যোতির্ময় বা অরুণলেখাকে আপনি চিনলেও চিনতে পারেন৷ যদি কখনও তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়ে থাকে, তবে প্লিজ জানাবেন একটু৷ যদি না চেনেন, তাতেও ক্ষতি নেই৷ পরেরবার কলকাতা গেলে শান্তিনিকেতনে গিয়ে আপনার ইন্টারভিউ নিয়ে আসব, জানব আপনার দেখা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ও সমাজকে, যদি আপনি অনুমতি দেন’, রোহিণী লিখেছিল৷

প্রায় দিন দশেক সব চুপচাপ৷ প্রায় ধরেই নিয়েছিল রোহিণী তার ই-মেলের কোনও উত্তর দেবেন না আলো সেন৷ তাকে শুধু ওঁর ব্লগগুলো পড়েই তথ্য সংগ্রহ করতে হবে৷ আরেকটা ব্লগ পোস্ট করেছেন এর মধ্যে আলো সেন৷ একটু আশ্চর্য লেগেছিল রোহিণীর৷ অদ্ভুত ভদ্রমহিলা তো! এত সুন্দর পার্সোনালাইজড্‌ একটা চিঠি লিখল রোহিণী, মেলটাও ঠিকই আছে, প্রাপক নেই বলে বাউন্স ব্যাক করে আসেনি, কিন্তু ভদ্রমহিলা তার একলাইনও জবাব দেবেন না? চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করবেন না? এরকমটা ও ভাবেনি৷ কেন জানে না আলো সেন সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারণা হয়েছিল ওর৷ ভদ্রমহিলার প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই বয়স৷ শান্তিনিকেতনে বসে একজন বৃদ্ধা মহিলা যে বাইরের জগতের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চাইছেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি যে নিজের মতো করে ভাবছেন এবং তারপর সেই ভাবনাগুলোকে বাংলায় টাইপ করে প্রকাশ করছেন সর্বসমক্ষে— সেটাই আর পাঁচজনের থেকে কোথাও যেন আলাদা করে দেয় আলো সেনকে৷ রোহিণীর চিঠি পাবার পর উনি কম্পিউটার নিয়ে বসেননি এমন নয়, বরং এই ব্লগটা অন্যান্য পোস্টের তুলনায় আকারে বেশ বড়৷ ভিতরে ভিতরে একটু রাগ হল রোহিণীর৷ তবু কী এক আকর্ষণে রোহিণী আলো সেনের সাম্প্রতিক ব্লগ পোস্টে মন দিল।

*****

‘আমাদের ছেলেবেলায় অর্থকষ্ট থাকলেও তার জন্য বিশেষ বিশেষ খাবার করায় ভাঁটা পড়েনি কোনওদিন৷ প্রথমদিকে বাবার রোজগারে শুধু আমাদেরই সংসার চলত, তা নয়৷ জ্যাঠামশায়দের নিয়মিত টাকা দিতে হত৷ দেশভাগের পর যখন ভাড়াবাড়িতে বাস, তখনও শীতের দিনে দেশবাড়ির আচার অনুষ্ঠান ধরে রেখেছিলেন মা৷ পুরনো প্রথা মেনে আমাদের বাড়িতে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন নবান্ন পালিত হত৷ পুজো শেষে নতুন চালের নৈবেদ্য কাককে উৎসর্গ করা হত৷ মায়েদের মুখে শুনতাম, কাকের মাধ্যমে এই নতুন চাল ও নতুন গুড়ের নৈবেদ্য নাকি পৌঁছে যায় পূর্বপুরুষদের আত্মার কাছে৷ এসব ক্রিয়াকর্মের শেষে মা জামবাটিতে করে নলেনগুড় মেশানো চালের মিশ্রণ খেতে দিতেন আমাদের৷

ভদ্রমহিলার প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই বয়স৷ শান্তিনিকেতনে বসে একজন বৃদ্ধা মহিলা যে বাইরের জগতের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চাইছেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি যে নিজের মতো করে ভাবছেন এবং তারপর সেই ভাবনাগুলোকে বাংলায় টাইপ করে প্রকাশ করছেন সর্বসমক্ষে— সেটাই আর পাঁচজনের থেকে কোথাও যেন আলাদা করে দেয় আলো সেনকে৷

নবান্নের পরবর্তী অনুষ্ঠান ছিল পৌষ সংক্রান্তি৷ সংক্রান্তির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল দুধপুলি, পাটিসাপটা আর পাটালিগুড়ের পায়েস৷ পুলিতে নারকেল পুরে খেজুর গুড়ের পাক৷ কড়াইতে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে না ভাজা পুলি ফেলে দু-চার ফুট দিয়ে মা তাতে নলেনের রস মেশাতেন অতি সাবধানে, যেন দুধ কেটে না যায়৷ পাটিসাপটায় আবার পড়ত ক্ষীরের পুর, আমাদের মতো বাঙাল পরিবারে৷ বাড়িওয়ালার স্ত্রী অঞ্জলি মাসিমা আবার পাঠাতেন নারকেলের পুরের চিনির রসে পাক দেওয়া পাটিসাপটা৷ জেঠিমাদের মুখে গল্প শুনেছি দেশের বাড়িতে নাকি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করায় পারদর্শী ‘শিউলি’ বা ‘গাছি’রা ছিল৷ প্রথমে তারা গাছের গায়ে নলি পুঁতে আসত৷ তারপর প্রথম যেদিন নলি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে রস পড়তে শুরু হয়, সেদিন হাঁড়ি বাঁধতে হত গাছের গায়ে৷ প্রথম দিনের রসকে ‘নলেন’ বলে৷ পরের দিনের রসের নাম ‘দো-কাটের রস’ বা ‘ঝরা’৷ খেজুর গাছ থেকে প্রথম পাওয়া জিরেন রসেই ‘পয়লা’ বা পয়রা গুড়৷ এরপর গাছকে তিনদিনের বিশ্রাম দিয়ে ‘ঝরা’ রস থেকে পাতলা নলেন গুড়৷ শান্তিনিকেতনে পড়ার সময়ও আমরা মোহনদাদার নেতৃত্বে আলো ফোটার আগেই খেজুর রস খেতে যেতাম৷ মোহন দাদা আমাদের গাছ চেনাতেন৷ চারা গাছের রস বেশি৷ বুড়িগাছে রস কম৷ সে গাছের রসের রং সোনালি, সবচেয়ে বেশি মিষ্টি হয় সে রস৷

