banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কিশোর আইনস্টাইন: কিছু সত্য কিছু মিথ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

মার্চ ১৪, ২০২৪

Albert Einstein Myth and Facts
Albert Einstein Myth and Facts
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

আলবার্ট আইনস্টাইনের (Albert Einstein) নাম আমরা সবাই জানি। তাঁর আবিষ্কৃত ভর ও শক্তির তুল্যমূল্য বিচারের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে পৃথিবীর বিখ্যাততম সমীকরণ। যেকোনও খ্যাতনামা ব্যক্তির মতো তাঁর সম্পর্কেও অনেক গল্প প্রচলিত আছে, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আরও বেশ নতুন কয়েকটা জানতে পেরেছি। তাদের কয়েকটা সত্যি হতেও পারে, কিন্তু অনেকগুলিই সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। আইনস্টাইনের পক্ষে কোন স্টেশনে নামতে হবে তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়া বা নিজের বাড়ির ঠিকানা ভুলে যাওয়া সম্ভব হতেও পারে। কিন্তু আইনস্টাইনের বদলে তাঁর ড্রাইভারের বক্তৃতা দেওয়া নিতান্তই অসম্ভব, তা হলে ধরে নিতে হয় শ্রোতারা পৃথিবীর সব থেকে বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে চিনতেন না। এমনকি ইহুদি আইনস্টাইনের মেয়ের বিয়ে চার্চে হওয়ার গল্পও চালু আছে। স্কুলে আইনস্টাইন অঙ্কে ফেল করেছিলেন, এমন কথাও আইনস্টাইনের এক জীবনীতে পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

আইনস্টাইনকে নিয়ে নানা গল্পের পিছনে আছে তাঁর চরিত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য যা তাঁকে অধিকাংশ মানুষের থেকে আলাদা করে রেখেছে। যে সমস্ত কাহিনি তাঁকে ঘিরে প্রচলিত আছে, তার পুরোটা সত্য না হলেও অনেকের মধ্যেই হয়তো সত্যের বীজ লুকিয়ে আছে, প্রায় সব মিথের ভিতরেই যা থাকে। এই লেখার স্বল্প পরিসরে আমরা শুধু তাঁর জীবনের প্রথম আঠারো বছরের কথা শুনব এবং কৈশোর ও প্রাক যৌবনের ঘটনাগুলির মধ্যে তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলির উৎস খুঁজব। 

Albert Einstein

আইনস্টাইনের জীবনীকারেরা সকলেই তাঁর জীবনের প্রথম পর্ব নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। ব্যক্তিগত বিষয়ে আইনস্টাইনের স্মৃতিশক্তি সত্যিই দুর্বল ছিল, যে কারণে সাতষট্টি বছর বয়সে লেখা তাঁর স্মৃতিকথা খুব নির্ভরযোগ্য নয় বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। আইনস্টাইনের বোন মারিয়া (বা মাজা) ছাড়া আত্মীয়রা কেউই তাঁর ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু লেখেননি। মাজাও লিখেছেন ১৯২৪ সালে, যখন আইনস্টাইনের বয়স পঁয়তাল্লিশ। ম্যাক্স তালমুদ (পরে তালমে) ছিলেন আইনস্টাইনের টিউটর, বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে কাটিয়েও আপেক্ষিকতা বিষয়ে তাঁর লেখা একটি বইতে তিনি আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় সম্পর্কে মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠা ব্যয় করেছিলেন। তবে আইনস্টাইনের জীবনীকাররা হাল ছেড়ে দেননি, তাঁরা নানা তথ্য খুঁজে বার করেছেন। সেসব তথ্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা আছে, কিন্তু সমস্ত মিলিয়ে একটা ছবি ফুটে ওঠে। সেই ছবি এক বিদ্রোহী তরুণের যে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ; যে সমস্ত বিষয়ে সে আগ্রহী সেখানে তার তুলনা মেলা শক্ত, কিন্তু জোর করে কোনও কিছু তার উপরে চাপানো প্রায় অসম্ভব। 

আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম জার্মানির উল্‌ম শহরে ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ। তাঁর বাবার নাম হেরম্যান ও মা পলাইন। আলবার্ট ও মাজা দুজনের স্মৃতিকথাতেই আছে শিশু আলবার্ট অনেক দিন পর্যন্ত কথা বলেনি। এই স্মৃতিটা সম্ভবত সত্যি নয়, কারণ তাঁর দাদুর চিঠিতে দু’বছর বয়সী আলবার্টের দাদু-দিদিমার সঙ্গে কথা বলার উল্লেখ পাওয়া যায়। পারিবারিক স্মৃতিতেই আছে বোন মাজার জন্মের পরে আলবার্টকে যখন বলা হয়েছিল যে তার একটা নতুন খেলনা এসেছে, তখন সে প্রশ্ন করেছিল, ‘চাকা নেই, তাহলে খেলব কেমন করে?’ তখন তার বয়স আড়াই বছর। তবে সাত বছর বয়স পর্যন্ত আলবার্টের অভ্যাস ছিল কোনও কথা বলার আগে পুরো বাক্যটা নিজের মনে একবার বলে নেওয়া, সেই কারণেই হয়তো তাঁকে বোকা মনে হত। কোনও কথা লেখা বা বলার আগে চিন্তা করে নেওয়া, আইনস্টাইনের এই ট্রেডমার্ক অভ্যাস সারা জীবন বজায় ছিল। ফলে তাঁর চিন্তাভাবনাগুলো সবসময়েই স্পষ্ট ফুটে উঠত।

আইনস্টাইনের ছোটবেলায় তাঁর পরিবার মিউনিখে চলে আসে। সেখানে আলবার্টকে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়। চট করে কোনও উত্তর দিতেন না বলে শিক্ষকরা তাঁকে হয়তো বোকা ভাবতেন, কিন্তু পরীক্ষার ফল নিশ্চয়ই সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছিল। সেই স্কুলে তিনি অধিকাংশ সময়েই প্রথম হতেন, এবং কখনও দ্বিতীয়র নীচে নামেননি। তিন বছর পরে তাঁকে মিউনিখের লুইটপোল্ড জিমন্যাসিয়াম স্কুলে ভর্তি করা হয়। খুব ভালো ছাত্র ছাড়া সেখানে সুযোগ পাওয়া যেত না। 

Albert Einstein and his sister
বোন মাজার সঙ্গে কিশোর আইনস্টাইন

একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আইনস্টাইনের ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়, বিশেষ করে মনে আসে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, “ঈশ্বর পাশা খেলেন না।” এই ঈশ্বর কে? তিনি নিজে বলেছিলেন, “আমি (বারুচ) স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাসী, মানুষের কাজ বা ভবিষ্যৎ নিয়ে যে ঈশ্বরের মাথাব্যথা নেই, সৃষ্টির সুশৃঙ্খল ঐকতানের মধ্যে যাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।” বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই ঐকতান ছিল আইনস্টাইনের ঈশ্বর। তিনি নিজেকে আস্তিক বলতেন, কিন্তু তাঁর আস্তিকতাকে সাধারণ মানুষের বিচারে নাস্তিকতার থেকে আলাদা করা শক্ত। তিনি মৃত্যুর পরে আত্মা বা কোনও দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। আইনস্টাইনের পরিবার ছিল ইহুদি, কিন্তু তাঁরা বাড়িতে ধর্মীয় অনুশাসন সেভাবে মেনে চলতেন না। পরবর্তীকালের আইনস্টাইন ইহুদি সংস্কৃতি বিষয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হলেও ইহুদি ধর্ম বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। ‘অন্য সব ধর্মমতের থেকে বেশি ক্ষতি করেনি,’ এই ছিল ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সংক্ষিপ্ত অভিমত। কিশোর আইনস্টাইন কিন্তু অল্প সময়ের জন্য হলেও ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায়— প্রতিটি মানুষেরই একসময় জীবনকে অর্থহীন মনে হয়, তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার প্রথম পথ হল ধর্ম, যা আমাদের পরম্পরাগত যান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিটি শিশুর মনে প্রোথিত করে দিয়েছে। কিন্তু বারো বছর বয়সে হঠাৎ সেই দশার সমাপ্তি ঘটে। বিজ্ঞানের জনপ্রিয় বই পড়ে তিনি বুঝতে পারেন যে বাইবেলের অনেক কথাই সত্যি হতে পারে না। (মনে রাখতে হবে, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট ইহুদিদেরও পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মধ্যে পড়ে।)

