সুমিতাভ থেমে থেমে চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্রের কথা বলছিলেন। শুনুন অনুতোষ, সেই প্রবল চৈত্র দুপুরে কী হয়েছিল। সেই শেষ বসন্তবেলায় বছর কুড়ির তরুণী তাকে বারবার বলেছিল, না চঞ্চলদা, না, আমি পারব না, ক্ষমা করুন, আপনি শুভাননকে ছেড়ে দিন, ওর চাকরি খেয়ে নেবেন না।
আমি তো এই কথা শুনতে আসিনি। বুক উঁচিয়ে বছর পঁচিশের যুবক বলেছিল, আমি তোমাকে ভালবাসি, আমার প্রথম পোস্টিং ইওরোপের কোনও দেশে হবে, তুমি ভাব, আমরা টেমস নদীর ধারে ঘুরব, অ্যাভন নদীর ধারে সেক্সপিয়রের বাড়ি, নাট্যশালা, প্যারিস, আইফেল টাওয়ার, রোম, মিলান…।
লোভ দেখবেন না চঞ্চলদা, ভালবাসা কি ওইসব দ্যাখে? মঞ্জরী বলেছিল।
চঞ্চল বলেছিলেন, ভুল করছ তুমি, খুব ভুল করছ, সেটেলমেন্ট অফিসের ক্লার্ক, ওর ভবিষ্যৎ কী ?
কার ভবিষ্যৎ কী তা কি কেউ জানে, আপনি কি জ্যোতিষচর্চা করেন ?
ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন চঞ্চল। বলেছিলেন, ক’দিন বাদে বুঝতে পারবে কী চর্চা করি।
তারপর আর দেখা হয়নি। কিন্তু চঞ্চল ভোলেননি মঞ্জরীকে। চঞ্চল মায়াময় স্বপ্নের ঘোরে উঠে বসতেন। কলকাতা, দিল্লি, কাবুল, নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস……চঞ্চল ঘুমের ঘোরে খুঁজতেন তাঁকে। তবু তার ভিতরে জীবন চলতে লাগল। বয়ে যেতে লাগল। একদিন তিনি মহাতীর্থ জেরুজালেম পৌঁছলেন।
জেরুজালেম শহরে আল-ফারাবি হোটেলের সেই রাত ভুলবেন না। দুর্মর ইচ্ছে হলো মঞ্জরীর কাছে মার্জনা চেয়ে নেন। ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অনুতাপ করেন। অনুতাপ, পাপ স্বীকার এসব খ্রিষ্ট ধর্মের রীতি, কিন্তু চঞ্চলচন্দ্রর মনে হয়েছিল জেরুজালেমে থেকে মার্জনা প্রার্থনা করলে ঈশ্বর, তিনি যদি থাকেন তা তিনি মঞ্জুর করবেন। মঞ্জরী টের পাবে, তাকে যে ভালোবাসত, সে অনুতপ্ত একটি মৃত্যু এবং অপমানের জন্য। সে মার্জনা চাইছে।
সুমিতাভর কথা শুনতে শুনতে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম, চাপা গলার গর্জন শুনলাম নিজের কানে, ছিহ, লোকটা তো পাপী। খুনি।
প্রেমে এবং যুদ্ধে এসব হয়, নৈতিকতা দিয়ে বিচার হয় না। সুমিতাভ বললেন।
আমি বললাম, না হয় না, একটা ছেলে সুইসাইড করল, উফ কী ভয়ঙ্কর!
সুমিতাভ বললেন, আপনি কি শুনবেন বাকিটা?
শুনব কিন্তু এসব কথার সত্যতা কোথায়, চঞ্চল কি বলেছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
গল্পের কি সবটাই ঘটে, গল্প আসে কল্পনা থেকে, বলেছেন কি বলেননি, তা অপ্রাসঙ্গিক। সুমিতাভ বললেন, আমি আমার নতুন গল্পটি আপনাকে শোনাতে ডেকেছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি প্রেমের গল্প লিখছেন না নারী দখলের গল্প লিখছেন ?
