banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ১৩

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

নভেম্বর ১৬, ২০২২

India Bangladesh border
চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া, সীমান্তের দু’পাশে প্রচুর প্রহরা।
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২]

(২৪)

‘নাঃ! অরুণলেখা বলে তো ঠিক কাউকে চিনতে পারছি না৷ আমাদের সময় অরুণা বলে একজন ছিল৷ কিন্তু তোমার দিদিশাশুড়ি, রণদীপের দাদি, সি মাস্ট বি ইন হার এইট্টিস নাও৷’ হেনা চৌধুরী পান খান নিয়মিত৷ রসে ঠোঁট দু’খানি রাঙা হয়ে আছে৷

‘হ্যাঁ, দিদানের বিরাশি চলছে৷’

‘ওঃ! তাহলে আমার চেয়ে বহু সিনিয়র৷’ হেনা চৌধুরী এবার আশ্বস্ত হন৷ ‘তোমাদের দাদি প্রাক্তনীদের গ্রুপে আছেন? যাওয়া হয় শান্তিনিকেতনে? অবশ্য তুমি তো বললে উনি অসুস্থ৷ তাহলে নিশ্চয়ই অনেকদিন যাওয়া হয়নি?’

রোহিণী কথা বলছে নূরের আম্মার সঙ্গে৷ হিসেবমত হেনা চৌধুরীর বয়স প্রায় আটষট্টি বছর৷ যদিও দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই৷ হেনা চৌধুরী তাঁর কোনও একটা ঘরের একটা আরামদায়ক গদিওয়ালা চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসেছেন৷ ঘরের কোণায় একটা এসরাজ, একটা বড় ডিভানে একটা স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম৷ রোহিণীর দৃষ্টি সেদিকে দেখে, উনিও দৃষ্টি ঘোরান সেদিকে৷

‘ওঃ! তুমি আমার হারমোনিয়ামটা দেখছ? জানো এটার বয়স কত এখন? উনি খুব স্নেহের সঙ্গে তাকান হারমোনিয়ামটার দিকে৷ আটষট্টি সাল নাগাদ আমার আব্বা এটা অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন ডোয়ার্কিন কোম্পানি থেকে৷

harmonium
তুমি আমার হারমোনিয়ামটা দেখছ? জানো এটার বয়স কত এখন?

ডোয়ার্কিনের নাম শোনেনি রোহিণী, সেটা ওর চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন হেনা৷ একটু হেসে বলছেন ডোয়ার্কিন তোমাদের কলকাতা শহরেরই একজন মানুষ দ্বারকানাথ ঘোষের দোকান৷ চিৎপুরে ওঁদের আদি দোকান ছিল৷ ডোয়ার্কিন নামটা অবশ্য উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর দেওয়া৷ সুকুমার রায়ের বাবা৷ দ্বারকানাথ ঘোষের বৌবাজারের দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে আব্বা এটি বানান আমি শান্তিনিকেতনে গান শিখতে যাব বলে৷ এতগুলি কথা বলে হেনা চৌধুরী একটু হাঁপাতে থাকেন৷ পাশে রাখা পানের বাটা থেকে একটা সেজে রাখা পান মুখে ফেলে দেন আলতো করে৷

উপেন্দ্রকিশোর সুকুমার রায়ের বাবা খুব পেট্রনাইজিংভাবে বলাতে একটু রাগ হয় রোহিণীর৷ তবে ওঁর দোষ কি? উনি হয়তো নূরের বাংলাজ্ঞান দিয়েই মাপছেন ওকে৷ নূর বাংলা বলতে পারলেও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে ওর জ্ঞান খুব সীমিত৷ শান্তিনিকেতনের প্রসঙ্গ শুনে ও একটু নড়ে চড়ে বসে৷

— ‘আন্টি, আপনি শান্তিনিকেতনে কবে গেলেন? আর কেনই বা ঢাকা থেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে গেলেন?

— ‘ওই যে বললাম, পড়তে তো যাইনি, গেছিলাম গান শিখতে৷ আরও বিশেষভাবে বললে রবীন্দ্রনাথের গান শিখতে৷’ হেনা চৌধুরীর ছোট্ট কপালখানা৷ ভাসা ভাসা স্বপ্নিল চোখ৷ ভুরুদুটো প্লাক করে নিখুঁত করে আঁকা৷ হেনা চৌধুরী চোখে সুরমা পরে আছেন, নাকি নীল রঙের কাজল ঠিক বুঝতে পারছে না রোহিণী৷ ওঁর পরনে স্লিভলেস একটা নাইটি৷ রোহিণী আসার পর একটা স্কটিশ কিল্টের কাপড়ের লাল কালো হাউসকোট জড়িয়েছেন উনি৷ রোহিণী লক্ষ্য না করে পারল না যে ঘরের মধ্যেও উনি মুখে যথেষ্টরও বেশি মেক-আপ করে আছেন৷ হয়তো ঘরে থাকলেও এইরকম মেক-আপ করতেই অভ্যস্ত উনি৷ কিম্বা আজ রোহিণী আসবে বলে উনি একটু বেশি সাজসজ্জা করেছেন৷ হেনার চামড়া বয়সানুযায়ী অস্বাভাবিক মসৃণ৷ হেনার গালে কপালে আলো যেন চলকে যায়৷ হয়তো উনি নিয়মিত মুখের পরিচর্যা করেন৷ হরমোন ট্রিটমেন্ট করানোও বিচিত্র নয়৷ রোহিণীর মুখে চোখে বিস্ময় হয়তো একটু বেশিমাত্রায় প্রকট হয়ে গিয়েছিল৷ উনি তাই প্রথমেই বলেছেন ‘তুমি হয়তো সত্তর বছরের বুড়িকে দেখবে বলে expect করেছিলে৷ লেট মি টেল ইউ, আই লাভ মাই বডি৷ তাই নিজেকে একটু বেশি যত্ন করার চেষ্টা করি৷ একটা স্ট্রিক্ট রেজিমেন ফলো করি৷ যা ইচ্ছে হয় তাই-ই খেলাম – তা করিনা৷ তাছাড়া নিয়মিত এক্সারসাইজ, জিমে যাওয়া, পার্লার, মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটাকেও অবহেলা করি না৷’

রোহিণীর মায়ের চেয়েও অনেক বড় উনি৷ ওঁর চল্লিশ-একচল্লিশ বছরে নূরের জন্ম৷ কেনই বা উনি এত বয়সে প্রথম মা হলেন, এখন উনি জীবনটা কিভাবে কাটাতে চান, এসব অনেক কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে গজগজ করছিল৷ কিন্তু কীভাবে প্রশ্নগুলো করবে ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল রোহিণীর৷ উনি তো আত্মীয় নন, ইন ফ্যাক্ট এই প্রথম সামনাসামনি বসে এত কথা হচ্ছে ওঁর সঙ্গে৷ 

রোহিণী কথা বলছে নূরের আম্মার সঙ্গে৷ হিসেবমত হেনা চৌধুরীর বয়স প্রায় আটষট্টি বছর৷ যদিও দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই৷ হেনা চৌধুরী তাঁর কোনও একটা ঘরের একটা আরামদায়ক গদিওয়ালা চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসেছেন৷ ঘরের কোণায় একটা এসরাজ, একটা বড় ডিভানে একটা স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম৷ রোহিণীর দৃষ্টি সেদিকে দেখে, উনিও দৃষ্টি ঘোরান সেদিকে৷

‘ডোন্ট গেট এমব্যারাস্‌ড্‌, আস্ক মি ওয়াটেভার ইউ ওয়ান্টেড টু আস্ক ’ মুহূর্তে পরিস্থিতি সহজ করে দিয়েছিলেন উনি৷ ‘আর তাও যদি কোনও জিজ্ঞাস্য রয়ে যায়, আমার স্বামীর সঙ্গে ক্রস চেকও করে নিতে পার৷ নূর’স  আব্বা৷ তুমি ডিনার টেবিলে ওঁর দেখা পাবে৷ হি ইজ এক্সট্রিমলি বিজি দিজ ডেজ৷ ’

