(Bengali New Year) পয়লা বৈশাখ ১৪৩২। প্রতি বছরের মতো এবছরেও সারাবিশ্বের বাঙালি অসীম আগ্রহে অপেক্ষারত। পুরনো হিসেব নিকেশ ঋণ মিটিয়ে নতুন শুরু। জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে চলার আর এক নতুন উদ্যম। নতুন জামাকাপড়, সাজানো বাড়ি, নিকোনো উঠোন, নতুন ধানের গোলার সাথে বাঙালির রান্নাঘরও সেজে ওঠে নতুন পদ নিয়ে।
প্রবল গরম আর পেট পুজো, দুটোই মাথায় রেখে আজকের বেশির ভাগ পদ। সৌজন্যে রেণুকা দেবী চৌধুরানী। স্বাদে গন্ধে বর্ণে মন ভালো করে, শরীরও ঠান্ডা রাখে। রেণুকা দেবী চৌধুরানী বাঙালি রান্নার জগতে এক অনন্য নাম! কথায় বলে মাছে ভাতে বাঙালি। সেই আমিষ আধিক্য বাঙালির রান্নাঘরে নিরামিষ রান্নাও যে তার স্বাদ আর বিপুল বৈচিত্র্য নিয়ে স্বগরিমায় এক শিল্প উঠতে পারে, তার উদাহরণ ওঁর রান্নার সঙ্কলন। যে রান্না খেয়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু থেকে সরোজিনী নাইডু পর্যন্ত মুগ্ধ ছিলেন। যাঁর রান্নাঘরের পরীক্ষাগারে অনায়াসে স্থান পেয়েছে, দেশি বিদেশি ও নানান ধর্মে থেকে সোৎসাহে শিখে নেওয়া হরেক রকমের রান্না। আজ নববর্ষের রান্নায় রইল তাঁর রান্নাঘরের ছোঁয়া। কিছু হারিয়ে যাওয়া, কিছু খুঁজে পাওয়া মণিমাণিক্য…সঙ্গে আরও অন্যান্য। (Bengali New Year)

বাঁধাকপির শুভ্রানী
যদিও বাঁধাকপি মূলত শীতকালের সবজি, কিন্তু এখন সব সবজিই সারাবছর পাওয়া যায়। এই রান্নার মন প্রাণ ঠান্ডা করা শুভ্র রং এবং স্বাদটি গরম কালের জন্যে বড়ই উপযোগী।
বাঁধাকপির ভিতরের সাদা পাতা ৩০০-৩৫০ গ্রাম মতো
কচি কড়াইশুঁটি বড় ২ চামচ
ময়দা মাঝারি ১ চামচ
নুন স্বাদমতো
চিনি দেড় চা চামচ
ফোড়নের জন্য কালো জিরে ১/২ চা চামচ
তেজপাতা দুটো
গোটা গরম মশলা থেঁতো করে নেওয়া (ছোট এলাচ ২, ফুল ফেলে দেওয়া লবঙ্গ ২, দারচিনি ছোট ৩/৪ টুকরো)
ঘি সামান্য
তেল

বাঁধাকপির পাতা কেটে কুচো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। তেল গরম করে, তাতে বাঁধাকপির পাতা আর সামান্য নুন দিতে হবে। বেশ করে বাঁধাকপির পাতা কষে আঁচ থেকে নামিয়ে রাখতে হবে। খেয়াল থাকে যেন পাতা গুলো লাল হবে না মোটেই। (Bengali New Year)
আঁচে কড়াই চাপিয়ে তাতে তেল গরম করে তারপর ঘি দিতে হবে। একে একে, কালোজিরে, তেজপাতা, আর গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে, সুগন্ধ বেরোলে তাতে বাঁধাকপির পাতাগুলো দিয়ে দিতে হবে, আর সঙ্গে কড়াইশুঁটিও। আন্দাজ মতো নুন আর চিনি দিয়ে ভালো করে নেড়ে নিয়ে জল দিয়ে ঢাকা দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে। কপি সেদ্ধ হলে, আর জল টেনে গেলে, দুধে ময়দা গুলে ঢেলে দিয়ে নেড়ে নিতে হবে। এই রান্না সাদা রঙের ফ্রেশ দেখতে, এবং কিঞ্চিৎ মিষ্টি স্বাদের হয়। (Bengali New Year)
ডাবের শাঁসের কৌড়া
ডাবের শাঁস
সামান্য সর্ষে
স্বাদমতো নুন
চিনি
কালোজিরে
কাঁচা লঙ্কা
তেল

