পাহাড়ের মাথায় আমাদের হোটেলের গায়ে মধ্য-দুপুরের এক চিলতে রোদ্দুর লেগে আছে। খোলা চাতালে বসে চারদিকটা দেখতে খুব ভালো লাগছে। অনেক নীচে গভীর-নীল এজিয়ান সাগর (Aegean sea) । আমাদের হোটেলটা অনেক উঁচুতে বলে এখান থেকে সমুদ্র খুব শান্ত দেখাচ্ছে। জলের উপরে অজস্র সাদা সিগাল উড়ছে, যেন এক ঝাঁক সাদা প্রজাপতি ডানা মেলেছে। আমাদের চারধারে খাঁড়া ন্যাড়া পাহাড়, সামনে সমুদ্র। পাহাড়গুলো রুক্ষু-শুখু, মাটি বাদামি-কালচে-লাল, একটাও গাছ নেই। খাড়া পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সাদা খামের মতন আয়তক্ষেত্রকার বাড়ি গোঁজা আছে। কয়েকটা বাড়ির ছাদ সমুদ্র-নীল এবং গম্বুজাকৃতি। এই নীলমাথা গুলো ( Blue Dome) আসলে চার্চ। নীলে-সাদায়-সমুদ্রে-বাদামি পাহাড়ে মিলেমিশে এই দ্বীপটা ভারি ম্যাজিকাল। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, উঠে গিয়ে হাল্কা গরম জামা পড়ে এলাম।
ব্লু ডোম’এর কথা শুনে বোধহয় আন্দাজ করতে পারছেন, আমরা স্যান্টোরিনিতে (Santorini) এসেছি। এখানেই নিকোলাসের সঙ্গে আলাপ হোল।
গ্রীসের এজিওহো সমুদ্রের বুকে স্যান্টোরিনি (Santorini) দ্বীপটা পাহাড়ের মাথায় যেন একটা সরলরেখায় আঁকা। এই দ্বীপের উত্তর থেকে দক্ষিণ মাত্র ১৬ কিলোমিটার লম্বা। ছোট্ট দ্বীপ। মাত্র ঘন্টা দুয়েক আগে এসে পৌঁছেছি। রেস্টুরেন্টে বসে চারপাশের ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখতে দেখতে বেশ বেলাতেই প্রাতরাশ সারলাম। আহ! গ্রিক খাবারের কোন জবাব নেই – নানা রকমের চিজ (cheese), পাঁউরুটি, ঠান্ডা মাংস, বিখ্যাত গ্রিক দই আর টাটকা ফল। ডেভিড নামে যে তরুণ খাবার পরিবেশন করছিলেন, তাকে একেবারে গ্রিক দেবতার মতন দেখতে। তখনও আমাদের হোটেলের রুম তৈরি হয় নি, তাই কিছুক্ষণ ডেভিডের সাথে আড্ডা চলল। ভারি অমায়িক হাসিখুশি ছেলেটি। ৮ বছর আগে এখানে কাজ নিয়ে এসে থেকে গেছেন।
এই পুরো অঞ্চলটা আসলে একটা ক্যালডেরা (Caldera)। খ্রীষ্টপূর্ব ১৬২০ সালে এখানে সমুদ্রের নীচে ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে মারাত্মক অগ্নুৎপাত ঘটিয়েছিল। মিনোয়ান সভ্যতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে লাভার নীচে চাপা পড়ে যায় । বহু বছর পরে এই ক্যালডেরা থেকে পাঁচটা দ্বীপ জেগে ওঠে – স্যান্টোরিনি এদেরই মধ্যমণি। দূরে অন্য দ্বীপগুলোও দেখতে পাচ্ছি। পাহাড়ে থাকি বলে, আমার সমুদ্র দেখবার খুব শখ। ভেবেছিলাম, এখানে বালির বিচ থাকবে, দিব্যি জলে নামতে পারব। কিন্তু আগ্নেয়গিরি থেকে উঠেছে বলে স্যান্টোরিনির বিচগুলো কালচে, লাল রঙের, পাথুরে, বেশ উঁচু-নিচু । বেশিরভাগ বিচে যাওয়া যায় না। সমুদ্রের ভিতর দিয়ে গিয়ে বোটে করে নামতে হয়। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই, তাই বোট যাত্রাটা হল না।
