ঘর ও ছাত: পর্ব ১
৩
ঢালাই হয়ে গেছে। জগন্নাথ মিস্ত্রি কথা রেখেছে। কনট্রাকটর হিসেবে পাক্কা। ভাল কানেকশনে পেয়েছিলাম। আমার কাজে ফাঁক নেই। অডিটি অর্গ্যানাইজেশনের হুগলি নদীর ওপর জেটি ঢালাই করেছে এই মিস্ত্রি। সোজা কথা নাকি! এসব ছোটখাট বাড়ি বানানোর কাজ ও করেই না।
সেবার অডিটে শাটারিংয়ের ওপর পয়েন্ট ধরেছিলাম। আয়লায় শাটারিং ভেসে গেছে বলে দুবার শাটারিংয়ের টাকা পেয়েছিল জগন্নাথ কনট্রাকটর। সেই দুটো টাকা সরকারের ঘর থেকে বেশি গেছিল বলে প্যারা খেয়েছিল সরকারি দফতর। একটা জেটি ঢালাই, তাতে কত দিকে কত পারসেন্টেজ যায়। তার ওপর একটা আয়লা, একটা আমফান হলে তো কথাই নেই। আমি প্যারা দিলাম বলে প্যারা ডিসকাস করার মওকা পেলাম। অফিসার এল, অফিসারের তস্য অফিসার এল। তার নীচের কনট্রাকটরও আমার বাড়িতে এল। মিতুলের জন্য শাড়ি এল, আমার জন্য বাদাম, পেস্তা, কিসমিসের ভেট। কানেকশন তৈরি হল, মোদ্দা কথা।
তাবলে ঘুষ খেয়ে প্যারা আমি ড্রপ মোটেই করিনি। আমাদের এজি সাহেব, সাউথ থেকে আসা, কলকাতার ওয়র্ক কালচার নিয়ে খোঁটা দিত। বলত, আমি কি জানি না এজি অফিসের পেছনদিকের জিরো মাইলস রেস্তোরাঁতে প্যারা ড্রপ হয়, প্রতি ড্রপ হওয়া প্যারায় এক লাখ দু’লাখ। কোথায় এসব দেখেছেন, কে জানে। চেন্নাই ফেন্নাইতে হবে হয়তো। এখানে প্যারার দাম এক লাখ! ঘোড়ায় হাসবে কত্তা। এখানে জিরোমাইলস-এ এক পেগ বড়জোর। তাতেই কাজ।
আর প্যারা ড্রপ কেন? ধীর, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু তো আছেই তার কপালে। দশ বছর ইনস্পেকশন রিপোর্ট ঝুলবে, তারপর নতুন এক এজি এসে সেটা ড্রপ করে দেবে। এভিডেন্সে খামতি থাকলে প্যারা কোথাও যাবে না। ব্রহ্মাণ্ডে ঝুলে থাকবে। এ শর্মা জানে ড্রিবল করতে। ছোটবেলায় ফুটবল খেলা ভালো লাগত। ফুটবলের কথাটা আজ রাতে মনে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে। সেই কাদামাখা পা। সেই সবুজ ঘাস। ছেলেদের দঙ্গল। আসছেই।
আরও পড়ুন: অবন্তিকা পালের গল্প: অবরোহণ
অফিসের বাঁড়ুজ্জেদা প্রথমদিন আমার জাত জিগ্যেস করেছিল। আমি যে গাঁয়ের ছেলে, জেনে নিয়েছিল। এইসব জেনে দেখে বুঝে ঘাঘু হয়ে গেলাম। ওরা আমাদের বাইরে বাইরে রাখতে চায়। অন্দরে আসতে দিতে চায় না। আমাদের ঈর্ষাও করে। বাঁড়ুজ্জেদা সারাজীবনে ক্লার্ক থেকে অডিটর পর্যন্ত উঠেছিল। নাটক করাত, গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তিও। আমার মতো তরতর করে ওপর দিকে ওঠার ধক ছিল না তো। শহুরে, আতুপুতু মাল সব। নিজের ব্রাহ্মণ্য গর্বে আর নিজেদের শহুরে, তিন প্রজন্মের পড়াশুনোর গরমে, কোনওদিন সেকশন অফিসারের পরীক্ষাটাই দিয়ে উঠতে পারল না। কী ফালতু ঘ্যাম নেওয়া মাইরি। ওসব অফিসার টফিসার হব না। চিরদিন নীচে থাকব।
