banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ১১

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

নভেম্বর ৪, ২০২২

Romani tribe
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০]

রোমানিদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতবর্ষ৷ মোটামুটি হাজার দেড়েক বছর আগেই তারা মাইগ্রেট করতে শুরু করে৷ প্রথমে ইউরোপে, তারপর আমেরিকায়৷ পশ্চিমমুখী এই মাইগ্রেশনের ফলে রোমানিরা ছড়িয়ে আছে বহু দেশে৷ প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদানের ফলে তাদের ধর্ম, ভাষা এসব বদলে গেছে৷ যেখানে তারা বসতি করেছে, সেই জায়গার ধর্ম তারা গ্রহণ করেছে, রোমানি ভাষায় ঢুকে গেছে বহু আঞ্চলিক শব্দ৷ কিন্তু যেহেতু এদের আদিভূমি ভারত, সেজন্য হিন্দি আর পাঞ্জাবি ভাষার সঙ্গে এদের ভাষার মিল রয়েছে, ভাষার ব্যাকরণও বাংলা ব্যাকরণের অনুসারী৷ সংস্কৃত ভাষার আদি ছাঁচ এখনো এ ভাষায় স্পষ্ট৷ নীলের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হবার আগে বিস্তর হোমওয়ার্ক করেছে জিনি রোমানিদের সম্পর্কে৷ সান-ডিয়েগো ম্যারিয়টে উঠেছে নীল৷ হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে কনভেনশন সেন্টার৷ সেন্টারটা বিশাল লম্বা, টানা এক ব্লক ধরে এমুড়ো থেকে ওমুড়ো অবধি চলে গেছে৷ নীল একবার যেখান থেকে ওর বই বেরোচ্ছে তাদের অফিসেও দেখা করবে৷ কিন্তু সেটা ওর গৌণ উদ্দেশ্য৷ ও এবার মূলত এসেছে কনভেনশন সেন্টারে তিনদিনের একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে৷ জিনিকে আসার আগে ও ফোন করেছিল একবার৷
– আমাকে একটা কাজে এবার ওয়েস্ট কোস্টে যেতে হচ্ছে৷ আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং ইফ আই কুড মিট ইউ ফর এ ব্রিফ চ্যাট ওভার এ বিয়ার অর টু, সাম টাইম?
জিনি এককথায় সানন্দে সম্মতি দিয়েছিল৷ অনেকদিন ধরেই ও ভাবছিল নীলকে মিট করলে হত একবার৷ শুক্র-শনি-রবি নীল সকাল থেকে রাত অবধি খুব ব্যস্ত থাকবে৷ সারাদিন কনফারেন্সের পরও কনফারেন্স ডিনার, মিট দ্য প্রেস এসব থাকবে৷ সেজন্য ওরা ঠিক করেছে বৃহস্পতিবার আর্লি বিকেলে নীল পৌঁছনোর পরই কোথাও একসঙ্গে বসবে৷

রুণকে বিয়াট্রিসই সামলাবে, যেমন অনেক বছর ধরেই ও করে আসছে৷ বিয়াট্রিস কখনও জিনির কাজের ব্যাপারে নাক গলায় না৷ শুধু প্রশ্ন করে ফিরতে কত দেরি হবে৷ আজ নীলের সঙ্গে ডিনার করে ফেরার সম্ভাবনা৷ জিনির ফিরতে দেরি হবে শুনে বিয়াট্রিস কাঁধ ঝাঁকাল৷
– হোপ, ইউ এনজয় ইয়োর ইভনিং!
বলার দরকার ছিলো না, তবু জিনি কিছুটা কৈফিয়তের সুরেই বলল,
– ইট্‌স সেমি-অফিসিয়াল৷
নীলের বই যে ওদের পাবলিশিং হাউস থেকে অদূর ভবিষ্যতেই বেরোতে চলেছে সেসব গল্প বিয়াট্রিসকে বলল কিছুটা, ও জানতে না চাইলেও৷ বিয়াট্রিসের জিনির উপর একটা প্রচ্ছন্ন অধিকারবোধ আছে৷ সেই ব্যাপারটা এমনিতে জিনির ভালোই লাগে, তবু কোনও কোনও সময় মনে হয় একটু শ্বাসরুদ্ধ লাগছে৷ ওর মনের গড়নের জন্য বা অন্য যে কোনও কারণে, নিজের স্বাধীনতা সম্পর্কে ও খুব সচেতন৷