এইবার নিকোলাসের কথায় আসি। বিকেল চারটে নাগাদ নিকোলাস গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন। আমাদের চালক ও ট্যুর গাইড। হোটেল থেকেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মানুষটি ছোটখাটো, হাসিখুশি আর খুব আন্তরিক। আমরা উঠেছি স্যান্টোরিনির রাজধানী ফিরা’তে (Fira), এখন উত্তরে ইয়া’তে (Oia) যাচ্ছি। সারা বিশ্বের মানুষ ইয়া’তে সূর্যাস্তের ফটো তুলতে আসে। ভিড় এড়াতে আমরা সন্ধ্যের অনেক আগেই রওনা দিয়েছি। ফিরা আর ইয়ার দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার হলেও, যেতে অনেক সময় লাগল। একটাই লেন, রাস্তা এঁকেবেঁকে চলেছে। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে উপত্যকা, দুদিকেই ধবধবে চুনকাম-সাদা বাড়ি, প্রেক্ষাপটে ঘন নীল সমুদ্র। আঙুরের খেত, টম্যাটো গাছগুলো সোনালি রোদ্দুর মেখে বড্ড খুশি। সব মিলিয়ে একটা চমৎকার রূপকথার ছবি। ছোট জায়গায় যেমন হয়, সবাই সবাইকে চেনে। নিকোলাস আমাদের সাথে গল্প করছেন। আবার পাশ দিয়ে গাড়ি গেলে, জানালার কাচ নামিয়ে গলা বার করে, কুশল সংবাদও নিচ্ছেন। অর্থাৎ গাড়ির সাথে কথাও চলছে। আমরাও জানলার কাচ নামিয়ে দিলাম, ফুরফুরে সমুদ্রের হাওয়ায় চুল উড়ছে। যেন ময়ূরপঙ্খী নৌকায় চড়ে এক স্বপ্নের দেশে ভেসে চলেছি।
নিকোলাসের কাছ থেকে যা শুনলাম, তার বিবরণ খানিকটা এরকম… এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্যান্টোরিনির পিক সিজিন। এই সময়টা দ্বীপের মানুষজন খুবই ব্যস্ত, দিনে ১২-১৩ ঘন্টা কাজ করেন। তারপর শীত এলে, ট্যুরিস্টদের সংখ্যা কমতে থাকে। তখন স্থানীয় লোকেরা অন্য কোথাও কাজ নিয়ে চলে যান। শুধু গুটি কয়েক হোটেল-রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে।
“এখানকার শীত হাড়-কাঁপানো। সমুদ্রের গর্ভ থেকে কনকনে জোলো বাতাস উঠে আসে। সেই সাথে বৃষ্টিতে ভিজে পাথুরে রাস্তা একেবারে পিছল হয়ে যায়। শীতে আমি এখানেই থাকি, পুরোপুরি বিশ্রাম নিই। ব্যস্ত সিজিনের শেষে পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডা, ভালো মন্দ খাওয়াদাওয়া হয়।” আমি জানতে চাইলাম “আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?” “আমি, আমার স্ত্রী, এক ছেলে, আর বাবা-মা। আমার স্ত্রী হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন। ছেলে ১৮ তে পা দিয়েছে। তার আপাতত টিন এজ সিনড্রোম চলছে।” উনি বললেন, গ্রীকদের মধ্যে ভারতীয়দের মতন দাদু-ঠাকুমাকে নিয়ে তিন পুরুষ একসাথে থাকার প্রথা আছে।
এসে গেলো ইয়া (Oia), পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট মায়াবী শহর। নিকোলাস আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্ক করতে গেলেন। “সোজা পথ, এগিয়ে যান। আমি আসছি।” ঠিক কোথায় গেলে নিকোলাসের দেখা মিলবে বুঝতে না পারলেও আমরা পাথুরে গলিতে ঢুকে পরলাম। ব্যাস, শুরু হোল আরব্য রজনীর ম্যাজিকাল পথে চলা। দুপাশে অসাধারণ সুন্দর চুনকাম-সাদা অথবা হালকা হলুদ বাড়ি, বুটিক, রেস্টুরেন্ট, প্রাচীন বই-এর দোকান। একধারে খোলা সমুদ্র, পাশে পাহাড়ের খাঁজে গোঁজা বাড়ি, যেগুলো খুবই দামি হোটেল-রিসর্ট। বারবার পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা, বারবার দাঁড়িয়ে ফটো তোলা। এতো শৈল্পিক যে বলার নয়। জানলা-দরজায় সমুদ্রের রঙ মিলিয়ে নীল বা কন্ট্রাস্ট রং। ছোট্ট বারান্দায় ফুলের গাছ, সামনে পাহাড় এবং খোলা সমুদ্র। এই ছবির মধ্য দিয়েই স্মৃতি আলোকিত থাকবে।