আমি অবশ্য নীচে থাকিনি। ক্রমশ উঠেছি। খালে বিলে সাঁতার কাটা হাড়গোড় আমার। রোদ্দুর খাওয়া কালো তামাটে চেহারা। শরীরে ক্যালশিয়াম আর ভিটামিন ডি, কোনওটার কোনও অভাব হয়নি কোনওদিন।
আজ মঞ্জু ফিশফ্রাই করেছে। মিতুল করিয়েছে। কিন্তু মিতুল আমাকে ঘেন্না করে তো… ও নিজে দিতে আসবে না। এসেছিল ছুটকি। আমার ঘরে এসি চলছে। ছুটকি বলল, বাইরে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেছে। নেমে গেছে পারদ। বাবা এখনো এসিতে বসে আছ? ও বলল মেঘে মেঘে আকাশ ঝুলে নিচু হয়ে এসেছিল কেমন। ও নাকি ছাতে উঠে দেখেছে।
ছুটকির আকাশ দেখার বয়স যায়নি। এই মেয়েটাই এ বাড়িতে একমাত্র, আমাকে সত্যি ভালবাসে বোধহয়। ওকে বললাম ঝড়ের সময়ে ছাতে যাবে না ছুটু। বাজ পড়তে পারে। আমি মাঠের মধ্যে বাজ পড়ে ঝলসে মরা মানুষ দেখেছি। আমি গ্রামে আকাশ দিয়ে ধেয়ে আসা ঝড়, বৃষ্টি দুইই দেখেছি। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আমরা ছুটতাম… আহ আহ আহ… চিৎকার করে ছুটতাম… দু’ হাত দুদিকে ছড়িয়ে। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা যাকে ছোঁবে সে হেরো।
এইসব জেনে দেখে বুঝে ঘাঘু হয়ে গেলাম। ওরা আমাদের বাইরে বাইরে রাখতে চায়। অন্দরে আসতে দিতে চায় না। আমাদের ঈর্ষাও করে। বাঁড়ুজ্জেদা সারাজীবনে ক্লার্ক থেকে অডিটর পর্যন্ত উঠেছিল। নাটক করাত, গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তিও। আমার মতো তরতর করে ওপর দিকে ওঠার ধক ছিল না তো। শহুরে, আতুপুতু মাল সব।
আসলে ছোটবেলায় মাঠ ভাল লাগত। মাঠে গেলে আকাশ দেখা যেত তো। ঘর ভাল লাগত না। ঘর ভাল লাগবে কীভাবে? কলকাতায় তো ঘর বলতে কাকার বস্তির ভাড়াঘর। করপোরেশনের টাইমের বারোয়ারি কলে চিৎকার চেঁচামেচি। কমন পায়খানায় লাইন দেওয়া। কাকা কাকিমা খুড়তুতো দুটো ভাই খাটের ওপর। খাট চারটে করে ইট দিয়ে উঁচু করে নীচে হাঁড়িকলসি, চালের বস্তা, এটা ওটার পাশে আমার আর কাকার বড় ছেলেটার ঘুমনো। পাটিসাপটার মতো রোলকরা বিছানাবালিস অন্য সময়ে। রাতে ঘুমের মধ্যে কানের পাশে ইঁদুরের খুটুরখুটুর শুনে ঘুম ভেঙে যেত। মটকা মেরে ঘুমের ভান করে থাকতাম। পরে ভাইগুলোকে আনা করালাম কলকাতায়, তখন তো আরও কষ্ট। কাকা কোনওদিন কিছু বলেনি। কিন্তু হেঁপো রুগি ছিল কাকিমা, আর তেমনি খিটখিটে। জল তুলে দেওয়া থেকে কত কাজ যে আমাকে করে কেতজ্ঞতা শুধতে হয়েছিল।