ডাবের শাঁস ছেঁচে নিতে হবে। সর্ষে একটু নুন আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বেটে রাখতে হবে।
তেলে কালোজিরে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, ডাবের মালার শাঁস দিতে হবে। নরম আঁচে নরম ভাজা করে, সর্ষেবাটা দিয়ে নেড়ে নিয়ে নামাতে হবে। এই পদ গরম ভাতে আর গরমকালে অসাধারণ লাগে! (Bengali New Year)
ছানার মৌল
২৫০ গ্রাম জল ছাড়া ছানা
১/২ মালা নারকেলের দুধ
১/২ চামচ ময়দা
ছোট এলাচ ৩টি
দারচিনি ২ ইঞ্চি মতো ছোট টুকরো করা
ফুল ফেলা লবঙ্গ ৩/৪ টি
তেজপাতা ৪/৫ টি
আদা কুচি বড় ১ চামচ
দুটো কাঁচা লঙ্কা কুচানো
স্বাদমতো নুন
সামান্য চিনি
ঘি বড় ১ চামচ

ছানা কাপড়ে বেঁধে কোনও ভারী জিনিস চাপা দিয়ে ভালো করে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। তারপর চাপা তুলে চৌকো করে কেটে রাখতে হবে। নারকেল কোরা থেকে দুধ বের করতে হবে। প্রথমে চেপে নিয়ে তারপর ১ কাপ গরম জল দিয়ে সেটা ভালো করে চেপে চেপে অবশিষ্ট দুধ বের করতে হবে। ওই জল সমেত দুধে ময়দা গুলে নিতে হবে ভালো করে, যাতে ডেলা না থাকে। তেজপাতা দিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল দিতে হবে।
একটু ঘন হলে নামিয়ে, গরম মশলা, আদা কুচি, নুন, মিষ্টি, ছানার টুকরো, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে অল্প ফুটিয়ে, নারকেলের প্রথমে বের করা গাঢ় দুধটা দিতে হবে। অন্য কড়াইতে ঘি দিয়ে, তাতে আদার কুচি ভেজে ওই ছানার পাত্রে ঢালতে হবে। অল্প সময় দমে রাখতে হবে। ওপরে ঘি ভাসা আর মাঝারি ঘন হবে এই মৌল । চাইলে ছানার বদলে পনির আর সঙ্গে একটু নৈনিতাল আলুও দেওয়া যেতে পারে প্রথমের দিকে, যাতে সুসেদ্ধ হয় আলু। (Bengali New Year)
কমলা ডাল
এখানে বলে রাখি, কমলালেবু যদিও এখনও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, তবুও হাতের কাছে না পাওয়া গেলে প্যাকেট করা ন্যাচারাল কমলার পাল্প কিংবা রস পাওয়া যায়, তাই দিয়েও এই ডাল সুস্বাদু হবে দারুণ ।
ভাজা সোনামুগ ডাল ২৫০ গ্রাম
১/২ লিটার দুধের ছানা, জল ঝরিয়ে ১৫/১৬ টুকরো করা
২টো কমলালেবুর খোসা ও সাদা অংশ ছাড়িয়ে নেওয়া কোয়া
১০/১২ টুকরো আলু, ছানার মতো করে কাটা
ঘি বড় ২ চামচ
আদাকুচি বড় ১ চামচ
চেরা কাঁচা লঙ্কা ৮/১০ টা
২/৩ টে ছোট এলাচ
৩/৪ ছোট টুকরো দারচিনি
১ চা চামচ জিরে
সামান্য মৌরি
শুকনো লঙ্কা ১টা
তেজপাতা ২/৩ টে