সারাদিন বসে ওঁর গল্প শুনছে রোহিণী৷ পাকিস্তানে যখন যুদ্ধ বাধার উপক্রম, তখন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব এড়াতে হেনাকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন ওঁর আব্বা৷ আবু চৌধুরীর পরিবারের লোক দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একদল থাকতেন ঢাকায় আর অন্যদল বীরভূমে৷ হাওড়ার বেশ কিছু জুটমিলে কাঁচা পাটের যোগান দিতেন তাঁরা৷ দেশভাগের কিছু পরেও আবু চৌধুরী ভেবেছিলেন – এইভাবে যাতায়াত করেও ব্যবসা রক্ষা করা সম্ভব৷ কিন্তু ক্রমে কাঁচামাল সংগ্রহ করা দুষ্কর হয়ে পড়ছিল৷ একসময় আবু চৌধুরী বুঝতে পারেন এভাবে আর চলবে না৷ অবিলম্বে ঢাকায় ফিরে না গেলে কাঁচাপাটের জমিগুলি বেহাত হবার সম্ভাবনা৷ অগত্যা আবু চৌধুরী বীরভূমের ভূসম্পত্তির মায়া ত্যাগ করেন৷ বীরভূমের কিছু পরিবারকে উনি তৈরি করেছিলেন, যারা পাটের ব্যাগ এবং পাটজাত কাপড়ের উপর নক্সা তৈরির কাজ করত৷ রকমারি নকশা করা জিনিসগুলি স্থানীয় বাজারে বেশ চাহিদা ছিল৷ আবু পঞ্চাশ একান্ন সাল থেকে ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে কাঁচাপাট সরবরাহ করতে শুরু করেন৷ উনিশশো বাহান্নতে হেনার জন্ম৷ বাহান্নতে পাসপোর্ট চালু হলে আবু চৌধুরী পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেন৷ কেননা ঢাকায় থাকা তাঁর রুজিরোজগারের জন্য জরুরি ছিল৷

‘এইসময় আমার আব্বা গেন্ডারিয়ায় একটা বাড়ি কেনেন৷ মিউচুয়াল এক্সচেঞ্জে৷ মিউচুয়াল এক্সচেঞ্জ জান তো?’

রোহিণী মাথা নাড়ে৷ সে শুনেছে৷ হিন্দু আর মুসলমানরা দেশভাগের পরে সীমান্ত বদল করার সময় নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে পাস্পরিক সম্মতিতে বাড়ি বিনিময় করতেন৷ হ্যাঁ, সেরকমই করেছিলেন হেনা চৌধুরীর আব্বা৷ আব্বার সুহৃদ অবনী জ্যাঠার বাড়িটায় এসে থিতু হয়েছিলেন ওঁরা ৷

খুব মজার কথা যেন মনে পড়েছে এইভাবে হেনা চৌধুরী বলছেন রোহিণীকে, ‘মজার ব্যাপার হল বিনিময়ের সূত্রে আব্বা একজন বাজার সরকার কাম ম্যানেজার পান – যিনি ছিলেন বাবার ডানহাত৷ কি ভাল নাম জানতাম না৷ আমি বিশুকাকা বলতাম ওঁকে৷ বিশুকাকা শুধু যে বাবার পাটের ব্যবসা, বিষয়-আশয় দেখায় সাহায্য করতেন তা নয়, আমাদের মানে বাড়ির ছোটদের অনেক মজার মজার গল্প শোনাতেন৷ পুজোর সময় আমাদের নিয়ে ঠাকুর দেখাতে যেতেন৷ বুড়িগঙ্গার ওদিকে কাকাদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো হতো৷ আব্বাই পুজোর সব ব্যবস্থা করে দিতেন৷ পূজোর সময় আমরা আমাদের পড়ার বইগুলি দেবীর পায়ের কাছে রেখে জোড়হাতে বিড়বিড় করে বলতাম, ‘সরস্বতী দেবী, একটু বিদ্যে দিও মাগো৷’ সেটাও ছিল আবার মুসলমানের পালনীয় রীতিগুলিও মানতাম৷ বাড়িতে মায়েদের দেখতাম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে৷ আবার অন্যদিক থেকে আব্বা ছিলেন খুব সৌখিন মানুষ৷ শীতের দিনে বিলিতি পোষাক, টুইডের কোট, হ্যাট, আবার গরমের কালে ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি৷ ছটা গ্রে হাউন্ড কুকুর ছিল আব্বার৷ ভিতরে ভিতরে খুব রবীন্দ্রভক্ত৷ ওইজন্য তো মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে নিশ্চিন্তে গান শিখতে পারি৷’

পাশে রাখা চায়ের মাগে লম্বা একটা চুমুক দেন হেনা চৌধুরী৷

রোহিণীও পাশে রাখা চা নেয়৷ সুদৃশ্য পাতার আকারে পাত্রতে বিভিন্ন রকম বাদাম রাখা৷ ও নিচ্ছে না দেখে হেনা বললেন ‘তুমি একটু নাট্‌স্‌ নাও৷ দুপুরে তো খেলে না কিছুই, রাতে তোমার জন্য বিরিয়ানি করতে বলেছি৷ ভাল করে খাওয়া চাই৷’

Santiniketan
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে নিশ্চিন্তে গান শিখতে পারি৷’

একমুঠো কাজু আর পেস্তা তুলে নিয়েছে রোহিণী৷ রেকর্ডারটা কাজ করছে কিনা দেখে নিল একবার৷ তারপর আবার ফিরছে প্রশ্নে, ‘আন্টি আপনি শান্তিনিকেতনে গানের ডিগ্রি করেছিলেন?’

‘হ্যাঁগো! সেই সেকালের সঙ্গীতভবনে৷ কাদের সব পেয়েছি জানো শিক্ষক হিসেবে? বাচ্চুদি মানে নীলিমা সেন, মোহরদি তো শেখাতেনই৷ কি অপূর্ব চেহারা ছিল মোহরদির৷ উনি ক্লাসে ঢুকতেন, সারা ক্লাস যেন আলো হয়ে যেত৷ সেই বিশুকাকার বাড়িতে দেখা সরস্বতীর প্রতিমার মত৷ শান্তিদা ছিলেন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ৷ খুব একটা বেশি ক্লাস নিতে পারতেন না, খুব ভয়ও পেতাম ওঁকে৷ আমাদের যতো আব্দার ছিল মোহরদি আর বাচ্চুদির সঙ্গে৷ বাচ্চুদির মেয়ে চুয়া তখন কতো ছোট৷ বড় অকালে চলে গেল চুয়া৷’ একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে হেনা আন্টির৷ রোহিণী লক্ষ্য না করে পারে না, শান্তিনিকেতনের কথা বললেই কিরকম শ্যামল একটা ছায়া খেলা করে যাচ্ছে ওঁর মুখে৷ মুখের মেক-আপ-এর জন্য যে দূরায়ত ভাবটা ঘিরে ছিল, তার জায়গা নিচ্ছে এক অন্য নারী যাকে ছোঁয়া যাচ্ছে৷

 ‘আন্টি! আপনি খুব ঘনঘন যান দেশে ?’

কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখায় হেনা চৌধুরীকে৷

‘দেশে! হ্যাঁ, আমি প্রত্যেক বছর না হলেও এক বছর অন্তর অন্তর অবশ্য যেতে চেষ্টা করি ঢাকা আর শান্তিনিকেতনে৷ না গেলে প্রাণটা হাঁপিয়ে ওঠে৷’

‘পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় আন্টি যখন যান?’