দেশে যাও, তো দেশের বাড়ির অন্য গল্প। আরও ছোট যখন আমি, কলকাতা আসিনি, তখনকার কথা। ঠাকমা ঘর জুড়ে। সেরিব্রাল। অঙ্গ পড়ে গেসল। একপাশে শুয়ে থাকত। না থাকার মতো। শুধু ঘরময় ঠাকমার গায়ের পাঁচড়ার গন্ধ, হিসিভেজা কাঁথার গন্ধ। অন্য ঘরে চার ভাইবোন আমরা।
আরও পড়ুন: রুনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প: ফুল্লরার চাঁদকথা
মা সারাদিন রান্নাঘরে। শেষবেলায় এসে ঠাকমার ঘরের এক কোণটিতে শুয়ে পড়ত। বাবা শুত দাওয়াতে। মা কত যত্ন করে বাবাকে বিকেল থেকে বিছানা পেতে দিত। বাবা মায়ের সঙ্গে বিশেষ কথা বলত না, শুধু হাতে হুঁকোটি নিয়ে সন্ধে থেকে ঝিম মেরে থাকত। সারাদিনের মাঠের পরিশ্রমের পরে বাবার সারা শরীলে তখন বিষব্যথা। শরীর লিখতে গিয়ে এই দ্যাখো, শরীল লিখে ফেলেছি।
দাওয়ার এক পাশে রাখা থাকত ছনের বেড়ার টুকরো। সেগুলো শীতকালে বাবার মশারির চারদিকে দাঁড় করিয়ে রাখত বাবা। মাঝে মাঝে ঘোর শীতে মায়ের দেওয়া কয়লার আংটা নিয়েও শুত। আমরা ছোটরা জড়াজড়ি করে মেঝেতে পাতা ঢালাও বিছানায় শুতাম। এ ওর কাঁথা নিয়ে টানাটানি করতাম। কাঁথা সব মায়ের শাড়ি দিয়ে বানানো। ঠাকমার শাড়ি, বাবার ধুতি। যাকিছু ছিঁড়ে যেত, কাঁথাতে একটা করে পরত জুড়ত। কাঁথা জিরজিরে হত, আবার পরত দিয়ে দেওয়া হত। একটার ওপর আরেকটা। ভাঁজে ভাঁজে, পরতে পরতে উষ্ণতা।
সেইসব কাঁথার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে মায়ের আর্তস্বর শোনা যেত তবু। মা, সবাই ঘুমোলে বাবার কাছে যেত। ওই দাওয়াতে, বাবার ছন দিয়ে মোড়া মশারির ভেতর। আমি খালি ভাবতাম মাকে বাবা মারে। তাও মা কেন নিজের বিছানা থেকে উঠে ওখেনে যায়। বাবার কাছে যায়। বাবাকে ঘেন্না করতাম। নিচু হয়ে আসা, দিনেও অন্ধকার, রাতে ভীষণ ঠান্ডা অথবা গরম, ঐ ঘরটাকে ঘেন্না করতাম আমি। তাই যত তাড়াতাড়ি পারলাম বাবা মাকে ছেড়ে শহরে পড়তে চলে গেলাম। তারপর ভাইদুটোকেও টেনে নিলাম।
কলেজে উঠে মেসবাড়িতে বেড পেয়েছি। বন্ধু একপাল তো হয়েইছে, অনিকেত বিকাশদের কথা তো আগেই বললাম। ওদের বাড়িতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ি, আড্ডা দিই, ওদের রেকর্ড প্লেয়ারে গান শুনি। ঘুমাই, রাতেও থেকে যাই কখনও বা।