Neil and Jinia
তিনজনে বার কাউন্টারে গিয়ে পছন্দমতো মাছ ভাজা নিয়ে এসেছে।

হোটেলে পৌঁছেই ফোন করেছে নীল৷ কোথায় কীভাবে দেখা হতে পারে? জিনিয়া ওকে বলল, সাড়ে চারটে নাগাদ হোটেলের পাশের দিকটায় টিন ফিশ কাফেতে চলে আসতে৷ ট্রাম নিয়ে ঠিক চারটে কুড়ির সময় কাফের সামনের স্টপেজে নামল ও৷ গাড়ি আনেনি আজ৷ অফিসে বা নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেরনো একটা বদারেশন৷ টুকটাক পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠে পড়া, আবার নেমে যাওয়া অনেক বেশি সুবিধার৷ তাছাড়া নীল আগে এ শহরে এসেছে কিনা, জিনিয়া জানে না৷ যদি শহর ঘুরতে চায়, তাহলে পায়ে হাঁটার কোনও বিকল্প নেই৷ এই কাফেটা খুব মজাদার৷ ভিতরে কিছু বসার বন্দোবস্ত আছে৷ কিন্তু কাফের পাশে একটা চৌকো উঠোনের মতো জায়গা ঘিরে নিয়ে বসানো হয়েছে আরও অনেকগুলো গোল উঁচু টেবিল৷ পাশে দুটো বা তিনটে করে চেয়ার৷ আইডিয়াটা এরকম যে রাস্তার লোকজনও যেতে যেতে তাকিয়ে দেখবে খোলা চত্বরে সবাই গল্পগুজব করছে, টুকটাক খাবারও খাচ্ছে৷ অন্যদিকে কাফেতে বসে খাবার খেতে খেতে কাফের খরিদ্দাররাও দেখবে চারপাশে বয়ে যাওয়া চলমান জীবনকে৷ 

আজ টিন ফিশ কাফেতে বেশ ভিড়৷ এখন অফিশিয়ালি স্প্রিং৷ কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার একটা সুবিধা– শীত-গ্রীষ্ম কোনওটাই এখানে তীব্র আকার ধারণ করে না৷ এখন অনেকক্ষণ বিকেল থাকে৷ সামারে এই বেলাটা আরও প্রলম্বিত হবে৷ সূর্য অস্ত যাবে অনেক দেরিতে৷ লম্বা লম্বা পা ফেলে জিনিয়া গিয়ে ট্রামলাইনটা চোখে পড়ে, এমন একটা জায়গা দেখে বসে পড়ল৷ নীল টেক্সট করেছে ‘ইজ ইট ওকে ইফ আই ব্রিং অ্যালং অ্যানাদার গাই?’ জিনিয়ার ভুরুটা একটু কুঁচকে গেলেও সেটা ও তৎক্ষণাৎ ঢেকে নিল৷ ‘অ্যাবসল্যুটলি ফাইন’ ফিরতি ম্যাসেজ-এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জিনিয়া দেখল দু’জন একটু অনিশ্চিতভাবে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে কাফেতে ঢুকছে৷ বহু করেস্পন্ডেন্সের সূত্রে নীলের