Date tree and juice
খেজুর গাছ থেকে প্রথম পাওয়া জিরেন রসেই ‘পয়লা’ বা পয়রা গুড়

প্রথমে বাবা-মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় এবং তারপর শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির অনাবিল সাহচর্যেই আমার জীবন কেটে যেত, যদি না আমার ছোট ভাই স্বাধীন পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের রূঢ় বাস্তবের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ না করত৷ সেই প্রথম একদিন বলেছিল, ‘ছোড়দি! তুই যেখানে আছিস— সে জায়গাটা একটা মায়াবী বুদ্বুদের মতো৷ জীবনের মালিন্য, ক্লেদ, বাস্তবতাকে তোরা সেভাবে এনকাউন্টার করিস না৷ বেশ কিছুদিন ধরে যুদ্ধ চলছে৷ সমস্ত পৃথিবীতে ইয়ুথরা জেগে উঠছে৷ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় মিছিল করছে ছাত্র-ছাত্রীরা৷’

আমি বলেছিলাম, ‘বিদেশে কোথায় কী হচ্ছে, তা জেনে কী লাভ আমাদের? শান্তিনিকেতনে আমরা তো ভালো আছি৷ কলকাতায় দিন দিন যা অবস্থা হয়ে যাচ্ছে তার থেকে অনেক শান্তিতে৷ খামোখা জীবনকে অশান্তিময় করে তুলব কেন?’

আমার ভাই খুব করুণাভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল৷ বলেছিল,‘আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি? কেন মুখ গুঁজে আছ তবে মিছে ছলে? কোথায় লুকোবে? ধূ ধূ করে মরুভূমি; ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে’৷ ছোড়দি জানিস্‌ তো বালির ঝড় যখন আসে, উটপাখি বালির মধ্যে মুখ গুঁজে ঝড়কে অস্বীকার করতে চায়৷ মনে রাখিস প্রলয় আসছে৷ অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? কোথাও পরিত্রাণ নেই৷ তোদের গুরুদেব শান্তিনিকেতনের লোকেদের সেই যে মায়াঞ্জন পরিয়ে কেটে পড়েছেন, তার জের এখনও চলছে৷ কোথায় পালাবি? রুক্ষ ধুলোঝড় তোর সাজানো বাগান তছনছ করে দেবে৷ তখন বুঝতে পারবি আমি তোকে আগেই সাবধান করেছিলাম৷’

এমনভাবে কথা বলত ও যেন আমিই ওর ছোট বোন৷ আমার চেয়ে পুরো সাত বছরের ছোট ছিল ও বয়সে৷ কিন্তু বুদ্ধি, বিদ্যা, বাগ্মিতা সবদিক থেকেই আমার থেকে অনেক উপরে মনে হত ওকে৷ অনেক দূরায়তও মনে হত অনেক সময়৷ এত পড়াশুনো, জগৎ সম্পর্কে এমন বড়ভাবে ভাবা, এসব ছিল ওর মজ্জাগত৷ সর্বার্থেই ও ছিল প্রকৃত স্বশিক্ষিত৷

ছোড়দি জানিস্‌ তো বালির ঝড় যখন আসে, উটপাখি বালির মধ্যে মুখ গুঁজে ঝড়কে অস্বীকার করতে চায়৷ মনে রাখিস প্রলয় আসছে৷ অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? কোথাও পরিত্রাণ নেই৷ তোদের গুরুদেব শান্তিনিকেতনের লোকেদের সেই যে মায়াঞ্জন পরিয়ে কেটে পড়েছেন, তার জের এখনও চলছে৷ কোথায় পালাবি?