হেনা চৌধুরীর মুখখানা ঝলমল করে ওঠে, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ৷ ঢাকা যাই, এখনও বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজন আছেন বলে৷ আব্বা আম্মা না থাকলেও ভাই-বোনেরা আছে৷ তাদের মুখগুলো দেখলে খুশি লাগে৷ আর সবচেয়ে খুশি লাগে শান্তিনিকেতনে গেলে৷ বিশ্বের  চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা ওই দুটো সময়ে জড়ো হয় শান্তিনিকেতনে – বসন্তোৎসব আর পৌষমেলা৷ আমি দুটোতেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যাবার চেষ্টা করি৷ প্রাক্তণীদের স্টলে পুরনো কতজনের সঙ্গে যে দেখা হয়!

*****

রাতে খাবার টেবিলে রোহিণীর সঙ্গে দেখা হল ডক্টর রহমানের৷ ডক্টর রহমানকে দেখে একটু বিস্মিত হল রোহিণী৷ নূরের বাবার যে এত বয়স হয়েছে ও সেটা একেবারেই আন্দাজ করেনি৷ ডক্টর রহমানের মাথার চুলগুলো সব সাদা৷ তবে হেনা আন্টির মতো উনি বয়স ঢাকার কোনও চেষ্টা করেন না৷ ওঁর কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে ধোপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরে খাবার জন্য এলেন উনি৷ মুখে প্রসন্ন একটা হাসি ফুটেছে রোহিণীর পরিচয় পেয়ে৷

 ‘হ্যাঁ, তোমার কথা তো শুনেছি, নূরের কাছ থেকে৷ হেনা বলছিল, তোমার নাকি রিসার্চের প্রয়োজনে আসতে হতে পারে৷ আই ওয়াজ এক্সপেকটিং ইউ৷ আমার মেয়ের তো আজকাল আসার সময়ই হয় না৷ শি হ্যাজ নো টাইম ফর ওল্ড পিপল লাইক আস৷’ যদিও হাসি হাসি মুখেই বলছেন উনি, তবু যেন একটু বেদনা রয়েছে কোথাও৷

টেবিলের ওধার থেকে হেনা আন্টি ছদ্মকোপে ঝঙ্কার দিচ্ছেন, ‘ওঃ হো! মেয়েটা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এল, আর তুমি এখন তোমার যাবতীয় অভিমানের ঝুলি খুলে বসেছ? রোহিণী, তুমি কিছু মনে কোর না, মেয়ে অন্ত প্রাণ ডক্টর রহমানের৷ মেয়েরও বাপের কাছেই যত আব্দার৷ কিন্তু কয়েকদিন অদর্শনেই খুব কাতর হয়ে পড়েন উনি৷’

বিরিয়ানির সুগন্ধে ভুরভুর করছে খাবার জায়গা৷ আসার পরই রোহিণী লক্ষ্য করেছে এ বাড়িতে দুটি অল্পবয়সি মেয়ে আছে যাদের নাম নীলুফার আর শিউলি৷ ঘরের প্রতিটি কাজে, অতিথিকে চা পরিবেশন করা থেকে বিরিয়ানি রান্না অবধি সব ব্যাপারেই হেনা ওদের উপর নির্ভরশীল৷ সবসময় হাসিমুখ মেয়ে দুটির৷ খুব পরিচ্ছন্ন সালোয়ার-কামিজ পরে পরিবেশন করছে দুজনেই৷

হেনার বকুনিতে মিটিমিটি হাসছেন ডক্টর রহমান৷ দু’হাত তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গীতে বলছেন, ‘ আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম সরি৷ এখন থেকে আর বর্তমানের কথা নয়৷ শুধু অতীতচারণা৷ বল মাগো! কি জানতে চাও?’ শেষ বাক্যটা রোহিণীকে উদ্দেশ্য করে৷

‘শোন, ওর একটা মেথড আছে৷ ইউ এক্সপ্লেন রোহিণী৷ এইভাবে খেতে খেতে ক্যাজুয়ালি গল্প শুনতে চাও তুমি নাকি খাওয়ার পরে রেকর্ডার বের করে, আবার মাঝে মাঝে নোটও নাও তুমি – তাই না?’

ওকে আর বলতে হচ্ছে না, হেনা আন্টিই বলে দিচ্ছেন ওর হয়ে৷ বেজায় ভালো বিরিয়ানিটা৷ চাল, মাংস, সরেস ঘি-এর কম্বিনেশনে জমে গেছে ব্যাপারটা৷ খেতে খেতে টুকটাক কথা হতে লাগল৷ হেনা আন্টি সবিস্তারে বোঝালেন বিরিয়ানিতে কেমন করে স্বাদ তুলতে হয়৷ রোহিণীর শাশুড়ি কিংবা দিল্লিতে ওর মা, কেউই এসব রাঁধতে জানে না৷ তাই রোহিণীই এবার বিরিয়ানি রেঁধে সবাইকে অবাক করে দেবে৷

রাতে খাবার টেবিলে রোহিণীর সঙ্গে দেখা হল ডক্টর রহমানের৷ ডক্টর রহমানকে দেখে একটু বিস্মিত হল রোহিণী৷ নূরের বাবার যে এত বয়স হয়েছে ও সেটা একেবারেই আন্দাজ করেনি৷ ডক্টর রহমানের মাথার চুলগুলো সব সাদা৷ তবে হেনা আন্টির মতো উনি বয়স ঢাকার কোনও চেষ্টা করেন না৷ ওঁর কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে ধোপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরে খাবার জন্য এলেন উনি৷ মুখে প্রসন্ন একটা হাসি ফুটেছে রোহিণীর পরিচয় পেয়ে৷

খাবার পর ওরা আবার আরাম করে বসল৷ এটা সেই বাদ্যযন্ত্র ভর্তি ঘরটাও নয়, পুবের ঘর, রোদ আসে বলে হেনা চৌধুরী যেটাকে ‘সানরুম’ বলে উল্লেখ করেছিলেন৷ এটা ওদের প্রশস্ত লিভিংরুমও নয়৷ এটা দোতলায় শোবার ঘরের লাগোয়া একটা অপেক্ষাকৃত ছোট লবি – যার চারপাশে ছড়ানো গোটা তিনেক বেডরুম৷ নূরের বন্ধু বলে নূরের জন্য নির্দিষ্ট বেডরুমটিতেই রোহিণীর শোবার ব্যবস্থা হয়েছে যদিও আরেকটা আরও বড় গেস্টরুম আছে৷ রোহিণীর বেশ ভালো লেগেছে বাড়িটা৷ এটা মাম্মাদের লেক্সিংটনের বাড়ির মতো লেক ফেসিং – চার বেডরুমওয়ালা বিশাল বাড়ি নয়, তিনটে গ্যারাজও নেই৷ এ বাড়ির গ্যারাজ দুটো৷ কিন্তু গোটা বাড়িটা দুবাংলার বিভিন্ন জেলার মনোরম শিল্প সামগ্রী, হাতের কাজ দিয়ে সাজানো৷ খাগড়ার কাঁসা-পিতলের হরেক বাসন, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল, বিষ্ণুপুরের পোড়া মাটির ঘোড়া, ফ্রেম করা বালুচরিতে রাম-সীতার গল্প, মেদিনীপুরের মাদুর, যেদিকে তাকানো যায় সূক্ষ্ম এবং সুন্দর হস্তশিল্পের ছড়াছড়ি৷ খাওয়ার পর যেখানে বসা হয়েছে সেখানে নিচু নিচু ডিভান তিন-চারটে৷ তাতে শ্রীনিকেতনের চাদর পাতা আর নরম আরামের কোলবালিশ৷ একটি তাকিয়ায় আধশোয়া হয়ে হেনা আন্টি৷ পাশে দুটো বেতের গদিওয়ালা রকিং চেয়ারের একটায় রোহিণী অন্যটায় ডক্টর রহমান৷ 