চেহারাটা এখন জিনির কাছে ছবিতে পরিচিত৷ কিন্তু ছবিতে যেমন মনে হয়, তার থেকে আরও অন্যরকম নীল৷ ওর মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুল এখন মাথার পিছনে একটা ব্যান্ডানা দিয়ে বাঁধা৷ বাদামি রঙের চোখের মণিতে বালকের মতো একরাশ বিস্ময়৷ গড়নটা মোটের উপর মাঝারি৷ উচ্চতাও খুব বেশি নয়৷ পরে আছে একটা ফুল ছাপ ছাপ সুতির হাফপ্যান্ট আর সেরকমই একটা বিচ শার্ট৷ মাথায় একটা পানামা হ্যাট৷ হঠাৎ করে দেখলে ওকে ল্যাটিন আমেরিকান বলে ভুল হতে পারে৷ পঁয়তিরিশ বছর বয়স বোঝা যায় না৷ হয়তো মুখচোখে অসম্ভব সারল্যের জন্য৷ অন্য যে ছেলেটি নীলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে জিনিয়ার সঙ্গে করমর্দন করছে, তার নাম ইউজিন৷ নীল পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,
– মিট মাই সোলমেট৷ হি থট হি শ্যুড নট ইন্ট্রুড ইনটু আওয়ার ফার্স্ট ফেস টু ফেস মিটিং৷ বাট আই প্রডেড হিম টু ডু সো৷
– ডিড দ্য রাইট থিং৷
জিনি ভদ্রতা রক্ষার জন্য বলছে৷ তিনজনে বার কাউন্টারে গিয়ে পছন্দমতো মাছ ভাজা নিয়ে এসেছে৷ নীল আর ইউজিন বিয়ার খাচ্ছে৷ ইউজিন বিয়ারটাতে স্প্রাইট মিশিয়ে শ্যান্ডি করে খাচ্ছে৷ জিনিয়া একটা লাইম জুস্‌ কর্ডিয়াল খাচ্ছে৷ বিয়ারের তিতকুটে স্বাদ ওর পছন্দ নয়৷ আস্তে আস্তে জমে উঠছে কথোপকথন৷ শেষ কবে যে জিনিয়া এতটা উপভোগ করেছে একটা বিকেল, এমন প্রাণময় বাক্যালাপে, ও মনে করতে পারে না নিজেই৷ ইউজিন নীলের পার্টনার, এটা ও আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল৷ ওরা এসেছে একটা এলজিবিটিকিউ কনফারেন্সে৷ এতদিন বিয়াট্রিসের সঙ্গে এক ছাদের তলায় বসবাস করলেও জিনিয়া এমন কোনও সম্মেলনে যায়নি৷ কখনও পাবলিক কোনও ফোরামে ভাগ করে নেয়নি ওদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে৷ ওর জীবনের গল্পটাও ভাগ করে নিচ্ছে জিনিয়া ওদের সঙ্গে৷ শুনতে শুনতে ইউজিন প্রস্তাব দিচ্ছে,
– ইউ ক্যান কাম অ্যালং৷ ইট’জ অ্যান ওপেন কনফারেন্স৷ নোবডি ইজ বারড ফ্রম এনটারিং দ্যা সেশনস্‌৷ 