রাবীন্দ্রিকতা, রবীন্দ্র সংস্কৃতির চৌহদ্দির সম্পূর্ণ বিপরীতে বয়ে চলা বিশ্বের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খবর ওর মুখেই পেতাম৷ আর্জেন্টিনার মাকর্সবাদী বিপ্লবী চে গেভারা সেই প্রজন্মের তরুণদের কাছে একজন আইকন৷ কিউবার বিপ্লবের পুরোধা চে প্রথম জীবনে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে মোটর সাইকেলের পিছনে সমস্ত দক্ষিণ আমেরিকা চষে ফেলেছিলেন৷ তাঁর সেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে লেখা ‘মোটরসাইকেল ডায়ারিজ’ একসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ চে কীভাবে দক্ষিণ আমেরিকার প্রত্যন্ত গ্রামের লোকেদের মধ্যে মিশে গিয়ে তাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হচ্ছিলেন— এসব বলতে বলতে আমার ভাইটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত৷ সমাজের খোল-নলচে একেবারে পালটে দেবার স্বপ্ন দেখত ওরা৷

ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি৷ শুরু করেছিলাম নলেন গুড় আর নবান্ন দিয়ে৷ আমার ছোট ভাইটির কথা মনে এল কারণ দেশ বিদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সম্পর্কে প্রথম সচেতনতা আসে তারই মাধ্যমে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বম্বেতে আই.পি.টি.এ-র মতো সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর জন্ম হয়৷ এর কিছুদিন আগেই প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনও গড়ে উঠেছে৷ পিপলস্‌ থিয়েটার নামটির প্রস্তাব করেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা৷ রোম্যাঁ রোঁলার বই পড়ে গণনাট্য বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়েছিল তাঁকে৷ প্রথম যুগে গণনাট্য আন্দোলনে অনেক রথী-মহারথী যোগ দেন৷ বম্বের পৃথ্বীরাজ কাপুর, বলরাজ সাহনি, খাজা আহমেদ আব্বাস, বাংলার বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সবাই৷ এই দলের বিজন ভট্টাচার্য ১৯৪৪-এ ‘নবান্ন’ নামে নাটক লেখেন যা পরে বহুরূপীতে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র অভিনয় করেন৷ ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় লেখা নাটক৷ ৪৩-এর মন্বন্তর নিয়ে কে. এ. আব্বাস সিনেমা করেন ‘ধরতি কে লাল’৷ নাটককে বাণিজ্যিক ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে সত্যিকারের গণনাট্যে পরিণত করে সাধারণ্যে ছড়িয়ে দেবার যে একনিষ্ঠ প্রয়াস এঁরা করেছিলেন, তার প্রথম উদাহরণ ছিল ‘নবান্ন’৷

Che Guevara
আর্জেন্টিনার মাকর্সবাদী বিপ্লবী চে গেভারা সেই প্রজন্মের তরুণদের কাছে একজন আইকন

আমার ছোট ভাইটি যখন আকস্মিকভাবে চলে যায়, তখন আমার জীবনটা হঠাৎ করে ফাঁকা হয়ে গেছিল৷ বিভিন্ন দিকে আমার চোখ খুলে গেছিল, কিন্তু আলোচনার মতো কেউ ছিল না৷ ছোট ছেলের মৃত্যুসংবাদে বাবা পাথর হয়ে গেছিলেন৷ মা শয্যা নিয়েছিলেন৷ দিদি সাময়িকভাবে এসেছিল ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে৷ কিছুদিন বাদে আবার চলেও গেছিল নিজের সংসারে৷ দাদা তখন কলকাতায় ফেলে যাওয়া সংসারের জন্য সময় বের করতে পারেননি৷ অগত্যা আমাকেই হাল ধরতে হয়েছিল৷ তখন সদ্য শান্তিনিকেতনে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছি৷ প্রতি সপ্তাহে কলকাতা আসতাম৷ পুলিশ তখনও আমাদের বাড়ির উপর নজর রাখছে৷ সেই সময় বাসা ভাড়া করে থাকি৷ সেই সময় সত্তরের দশকের শেষের দিকে দুটি ঘটনা ঘটল৷ একদিন আমার কাছে একটা চিঠি এল৷ চিঠিটা এক মেয়ের লেখা, যার নাম এখানে আমি গোপন রাখছি৷ এই অপরূপ সুন্দরী মেয়েটি আমাদের বাড়িতে সকলেরই পরিচিত৷ মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজ যখন দীক্ষাদানের জন্য আমাদের বাড়িতে আসেন, তখন এই মেয়েটিই মহারাজের সঙ্গে এসে গান গেয়েছিল৷ সেই দিন শুধু আমার ছোট ভাই বাড়ি ছিল না৷ কিন্তু তার সঙ্গে যে মেয়েটির পরে পরিচয় ঘটেছে, সেটা আমরা কেউ জানতাম না৷ ও সেই চিঠির সঙ্গে আরও কয়েকটি জিনিস যত্ন করে গেঁথে এক বন্ধুর হাতে পাঠিয়েছিল, আমার হাতে দেবার জন্য৷ সেই প্রথম ওরই চিঠিতে ওর সঙ্গে পরিচিত হই৷ ও আমার দাদা-বৌদির পরিচিত৷ সে যখন আমাকে চিঠিটি পাঠায়, তার বেশ কিছু আগে থেকেই সে ওদেশে চলে গেছে৷ সে যে কেন ওই জিনিসগুলি আমাকে দেওয়া মনস্থ করে আমি জানি না৷ হয়তো তার মনে হয়েছিল আমার ভাইয়ের স্মৃতিকে আমি যথাযোগ্য মূল্য দিতে পারব৷ হ্যাঁ, সেই জিনিস ক’টি আমি এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি৷ মেয়েটির এখন আমার হিসেবে প্রায় সত্তর বছর বয়েস৷ আমার ভাই-এর চেয়ে একটু ছোট ছিল সে৷ তার সঙ্গে আমার এত বছরেও আর কখনও দেখা হয়নি৷