কিছুটা যাবার পর দেখি নিকোলাস হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ডানদিকে একটা খুব সুন্দর সাদা চার্চ (Panagia Platsani), মাথায় নীল গম্বুজ, ছ’টা চার্চ বেল। ওঁর কাছ থেকে এই চার্চ পত্তনের একটা আশ্চর্য গল্প শুনলাম। আন্দাজ ১৮২০ সালে মৎস্যজীবিরা সমুদ্রে মাদারের একটা আইকন খুঁজে পান, জলের মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল। তাঁদের কাছে এই খবর শুনে ফাদার স্থানীয় লোকজন নিয়ে এসে তা তুলে নিয়ে গিয়ে চার্চে প্রতিষ্ঠা করলেন। সকালে উঠে দেখা গেল সেই আইকন হাওয়া। শেষে সমুদ্রে খুঁজে পাওয়া গেলো। আবার চার্চে এনে প্রতিষ্ঠা, আবার উধাও। এতো ভারি জ্বালা! কিন্তু লোকেরা হাল ছাড়লো না। শেষে বোঝা গেল, মাদার সমুদ্রের ধারে একটা বিশেষ জায়গায় চার্চ বানাবার নির্দেশ দিচ্ছেন। যেখান থেকে তিনি দূরপাল্লার জাহাজের নাবিকদের আশীর্বাদ করতে পারবেন। চার্চ এই সময়ে বন্ধ আছে, ভিতরে যেতে পারলাম না।
নিকোলাসের সাথে আড্ডা দিতে দিতে এগোচ্ছি। “আপনাদের ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট আছে? ওই কোনাটায় চলুন। এটাই ইয়ার ইন্সটাগ্রাম-পারফেক্ট ফটোগ্রাফি স্পট”। উনি যেদিকটা আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন, সেটা কিছুটা উঁচুতে। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে ঘুরে ঘুরে উঠতে নামতে হবে। ভাবছি, কী জানি সিঁড়িগুলো পিছল কিনা? এখন ভরপুর গ্রীষ্মকাল, জল কোথা থেকে আসবে? আমাকে ইতস্তত করতে দেখে, নিকোলাস কী বুঝলেন জানি না, জোড় দিয়ে বললেন “ নিশ্চিন্তে চলে আসুন। কিচ্ছু হবে না।” ওঁর সাথে সেই বিখ্যাত বাঁকে পৌঁছে দেখি ইয়া তার সুন্দরতম দরজা খুলে দিয়েছে। বাঁ দিকে উন্মুক্ত আশমানি-নীল সমুদ্রের প্রেক্ষাপটে পাহাড়ের মাথায় সাদা নান্দনিক বাড়ির মাঝে নীল পরীর মতন দুটো চার্চ। এই সেই পৃথিবী বিখ্যাত ব্লু ডোম (Blue dome) চার্চ (Agios Spiridonas এবং Anastasios)। চুনকাম-সাদা আর মাথায় নীল গম্বুজাকৃতি ছাদ। তখনও সূর্য মধ্য গগনে, টকটকে লাল হতে অনেক দেরি। সুসজ্জিত তরুণ-তরুণীরা ফটো তোলার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েদের পোশাক নীল-সাদার পটভূমির সাথে ম্যাচিং। তারুণ্যের একটা আলাদা লাবণ্য আছে, সবাইকে সুন্দর দেখাচ্ছে।
এক জুটির সাথে আলাপ হোল, তাইওয়ান থেকে এসেছেন, “বিকেল পাঁচটা থেকে বসে আছি। আটটায় সূর্যাস্ত। এখান থেকে সবচেয়ে ভাল ফটো উঠবে।” ওঁদের এই সিদ্ধান্তে একটু অবাক হলাম। তিন ঘণ্টায় তো আরও কত কিছু দেখা হয়ে যেত! ওঁরা ইয়াতে এই স্পট থেকেই সূর্যাস্তের ফটো তুলবেন বলে এত থেকে দূর এসেছেন! নিকোলাস এই স্থানে এক রকম জোড় করে বসিয়ে আমাদের ফটো তুলে দিলেন।