নীলের বই যে ওদের পাবলিশিং হাউস থেকে অদূর ভবিষ্যতেই বেরোতে চলেছে সেসব গল্প বিয়াট্রিসকে বলল কিছুটা, ও জানতে না চাইলেও৷ বিয়াট্রিসের জিনির উপর একটা প্রচ্ছন্ন অধিকারবোধ আছে৷ সেই ব্যাপারটা এমনিতে জিনির ভালোই লাগে, তবু কোনও কোনও সময় মনে হয় একটু শ্বাসরুদ্ধ লাগছে৷ ওর মনের গড়নের জন্য বা অন্য যে কোনও কারণে, নিজের স্বাধীনতা সম্পর্কে ও খুব সচেতন৷

জিনিয়ার মধ্যেও এইরকম একটা সম্মেলনে যাবার ইচ্ছে জাগছে ভিতর থেকে৷ ইউজিনের তামাটে চেহারা, মাথা পরিপাটি করে কামানো, কালো চোখের মণিতে কীসের যেন বিষণ্ণতা। সুঠাম চেহারা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চুমরানো গোঁফ৷ পরনে পাতলা পাজামা আর সাইড বাটনড্‌ কুর্তা৷ জিনিয়া লক্ষ না করে পারে না যে ইউজিন মাঝে মাঝেই অপলক চেয়ে থাকে নীলের দিকে৷ ও বেশি কথা বলে না৷ শুধু নীলের দিকে গভীর বিষণ্ণভাবে তাকিয়ে থেকে যেন বুঝিয়ে দেয় ওর মনের কথা৷ ওদের ব্যক্তিগত কথা যতদূর ওরা বলে, তার চেয়ে বেশি জিজ্ঞেস করাটা অভব্যতা, তাই জিনিয়া কথা তোলে রোমানি হিসেবে নীলের অভিজ্ঞতা জানতে চেয়ে৷ জিনিয়ার কথায় নীল হাসে হা হা করে৷ বলে,
– ‘তুমি নিশ্চয়ই আমার উপন্যাসটা পড়ে ভেবে নিয়েছ আমি রোমানি? অ্যাকচুয়ালি লেট মি টেল ইউ, ইউজিন আমার সহ-লেখক৷
– মানে?
জিনিয়া একটু অবাক ৷ 
– মানে আর কিছুই না৷ আমার বইতে যে অভিজ্ঞতাগুলো, যে গল্প রয়েছে, তা যেমন আমারও অভিজ্ঞতা, তেমনই ইউজিনেরও৷
– হি ইজ মাই স্টোরি টেলার৷
ইউজিন একটু বিষণ্ণ হাসে৷ নীল আবারও বোঝাচ্ছে জিনিয়াকে৷ রোমানি পিপল আসলে একটা ক্যাচঅল শব্দ৷ অঞ্চলভেদে, দেশভেদে, সমাজভেদে রোমানিরা বদলায়৷ যে দেশে যায় সেই দেশের সংস্কৃতি, ধর্ম, জল-হাওয়াকে পুরোপুরি তো প্রতিরোধ করতে পারে না৷ মানিয়ে নিতে হয়। নীল ভারতবর্ষের সেই যাযাবর সম্প্রদায়ের লোক৷ বানজারা৷ সেজন্য ওর বাবার পদবীতে না লিখে ও নীল বানজারা নামে লেখে৷ সত্যিই তো! জিনিয়া তো জানে নীলের পুরো নাম নীল বানজারা৷ কিন্তু বানজারা শব্দটার মানে কী, তা নিয়ে জিনিয়া কোনওদিন মাথা ঘামায়নি৷ বানজারা মানে যারা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, ওয়ান্ডারারস ইন দ্য জাঙ্গল৷ বনচারী এই মানুষরা বনের সম্পদ আহরণ করে বেঁচে থাকত৷ আদিম কৌম অবস্থা থেকে সরে গিয়ে বন কেটে বসত করার কথা ভাবত না৷ তারা কোথা থেকে এসেছিল কেউ জানে না৷ কেউ বলে আফগানিস্থান থেকে ভারতে এসেছিল৷ আবার র‌্যালফ লিলি টার্নার নামে একজন ভাষাতত্ত্ববিদ বলেছিলেন মধ্য ভারতের মধ্যেই এদের উদ্ভব, ক্রমে যারা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে৷
– কিন্তু রোমানিরা চলে গেল কেন?
জিনিয়া জিজ্ঞেস করে৷ নীল এখন প্রবল উৎসাহে জিনিয়াকে বোঝাচ্ছে এই যাযাবর সম্প্রদায়ের চলনের ইতিহাস৷

Romani Gypsy
বনচারী এই মানুষরা বনের সম্পদ আহরণ করে বেঁচে থাকত৷

রোমানিরা অষ্টম শতক থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে পাড়ি জমাতে থাকে ইউরোপে৷ কেন যে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছিল কে জানে? ইতিহাসে অনেকরকম ব্যাখ্যা মেলে৷ কেউ কেউ বলে গজনীর মামুদের আক্রমণ এড়াতেই এই দেশত্যাগের শুরু৷ আবার এমনও হওয়া সম্ভব যে ভারতবর্ষের বর্ণ ব্যবস্থার শৃঙ্খলিত অবস্থান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল তারা৷ বানজারাদের স্থান ছিল বর্ণ ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচু কাঠায়৷ সবাই তাদের বাঁধতে চাইত৷ বর্ণহিন্দুরা তো বটেই, পরে ব্রিটিশ আমলে ১৮৭১-এ চালু হল ক্রিমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট ৷ ঔপনিবেশিক শাসক আইনের সাহায্যে জোর খাটাল তাদের উপর৷ বনচারী জীবন থেকে সরিয়ে এনে কৃষকের বৃত্তিতে জোর করে পুনর্বাসন দেওয়া হল মানুষগুলোকে৷