তারপর আর দেখা হয়নি। কিন্তু চঞ্চল ভোলেননি মঞ্জরীকে। চঞ্চল মায়াময় স্বপ্নের ঘোরে উঠে বসতেন। কলকাতা, দিল্লি, কাবুল, নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস……চঞ্চল ঘুমের ঘোরে খুঁজতেন তাঁকে। তবু তার ভিতরে জীবন চলতে লাগল। বয়ে যেতে লাগল। একদিন তিনি মহাতীর্থ জেরুজালেম পৌঁছলেন।
দখল হতে পারে, প্রেমও হতে পারে, প্রেমে কি দখল থাকে না? সুমিতাভ বললেন।
এসব মধ্যযুগে ঘটত। ডুয়েলে আহ্বান জানাত পরস্পরকে। পিস্তল তাক করে আছে একে অপরকে। কিন্তু এই চক্রান্ত করে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া, একে ঘৃণা না করে পারা যায় ? আমি বললাম। জবাব দিলেন না সুমিতাভ।
তখন অন্ধকার নেমে আসছে এই শহরে। ফিসফিসে বৃষ্টি নামল হয়ত। ব্যালকনির সামনে পার্শ্বনাথের মন্দিরের আলো জ্বলে গেছে। আলোয় বৃষ্টির রেখা ঝিকমিক করতে লাগল। মেঘের গুরুগুরু শোনা গেল। সুমিতাভও ব্যালকনির উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। আমি বললাম, চলুন ভিতরে যাই।
কেন এখানে নয় কেন? সুমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন।
আপনি কি পার্শ্বনাথ জীউকে সাক্ষ্য রেখে একটা পাপের কাহিনি শোনাতে চান। আমি আবার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছি, এসব কথা বন্ধ ঘরে বলতে হয়।
সুমিতাভ বললেন, তা কেন, আপনি যদি না শুনতে চান না শুনতে পারেন, আমি আপনাকে একটি গল্পের জন্ম কীভাবে হয় শোনাতে ডেকেছিলাম।
আমার ভাল লাগছিল না। আমি উঠে এলাম। সুমিতাভ আমাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আপনি ভুল ভাবছেন, কাহিনি এখানে শেষ নয়।
দরজায় দাঁড়িয়ে আমি বললাম, সুইসাইড তো হয়েছিল, প্রেমিক অপমানিত এবং ধিকৃত হয়ে নিজেকে মেরে ফেলেছিল তো, একটি প্রেমের করুণ পরিণতি হয়েছিল।
তখন বাইরে বৃষ্টি এল জোরে। আমি ছাতা আনিনি। সুমিতাভ হেসে বললেন, আমার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন কেন, আপনি কি তলস্তয়ের রেজারেকশন পড়েছেন ?
ভিতরের বিরক্তি চেপে মাথা নাড়লাম, একটি যুবক ভালবেসেছিল এক যুবতিকে, পরিণতি আত্মহনন, তলস্তয় দিয়ে তা চাপা দেওয়া যায় ? বললাম, পড়িনি মনে হয়, পাবার পড়তেও পারি, মনে নেই।
ভিতরে আসুন। সুমিতাভ আমাকে ডেকে নিলেন। এবার আর ব্যালকনিতে নয়, তাঁর স্টাডিতে নিয়ে বসালেন। দেওয়ালজুড়ে অনেক বই সেখানে। লেখকের ঘর এমনিই হয়। চা এল। সুমিতাভর স্ত্রী বন্দনা মৈত্রর সঙ্গে পরিচয় হল। তখন বেশ বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বন্দনা আমাকে বললেন, আপনার কথা অনেক শুনেছি, এই একটি গল্প, যেটির প্রথম পাঠক আপনি, আমি পড়িনি।