রোহিণী কতগুলো বিশেষ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিল৷ খেই ধরানোর মতো এই প্রশ্নগুলো ও যাদের ইন্টাভিউ নিচ্ছে তাদের সকলকেই করে৷ উত্তরে গল্পটা বইতে থাকে তরতর করে, জলস্রোতের মতো৷ কতগুলো স্ট্যাণ্ডার্ড প্রশ্ন আছে, ‘আপনার জন্ম কোন সাল বা কোন সময় নাগাদ? দেশভাগ আপনাকে বা আপনার পরিবারকে কীভাবে অ্যাফেক্ট করেছে? আপনি কি স্বাধীনতার আগেই দেশ ছেড়েছেন না পরে? ঠিক কোন পরিস্থিতিতে জায়গা বদলের কথা ভাবলেন? পরবর্তী জীবনটা কেমন হল? আজ এখানে বর্তমান অবস্থানে দাঁড়িয়ে কোনও খেদ হয়? কোনও স্বপ্নপূরণ করতে ইচ্ছে হয়?’ প্রশ্নগুলোর প্রিন্ট আউট অনেক ক্ষেত্রে দিয়ে দেয় ও৷ সেরকমই একটা ছাপানো প্রশ্নাবলী ডক্টর রহমানের সামনে রাখতে রাখতেই ওর হঠাৎ মনে হলো আজ রণো একবারও ফোন করল না৷ ক্যালিফোর্নিয়া যাবার পর, এই ক’মাসে রণোর ফোন বেশ কমে এসেছে৷ আগে দিনে অন্ততঃ দু’বার ফোনে কথা হতই৷ এখন দিনে একবার একটু দায়সারা ভাবে কথা শেষ হয়৷ কী করছিস? কী খাবি আজ? কাজে বেরিয়ে গেছিস? এরকম নিয়মরক্ষার জন্য কিছু কথা৷ কিছুদিন আগেও রণোর ফোন না এলে – ওর একটু অস্থির লাগত৷ এখন রণোর সবে সন্ধ্যে হয়েছে৷ ওরা তিন ঘন্টা পিছিয়ে৷ হয়তো ও কাজের মধ্যে ডুবে আছে, তাই ফোন করছে না৷ কিন্তু সবিস্ময়ে রোহিণী রিয়েলাইজ করছে রণোকে ও আর বিশেষ মিস করছে না৷ বরং এই মুহূর্তে রোহিণী ভাবছিল এখন রণোর ফোন না এলেই ভাল হয়৷ অকারণ তাহলে ইন্টারভিউটায় ছেদ পড়বে৷ এই চিন্তা কি বিয়ের দু’বছরও না পেরনো স্ত্রীর পক্ষে আদৌ স্বাভাবিক? ও ঠিক বুঝতে পারল না৷

প্রশ্নাবলীর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছেন ডক্টর রহমান৷ চশমার পুরু লেন্সের মধ্যে দিয়ে তাঁর চোখে একটু প্রশ্রয়ের হাসি৷ উনি বলছেন, ‘হ্যাঁ! তোমার প্রশ্নগুলোর সারমর্ম হচ্ছে ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে গোটা জীবনটার উপর সার্চলাইট ফেলা৷ তুমি তো আবার কাল চলে যাবে৷ তা আমি যদি আজ সারারাত ধরেও গল্প বলি, তাতেও কি একটা জীবন সম্পূর্ণ ধরতে পারবে তুমি?’

বাড়িতে ফিরে এসে দু’দিন বাদে আবার রেকর্ডারটা চালু করল রোহিণী৷ নোট্‌সের সঙ্গে মিশিয়ে ট্রান্সস্ক্রিপ্ট বানাতে হবে৷ মোটামুটি একটানাই গল্প বলে গেছেন ডক্টর রহমান৷ রোহিণী প্রায় নিঃশব্দেই শুনে গেছে দু-একটা ছোটখাটো জিজ্ঞাসা বাদে৷ রোহিণী ডক্টর রহমানের বক্তব্যটা আবার খুব মন দিয়ে শুনছিল৷

‘বামপন্থায় বিশ্বাসী পরিবার আমাদের৷ এইটা গোড়াতেই বলছি, কারণ একটা পরিবার, একটি ব্যক্তির চলন বা ট্র্যাজেকটরি তুমি কিছুতেই পুরো বুঝতে পারবে না, যতক্ষণ না তার ধ্যানধারণা, রাজনৈতিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ এসবের সঙ্গে তুমি পরিচিত হবে৷ শুধু তাই না, আমি খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করি তুমি শুধু দেশভাগের ট্রমা, পার্টিশান পরবর্তী জীবন, এসব দিয়ে তুমি কাজ করতে পারবে না, যদি না ব্যাকড্রপে বড় রাজনৈতিক গল্পটা মাথায় থাকে৷ পার্টিশনের ওরাল হিস্ট্রি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের খতিয়ান নিতে হলে এই উপমহাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, রাজনীতি অর্থাৎ বিগ পিকচারের ট্রেনিংটাও জরুরি৷ যাক্‌, নিজে গল্পে ফিরি৷ যা তুমি শুনতে চেয়েছ৷

বিয়াল্লিশের এক ভয়ানক সাইক্লোনের রাতে আমার জন্ম৷ এইটি বলার একটি বিশেষ কারণ হল তোমাদের প্রজন্মের অনেকেই বিশেষতঃ তোমরা যারা পশ্চিমি দেশে থাক তারা জানই না আমাদের দেশগুলোতে সাধারণ মানুষদের কিভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে হয়৷ পৃথিবীর কোথাও হয়ত এখনও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয় না৷ কিন্তু পশ্চিমি দেশগুলোতে এখন কখন টর্নেডো আসছে, কোথায় বরফের প্রেডিকশন, কবে বৃষ্টি, কবে কিরকম টেম্পারেচার থাকবে, সব মোটের উপর নির্ভুলভাবে বলে দেওয়া সম্ভব৷ আমি তো দেখি নূরের বাড়িতে নূর বাড়ি থেকে বেরোবার আগে হেঁকে একটা গোলাকার চাকতিকে জিজ্ঞেস করে, ‘হে গুগল! ওয়াট ইজ দ্য ওয়েদার টুডে?’ যন্ত্রমানবী মেকানিক্যাল গলায় উত্তর দেয়, ইট’জ নাইস অ্যান্ড সানি৷ দ্য টেম্পারেচার ইজ …’৷

সেই ভরসায় নূর ঠিক করে ও রেনকোট নেবে, নাকি একটা সোয়েটার৷ আমাদের দেশে তো এখনও এই লেভেলে নির্ভরশীলতা আসেনি৷ আর তখন তো বুঝতেই পারছ, প্রায় আশি বছর আগের কথা বলছি৷ মানুষ পুরোপুরি প্রকৃতির দয়ায় বাস করত৷

stormy night
বিয়াল্লিশের এক ভয়ানক সাইক্লোনের রাতে আমার জন্ম৷

বিয়াল্লিশের সাইক্লোন শুনেছি ভয়াবহ ছিল৷ বঙ্গোপসাগরে সাংঘাতিক জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল৷ তীরবর্তী এলাকাগুলো খুব বেশিরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ প্রায় এগার হাজার লোক মারা গেছিল অবিভক্ত বাংলায়৷ তা সেই ঝড়ের রাতে আমি পৃথিবীতে এলাম৷ আমার মা প্রসবের জন্য তাঁর বাপের বাড়িতে ছিলেন৷ আমার নানি বাড়ি৷ ষোলোই অক্টোবর রাতে আমি জন্মাবার পর প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা থেমে গেল ভোররাতে৷ নানা মন্তব্য করেছিলেন ‘ব্যাটা জন্মাবার সময় বেছেছে কেমন৷ ঝড়ের সঙ্গে আগমন৷ আমি ওকে ঝোড়ো বলেই ডাকবো৷ তা পরে যতই আমেদ নাম হোক না কেন৷ আজ পর্যন্ত আমাকে সবাই ঝোড়ো রহমান বলেই চেনে৷ হাঃ হাঃ হাঃ৷’ যেন খুব মজার কথা বলছেন – ঠিক সেইভাবে কথাটি বলে একটু দম নিচ্ছিলেন ডক্টর রহমান৷ রোহিণী সেই সুযোগে জিজ্ঞেস করেছিল — ‘আপনার নানির বাড়ি কোথায় ছিল? আর আপনার মা-বাবা এমনিতে থাকতেন কোথায়?’