নীল হাসছে৷ কিন্তু যাযাবর বৃত্তি যাদের রক্তে, তারা কি করে এক জায়গায় স্থির থাকবে? আদিবাসী কৌম এই প্রান্তিক মানুষরা কখনও সভ্য সমাজ বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে, যুক্তি শৃঙ্খলার বেড়িতে বাঁধা পড়ত না৷ ভারতেও নয়, ইউরোপেও নয়৷ ষোড়শ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রোমানি বিরোধী আইন চালু করেছিল৷ একঘরে করার চেষ্টা হয়েছিল ‘জিপসি’ তকমা দিয়ে৷ ডেনমার্কের মতো দেশে এই সম্প্রদায়ের কোনও মানুষ ধরা পড়লেই মৃত্যুদণ্ড হত৷ ইউরোপের কালেক্টিভ মিথোলজিতে রোমানিদের দেগে দেওয়া হয়েছিল বহিরাগত, তন্ত্রমন্ত্র বশীকরণে পারদর্শী, ফোঁপরা নৈতিক চরিত্রের এক প্রহেলিকাময় জাতি হিসেবে, যাদের কাছ থেকে শত হস্ত দূরে থাকাই ভাল৷ ইউজিন এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল৷ এবার পাশ থেকে যোগ করে,
– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোয় নাৎসিরা রোমানিদের উপর কম অত্যাচার করেনি৷ ১৯৩৬ থেকে ৪৫ এর মধ্যে ১৫ লক্ষ লোক মারা গেছিল নাৎসিদের অত্যাচারে, যাকে বলা হয় প্রগ্রমস বা রোমানি হলোকস্ট৷
নীল বলে ইদানীং বিভিন্ন দেশের টনক নড়েছে৷ আগের অনেক ভুল ধারণা খারিজ হতে শুরু করেছে৷ কয়েক বছর আগে ২০১১ সালে বেলগ্রেডে একটা রোমানি অ্যাকাডেমি চালু হয়েছে রোমাণিদের বিভিন্ন দিক নিয়ে সিরিয়াস গবেষণার জন্য৷ অ্যাকাডেমির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের ২১ জন সদস্যের মধ্যে ১১টা ইউরোপীয় দেশের তো বটেই, ভারত, যা রোমানিদের আদি জায়গা এবং আমেরিকার প্রতিনিধিও রয়েছেন৷
– হ্যাঁ, ভালো কথা৷ তুমি তো বললে ওরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছিল৷ আমেরিকায় এল কবে? 
অনেকক্ষণ উত্তেজিত বক্তৃতার পর নীল একটু হাসে।
– যা শুনেছি ১৪৯৮-তে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের তৃতীয় সমুদ্রযাত্রার সময় চারজন রোমানি তাঁর সঙ্গী হয়৷ প্রচুর সংখ্যক লোক আসতে শুরু করে ১৯০০ সাল নাগাদ৷ ভার্জিনিয়া আর ফ্রেঞ্চ লুইসিয়ানা অঞ্চলে প্রথমে আসে ওরা৷
– ধর্ম কী ছিল রোমানিদের?
– ধর্মের ব্যাপারটা চিরকালই খুব গোলমেলে৷ জানো তো? ওই যে বললাম বর্ণহিন্দুদের অত্যাচার তো ভারতের দলিত বানজারারা চিরকালই সাফার করেছে৷ অথচ আমার বাবার মতো লোক, যে অত্যাচার এড়ানোর জন্য খালাসি হয়ে এদেশে পালিয়ে এল৷ তারপর সারাজীবন কাজ করছে ট্রাম্প ক্যাসিনোতে, সে তো নিজেকে হিন্দু বলেই খাতায় কলমে বলে৷ আমি অবশ্য কোনও ধর্মেই নেই৷ অ্যাগনস্টিক৷ আবার ইউজিনের পূর্বপুরুষরা, যারা উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষ থেকে পশ্চিমমুখো গিয়েছিল ইউরোপে, হাজার বছর আগে, আর সেখান থেকে দুশো বছর আগে পাড়ি জমিয়েছিল আমেরিকায়, তারা খ্রিস্টান হয়ে গেছে আগেই৷ আবার মুসলমানও আছে কিছু৷ তবে ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক বল, জন্মের পরে আতুঁড়ঘর বল, মৃত্যুর পরে অশৌচ বল, এসব রিচুয়ালে বিশ্বাসে কোথাও রোমানিরা ভিতরে ভিতরে হিন্দুই রয়ে গেছে৷