সম্ভবত এই সময়েই ম্যাক্স তালমুদ তাঁকে একটি উচ্চতর জ্যামিতির বই পড়তে দেন। ম্যাক্স দেখেছিলেন যে বিজ্ঞান ও অঙ্কে তাঁর ছাত্র সমবয়সীদের থেকে অনেক এগিয়ে। তার আগেই আলবার্ট জ্যামিতি শিখেছিলেন, কিন্তু এর পরে তিনি গণিতের দিকে আলাদা করে মন দেন। বারো থেকে ষোল বছর বয়সের মধ্যে বই পড়েই তিনি ক্যালকুলাস শিখে ফেলেন। ম্যাক্স ছিলেন ডাক্তারির ছাত্র এবং আইনস্টাইনের থেকে এগারো বছরের বড়। কিন্তু তিনিও আর ছাত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না। তিনি আলবার্টকে ইম্যানুয়েল কান্টের দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করেন। তেরো বছর বয়সী আলবার্ট কান্টের দর্শন অনেকটাই আত্মস্থ করতে পেরেছিল। দর্শনের প্রতি আগ্রহ আইনস্টাইনের সারাজীবন ছিল। বিশেষত আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে গবেষণার সময় তাঁকে আর্নস্ট মাখ-এর ‘দৃষ্টবাদ'(Positivism) বিশেষ প্রভাবিত করেছিল। পরে অবশ্য তিনি মাখের মতকে ভুল বলেছিলেন। 

Max Talmey & Einstein
ম্যাক্স তালমুদ ও কিশোর আইনস্টাইন

ইউরোপে সে যুগে গ্রিক ও ল্যাটিন পাঠক্রমের অন্তর্গত ছিল। মাজার স্মৃতিতে আছে যে জিমন্যাসিয়ামে আলবার্টের গ্রিক শিক্ষক একবার বলেছিলেন যে তাঁর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। আইনস্টাইনও প্রায় একই গল্প পরে বলেছেন, খালি তাঁর স্মৃতিতে এসেছে ল্যাটিন শিক্ষকের কথা। একাধিক জীবনীতে এই গল্পটা অন্যভাবে পড়েছি; আইনস্টাইনের বাবা হেরম্যান যখন হেডমাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ছাত্র কোন পেশার উপযুক্ত, তখন তিনি নাকি বলেন যে আপনার ছেলে জীবনে কোনও কিছু করতে পারবে না। কথাটা মেনে নেওয়া খুব শক্ত, কারণ সেই স্কুলে আলবার্ট অঙ্কে ও বিজ্ঞানে সবসময়েই প্রথম হতেন, এমনকি গ্রিক বা ল্যাটিনেও (!) উপর দিকেই থাকতেন। হতে পারে যে কোনও এক বিশেষ পরিস্থিতিতে এক শিক্ষক এই কথা বলেছিলেন। ভাষাশিক্ষার বিষয়ে আইনস্টাইনের অনীহা ছিল, ইহুদিদের হিব্রু শেখার মতো সাধারণ অভ্যাসকেও আইনস্টাইন এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেই অনীহাও তাঁর শিক্ষকের বিরক্তির কারণ হয়ে থাকতে পারে। 

তবে ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও আলবার্ট স্কুলকে প্রচণ্ড অপছন্দ করতেন। স্কুলের মুখস্থবিদ্যার উপর জোর বা জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেওয়া শৃঙ্খলা তাঁর সহ্য হত না। যে আইনস্টাইন সারা জীবন বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে প্রশ্ন করে আমাদের সামনে নতুন জগৎ খুলে দিয়েছেন, সেই বিদ্রোহী কালাপাহাড়ের জন্ম হয়তো এই সময়েই। পরবর্তীকালে তিনি সেই বিতৃষ্ণা থেকেই তাঁর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সৈন্যবাহিনীর সার্জেন্ট এবং জিমন্যাসিয়ামের শিক্ষকদের লেফটেন্যান্টদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। 

Albert Einstein at the age of 3
বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক যখন তিন বছরের শিশু