চিঠিটা এক মেয়ের লেখা, যার নাম এখানে আমি গোপন রাখছি৷ এই অপরূপ সুন্দরী মেয়েটি আমাদের বাড়িতে সকলেরই পরিচিত৷ মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজ যখন দীক্ষাদানের জন্য আমাদের বাড়িতে আসেন, তখন এই মেয়েটিই মহারাজের সঙ্গে এসে গান গেয়েছিল৷ সেই দিন শুধু আমার ছোট ভাই বাড়ি ছিল না৷ কিন্তু তার সঙ্গে যে মেয়েটির পরে পরিচয় ঘটেছে, সেটা আমরা কেউ জানতাম না৷ ও সেই চিঠির সঙ্গে আরও কয়েকটি জিনিস যত্ন করে গেঁথে এক বন্ধুর হাতে পাঠিয়েছিল, আমার হাতে দেবার জন্য৷ সেই প্রথম ওরই চিঠিতে ওর সঙ্গে পরিচিত হই৷

এই চিঠি পাওয়ার কিছু আগে-পরে আমার জীবনে আরেকটি ঘটনা ঘটে৷ রঙিন৷ রঙিন আমার জীবনে আসে একঝলক টাটকা বাতাসের মত৷ আমার ভাইয়ের আকস্মিক চলে যাওয়া আমার মধ্যে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, রঙিন ছিল তার উপশম৷ শুশ্রূষা দিয়ে আমাকে নিরাময় করেছিল সে৷ রঙিন পড়তে এসেছিল বিশ্বভারতীতে৷ ওর পরিবার থেকে প্রথম কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হল কলেজে৷ রঙিন কলাভবনের ছাত্র ছিল৷ চিত্রশিল্পী নয়, ও চেয়েছিল ভাস্কর হতে৷ বাঁশি বাজাত রঙিন৷ ভালোবাসত ট্রেকিং-এ গিয়ে হিমালয়ের দুর্গম জায়গায় হেঁটে বেড়াতে৷ রঙিন ছিল সতত সঞ্চরমান৷ নিজের মধ্যে স্থবিরতার শ্যাওলা জমতে দেয়নি কখনও৷ ওকে সবাই মানতে পারত না৷ অনেকেই মেনে নিতে পারেনি আমার সঙ্গে ওর এই বোঝাপড়ার জন্য৷ বন্ধুবান্ধব দূরে সরে গেছিল৷ বাবা-মাকে বলতে পারিনি রঙিনের কথা৷ সন্তান বিয়োগের পর ওঁরা আর কোনও নিষ্ঠুর সত্যের জন্য তৈরি ছিলেন না৷ দিদির সঙ্গে রঙিনের কথা বলার মতো নৈকট্য ছিল না৷ একমাত্র দাদাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম৷ কেননা বাবার মৃত্যুর পর দাদা বারবার আমাকে আমেরিকায় চলে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন৷ হয়তো বাবা-মার জন্য কিছু না করতে পারার কোনও দুঃখ বা হতাশা ছিল দাদার মধ্যে৷ দাদা বারবার চাপ দিলে আমি দাদাকে রঙিনের কথা বলতে বাধ্য হই৷ রঙিন আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট৷ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ। রঙিনের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক দূরস্থান, বোন যে এমন একটি অসম ‘কুরুচিকর’ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, সে কথা সহ্য করাও দাদার পক্ষে অসম্ভব ছিল৷ দাদা সেই মুহূর্ত থেকে আমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন৷ বিগত চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমরা পরস্পরের কাছে মৃত৷ কয়েকদিন আগে দৈবাৎ জানলাম দাদা চারবছর আগে মারা গেছেন৷ আসলে তার চল্লিশ বছর আগে থেকেই দাদা আমার কাছে মৃত, যেমন তাঁর কাছেও আমি মৃত৷

*****

ব্লগ পড়া শেষ করে একবার মেল চেক করল রোহিণী। হ্যাঁ, আলোলিকার উত্তর জমা হয়ে আছে মেলবক্সে৷ আলো কী লিখেছেন জানাই আছে রোহিণীর৷ এই ব্লগটা পড়ে এখন নিঃসংশয় ও৷ তবু কৌতূহলবশে আলোর মেলটা ক্লিক করে খুলল ও৷ আলো লিখেছেন… 

‘কল্যাণীয়া রোহিণী,  

জীবনে এক একটা দিন আসে যখন বেঁচে থাকার মানে পাল্টে যায়৷ আমার এই যন্ত্রটা খুলে দশ দিন আগে যখন তোমার চিঠিটা স্ক্রিনে ফুটে উঠল, সেই দিনটা ছিল তেমনই বিশেষ একটা দিন৷ বয়সে শুধু নয়, সম্পর্ক অনুযায়ীও তুমি আমার দুই প্রজন্ম পরের মেয়ে৷ তাই প্রথম আলাপেই (চিঠির উত্তরকে যদি আলাপ বলে গণ্য করা যায়) ‘তুমি’ সম্বোধন করছি তোমাকে৷ আশা করছি মনে করবে না কিছু৷

অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম এই ক’দিন৷ তোমার চিঠির উত্তর দেব কি-দেব না৷ যে সম্পর্ক তোমার দাদাশ্বশুর আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছরেরও বেশি আগে শেষ করে দিয়েছিলেন, প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল আমায়, আমার দিক থেকে যোগাযোগের কোনও চেষ্টা করব না৷ সেই বিচ্ছেদের ভাঙাপথে আবার তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করা আসলে আমার মৃত ‘দাদা’র সঙ্গেই আবার যোগাযোগ রচনা করা৷

man with flute
বাঁশি বাজাত রঙিন

হ্যাঁ, তোমার দাদাশ্বশুর— এবং আমার দাদা জ্যোতির্ময় সেন— এক এবং অভিন্ন ব্যক্তি৷ বললাম বটে, কিন্তু সত্যিই কি ১৯৬৮ সালে যে জ্যোতির্ময় উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান, আর ২০১৫-১৬তে যে জ্যোতির্ময়কে তুমি দেখেছ, অথবা তোমার পরিবারের লোকের কাছে শুনেছ তাঁর কথা, তাঁরা কি সত্যিই একই ব্যক্তি? সময় সবচেয়ে বড়ো ঘাতক৷ এক জীবনে কতবার যে মৃত্যু এবং নবজন্ম হয় আমাদের৷ রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন— ‘জন্মদিনের ধারা চলেছে মৃত্যুদিনের দিকে’, যে অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা হয়ে চলে নানা রবীন্দ্রনাথের একখানি মালা, ঠিক তেমনই বিনি সুতোর ‘আমি’র মালা গাঁথা হয়ে চলেছে আমাদের জীবনেও৷

সুতরাং একটি নিষিদ্ধ এলাকায় এতদিন বাদে সম্পর্কের জোরে ঢুকে পড়া একরকম অনধিকার প্রবেশ কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হতেই কয়েকটি দিন কেটে গেল৷ ক্ষমা কর আমাকে— যদি দশ দিন অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে থাক, দেরির সব দায় আমি এই লেখার মাধ্যমে স্বীকার করে নিচ্ছি৷ দ্বিধাবিভক্ত মনের স্বাভাবিক ইচ্ছে যে আবার বাঁধনে জড়াতে চাওয়া, একথা বুঝতে এই কটা দিন সময় নিলাম আমি৷

তুমি আমার ব্লগ পড়ে খুশি হয়েছ, এর চেয়ে বড় পাওনা আর স্বল্পমেয়াদি লেখার জীবনে কী থাকতে পারে? এই চিঠি যখন খুলবে, তখন আমার সাম্প্রতিক ব্লগপোস্টও তুমি নিশ্চয়ই পড়ে ফেলবে৷ যদি না পড়ে থাক, তবে পড়ে নিও ওটা৷ দাদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হবার কারণটুকুর আভাস রয়েছে ওখানে৷ তবে কারণের পিছনেও তো ইতিহাস থাকে, অব্যক্ত পুঞ্জীভূত বেদনার নকসিকাঁথা বিছানো থাকে প্রান্তর জুড়ে৷ সেই বাকি ইতিহাসটুকু হয়তো পরে কখনও বলা যাবে তোমাকে৷

আপাতত তোমাকে আমার চেনা দাদার গল্প একটু বলি৷ যৌথ পরিবারে জন্ম হয়েছিল আমার৷ সেটা অবিভক্ত বাংলা৷ তুমি দেশভাগ নিয়ে গবেষণা করেছ লিখেছিলে৷ দেশভাগের স্মৃতি আমার কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়৷ শুধু আবছা মনে পড়ে ভৈরব নদী পেরিয়ে যাওয়ার স্মৃতি৷ একটা ট্রেনে চড়ে সেই প্রথম আসা কলকাতা বলে একটা বড় শহরে৷

এই চিঠি যখন খুলবে, তখন আমার সাম্প্রতিক ব্লগপোস্টও তুমি নিশ্চয়ই পড়ে ফেলবে৷ যদি না পড়ে থাক, তবে পড়ে নিও ওটা৷ দাদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হবার কারণটুকুর আভাস রয়েছে ওখানে৷ তবে কারণের পিছনেও তো ইতিহাস থাকে, অব্যক্ত পুঞ্জীভূত বেদনার নকসিকাঁথা বিছানো থাকে প্রান্তর জুড়ে৷