Ugene and Jinia
ইউজিন এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল

অবাক হয়ে শোনে জিনিয়া৷ তার বাবার জন্ম হয়েছিল খুলনায় দেশের বাড়িতে একটা আতুঁড়ঘরে৷ পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকানুনের কিছু কিছু আভাস জিনি বড় হয়ে ওঠার মধ্যেও পেয়েছে৷ অন্য দেশে অন্য সমাজেও ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাই যে গেঁড়ে বসে থাকে, মনে করা হয় বিয়ের পর মেয়েটির দায়িত্ব হল তার স্বামীর পরিবারের দেখভাল, এসব জিনিয়ার কাছে একটা রেভেলেশনের মতো৷ গল্পে গল্পে অনেক সময় কাটছে৷ ওরা সবাই মিলে একটা মধ্য-প্রাচ্যের রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে এসেছে৷ খেতে খেতে হঠাৎ যেন গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু মনে পড়ে গেছে এভাবে ইউজিন বলল,
– জানো তো, এমনকী আমাদের দেবীও এক৷
আবার অবাক হবার পালা জিনিয়ার৷

আজ টিন ফিশ কাফেতে বেশ ভিড়৷ এখন অফিশিয়ালি স্প্রিং৷ কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার একটা সুবিধা– শীত-গ্রীষ্ম কোনওটাই এখানে তীব্র আকার ধারণ করে না৷ এখন অনেকক্ষণ বিকেল থাকে৷ সামারে এই বেলাটা আরও প্রলম্বিত হবে৷ সূর্য অস্ত যাবে অনেক দেরিতে৷ লম্বা লম্বা পা ফেলে জিনিয়া গিয়ে ট্রামলাইনটা চোখে পড়ে, এমন একটা জায়গা দেখে বসে পড়ল৷

– কোন দেবী? 
– কেন? সেন্ট সারা যাঁর আরেক নাম সারা-এ-কালী তিনি তো তোমাদের দেবী কালী৷ এখন জানা গেছে আদতে ভারত থেকে আগত রোমানিরাই দেবী কালীকে এনেছিল ফ্রান্সে৷ এখন তাঁকে সেন্ট সারা নামে আমরাও পুজো করি৷
– এখন সারা পৃথিবীতে রোমানিদের জিপসি বলে সন্দেহের চোখে দেখা, একঘরে করে রাখার প্রবণতা একটু কমের দিকে৷ ইন্ডিয়ার বিদেশমন্ত্রক রোমানিদের ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ তারপর থেকে ইন্ডিয়ান ডায়াসপোরার অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে রোমানিদের৷ তারপরেই তো ভাবলাম, এই যে ডায়াসপোরা, আমিও যার অংশ, তাদের লড়াই, তাদের জীবন নিয়ে লিখি৷  
– প্রান্তিক মানুষদের এই জার্নির সঙ্গে তো আরও একটা জিনিসও আছে তোমার গল্পে৷ একজন মানুষের সমপ্রেমের গল্প? সেই জার্নিটাও তো ভীষণই কঠিন৷
– তা বলতে পারো৷
নীল একটু ভাবছে বলবে কি বলবে না৷
– আসলে তোমাকে বলছিলাম না এটা যেমন আমার গল্প, তেমনি ইউজিনেরও গল্প৷ আমি ছোট থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশান৷ ইউজিনের বুঝতে কিছুটা দেরি হয়েছিল৷ তোমরা ফেমিনিস্টরা ভারতীয় নিম্নবিত্ত মেয়েদের ডাবলি মার্জিনালাইজড বল, আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পেরেছি ইউজিন একজন পুরুষ হয়েও কীভাবে ডাবলি মার্জিনালাইজড ৷ আমার কিন্তু অন্য অনেক সম্পর্ক হয়েছে৷ মেয়েদের সঙ্গে, পুরুষদের সঙ্গে৷ কিন্তু ইউজিনের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা একদম আনকোরা, নতুন, টাটকা। ওর মা-বাবা ওকে ত্যাগ করেছে আমার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জেনে৷ এখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক না টিঁকলে, আমি তো স্বাধীন হয়ে যাব৷ ইউজিন যে কী করবে, ওই জানে৷ ইউজিন ওইজন্য ওর মিউজিক আর ক্রাফ্ট-কে বেছে নিয়েছে৷ হাঃ হাঃ হাঃ৷ ও দারুণ একজন সংগ্রাহক৷ রাজস্থানে ঘুরে ঘুরে যা ফোক মিউজিক কালেক্ট করেছে না, মাথা ঘুরে যাবে তোমার…
হুইস্কির ঘোরে নীল যা বলার নয়, তাও বলে যাচ্ছে৷ এগুলো ওদের প্রাইভেট ডোমেন৷ এত কথা না বললেও পারত নীল৷ পাশে বসে ইউজিন একটু অসহায়ভাবে হাসে। বলে,
– তোমাকে কখনও আমার মিউজিকের সংগ্রহের কিছু স্যাম্পেল শোনাতে পারলে খুশি হব৷