কলকাতায় তো ঘর বলতে কাকার বস্তির ভাড়াঘর। করপোরেশনের টাইমের বারোয়ারি কলে চিৎকার চেঁচামেচি। কমন পায়খানায় লাইন দেওয়া। কাকা কাকিমা খুড়তুতো দুটো ভাই খাটের ওপর। খাট চারটে করে ইট দিয়ে উঁচু করে নীচে হাঁড়িকলসি, চালের বস্তা, এটা ওটার পাশে আমার আর কাকার বড় ছেলেটার ঘুমনো।
অনিকেতদের ঘরেই আমি পেলেপুষে শহুরে হলাম। তবু গা থেকে গায়েরঁ গন্ধ গেল না। মিতুল অনিকেতের বাড়িতেই আমাকে প্রথম দেখেছিল। মিতুল হয়তো আমার প্রেমে না পড়লে বিকাশের প্রেমে পড়ত। আমাকে বিয়ে না করলে বিকাশকেই বিয়ে করত। সুখী হত। শহরের মেয়ে শহুরে ছেলেকে বিয়ে করলে ওর কোনও প্রবলেম হত না। গাঁয়ের ছেলে। আমাকে ও কেন ভালোবাসল কে জানে। ভালোবাসা যখন হয়ে যায়, তখন এমনি করেই ভুল লোকেদের জড়িয়ে দেয়। ভোগের পাকে ফেলে মারে। ঘুরিয়ে মারে। নিজের দড়িদড়ায় নিজে জড়ানো ছাগল ছানার মতো।
আজ আমার মন বাঁধ মানছে না । সমানে পুরনো কথা বলে চলেছি। মঞ্জুউউউউ আমাকে বরফটা আর সালামিটা দিবিইইই? অনিকেত ফোন করেছিল আজ। চিরকালের লুজার হয়ে রইল। সুমন চাটুজ্জেও হতে পারল না। ক্লাস ওয়ান অফিসারও হতে পারল না। মামুলি ইস্কুল মাস্টার। আজকাল ইস্কুলমাস্টাররাও লাখ টাকা মাইনে পায় বটে। তাও তো পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আমার মতন ভারত সরকার না। কষ্ট হয়। আমাকে বলেছিল আমি উঁচু ডালে মই বাঁধছি। ব্যাটা, তোদের সব শহরে জন্মানো নেকুপুষু মালগুলোকে দেখিয়ে দিয়েছি রে আমি কে, কাঁহা সে আয়া ম্যায় হুঁ ডন।
খক খক খক কাশি উঠে আসছে আমার। কাশির সঙ্গে সঙ্গে কেমন বমি বমিও লাগছে। মঞ্জু, মঞ্জু তোর কাকিমাকে ডাক একবার। মিতুল… মিতুউউউল … ও মিতুউউউল… ! মায়ের জন্য আমি বাড়ি বানাচ্ছি… দ্বিতীয় বাড়ি আমার জীবনে। মা, অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম মা, তোমার জন্য আমার প্রথম বাড়িটা বানানো উচিত ছিল। কিন্তু তখন আমি মিতুলের জন্য বানিয়েছিলাম। মিতুল আমাকে ঘর দেয়নি মা।
মিস্তিরিকে ফোন করেছিলাম… ইন্টিরিয়রের কাজ হচ্ছে এবার। ভেতরের কাজে বাইরের থেকে বেশি সময় লাগে। একুশ দিন ঢালাই ফেলে রাখার পর কাজ শুরু করল। শাটারিং খুলল। ছাত তো হয়ে গেছে। এবার বাড়িও হয়ে যাবে। … এনি ডে নাউ। এবার আর আমার লোন নিতে হয়নি। এবার আমার অন্য সোর্স আছে… এতদিন ধরে কি এমনি এমনি সরকারি চাকরি করছি…? গৌহাটিতে মাটি থেকে তেল তোলার কোম্পানি আছে সরকারের কতগুলো,অডিটে যাই তো রেগুলার। ওদের সব ঘাঁতঘোঁত আমার জানা। কী কী ভুল ওরা করবে, তা ধামাচাপা দেবার জন্য কত মাইল মাইল ওরা হেঁটে যাবে। আমার পায়ে কত তেল ঢালবে!