‘আমার মা’র বাপের বাড়ি রাণী চন্দ যেমন লিখেছিলেন৷ আমার নানার বাড়ি ছিল বাসন্ডা নামে একটা গ্রামে৷ দশ বিঘে জমির উপর বাড়ি৷ দহলিজ, মসজিদ, শান বাঁধানো পুকুর সবকিছু দেখবার মত৷ বিশাল আমবাগান ছিল৷ হিমসাগর, ল্যাংড়া, সিঁদুরকৌটো, কাঁচামিঠে, জোড়হাঁসা, চিনে, বোম্বাই কতরকম আম যে ফলতো! ওদিকে ধান-পাটের জমি, সব্জি ক্ষেত৷ বাড়ির পিছনে মেয়েদের জন্য আলাদা শান বাঁধানো ঘাটের পুকুর৷ পুকুর ঘিরে নারকেল গাছ, জাম গাছ আরও কত ফলের গাছ ছিল ৷ ওই পুকুরেই তো ছেলেবেলায় সাঁতার শেখাতেন নানি৷ নানির পায়ে পায়ে ঘুরতাম, যখনই ওখানে যেতাম৷ আর মজার ব্যাপার হল – কেউ নাতির জন্ম কবে জিজ্ঞেস করলেই নানি বলতেন – সেই যে যেবার আশ্বিনের শ্যাষে বিশাল ঝড় হইল, আমাগো সাত-সাতটা আমগাছ এক রাতের ভিতর পইড়্যা গেল, সেই রাতের বেলায়ই ওর জন্ম৷’ আগেকার মানুষ তো, সাল-তারিখ অত মনে রাখতে পারতেন না৷ আর আমার জন্মের সুখটুকুর সঙ্গে সাত-সাতটা আমগাছের ভূ-পতিত হবার শোক৷ সেই শোকও নানি আজীবন বহন করলেন৷’

আবার একটু চুপ আর অন্যমনস্ক হয়ে যান ঝোড়ো রহমান৷ ঠিক এই সময় ধড়ফড় করে হঠাৎ উঠে পড়েন হেনা৷ ‘কটা বাজল? ওহ্‌! ইট্‌স্‌ মিডনাইট ৷ রোহিণী, আমি শুতে যাচ্ছি৷ আর ইউ কমফর্টেবল হিয়ার? শীত করছে না তো? নাকি লাইব্রেরিতে গিয়ে কথা বলবে?’

‘আমি একদম ঠিক আছি আন্টি৷’ রোহিণী হেসে বলে৷ তবে জানি না আঙ্কলের কষ্ট হচ্ছে কিনা৷’

‘না না, উনি নিশাচর জীব৷ অনিদ্রা রোগে ভোগেন৷ ওঁর অর্ধেক রাত কেটে যায় বই মুখে নিয়ে৷’

হেনা আন্টি চলে যাবার পর আবার রেকর্ডারটা অন করেছে রোহিণী৷ ডক্টর রহমান কিঞ্চিৎ অন্যমনস্কভাবে কী যেন ভাবছেন ৷ লবির ঢিমে আলোয় সাদা চুল বৃদ্ধকে অদ্ভুত দূরায়ত মনে হচ্ছে. বেশ খানিকক্ষণ বাদে ডক্টর রহমানের সম্বিৎ ফিরল৷ উনি প্রায় স্বগোতক্তির মতো ভাবে কথা বলছেন এবার, ‘আমার কষ্ট হবে কিনা জিজ্ঞেস করছিলে না? আমার আর আজকাল কষ্ট হয় না৷ রাত জাগতে৷ বরং ভাবি সময় তো ফুরিয়ে এল৷ যত বেশি ঘুম হবে, তত সময় নষ্ট৷ জীবনে কতগুলি বই পড়া হয়নি, কতো ভাল গান শোনা বাকি রয়ে গেছে৷ গানের প্রসঙ্গে মনে পড়ল তোমাদের জেনারেশনে শচীনকর্তার গান শোন না তোমরা৷ শচীনকর্তার গান শুনে শুনে বড় হয়েছিলাম আমরা৷ আরও অনেক ঘটনা প্রবাহ তোমার ইতিহাসের বইতে পড়েছ যেসব, সেসব আমরা ঘটতে দেখেছি৷ জীবনের বেশিরভাগটা কর্মসূত্রে বাইরে বাইরেই কাটিয়েছি৷ খুব যে আনকমফর্টেবল ছিলাম এখানে তাও না৷ প্রতি বছরেই তো প্রায় ঢাকা যেতাম৷ এখনও যাওয়া হয়৷ গিয়ে ঘুরে বেড়াই এদিক ওদিক৷ কিন্তু মন লাগে না৷ আমার যৌবনের দেশ পাল্টে গিয়েছে অনেক৷ সব দেশের মতো মৌলবাদীরা আমাদের দেশগুলিতেও মাথা চাড়া দিয়েছে৷ নয়তো যেসব হিংসার ঘটনা ঘটে, তা ঘটত না৷ শহরের চরিত্রও বদলে গেছে৷ আমার প্রথম জীবনের জায়গাগুলো চোখের সামনে পাল্টে গেল একটু একটু করে৷ মানুষগুলোও৷ এখন যখনই ঢাকায় যাই, ভাইপো, ভাইঝি, তাদের ছেলে-মেয়েরা আমেরিকার কথা জানতে চায়৷ পুরনো কথা শুনতে আর কেউ আগ্রহী নয়৷ এদেশে যেসব সেকেন্ড বা থার্ড জেনারেশন বাঙালি ছেলে-মেয়ে, দে গিভ অ্যা ড্যাম অ্যাবাউট হিস্ট্রি অ্যান্ড মেমোরিজ৷ আমার কন্যাই জানতে চায় না কখনও৷ তাকে ইনসিস্ট করা হয়েছে বলে সে আমাদের সঙ্গে প্রতি বছর বাংলাদেশ যেত, বাংলা ভাষাটাও মোটামুটি জানে৷ কিন্তু পুরনো দিনের কথা সে নিজে কখনও জানতে চায় না৷ তাই মা, অনেকদিন পরে আমার যে কি অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে, আজ এতকাল পরে কেউ আমার জীবনের কথা জিজ্ঞেস করল৷ কফি চলবে তোমার?

শেষ কথাটা এত প্রক্ষিপ্ত যে রোহিণীর মুখ থেকে বেরিয়ে গেছিল, ‘আমাকে বলছেন?’ 

‘আরে বোকা মেয়ে৷ তোমাকেই তো বলছি৷ এখানে আর কে আছে? আমি একটু কফি করব৷ তুমি খাবে?’