Woman with Laptop
রাতে বাড়ি ফিরে নীলের বলা কথাগুলোই মাথায় তোলপাড় করছে।

রাতে বাড়ি ফিরে নীলের বলা কথাগুলোই মাথায় তোলপাড় করছে জিনিয়ার৷ ভারতবর্ষে শিকড় ছিল যাযাবর মানুষগুলোর৷ বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে, বহুরকম দুর্যোগ পার হয়ে থিতু হতে পেরেছে ওরা অবশেষে৷ মিলেছে সরকারি বদান্যতা, সাহায্যের আশ্বাস, পৃথিবীর বহু দেশে৷ তবু সঞ্চরমান মানুষ ওরা৷ চলমানতা ওদের রক্তে৷ ওদের গায়ে তাই স্থবিরতার শ্যাওলা লাগে না৷ ডিনারের শেষে নীলের যখন আবেশে চোখ বুজে এসেছে, তখন ইউজিনের সঙ্গেই কথা হচ্ছিল ওর৷ বারবার ইউজিন ধন্যবাদ দিল চমৎকার একটা সন্ধ্যে আর স্বাদু খাবারের জন্য৷ জিনিয়াও পাল্টা ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিল,
– তোমার সঙ্গে আরও আগেই দেখা হওয়া উচিত ছিল আমার৷ যদিও তোমার সঙ্গে আমার ইতিহাসের আপাতভাবে কোনও মিল নেই৷ তবুও আগে দেখা হলে আমরা পারস্পরিক মত আরও বিনিময় করতে পারতাম৷ 
উত্তরে স্বল্পবাক ইউজিন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল৷ রেস্টোরেন্টের স্তিমিত আলো তেরচাভাবে পড়েছিল ওর মুখে৷ তারই আভায় খুব রহস্যময় লাগছিল ওকে৷ রহস্যময় হাসছিল ইউজিন ঠিক যাদুকরের মতোই৷
– সবসময় মনে রেখো জিনিয়া, আমাদের সকলের মধ্যেই একটা বোহেমিয়ান লুকিয়ে থাকে৷ কেউ সেই যাযাবর বোহেমিয়ান সত্ত্বাটা বের করে আনে, কেউ সেটা তুলোয় মুড়ে বুকের গোপন কোনও কুঠুরিতে রেখে দেয়৷ সারাজীবন অপেক্ষা করে করে সেই অন্য আমিটা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে, আর জাগে না, জাগতে পারে না৷ আই নেভার লেট দ্যাট হ্যাপেন টু মি৷ সারা জীবন আমি কোনও চাকরি করতে পারিনি৷ খুব একঘেয়ে লাগবে এই ভয়ে৷ ভারতবর্ষে অনেকবার ছুটে গিয়েছি লুকনো মণিমুক্তোর আশায়, হিডেন জেমস্‌, খুব বড়ো কিছু হয়তো পাইনি৷ কিন্তু যা পেয়েছি, তা আমার কাছে যথেষ্টর চেয়েও বেশি৷ এক একদিন উল্টোপাল্টা হাওয়া দেয়৷ তখন তোমার যত্ন করে তুলে রাখা অন্য ‘আমি’টাকে জাগিয়ে দিতে হয়৷ ৷ নতুন কিছু করার জন্য, কিছু সৃষ্টি করার জন্য৷ ঘরের চেনা চৌহদ্দি থেকে বার হয়ে এসে তখন নিজের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারি আমি প্রবলভাবে বেঁচে আছি৷ চেনা সীমানা পেরিয়ে তখন পায়ে পায়ে পেরিয়ে যায় অনেকটা পথ, দিগন্তের সীমার শেষে অন্য কোনও পথের সম্ভাবনা খুলে যায় পথের থেকে৷ 

কথাগুলো যেন ফিস্‌ফিস্‌ করে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলছিল ইউজিন৷ অল্প আলোয় ভেসে ছিল ওর জাদুভরা মায়াবী বিষণ্ণ চোখদুটো৷    (চলবে)

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৮ নভেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Shutterstock

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com