আরও পড়ুন: প্রপা দে-র গল্প: রক্ত
মা, তোমাকে আমার ভেট… তোমার মাথার ওপর একটা ছাত। ঢালাই করা ছাত। গ্রাম ছেড়ে তুমি চলে আসবে মা, আমাদের বাড়ির তিনটে প্লট পরেই তোমার জন্য তোমার বড় ছেলে বাড়ি বানাচ্ছে মা। ভাইরা গ্রামে সেটল হয়ে গেছে। কুটু ট্রেকারের লাইন কিনেছে… পারিজাতের নিজের অত বড় রেশনদোকান আছে…। সবাই সেটল। সবাই সু-উপায়ী। হ্যাঁ, কিন্তু বড়ছেলে ত বড়ছেলেই হয়, না মা? আমার তো কর্তব্য তোমাকে দেখা। তোমার মাথার ওপর ছাতটা করে দেওয়া।
আমার কাশি হচ্ছে। বমি… মঞ্জু… বৌদিকে ডেকে দে… মঞ্জু এসে ব্যাপার দেখে হতভম্ব প্রথমটায়, মুখ তুবড়ে গেছে ভয়ে ত্রাসে বিস্ময়ে। মাল্লু খেয়ে মামা বমি করছে… ঘেন্না পাচ্ছে। মিতুলকে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে দৌড় দিল। ছুটকি দরজা থেকে এসে দেখছে… ভীষণ ভয় পাচ্ছে আমাকে ওরা সবাই, আমি হিক্কা তুলছি… এবার আমি একটু চুপ… থম মেরে পড়ে আছি… মিতুল ছুটে আসছে দুদ্দাড় করে… আওয়াজ পাচ্ছি। ওরা আমাকে দেখে বোধহয় ভেবেছে আমি মরে গেছি। হা হা হাঃ! এখনো এ বাড়ির একমাত্র ব্রেড আর্নার আমি। আমার টাকায় সংসার চলে। আমি মরে গেলে অত সোজা নাকি? মাসে দুবার দাম না দেখেই বিগ বাস্কেট থেকে বাজার অর্ডার করা…। ড্রেসিং টেবিলে রকমারি দেশবিদেশি পারফিউম মেকআপ… বাথরুমে কত ঢংয়ের শ্যাম্পু, কন্ডিশনার…।
মা… মা… তোমার গ্রামের ছেলে শহরে এসে বড় হয়েছে মা… সে মরে গেছে ভেবে রোজ “মর তুই! মর!” বলা মিতুল বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদবে। তোমাকে যেবার দামি ফোন কিনে দিয়েছিলাম সেবার মিতুল বেড়ালের মতো আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছিল… মিতুলের বাবা এখন দামি স্মার্টফোন অ্যাফোর্ড করতে পারে না। মিতুল নিজেকে তৈরি করেনি, চাকরি করার মতো যোগ্যতা ওর ছিল না, তবু আমাকে খোঁটা দেয়, আমি নাকি ওকে চাকরি করতে দিইনি। আমি নাকি ওকে ওর বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে দিইনি, আমার জন্য ওর সংসর্গ ত্যাগ করেছে ওর বাবা-মা…
মা, তুমি আমাকে রোজ স্মার্টফোনে একটা ফোন কর… আজও করবে…। আমার তোমাকে বলতে হবে… আমার সব গ্র্যাচুইটি ফ্যাচুইটির নমিনি তুমি… সব কাগজে তোমার নাম…। কয়েকদিন আগেই চেঞ্জ করিয়েছি মা… মিতুলের নাম আমি সরিয়ে দিয়েছি। আমি মরলে তুমি অনেক টাকা পাবে। বাড়িটা তো হয়েই গেছে প্রায়… বাড়িটায় আমাকেও তোমার সঙ্গে থাকতে দিও একটু মা… আমি তো কোনও বাড়ি পেলাম না কোনওদিন… ঘর পেলাম না…।
মঞ্জু, মঞ্জু তোর কাকিমাকে ডাক একবার। মিতুল… মিতুউউউল … ও মিতুউউউল… ! মায়ের জন্য আমি বাড়ি বানাচ্ছি… দ্বিতীয় বাড়ি আমার জীবনে। মা, অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম মা, তোমার জন্য আমার প্রথম বাড়িটা বানানো উচিত ছিল। কিন্তু তখন আমি মিতুলের জন্য বানিয়েছিলাম। মিতুল আমাকে ঘর দেয়নি মা।