রোহিণী মাঝরাতে তো দূরস্থান, সন্ধ্যের পর থেকেই কফি খায় না পারতপক্ষে৷ ওর ঘুমের সমস্যা হয়৷ কিন্তু আজ তো পুরোটাই ব্যতিক্রম৷ একজন আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ মানুষ মাঝরাতে বসে উজাড় করে দিচ্ছেন তাঁর সব না বলা কথা, যা চল্লিশ বছর ধরে জিজ্ঞেস করেনি কেউ৷ আর শ্রোতার ভূমিকায় রোহিণী৷ এই মহার্ঘ্য ব্যক্তিগত ইতিহাসের গল্প হয়তো সুরক্ষিত থাকছে একটি রেকর্ডারে, কিন্তু ওই বৃদ্ধ তো রেকর্ডারকে গল্প শোনাচ্ছেন না৷ একজন নিরপেক্ষ অনাত্মীয় বাইরের লোক হিসেবে রোহিণীর শ্রোতার ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবন করে সজাগ হয়ে ওঠে ও৷ বলে, ‘চলুন, আমি কফি করায় সাহায্য করি৷’

‘পাশের একটা টানা এল-আকৃতির ঘরকে লাইব্রেরির চেহারা দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে একপাশে গোল টেবিলে কফির সরঞ্জাম৷ ‘এখানে আমি পারকোলেটরে কফিটা বানাই৷ কলম্বিয়ান একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের কফি আমার পছন্দ৷ সেটা যথেষ্ট পরিমাণে স্টক করা থাকে যাতে যোগানে কোনও অসুবিধা না হয়৷ তোমারটা কি স্ট্রং না মিডিয়াম?

কফি নিয়ে এবার ওরা আবার কথায় ফেরত আসে৷ ঝোড়ো রহমান বলতে থাকেন৷

‘আমার বাবার দিকে ফ্যামিলিটা রাজনৈতিক ফ্যামিলি ছিল৷ অর্থাৎ খুব পলিটিকালি অ্যাওয়্যার৷ পরিবারের অনেকেই রাজনীতি করতেন৷ পরিবারে ইন জেনারেল একটা লিবারেল অ্যাটমোস্ফিয়ার ছিল৷ আদর্শের দিক থেকে একটু বামঘেঁষা৷’

‘মুজিবর রহমান কি আপনাদের আত্মীয়?’ প্রশ্নটা করে ফেলে খুব বোকা বোকা লাগে রোহিণীর৷

ডক্টর রহমান হেসে বলেন ‘অনেকেই করে এই প্রশ্নটা৷ না মা! আমরা রক্তের সম্পর্কে আত্মীয় নই, তবে বঙ্গবন্ধু আর আমার বাবা কলকাতায় একই কলেজের ছাত্র ছিলেন৷ আব্বা একটু সিনিয়র ছিলেন৷ ওঁরা তখন সব একসঙ্গে ছাত্র-রাজনীতি করতেন৷ লীগের সমর্থক ছিলেন৷’

উনি মুসলিম লীগের কথা বলছেন রোহিণী বুঝতে পারে৷

‘পরে বঙ্গবন্ধুর মতো আমার আব্বাও আওয়ামি লীগের সঙ্গে প্রথম থেকেই ছিলেন৷ মৌলানা ভাসানি তখন প্রথম সারির নেতা৷ সে তো অনেক পরের কথা৷ আমার বাবা বর্ধমানের ছেলে৷ বর্ধমান টাউন- স্কুলে পড়েছিলেন৷ তারপর কলকাতায় গিয়ে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ৷’

‘ওখানে আমার শ্বশুরের ঠাকুর্দা পড়াতেন৷ সেটা অবশ্য পার্টিশনের পরে অপশন দিয়ে ওঁরা তারপরে কলকাতায় চলে গেলেন, ইন দ্য ফিফটিস্‌৷’

‘ফিফটিস্‌? তখন তো তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমরা চলে গেছি পাকিস্তানে৷ তবে আমার আর্লি চাইল্ডহুড বর্ধমানে খুব আনন্দে কেটেছিল৷ গোলাপবাগে চাচারা ডাবলক্যারি করে নিয়ে যেত সাইকেলে, কার্জন গেট অবধি যেতাম গির্জার পাশের রাস্তা ধরে৷ স্বাধীনতার পর গেটটার নাম হলো বিজয় তোরণ, বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব যিনি গেটটি তৈরি করেন তাঁর নাম অনুযায়ী৷ বর্ধমান শহরে ইউনিভার্সিটিতে কত যে দান-ধ্যান করেছিলেন ওঁরা৷ রবীন্দ্রনাথ ‘বিসর্জন’ উৎসর্গ করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদকে৷ একটা মাঠ ছিল – যেখানে যুদ্ধের সময় প্লেন পড়েছিল – চাচারা বলতেন৷ তারপর তো চলে গেলাম ঢাকা- বাক্স-পেঁটরা বেঁধে৷ আট বছরের শিশু তখন আমি৷ তার আগে শীতের সময় কলকাতা যেতাম আমরা৷ ওখানে আমার ফুফুর বাড়ি ছিল পার্ক সার্কাসে৷ ফুফু মানে আমার পিসির মেয়েরা লেডি ব্র্যাবোর্নে পড়ত৷ বাবাদের সকলের বড় ছিলেন ফুফু৷ আপাদের দেখে মনে হতো ওরা যেন অন্য জগতের বাসিন্দা৷ অথচ এখন ভাবলে মনে হয় ওরা তো পর্দা ভাঙেনি৷ বোরখা পরে কলেজে ঢুকত৷ মেয়েদের কলেজ৷ সেখানে বোরখাখানা ছেড়ে রাখত৷ তারপর ক্লাস হয়ে গেলে আবার বোরখা চাপিয়ে হাঁটাপথে বাড়ি ফিরত৷ কলকাতা গেলেই নিয়ম করে যাওয়া হত আলিপুর চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যাদুঘর৷ লোকে যাদুঘরের নাম দিয়েছিল ‘মরা সোসাইটি’ আর চিড়িয়াখানা ছিল ‘জ্যান্ত সোসাইটি’৷ সন্ধ্যেবেলা আউট্রাম ঘাটে গঙ্গার বুকে থেকে থাকা জাহাজগুলোয় ঝলমলে আলো জ্বলত৷ রেড রোড ধরে যেতে যেতে দেখতাম পাশে বিশাল ঘোড়দৌড়ের মাঠ৷ চৌরঙ্গীর মেট্রো সিনেমায় কিংকং দেখে ট্যাক্সি চেপে ফুফুর বাড়ি ফিরছি৷ ভাবতাম এমন শহর আর কোথাও নেই৷ বড়ো হয়ে এই শহরেই থাকবো আমি৷ ফুফুর বাড়ির মতো একটা বাড়িতে৷ তা দেখ, মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক৷ নসিবে লেখা ছিল না তাই কলকাতায় থাকা হল না৷ তার বদলে চল্লিশ বছর ধরে পশ্চিমি শহরেই রয়েছি আমি৷’

Burdwan bijoy toron
স্বাধীনতার পর গেটটার নাম হলো বিজয় তোরণ…

কফিতে শেষ চুমুক দিচ্ছেন ডক্টর রহমান৷

‘আপনার নানির বাড়ি তো পূর্ববঙ্গে৷ আপনার মা বিয়ের পর বর্ধমানে এসেছিলেন?’ রোহিণী জানতে চায়৷

ঝোড়ো রহমান একটু ভেবে বলেন, ‘আমার মায়ের ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল৷ নানা নিজে সলভেন্ট ব্যক্তি ছিলেন৷ কিন্তু আমার মা’কে বিত্তবান ছেলের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে – বিয়ে দিলেন মেধাবী এবং শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে৷ বাবার উদ্যোগে মা-ই প্রথম পর্দাপ্রথা ভাঙলেন আমাদের পরিবারে৷ মণিকুন্তলা সেনের মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য হলেন আম্মা৷ তারপর প্রথম তিনিই বিনা পর্দায় বের হলেন৷ ওই সমিতির সদস্য ছিলেন বর্ধমান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙারের স্ত্রী বিভা, বিনয় চৌধুরীর স্ত্রী শেফালি এঁরা সব৷ কমিউনিস্ট পার্টি কিশোর বাহিনী বলে একটা সংগঠন চালাত৷ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য সভাপতি ছিলেন৷ পাড়ার ছেলেরা সেই কিশোর বাহিনীর ক্লাবঘরে জমায়েত হয়ে নানা বিষয়ে পড়াশোনা করত৷ মাঝে মাঝে মাঠে ড্রিলও করত৷ তাদের দেখেও আমার মনে হত কবে যে বড় হয়ে কিশোর বাহিনীর সদস্য হব! তার বদলে একদিন শিয়ালদা স্টেশনে এবং ইন্টার ক্লাস কামরায় চেপে আমরা ঢাকার দিকে রওনা দিলাম৷ শিয়ালদা থেকে গোয়ালন্দ – সোজা ট্রেন যেত৷ গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে করে যেতে হত নারায়ণগঞ্জ৷’

‘কেমন লেগেছিল যেতে? মনে আছে? বুঝতে পেরেছিলেন স্থায়ীভাবে চলে যাচ্ছেন অন্য জায়গায়?’