চুপ করে আছি। আসলে আমি লজ্জিত বোধ করছিলাম। অতটা প্রতিক্রিয়া না দেখাতেই পারতাম। সুমিতাভ একজন মানী লেখক। তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি শোনাতে ডেকেছেন আমাকে, আমার তো ধন্য হওয়া উচিত। আমি নিজে শ্যামাশ্রীকে নিয়ে লিখব ভেবেছি, কিন্তু পারব কি না জানি না। লেখার জন্য দক্ষতা দরকার হয়, আমার তা আছে কি না আমি জানি না। আমি বললাম, আপনি তলস্তয় নিয়ে কী বলছিলেন যেন, আমার তেমন পড়া নেই, তবে একটা লোক কত পাপ করেছে, মৃত্যুর আগে তা…।
ইভান ইলিচের মৃত্যু, পাপী তো অনুতাপ করেছিল। সুমিতাভ যুক্তি সাজালেন।
অনুতাপে পাপস্খলন হয় না। আমি বললাম, কত বড় অন্যায় করেছিল, হি ইজ আ মার্ডারার, নীলমাধবের কথা তাহলে ঠিক, লোকটা সন্দেহজনক, ওর একটা অন্ধকার অতীত আছে সত্যি।
রেজারেকশন উপন্যাস আমি আপনাকে পড়তে দেব, পড়ুন, বুঝবেন সত্যিকারের পুনরুত্থান হয় কী ভাবে। সুমিতাভ তাঁর বইয়ের তাকে গেলেন। বইটি খুঁজতে লাগলেন। আমি মনে করতে লাগলাম কোন বই হবে সেইটা? সেই যে একটি মেয়েকে যৌবনকালে নষ্ট করেছিল কাউন্ট, তারপর বহুদিন কেটে গেল…মেয়েটি অপরাধী হয়ে কাঠগড়ায় এল। কাউন্ট তাকে চিনতে পারলেন…আবছা মনে পড়তে লাগল। কিন্তু তার সঙ্গে চঞ্চলচন্দ্রকে মেলাব কী করে। উপন্যাস আর জীবন এক হয় না কি? তাহলে সমস্ত ধর্ষক ও হত্যাকারীকে মুক্ত করে দিতে হয়, হিটলার কি অনুতাপ করেছিল অত ইহুদি হত্যার জন্য, ভেবেছিল কি নাৎসি ক্যাম্পগুলিকে অনাথ আশ্রম করে তুলবে, যুদ্ধে জার্মানি না হারলে আরো নরহত্যা হত। আমি এতসব ভাবতে পারছি যে তাতে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি।
বৃষ্টি কমে এসেছিল বাইরে। সুমিতাভ তাঁর কাহিনি বলে যাচ্ছেন। তিনি চমৎকার গল্প বলতে পারেন। আমার আচমকা মনে হলো ধুয়ে যাচ্ছে, সব ধুয়ে যাচ্ছে। পাপপুণ্য সব ধুয়ে যাচ্ছে। আবদাল্লাকে চঞ্চলচন্দ্র নিজের ঘরে নিয়ে এলেন নাকি পাকাপাকি? তাহলেও কি সেই আত্মহত্যার গ্লানি তিনি কাটাতে পারবেন ? তিনি আর বিয়ে করেননি আত্মগ্লানিতে। নিজেকে শুদ্ধ করতে চেয়েছেন সারাজীবন ধরে। কিন্তু সব কি সত্য বলছেন চঞ্চলচন্দ্র ? এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষকে কে সহ্য করতে পারে ? তাঁর বউ তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে তা হতে পারে। হয়ত তিনি শুনেছিলেন যৌবনে চঞ্চলচন্দ্রর কীর্তির কথা।
সুমিতাভ বলছিলেন, পুরোন জেরুজালেমে, চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকর, টম্ব অফ দ্য ক্রাইস্ট যাকে বলা হয়, সেই জায়গাই গলগাথা বলে অনুমান করা হয়।
রেজারেকশন উপন্যাস আমি আপনাকে পড়তে দেব, পড়ুন, বুঝবেন সত্যিকারের পুনরুত্থান হয় কী ভাবে। সুমিতাভ তাঁর বইয়ের তাকে গেলেন। বইটি খুঁজতে লাগলেন। আমি মনে করতে লাগলাম কোন বই হবে সেইটা? সেই যে একটি মেয়েকে যৌবনকালে নষ্ট করেছিল কাউন্ট, তারপর বহুদিন কেটে গেল…মেয়েটি অপরাধী হয়ে কাঠগড়ায় এল।