নুন দিয়ে ভালো করে ধোয়া ডাল সেদ্ধ করতে দিতে হবে। কড়াইতে ঘি দিয়ে, আলু আর ছানার টুকরো আলাদা আলাদা করে হালকা লাল করে ভাজতে হবে। ডাল খানিকটা সেদ্ধ হয়ে এলে, হালকা ভাজা আলু,আদাকুচি আর মিষ্টি দিতে হবে। অন্য একটা পাত্রে বাকি ঘি দিয়ে, তাতে শুকনো লঙ্কা, জিরে মৌরি বাকি আদাকুচি তেজপাতা সব দিয়ে হালকা সুগন্ধ হলে ডালে ঢেলে দিতে হবে। ফুটে উঠলে, ভাজা ছানা আর বীজ ছাড়ানো কমলালেবুর কোয়া আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে দিতে হবে। আঁচ কমিয়ে সামান্য ফুটলেই তৈরি কমলা ডাল। (Bengali New Year)
মাছে ভাতে বাঙালি, আবার পয়লা বৈশাখ। ঠাকুরবাড়ির কোনও রান্না না হলে চলে? প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর স্মরণ নিলাম মাছের স্বাদের সন্ধানে। (Bengali New Year)
বাঙালির হেঁশেল থেকে উঠে এসেছে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, ইন্দিরা দেবী, কিংবা রেণুকা দেবীর নাম। নথি হয়েছে অনেক হারিয়ে যাওয়া পুরনো দিনের রেসিপি। অন্যদিকে হয়তো অগোচরে রয়ে গেছে কিছু মা দিদিমাদের রান্না। সংসারের চাপে, কাজের তাড়ায়, নথি হিসেবে লেখা হয়নি সেসব।
মাছের হিঙ্গি
আলু ২টো (প্রত্যেকটা ৬/৮ টুকরো করে কাটা)
কাঁচকলা ১টা (১২ টুকরো করে কাটা)
বড়ি ৬/৮ টা
ধনে ১ টেবিল চামচ
হলুদ ১ চামচ
শুকনো লঙ্কা ৩টে
তেজপাতা ৩টে
দই ২ বড় চামচ
নুন স্বাদমতো
জিরে ১ চামচ
হিং ২৫০ মিলিগ্রাম
ছোট এলাচ ২টো
লবঙ্গ ৩টে
দারচিনি ১ ইঞ্চি টুকরো করে নেওয়া
তেল ৪/৫ বড় চামচ
ঘি ১ মাঝারি চামচ
আদাবাটা ১ চামচ
মাছ ৭/৮ টুকরো
জল ১/২ লিটার

ধনে হলুদ আর শুকনো লঙ্কা বেটে রাখতে হবে।গরম মশলা এক সাথে ভালো করে পিষে রাখতে হবে। হিং জলে গুলে রাখতে হবে। তেল গরম করে বড়িগুলো ভেজে তুলে রেখে তাতে আলু আর কাঁচকলা টুকরো ভেজে নিতে হবে। বাকি তেলে মাছগুলো নুন হলুদ মাখিয়ে ভেজে রাখতে হবে। তারপর তাতে জল দিয়ে ফুটতে দিতে হবে। সব সুসিদ্ধ হলে, নুন দিয়ে ফেটানো দই দিতে হবে। আরও মিনিট চার ফুটলে নামিয়ে নিতে হবে। (Bengali New Year)
অন্য একটি পাত্রে ঘি গরম করে তাতে জিরে তেজপাতা আদা ও হিং দিতে হবে, তারপর মাছ আলুগুলো দিয়ে সাঁতলাতে হবে। শেষে গরম মশলা বাটা দিয়ে নেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা দিয়ে নামিয়ে রাখতে হবে। তাহলেই তৈরি মাছের হিঙ্গি! (Bengali New Year)