‘নাঃ! আমি ওসব কিছুই বুঝিনি৷ হয়ত বোঝাতে চাননি আব্বারা৷ শুধু মনে হয়েছিল এ যেন সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে৷ জ্ঞান বয়েসে সেই প্রথম স্টীমারে চড়া৷ পদ্মার মতো এতো বড়ো নদীও দেখিনি তার আগে৷ দামোদরও বড়ো নদ ছিল, কিন্তু পদ্মা যেন বিশাল৷ ওই স্টীমারে চড়াটা আমার কাছে এমন ইউনিক একটা অভিজ্ঞতা যে মনে রয়ে গেছে সেটা৷ তখন খাওয়া দাওয়া খুব ভালো ছিল৷ গোয়ালন্দ চিকেন কারি তো ফেমাস ছিল৷ এখন শুনি কলকাতার বিভিন্ন অথেনটিক বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্টে ওটা একটা ডেলিকেসি৷ আর ইলিশ মাছও থাকত৷ সব মিলিয়ে একটা রূপকথার মত ছিল জার্নিটা৷ কখন যে জলপথে সীমানা পেরিয়ে চলে গেলাম এক দেশ থেকে অন্যদেশে – খেয়ালও করিনি৷ তখন দেশভাগ হয়ে গেছে৷ পুলিশ চৌকি, চেকপোস্ট সবই নিশ্চয়ই পেরোতে হয়েছিল বড়দের৷ কাগজপত্র দাখিল করতে হয়েছিল৷ কিন্তু আমার শিশুমনে তার কোনও স্মৃতি নেই৷ 

আবার একটু চুপ করে কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন ডক্টর রহমান, ‘আসলে জানো মা, বাস্তব পরিস্থিতি তখন সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ পঞ্চাশের গোড়া থেকেই দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় দফায়৷ ঢাকায় দাঙ্গা চলছে৷ বর্ধমান যেখানে সম্পূর্ণ শান্তি বজায় ছিল, সে অবধি সেখানেও আমরা বাড়ি ছাড়ার পরই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়ি৷ আমার আব্বা, আম্মার কাছে এখনও আমার খুব কৃতজ্ঞ লাগে যখন বুঝি এই আগুনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেও কিভাবে তাঁরা আমাদের সাধ্যমতো রক্ষা করেছিলেন আগুনের আঁচ থেকে৷ আমি তো পারিনি আমার সন্তানকে সেইভাবে রক্ষা করতে৷’

এবার একটা অস্বস্তিকর নীরবতা৷ রোহিণী জানতই না ওঁদের অন্য কোনও সন্তান রয়েছে৷ নিশ্চয়ই নূরের কথা বলছেন না উনি! হেনা আন্টি তো সন্তান বিয়োগ সম্পর্কে একটি কথাও বলেন নি সকালবেলা? নূরও কোনদিন বলেনি তার দাদা বা দিদি ছিল? অনেক প্রশ্ন এবার একসঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিণীর মাথায়৷ কিন্তু এসব প্রশ্ন করা কি আদৌ শোভন হবে – উনি নিজে থেকে না বললে?

তবে আমার আর্লি চাইল্ডহুড বর্ধমানে খুব আনন্দে কেটেছিল৷ গোলাপবাগে চাচারা ডাবলক্যারি করে নিয়ে যেত সাইকেলে, কার্জন গেট অবধি যেতাম গির্জার পাশের রাস্তা ধরে৷ স্বাধীনতার পর গেটটার নাম হলো বিজয় তোরণ, বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব যিনি গেটটি তৈরি করেন তাঁর নাম অনুযায়ী৷ বর্ধমান শহরে ইউনিভার্সিটিতে কত যে দান-ধ্যান করেছিলেন ওঁরা৷ রবীন্দ্রনাথ ‘বিসর্জন’ উৎসর্গ করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদকে৷ একটা মাঠ ছিল – যেখানে যুদ্ধের সময় প্লেন পড়েছিল – চাচারা বলতেন৷ তারপর তো চলে গেলাম ঢাকা- বাক্স-পেঁটরা বেঁধে৷ 

ডক্টর রহমান রোহিণীর হতভম্ভ মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন৷ বলেন, ‘তোমার বোর্‌ড্‌ লাগছে না তো? এতকাল বাদে কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করল তো, তাই সব জীবনটা যেন সোডার মতো ভসভসিয়ে উঠে আসছে কর্ক স্ক্রু দিয়ে আটকানো বোতলের ছিপি খুলে৷ তুমি যদি শুতে চাও, বাকিটা না হয় থাক৷’

রোহিণী ঘাড় নাড়ে৷ না, তার জানা দরকার৷ সে শুনতে চায় সব৷ ও বলে, ‘আপনি বলুন৷ আমি শুনছি সব৷’

ঝোড়ো রহমান আবার স্মৃতিতে ফিরছেন৷

 ‘নারায়নগঞ্জে এসে স্কুলে ভর্তি হই৷ তারপর কলেজ৷ সায়েন্স নিয়ে লেখাপড়ার পরে প্রথম চাকরি শুরু করি৷ সিঙ্গাপুরে আমাকে যে কোম্পানিতে চাকরি করতাম তারাই পাঠিয়েছিল৷ সিঙ্গাপুর আমার ভালো লাগত না৷ বড় বেশি যান্ত্রিকতা ওখানে৷ দেশে চট করে যাওয়া যেত অবশ্য৷ চাকরি ছেড়ে দেশেই পালিয়েছিলাম৷ তারপর কি খেয়াল হলো, ভয়েস অব আমেরিকার সায়েন্স প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটরের চাকরিতে দরখাস্ত করলাম৷ হয়েও গেল৷ তার আগে সিঙ্গাপুরে থাকার সময়ই আমার বিয়ে হয়েছিল৷ আমার সেই স্ত্রী কিন্তু হেনা নয়৷ প্রধানতঃ আমার আম্মার আগ্রহে এই বিয়ে হয়েছিল৷ আমার নানির ছোটবেলার বকুলফুল সই-এর নাতনি৷ সই পাতানোর পর তাঁরা পরস্পরকে কথা দিয়েছিলেন, দুজনের ছেলেমেয়ের মধ্যে শাদি দেবেন৷ সেটা সম্ভব হয়নি – কেননা দুজনের কারওরই পুত্রসন্তান হয়নি৷ সেজন্য নাতি নাতনীর শাদি দেবার সুযোগ তাঁরা হাতছাড়া করতে চাননি৷ বিয়ের দেড় বছর পর আমি একটি পুত্রসন্তানের জনক হই৷ তখন আমার তিরিশ বছরও পেরোয়নি৷ কিন্তু সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তার মায়ের শরীর স্বাস্থ্য ডিটরিয়রেট করে৷ তুহিন, আমার স্ত্রীর হার্টের দুরোরোগ্য ব্যাধি ছিল৷ হাইপারট্রোফিক কার্ডিও-ভাসকুলার মায়োকার্ডিয়া৷