আইনস্টাইনের পরিবার প্রায়ই আর্থিক সংকটে পড়ত, ফলে হেরম্যান জীবিকা নির্বাহের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। আইনস্টাইনের বয়স যখন পনেরো, তখন তাঁর পরিবার ইতালিতে মিলান শহরে যান। মিউনিখে থেকে পড়া শেষ করার কথা ছিল আইনস্টাইনের, কিন্তু তিনি অল্প দিন পরেই স্কুল ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি এক ডাক্তারের সার্টিফিকেট জোগাড় করেছিলেন, কিন্তু সম্ভবত স্কুল সেই সার্টিফিকেট না নিয়ে তাঁকে বহিষ্কার করে। স্কুলের ডিসিপ্লিনের বিরুদ্ধে বারবার তাঁর বিদ্রোহ হয়তো কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি। এক শিক্ষক একবার তাঁকে ক্লাসে আসতে বারণ করেছিলেন, কারণ— “তুমি পড়াতে মন না দিয়ে ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে হাসিহাসি মুখে বসে থাকো, এতে শিক্ষক ক্লাসের কাছে যে শ্রদ্ধা আশা করেন তার ব্যাঘাত ঘটছে।” স্কুল ও ছাত্র কেউ কাউকে পছন্দ করেনি, ঘটনাচক্রে মিউনিখের সেই স্কুলের নাম এখন আলবার্ট আইনস্টাইন জিমন্যাসিয়াম।

আরও পড়ুন: সাহিত্যানুরাগী সত্যেন্দ্রনাথ বসু

এই সময় আইনস্টাইন জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। হেরম্যান প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলের জেদের কাছে হার মানেন। জার্মান, বা আরও বিশেষভাবে বললে প্রাশিয়ান সমাজের মিলিটারিসুলভ নিয়মানুবর্তিতা আলবার্টের কাছে অসহ্য ছিল। তাছাড়া সেই সময়ে জার্মান নাগরিকদের সৈন্যদলে দু’বছর কাজ ছিল বাধ্যতামূলক, তিনি তার থেকেও মুক্তি চেয়েছিলেন। পাঁচ বছর পরে তিনি সুইস নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। পরে দীর্ঘদিন জার্মানিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন, যেখানে জার্মান নাগরিকত্ব ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু আইনস্টাইন রাজি হননি, এবং কর্তৃপক্ষও বিষয়টা নিয়ে চোখ বুজে ছিলেন। আইনস্টাইন তাঁর নোবেল পুরস্কার নিতে যাননি, অনুষ্ঠানটির সময় তিনি সুইস পাসপোর্ট নিয়ে জাপানে। তাঁর হয়ে জার্মানি না সুইজারল্যান্ড কোন দেশের রাষ্ট্রদূত পুরস্কারটি নেবে, তাই নিয়েও সমস্যা হয়েছিল। 

হেরম্যান আগে পরে অনেক ঘটনাতেই বুঝেছিলেন ছেলের মত সহজে পরিবর্তন হয় না। পরবর্তীকালেও আমরা দেখেছি যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের মধ্যে একমাত্র আইনস্টাইনই তখনও মনে করতেন যে সেটি শেষ সত্য নয়। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা হয়তো অনেকেই পড়েছেন। একে একগুঁয়েমি বলতেই পারি, কিন্তু মনে রাখতে হবে এই একগুঁয়েমিকে ভুল প্রমাণ করার জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল ২০২২ সালে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ইহুদি ধর্মও ত্যাগ করেছিলেন। 

Einstein on Blackboard

ফিরে আসি আইনস্টাইনের পড়াশোনার কথায়। স্কুলের ডিপ্লোমা না থাকার ফলে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার দরজা তাঁর কাছে খোলা ছিল না। তিনি ঠিক করলেন সুইজারল্যান্ডে জুরিখ পলিটেকনিকে ভর্তি হবেন, সেখানে স্কুলের সার্টিফিকেট লাগে না। প্রথমবার ভর্তির পরীক্ষাতে তিনি পাস করেননি, সে কথা সব জীবনীতেই দেখি। কিন্তু খুব কম জায়গায় লেখা আছে যে আইনস্টাইন যখন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ষোল, পলিটেকনিকে ভর্তির সাধারণ বয়সের থেকে দু’ বছর কম। শুধু তাই নয়, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের স্কুলের পাঠক্রম এক ছিল না, ফলে বেশ কিছু বিষয় তাঁর কাছে একেবারে নতুন ছিল। তিনি ভর্তির পরীক্ষাতে খুব খারাপ করেছিলেন ফরাসিতে, যে ভাষাটা তিনি মাত্র ছ’মাস পড়েছিলেন। 