তুমি হয়তো শুনেছ আমাদের বাবা অপশন দিয়ে বদলি নিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে৷ সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ, যার এখনকার নাম মৌলানা আজাদ কলেজ— সেখানে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে৷ আমার নিতান্ত মধ্যবিত্ত বাবা-মা’র শখ ও সাধ্য খুব সীমিত ছিল৷ দেশভাগের সূত্রে যেসব মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়ত্ব ছুঁই ছুঁই মানুষরা সীমান্ত বদল করেছিলেন, তাঁদের সবারই হয়তো শুধু ওইটুকুই আশা ছিল৷ ভিটেমাটি থেকে উৎপাটিত হয়ে নতুন জায়গায় নতুনভাবে শুরু করার লড়াই করতে করতে তাঁরা ভেবেছিলেন এবার তাঁরা তাঁদের নিজস্ব কোণটুকু খুঁজে পাবেন৷ বৃদ্ধ বয়সে সন্তানরা তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে৷ বাইরের দাউদাউ আগুনের আঁচ থেকে বাঁচিয়ে যে সন্তানদের তিলে তিলে বড় করেছেন এতকাল, রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত থেকে ঢেকে রেখেছেন, পক্ষীমাতা যেমন তার শাবকদের রাখে, তার বদলে পরিণত বয়সের সন্তানরা প্রতিদান হিসেবে তার কণাটুকু ফিরিয়ে দেবে৷ দুঃখের বিষয় আমার বাবা-মায়ের ভাগ্যে তা ঘটেনি৷ দেশভাগের পর এপারে এসে কুড়ি বছর ধরে একটু একটু করে সামান্য হলেও সুখের মুখ দেখেছিলেন তাঁরা, পরম নিশ্চিন্তির সঙ্গে ভাবছিলেন সুদিন অবশেষে এল বুঝি৷ পরবর্তী একটি দশকের মধ্যে সেই চারাগাছের মতো নিরাপত্তা, সুখানুভূতি মুড়িয়ে দলে পিষে চুরমার হয়ে গেছিল৷ আমার ভাই স্বাধীন, আমাদের পরম আদরের ছোটকু চলে গেছিল দেশের কাজে৷ বৃহৎ কালেকটিভ লক্ষ্যপথে সে স্থির ছিল৷ কিন্তু তার এই আত্ম-বিসর্জনের মধ্যে যে তার ঘরের মানুষগুলোরও আত্মত্যাগ মিশে আছে, তা সে একবারও ভাবেনি৷ দাদা ঠিক সময়ে সুযোগ পেয়ে স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে নিয়ে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন৷ ছোটকুর মৃত্যুসংবাদও তাঁকে ফেরাতে পারেনি৷ তাঁকে তখন আরও পশ্চিম হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷ সেই ডাকের মোহে তিনি নিজের বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন, এতদিন বাদে একথা বলতে আমার আর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই৷ আমার দিদিও তখন নিজের সংসারে ব্যস্ত৷ আমার সংসার ছিল না৷ অবিবাহিতা মেয়ে হিসেবে আমি যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছিলাম৷ কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকু? শান্তিনিকেতনে তখন নতুন চাকরি৷ প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার রাতে বাড়ি ফিরে দেখতাম বাবা বারান্দায় বসে আছেন৷ ঘন হয়ে আসা অন্ধকারে নিষ্কম্প হয়ে বাবা কী ভাবতেন জানি না৷ হয়তো তাঁর গোটা আয়ুষ্কালের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতেন নিভৃতে৷ এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য তাঁকে গ্রাস করেছিল৷ যে বাবা আমাদের ছোটোবেলায় পৃথিবীর কত আশ্চর্য গল্প বলতেন, বলতেন ব্রাজিলের রাক্ষুসে পিরানহা মাছের কথা, অ্যামাজনের জঙ্গল, মিশরে নীল নদ, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, জাপানের ফুজিয়ামা পাহাড়, উত্তর মেরুর অরোরা বোরিয়ালিস আর এস্কিমোদের ইগলু, সব কিছু চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত, সেই বাবাই অমন চুপ হয়ে গেছিলেন ভিতর থেকে৷ আমার মনে হত বাবা যেন মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন৷

bisva bharati
শান্তিনিকেতনে তখন নতুন চাকরি

বুধবার শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন বলে মঙ্গলবার রাতে এসে আবার বৃহস্পতিবার রওনা দিতাম ভোরের ট্রেনে৷ ছোটকুর মৃত্যুর পর থেকে বাবার মৃত্যু অবধি দুটো বছর এই ছিল আমার রুটিন৷ বুধবার এসে দমদমের বাড়ির সব বকেয়া কাজ সারতাম৷ ইলেকট্রিকের বিল দেওয়া, বাথরুমের কল সারানো, বাজারহাট করা, বই গোছানো, ওষুধপত্র কেনা এসব করতে করতেই সময় কেটে যেত৷ সামনের চিলতে বাগান দেখাশুনোর অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছিল৷ আগাছার জঙ্গলে ঢেকে যাচ্ছিল সাধের ফুলগাছেরা৷ মা বিছানায় শুয়ে থাকতেন জীবন্মৃতের মতো৷ কারোও পায়ের শব্দ পেলেই বলতেন, ‘কে, খোকন আইল?’ ছোটকুর চলে যাবার পর মা হয়তো আশা করতেন তাঁর খোকন এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বুকের ক্ষতে প্রলেপ দেবে৷ দাদা এসেছিলেন, বাবার মৃত্যুর সময়৷ বাবা দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন নিরুচ্চার৷ দাদার হাতটা ধরেছিলেন আলতো করে৷ কৃতি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু কি বলতে চেয়েছিলেন বাবা? জানি না৷ হয়ত বাবার সব কথা তখন ফুরিয়ে গেছিল।

আমাদের মা তারপরও প্রায় দশ বছর বেঁচেছিলেন৷ দমদমের সংসার ভেঙে গেছিল৷ বাবার করা সাধের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হল নামমাত্র দামে৷ দাদা বাড়ি বিক্রির প্রাপ্য অর্থ আমাদের দুই বোনকে দিয়েছিলেন তাও যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি যে দশ বছর ধরে তিনি মায়ের দায়িত্ব ক্রমাগত অস্বীকার করেছিলেন৷ মাকে থাকতে হয়েছিল বড় মেয়ে-জামাইয়ের আশ্রয়ে৷ এই একটি বিষয়ে আমার দিদির কাছে আমি সবিশেষ ঋণী৷ মাকে শেষ জীবনে নিরাশ্রয় হবার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল সে৷ বাবা চলে গেলেন৷ মাকে দিদি নিয়ে গেল নিজের কাছে, দাদারা ফিরে গেলেন তাঁদের প্রবাসজীবনে অথবা নিজের ঘরে৷ আমিও সেই সময় থেকে আমার জীবন নিজের মতো করে ছকে নিলাম৷ অস্বীকার করব না, ছিয়াত্তর সালে দাদা চেয়েছিলেন আমি চলে আসি ওঁদের কাছে৷ ‘এখানে তোমার প্রফেশনকে সিরিয়াসলি নেবার লোকের অভাব হবে না৷ তোমার নিজের স্টুডিও করার ব্যবস্থা করে দেব আমি৷’ দাদা এরকম আশ্বাসও দিয়েছিলেন৷ কিন্তু আমার মন সায় দেয়নি পঁয়তিরিশ বছর বয়সে নিজের দেশ ছেড়ে হঠাৎ আমেরিকায় গিয়ে বাকী জীবনটা কাটাতে৷