এ রোগে হার্টের মাস্‌লের পাশে ফ্যাটের লেয়ার জমতে থাকে৷ তখনকার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসব অসুখের চিকিৎসা দূরের কথা, প্রায়শই ডিটেক্টেড হত না৷ তুহিনের ক্ষেত্রে রোগটা ধরা পড়েছিল৷ কিন্তু সন্তান জন্মের ধকল সে নিতে পারেনি৷ মুক্তির ভূমিষ্ঠ হবার পনের দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ তুহিনকে ভাল করে বোঝার আগেই সে চলে গেল৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে৷ তাই ওর নাম রাখি মুক্তি৷ মুক্তি আজাদ রহমান৷ আমার ফার্স্টবর্ন৷ মুক্তির মুখ দেখে প্রথম অপত্যস্নেহ টের পেয়েছিলাম৷ কিন্তু সেও বাঁচার জন্য আসেনি৷ এই পৃথিবীতে মুক্তিদের বাঁচার মেয়াদ বড় কম৷ মুক্তি বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স হতো আটচল্লিশ বছর৷ মাঝে মাঝে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী প্রৌঢ় মুক্তির মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করি আমি৷ পারি না৷ চোখের সামনে পাঁচ বছরের মুক্তির সেই বড় বড় চোখ দু’খানা মনে ভাসে৷ তেতাল্লিশ বছর আগে সেই বাচ্চা ছেলেটা এখনও আমার বৃদ্ধ বয়সের স্বপ্নে হানা দেয়৷ মনে হয় আমার অন্য সন্তানের জন্য সবরকম কর্তব্য করেছি আমি৷ নিজের মনে মতো করে মানুষ করেছি, স্বাবলম্বী পূর্ণবয়স্ক একটি মানুষ সে৷ কিন্তু মুক্তির জন্য যে দায়িত্ব ছিল আমার, সে দায়িত্ব আমি যথাযথভাবে পালন করিনি৷ জীবনের সেই পর্বে আমি চরম স্বার্থপরের মতো কেরিয়ারের দিকে তাকিয়ে পিতার কর্তব্যে অবহেলা করেছি৷ মুক্তি তার মায়ের দিক থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে রোগটি পেয়েছিল৷

সে রোগের চিকিৎসা আমি করাতে পারতাম৷ আমি তার বদলে চাকরি করতে চলে গেলাম ভয়েস অব আমেরিকায়৷ ভেবেছিলাম এখানে একটু সেট্‌ল্‌ করলে নিয়ে আসব ওকে৷ তখন তো আমি একা৷ হেনা সম্পর্কে আমার খালাতো বোন৷ ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না খুব একটা৷ বাড়িতে বিয়ে শাদি থাকলে, তখন দেখা এক-আধবার৷ এদেশে চলে আসার পর একটু বাউন্ডুলে প্রকৃতির হয়ে গিয়েছিলাম৷ নানি-দাদি সবাই তখন চাইছিলেন আবার আমি সংসারী হই৷ তখন হেনার সঙ্গে পরিবারের মেয়েরাই উদ্যোগী হয়ে আলাপের ব্যবস্থা করেন৷ ও তখন শান্তিনিকেতন থেকে এম-মিউজ করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেছে৷ তখন ওকে দেখে খুব ভাল লাগল আমার৷ আরও ভাল লাগল ওর গান শুনে৷ আমি চিরকাল মাঠ ঘাটে ঘোরা মানুষ৷ গণসংগীত গাইতাম৷ শচীনকর্তার গানে, বাউল, ভাটিয়ালির সুরে আচ্ছন্ন হয়ে থেকেছি চিরকাল৷ হেনার গান শোনবার পর মনে হল — নাঃ, জীবনটা যদি আরেকবার নতুন করে শুরু করা যায়, মন্দ হয় না৷’ ঝোড়ো রহমান একটানা কথা বলে থেকে যান৷ মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্য যেন হঠাৎ গাঢ় হয়ে ধরা দেয় রোহিণীর কাছে৷

padma river
পদ্মার পাড় দিয়ে সকাল সন্ধ্যে আমরা বেড়াতে বেরতাম৷

‘আন্টি কী গান শুনিয়েছিলেন আপনাকে মনে আছে?’ রোহিণীর অবাধ্য মুখ প্রশ্ন করে৷

উনি একটু ভাবেন৷ তারপর বলেন, ‘হেনা তো এখনও চর্চা করে৷ বাড়িতে অনেকে ওর কাছে গান শিখতে আসে৷ এখানে সেট্‌ল্‌ড বাংলাদেশী, ভারতীয় পরিবারগুলির ছেলেমেয়েরা৷ চল্লিশ বছর ধরে কত গানই যে শুনেছি হেনার গলায়৷ শিলাইদহ গেছিলাম একসঙ্গে আমাদের দুই পরিবার৷ এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল ওখানে৷ শিলাইদহ-সাজাদপুর অঞ্চলে ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ছিল৷ তখন অবশ্য কুঠিবাড়ি হাতবদল হয়ে গেছে৷ ভাগ্যকুলের রায়দের থেকে জমিদারি অ্যাবলিশনের পরে কুঠিবাড়ি ছিল সরকারী সম্পত্তি৷ রবীন্দ্রনাথ যে হাউসবোটে থাকতেন ওখানে গেলে, সেই বোটটাকে অবধি রেনোভেট করেছিল ওরা৷ হেনার কাছে শিলাইদহ সাজাদপুর অনেকটা তীর্থে যাবার মতো ও শান্তিনিকেতনের মেয়ে বলে৷ আমি তখন জীবনের প্রতি খুব সিনিক্যাল৷ পদ্মার পাড় দিয়ে সকাল সন্ধ্যে আমরা বেড়াতে বেরতাম৷ দুই বাড়ির লোকেরা হেনা আর আমাকে একত্র হবার সুযোগ করে দিত৷ আর আমরা খুব গান গাইতাম৷ রবীন্দ্রনাথ এইখানে বোটে থাকার সময় পাড়ের জনজীবনকে দেখতেন, ওই সময়ই লিখেছিলেন ছিন্নপত্রাবলী৷ ওইখানে থাকার প্রসঙ্গে পরে লিখেছেন ‘সেই নির্জনতায় আমি মুক্ত দিগন্তকে অফুরান রৌদ্র সুধার মতো পান করেছি৷ নদীর ছলোচ্ছল ধ্বনি আমার কানে কানে যেন প্রকৃতির নিগূঢ় রহস্যের কথা বলে গিয়েছে৷’ বিশ্বাস করো মা! কবির যাবার প্রায় একশো বছর পরে ওই জায়গার চরিত্র একইরকম থেকে গেছিল৷ বিশাল নদীর তীরে বসে থাকতাম আমরা৷ কত গান যে গাইত হেনা ওই ক’দিন৷ তবে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে একটি গান, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে৷’

ভোর হয়ে আসছে৷ দূরে নদীর আভাস৷ পটোম্যাক খুব শান্ত নির্জন নদী৷ নদীর পারে লোক চলাচল খুব কম৷ নদীর ওই রেখাটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রোহিণীর মনে হলো চল্লিশ বছর আগে শিলাইদহের পদ্মার তীর নিশ্চয়ই ঠিক এরকমই নির্জন ছিল৷ একটা ঘোরের মধ্যে রোহিণী ওয়াশিংটনের রাত শেষের ভোর হওয়া দেখছিল৷ হঠাৎ শুনলো ঝোড়ো রহমান আবৃত্তি করছেন  ‘বুঝি গো রাত পোহালো, বুঝি ওই রবির আলো, আভাসে দেখা দিল গগন পারে, সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর দুয়ারে৷’ তাঁর অবিন্যস্ত সাদা চুল, সযত্ন চর্চিত সল্ট অ্যান্ড পেপার দাড়ি, হাতদুটি জোড় করা আছে করজোড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে, কনুই চেয়ারে হাতলে, ঝোড়ো রহমান সামনে পথের দিকে তাকিয়ে আছেন৷

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৩ নভেম্বর ২০২২

ছবি সৌজন্য: Publicdomainpictures,Wikimedia Commons, Flickr

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com