ডানদিকে একটা খুব সুন্দর সাদা চার্চ (Panagia Platsani), মাথায় নীল গম্বুজ, ছ’টা চার্চ বেল। ওঁর কাছ থেকে এই চার্চ পত্তনের একটা আশ্চর্য গল্প শুনলাম। আন্দাজ ১৮২০ সালে মৎস্যজীবিরা সমুদ্রে মাদারের একটা আইকন খুঁজে পান, জলের মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল। তাঁদের কাছে এই খবর শুনে ফাদার স্থানীয় লোকজন নিয়ে এসে তা তুলে নিয়ে গিয়ে চার্চে প্রতিষ্ঠা করলেন। সকালে উঠে দেখা গেল সেই আইকন হাওয়া। শেষে সমুদ্রে খুঁজে পাওয়া গেলো। আবার চার্চে এনে প্রতিষ্ঠা, আবার উধাও। এতো ভারি জ্বালা! কিন্তু লোকেরা হাল ছাড়লো না। শেষে বোঝা গেল, মাদার সমুদ্রের ধারে একটা বিশেষ জায়গায় চার্চ বানাবার নির্দেশ দিচ্ছেন। যেখান থেকে তিনি দূরপাল্লার জাহাজের নাবিকদের আশীর্বাদ করতে পারবেন।
স্যান্টোরিনিতে ঘুরতে ঘুরতে বারে বারে ভূমিকম্পের কথা চলে আসছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এখানকার মানুষের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছে। পথে অনেকগুলো চার্চ দেখলাম। ভাবছিলাম, এই ছোট্ট দ্বীপে এতগুলো চার্চ কেন? এর পিছনে কি কোন গল্প আছে? নিকোলাস জানালেন, এখানকার বেশিরভাগ চার্চই প্রাইভেট। আমাদের দেশে যেমন মানত রাখা হয়, এখানে তেমন ভূমিকম্প থেকে নিরাপত্তা অথবা রোগমুক্তি কামনা করে মানুষ একটা করে চার্চ বানিয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে চার্চে পারিবারিক উৎসব হয়, এলাকার মানুষেরা যোগ দেয়।
আড্ডা দিতে দিতে আমরা ফিরাতে ফিরে এলাম। নিকোলাস আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। যাবার আগে ফোন নম্বর দিলেন, “পরের বার স্যান্টোরিনিতে এলে, একটু আগে থেকে জানাবেন। আপনারা আমার অতিথি হবেন।” কথাগুলোর মধ্যে ওঁর সহজাত আন্তরিকতা মিশে ছিল, যা আমাদের নীরবে ছুঁয়ে গেলো। গাড়িটা রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই আমি মুচকি হেসে বললাম “আমাদের গ্রীসেও একটা থাকবার জায়গা হয়ে গেল।”
ছবি সৌজন্য: লেখক, Flickr, rawpixel.com
কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, পেশায় রিসার্চ ফেসিলিটেটর। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, কলেজ, ফাউন্ডেশানে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি এবং গ্রান্ট ডেভালেপমেন্টের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডার ক্যালগেরি শহরের অধিবাসী। ঘুরেছেন নানা দেশ, ভালবাসেন সৃষ্টিশীল কাজ। লেখা তাঁর বহুদিনের ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা আর মানুষের কাহিনি; কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। গল্প ছাড়াও লেখেন প্রবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বেশ কিছু লেখা দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমানে এবং অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।