বিদেশের জন্য কখনোই লালায়িত ছিলাম না৷ স্বদেশের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের মধ্যে প্রোথিত থেকেই নিজেকে বার বার গড়তে চেয়েছি আমি৷ এ আমার মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর শিক্ষা৷ হ্যাঁ, দাদার প্রস্তাবে সায় না দেবার আরেকটা কারণ অবশ্যই ছিল রঙিন৷ আমার ব্লগ পড়ে তুমি নিশ্চয়ই রঙিন নামটার সঙ্গে পরিচিত৷

দমদমের সংসার ভেঙে গেছিল৷ বাবার করা সাধের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হল নামমাত্র দামে৷ দাদা বাড়ি বিক্রির প্রাপ্য অর্থ আমাদের দুই বোনকে দিয়েছিলেন তাও যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি যে দশ বছর ধরে তিনি মায়ের দায়িত্ব ক্রমাগত অস্বীকার করেছিলেন৷ মাকে থাকতে হয়েছিল বড় মেয়ে-জামাইয়ের আশ্রয়ে৷ এই একটি বিষয়ে আমার দিদির কাছে আমি সবিশেষ ঋণী৷ মাকে শেষ জীবনে নিরাশ্রয় হবার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল সে৷

পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে সেই মানুষটাকে আস্তে আস্তে বুঝেছি৷ তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক না থেকেও সে মানুষটার সঙ্গে চল্লিশ বছরের উপর বসবাস করেছি আমি৷ সে ছিল অন্ত্যজ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ৷ রঙিনের কথা পরে হয়তো কখনও আরও বলতে পারব আমার ব্লগে৷ রঙিনের কথা পরিবারের মধ্যে একমাত্র দাদাকেই বলেছিলাম আমি৷ যার পরিণামে আমৃত্যু আমাকে অস্বীকার করেছিলেন তিনি৷ যতদূর জানি দাদা তিন-চার বছর অন্তর কর্মসূত্রে এদেশে আসতেন৷ একদিনের জন্য সময় বার করে দেখা করতেন মা আর দিদির সঙ্গে৷ মা চলে যাবার পাঁচ বছর পর দিদি মারা যায়৷ মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে৷ দাদার সঙ্গে দেশের শেষ সংযোগসূত্রটাও নষ্ট হয়ে যায়৷

Bhairab River Bridge
শুধু আবছা মনে পড়ে ভৈরব নদী পেরিয়ে যাওয়ার স্মৃতি

দাদা যখন আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন প্রথম প্রথম খুব আশ্চর্য লাগত আমার৷ দাদার কথা ভেবে নয়, বেশি অবাক লাগত বৌদির কথা ভেবে৷ বৌদি- যাকে আমি অরুণদি বলেই ডাকতাম অনেকদিন, সে আমাদের বাড়িতে বউ হয়ে আসে ১৯৬১ সালে৷ বাইশ-তেইশ বছরের অরুণদির একমাথা কালো চুল, শ্যামলা রং আর মুখখানা ভারি ঢলঢলে, মায়াভরা৷ অরুণদিকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মনে হত আমার৷ পঁচাত্তর সালে বাবার মৃত্যুর সময় শেষ দেখি দাদা আর অরুণদিকে৷ বিয়ের পরও অরুণদি ডাকটিই মুখে আসত৷ বৌদি না বলায় আমাদের মা বকাবকি করতেন৷ আর অরুণদি প্রশ্রয়ের হাসি হাসত৷ অরুণদি ছিল দাদার যাকে বলে ‘সোলমেট’৷ তাই কি প্রশ্নহীন আনুগত্যে এই পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে দাদাকেই অভ্রান্ত সত্য বলে মনে করে গেল সে? একবারও তার মনে হল না খুশি কেমন আছে? তোমার চিঠি পাবার পর থেকে এই এত বছর পরে আবার তাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব৷ আর ইচ্ছে হচ্ছে বাবাই-কে দেখতে৷ বাবাই-এর জন্ম হয় কলকাতার মেডিকেল কলেজে৷ তার জন্মের পর থেকে ছ’বছর বয়সে যখন সে ইংল্যান্ডে চলে যায়, সে সময় অবধি সে ছিল আমাদের নয়নের মণি৷ আমি আর ছোটকু তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলাম৷ খুব কেঁদেছিল বাবাই ইংল্যান্ডে যাবার সময়৷ দাদু-ঠাম্মা-পিসি-কাকার মধ্যে বড় নিশ্চিন্তে বড় হচ্ছিল সে৷ ওখানে গিয়েও আমাদের জন্য কান্নাকাটি করত বাবাই-অরুণদি চিঠিতে লিখেছিল৷