হুঁ, গলগাথায় যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল জানি, পড়েছিলাম, ভুলে গেছি, সারাজীবনে কোথাও তেমন যাওয়া হয়নি, বিদেশ তো দূর অস্ত, আপনিও কি জেরুজালেম গেছেন কখনও? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মাথা নাড়লেন সুমিতাভ, বললেন, “না, একবার আমেরিকা মাস দেড়ের জন্য, একবার রাশিয়া পাঁচ দিনের জন্য, তা বাদে আর কোথাও না, বই পড়ে জেনেছি, সেই জানাও কম জানা নয়।” চুপ করে থাকলেন সুমিতাভ কিছু সময় তারপর বললেন, চঞ্চলচন্দ্র পুরোন জেরুজালেমে গলগাথা খুঁজে বের করতে পবিত্র গির্জায় গিয়েছিলেন, যিশুকে ওখানেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, সে ছিল পুণ্য শুক্রবার, গুড ফ্রাই ডে, তার তিন দিনের মাথায় ইস্টার মান ডে, সোমবারে তিনি পুনরুত্থিত হন, পবিত্র গির্জায় গিয়ে নিজের ভিতরে জেরুজালেম সিনড্রোম অনুভব করেন তিনি, ধর্ম কী, যা মানুষকে ধরে রাখে, সব ধর্মই মানুষের মঙ্গলকামনা করে। কিন্তু নিজের ধর্ম শ্রেষ্ঠ, এই অজুহাতে অন্য ধর্মের মানুষকে মানুষই খুন করে। মানুষের অন্তরই অন্যের মৃত্যু কামনা করে। অন্তরে পাপ এবং পুণ্যের দুই আত্মা পাশাপাশি বাস করে। বহুদিন বাদে আবার চঞ্চলচন্দ্রের মনে পড়ে যায় মঞ্জরী ও শুভাননের কথা। এই প্রথম মনে হয় শুভাননকে তিনিই হত্যা করেছেন। তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন শুভাননের মৃত্যু হোক। সে যেভাবে হয় হোক, দুর্ঘটনায়, সর্প দংশনে, অসুখে, অজানা জ্বরে, মৃত্যু ঘটুক। তাঁর সেই ইচ্ছাপূরণই হয়েছিল। তিনি এক খুনি, যে খুনের কোনো বিচার হয়নি। পবিত্র গির্জার দেওয়ালে মাথা রেখে তিনি অশ্রুপাত করেন, তারপর আল-ফারাবি হোটেলে রাত জেগে মঞ্জরীকে খুঁজতে থাকেন ফেসবুকে। পেয়েও যান।
ভগবান এই ভয়ঙ্কর ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন, আশ্চর্য, সে কেমন ভগবান। আমি আবার ক্রুদ্ধ হলাম।
ঘটনা ঘটেছিল, ভগবান ঘটান তা, না ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় ঘটে, তা বলবে কে? সুমিতাভ বললেন, অবশ্য এসব কথা চঞ্চলচন্দ্রর।
ভগবানের দোহাই দেয় মানুষ, হত্যা করে নিজে, ঈশ্বরের অভিপ্রায় বলে কিছু হয় না, হত্যার কোনও সাফাই হয় না, তবে তিনি যে বুঝতে পেরেছেন সেই মৃত্যুর দায় তাঁর, এইটি আপনার গল্পে ভাল করে আসুক। আমি বিজ্ঞের মতো বললাম। আমার মনে হচ্ছিল শ্যামাশ্রী আমার মুখে কথা জুগিয়ে দিচ্ছে, এত কথা বলার মানুষ আমি নই। শ্যামাশ্রী আমাকে সাহস জোগাচ্ছে। মঞ্জরীর কথা বলছেন সুমিতাভ।
অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।