বাঙালির হেঁশেল থেকে উঠে এসেছে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, ইন্দিরা দেবী, কিংবা রেণুকা দেবীর নাম। নথি হয়েছে অনেক হারিয়ে যাওয়া পুরনো দিনের রেসিপি। অন্যদিকে হয়তো অগোচরে রয়ে গেছে কিছু মা দিদিমাদের রান্না। সংসারের চাপে, কাজের তাড়ায়, নথি হিসেবে লেখা হয়নি সেসব। বাঙালির রন্ধন গৃহে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার অনেক কিছুই হয়তো হারিয়ে গেছে!
শেষ নিরামিষ রান্নাটি আমার মায়ের ডাইরির পাতা থেকে। নামটিও মায়ের দেওয়া। (Bengali New Year)
বেগুন বৈতান
বড়ার জন্যে:
বেগুন দুটো ৩০০ গ্রাম মতন
বেসন বড় ২ চামচ
নুন স্বাদমতো
১ বড় চামচ ভাজা জিরের গুঁড়ো
১ চামচ লঙ্কা গুঁড়ো
১ বড় চামচ আমচুর
স্বাদমতো চিনি
১ বড় চামচ লেবুর রস
ধনেপাতা কুচি ১ বড় চামচ
কালো জিরে ১ চা চামচ (ফোড়নের জন্যে)
গ্রেভির জন্যে:
জিরে ১ চা চামচ
১/২ শুকনো লঙ্কা
১ চামচ টমেটো বাটা
ধনে গুঁড়ো ১ চা চামচ
নুন মিষ্টি স্বাদমতো
সামান্য হলুদ
দই ২৫০ গ্রাম
ভাজা জিরের গুঁড়ো আর ধনেপাতা কুচি (গার্নিশিং-এর জন্য)

বেগুন পুড়িয়ে খোসা বাদ দিয়ে বড়ার জন্য সব উপকরণ গুলো দিয়ে মেখে রাখতে হবে। কড়াইতে অল্প তেল গরম করে কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে বেগুনের মিশ্রণটি ভালো করে নেড়ে, খানিক শুকনো হয়ে এলে নামিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। ঠান্ডা হলে মাঝারি মাপের বল এর আকার দিয়ে নিতে হবে। তারপর সেটি ডুবো তেলে আঁচ গরম করে, আবার কমিয়ে মাঝারি আঁচে ভাজতে হবে । (Bengali New Year)
অন্য একটি কড়াইতে তেল গরম করে, জিরে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, টমেটোবাটা, ধনে গুঁড়ো, নুন, মিষ্টি ও হলুদ দিয়ে, অল্প জল মেশানো আর ভালো করে ফেটিয়ে রাখা দই দিতে হবে। দই দিয়ে একটু কষে নিয়ে ভেজে রাখা বড়া দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে আঁচ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিতে হবে। জিরে ভাজার গুঁড়ো আর ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে।(Bengali New Year)
ভিনদেশি রান্না হোক বা বাঙালি পুরনো রান্না, ভাবতে অবাক লাগে বহু যুগ ধরে নানান পরীক্ষায় নানান হেঁসেলে কীভাবে বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা যোগ উঠে এসেছে। বাঁধাকপির শুভ্রানী, ছানার মৌল হোক বা বিদেশের হোয়াইট সস, রান্নাঘরেই আবিষ্কার হয়েছে ময়দা জলে গুলে যত গরম হতে থাকে তত জল শোষণ করে জিলেটিনাইজেশন করে ফেলে। আর তারপর যত ঠান্ডা হবে তত জেলির আকার নেবে। সেইমতো, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জল আর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তরকারির প্রয়োজন মতো ঘনত্ব নিয়ে আসা। ফলিত বিজ্ঞান তো একেই বলে! (Bengali New Year)
পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে বাংলার সেই সব রন্ধনশিল্পীদের এবং তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষাকে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই। (Bengali New Year)
ছবি সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।