সেই বাবাই পঁচাত্তরে যখন এল, বাবার মৃত্যুর সময়, তখন সে অনেক দূরের একটি ছেলে৷ মা বাবা বুঝতে পারেননি, কিন্তু আমি বুঝেছিলাম সাত বছরের বিদেশবাস বাবাইকে পাল্টে দিয়েছে৷ আর তার বোন, আমাদের ভাইঝিকে তো আমাদের চেনার সুযোগই হয়নি৷ আমার তো সন্তান নেই৷ দিদির ছেলে দীপ্তকে মাঝে মাঝে দেখলেও তাকে তেমন আপন করে পাইনি কখনও৷ বাবাই প্রথম এবং শেষ শিশু যে আমায় মাতৃত্বের অচেনা অনুভূতিকে একটু হলেও বুঝতে দিয়েছিল৷ এখন তার আটান্ন বছরে কেমন দেখতে হয়েছে তাকে, কাকে সে বিয়ে করেছে এসব জানার ইচ্ছে হচ্ছে নতুন করে! তার ছেলে এবং পুত্রবধূ তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে এ’কদিন৷

বাইশ-তেইশ বছরের অরুণদির একমাথা কালো চুল, শ্যামলা রং আর মুখখানা ভারি ঢলঢলে, মায়াভরা৷ অরুণদিকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মনে হত আমার৷ পঁচাত্তর সালে বাবার মৃত্যুর সময় শেষ দেখি দাদা আর অরুণদিকে৷ বিয়ের পরও অরুণদি ডাকটিই মুখে আসত৷ বৌদি না বলায় আমাদের মা বকাবকি করতেন৷ আর অরুণদি প্রশ্রয়ের হাসি হাসত৷ অরুণদি ছিল দাদার যাকে বলে ‘সোলমেট’৷

দৈব মানি না আমি৷ ছোটকু চলে যাবার পর থেকে আর মঙ্গলময় ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই আমার৷ কিন্তু ঈশ্বর থাক বা নাই থাক, নিয়তি বা ভাগ্য বলে হয়তো কিছু থাকে৷ নয়তো জীবনের উপান্তে এসে রঙিনের অনুপস্থিতিকে ভুলতে, নিজের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে কেনই বা ব্লগ লেখার সিদ্ধান্ত নেব আমি, আর কেনই বা সেই ব্লগে হঠাৎ চোখ আটকে যাবে তোমার! বহু বছর আগে অকালে হারানো পরিবারের সঙ্গে অলক্ষ্যে তৈরি হবে উর্ণতন্তুজালের মায়াবন্ধন! নিয়তি নির্দিষ্টই কি থাকে আমাদের জীবনের সব কিছু?

রোহিণী, এই জীবনে তোমার বা তোমাদের পরিবারের দেখা হবে কি না জানি না৷ আমার তো পাসপোর্টই নেই৷ নেই ওদেশে যাবার অনুমতিপত্র৷ তার বদলে তুমি কি একবার আসবে আমার কাছে? তুমি বা তোমরা কি কলকাতায় আসাযাওয়া কর মাঝে মাঝে? আমি শান্তিনিকেতনের পাট তুলে এখন কলকাতার বাসিন্দা৷ সেই কলকাতা, যে অচেনা শহরে তিয়াত্তর বছর আগে ট্রেনে চড়ে এসেছিলাম৷ কলকাতার পূর্বপ্রান্তে সুখদিয়া নামে একটা বৃদ্ধাবাসে স্বেচ্ছায় চলে এসেছি আমি৷ শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হয়নি পুরোপুরি৷ ষাট বছর ধরে যে জায়গা আমাকে লালন করেছে, আমার সব অপরাধ ধারণ করে আশ্রয় দিয়েছে, তাকে কি এক লহমায় দূর করে দিতে পারি? যদি তোমার দিদিশাশুড়ি কোথায় জীবনের প্রথম কুড়ি-একুশ বছর কাটিয়েছেন দেখতে চাও, তাহলে চলে এস আমার কাছে৷ আমার মতো ভালো রেডিমেড শান্তিনিকেতনের গাইড বুক তুমি কোথাও পাবে না৷ সারা জীবন অনেক আকস্মিক ঘটনার সঙ্গে যুঝতে হয়েছে আমায়৷ অনেক হঠাৎ আসা বাঁকের মুখে দিকবদল হয়েছে চলার পথের৷ দুঃসহ সেই সব মোড় ফেরা নিরুদ্ধ করতে পারেনি চলার গতি৷ দিগন্তের পর দিগন্ত পার হয়েছি, ধুলোর ঝড় সামলে- এই বয়সে এসে যখন একরকম নিশ্চিত হয়েছি, শেষের বিন্দুটির এই শুরু, তখন আবার সাগরপার থেকে অদৃশ্য তরঙ্গে ভেসে এল তোমার চিঠি, ‘হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন’-এর মতো তুমি এলে, চরম আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি বুঝলাম পথ এখনও শেষ হয়নি, এখনও অবাক করছে সামনের ঢালু হয়ে আসা রাস্তা, আবার বেঁচে থাকার বেঁচে ওঠার ইচ্ছে জাগছে মনে৷ তোমার অপেক্ষায় থাকব৷

ইতি, আলোলিকা সেন৷

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৭ ডিসেম্বর ২০২২

ছবি সৌজন্য:  Flickr, Wikimedia Commons, Adobe Stock,

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com