তবে পলিটেকনিকের প্রিন্সিপাল নিঃসন্দেহে আইনস্টাইনের মধ্যে কিছু দেখেছিলেন, তাই কুড়ি মাইল দূরের আরাউ শহরে এক বছর পড়াশোনার পরামর্শ দেন তিনি। এই একটি স্কুলে আলবার্ট যে স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, শেষ জীবন পর্যন্ত সেই কথা মনে রেখেছিলেন। এক বছর পরে আইনস্টাইন স্কুলের শেষ পরীক্ষাতে পাস করেন ও জুরিখ পলিটেকনিকে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হন। আঠারো বছর বয়সী আইনস্টাইনের জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। 

মাজা ও ম্যাক্স দুজনেই বলেছেন আইনস্টাইন একা কাজ করতে ভালোবাসতেন, যা পরেও দেখা গেছে। খেলাধূলা বিশেষ করতেন না, পড়াশোনার ব্যাপারে ছিলেন খুবই সিরিয়াস। সারা জীবনই আইনস্টাইনের মনোযোগের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, তাও দুই স্মৃতিকথাতে আছে।

কিশোর আইনস্টাইনই কি তাঁর ভবিষ্যৎ পথ স্থির করে নিয়েছিলেন? আরাউতে পড়ার সময় আইনস্টাইনের লেখা একটা কাগজ পাওয়া গেছে, যেখানে তিনি তত্ত্ব বিজ্ঞান ও অঙ্ককে ভবিষ্যৎ পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। হেরম্যানের ইচ্ছা ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হোক, কিন্তু আলবার্ট তা আগেই নাকচ করে দেন। আইনস্টাইন তাঁর ছোটবেলার দুটি বিস্ময়ের কথা লিখেছেন। প্রথমটি তাঁর চার বা পাঁচ বছর বয়সের এক ঘটনা, এক কম্পাসের চুম্বকশলাকার সারাক্ষণ উত্তর—দক্ষিণ হয়ে থাকা তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। সেই হয়তো চৌম্বক ও তড়িৎ বিষয়ে আইনস্টাইনের আগ্রহের সূত্রপাত। ষোল বছর বয়সী আলবার্ট তাঁর কাকাকে পাঠানো এক প্রবন্ধে ইথার মাধ্যম ও চুম্বক বিষয়ে ভবিষ্যৎ গবেষণার কথা লিখেছিলেন। ঠিক দশ বছর পরে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রের তত্ত্ব থেকে আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন, এবং আপেক্ষিকতাই বিজ্ঞানের জগৎ থেকে ইথার মাধ্যমকে বিদায় করে। দ্বিতীয় বিস্ময়টি হল বারো বছর বয়সে ইউক্লিডের জ্যামিতির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা হল জ্যামিতির তত্ত্ব, এমন জ্যামিতি যা দেখিয়েছিল যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ইউক্লিডের নিয়ম মেনে চলে না।

 

 

তথ্যসূত্র: Autobiographical Notes- Albert Einstein
Subtle is the Lord- Abraham Pais
Einstein- Ronald W Clerk
Einstein for Everyone- Robert L Piccioni
The Relativity Theory Simplified and the Formative Period of its Inventor- Max Talmey
Albert Einstein: Rebellious Wunderkind, Galina Weinstein, arXiv:1205.4509 [physics.hist-ph]

 

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Flickr, Public Domain 

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি বর্তমানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে সত্যেন্দ্রনাথের একটি ছোট জীবনী।

One Response

  1. অশেষ ধন্যবাদ এ লেখার জন্য । দুয়েকটা কথা –
    আইনস্টাইন ১৬ বছর বয়েসে জারমান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন, দু বছরের মধ্যে সুইস পাসপোর্ট পান। ১৯১৪-১৯৩৩ তিনি প্রাশিয়া তথা জারমান নাগরিক ছিলেন। হিটলারের অভ্যুদয়ের সঙ্গে জারমান নাগরিকত্ব ত্যাগ করে স্টেট লেস হন। আমেরিকান পাসপোর্ট পাবার আগে অল্পদিনের জন্য আলবানিয়ান পাসপোর্ট , তারপর আমেরিকান।
    নোবেল পুরস্কার ১৯২২ সালে ( ছাপার ভুলে ২০২২)

    ঈশ্বর নিজেও পাশা খেলেন না মন্তব্যটি মাক্স বর্নকে লেখেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com