আমি মারা গেলে মিতুল আমার ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে নিজে দখল নেবে। মনে মনে বলবে, মাতাল, মালখোর কোথাকার… মদ খেয়ে খেয়ে শরীরটা নষ্ট করে ফেলেছিল। কারও কথা শুনত না। পরিষ্কার করতে গিয়ে ডাঁই করা কাগজপত্র বেরুবে, সেই নব্বই দশক থেকে জমা করে রাখা। তার ভেতরে জয় গোস্বামীর ‘পাগলি তোমার সঙ্গে’ দেখে মিতুল একটু কাঁদবে। তারপর আবার রাগবে। টেবিলের তলায় গন্ডা গন্ডা খালি মদের বোতল… গু গু গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠবে ওর। এত গরম লাগে আমার, সারাদিন সারারাত দরজা জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে রাখি। জানি মিতুল সব জানালা হাট করে খুলে দেবে। ও এই দরজা জানালা বন্ধ করে রাখা সহ্য করতে পারে না। পুব দক্ষিণ খোলা, সবচেয়ে চমৎকার ঘরটাই দখল করে আছি আমি। মিতুল এখন থাকে উল্টো কোণের ঘরে। পশ্চিম আর উত্তর দিকের জানালা গ্রীষ্মের রোদের জন্য, নয়তো শীতের উত্তুরে হাওয়ার জন্য বন্ধ রাখতে হয়।
হাঁপ, হাঁপ ধরছে আমার। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। মিতুল তোমাকে আমি ঠকাইনি, আমার বুকের ওপরে আছড়ে পড়বে তো বটেই। না… আমি মাইনের টাকা তো তোমাকেই দিতাম সংসার খরচের জন্য। উপরির টাকায় মাল খেয়েছি বেশ করেছি, একা বেড়িয়েছি, এদিক ওদিক অফিস থেকে রেস্তোরাঁতে খেয়েছি। এত বার, এত রেস্তোরাঁ আছে কলকাতা শহরে। সব আমার মতো লোকেদের জন্য টিঁকে আছে আসলে। মিতুল তুমিও, সংসারের টাকা যা দিতাম, মিথ্যে বলবে না, তার থেকেই সরিয়ে তোমার বাবা-মাকে দিয়েছ।
এবার আমি চলে যাচ্ছি মিতুল, তোমাকে মুক্তি দিয়ে গেলাম। ভালো করে ঘটা করে আমার শ্রাদ্ধ করবে। হালকা রঙের তসর পরবে শ্রাদ্ধের দিন… চমৎকার একটা ঘিচা শাড়ি, সঙ্গে বুদ্ধের মুখ প্রিন্ট দেওয়া মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ ব্লাউজ। একটু আলুথালু করে পরা, শোকের ছাপটা যেন থাকে… চোখেমুখে। ঈষৎ এলোমেলো চুলে। কাঁদবে আবার দু’ফোঁটা লোক দেখানো… তারপর এই ঘরটাই দখল করবে। আহা, কী চমৎকার হাওয়া, শুয়ে কত আরাম।
মিতুলকে এখনও যুবতীই বলা যায়। শরীরের বাঁধন টসকায়নি… যদিও পরপুরুষের সঙ্গে নটঘট কখনও করেনি মিতুল। করলে না জানি কী হত… আমি হয়তো মেরেই ফেলতাম গলা টিপে। আমার শরীরের পাশে মিতুলের শরীর তো এইটুকুনি পুঁচকে…! মিতুল জানে না, বাড়ি বানানো শেষ হলেই আমি মায়ের কাছে গিয়ে থাকব। নতুন বাড়ি করেছি। আমি মায়ের পাশেপাশে থাকব। মায়ের পেটের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তো সন্তানের কিসসু করার থাকেনা শেষ পর্যন্ত, কিসসু না। ছুটকিটা, হ্যাঁ ছুটকিটাকেও পারলে নিয়ে যাব…
তোমাকে যেবার দামি ফোন কিনে দিয়েছিলাম সেবার মিতুল বেড়ালের মতো আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছিল… মিতুলের বাবা এখন দামি স্মার্টফোন অ্যাফোর্ড করতে পারে না। মিতুল নিজেকে তৈরি করেনি, চাকরি করার মতো যোগ্যতা ওর ছিল না, তবু আমাকে খোঁটা দেয়, আমি নাকি ওকে চাকরি করতে দিইনি। আমি নাকি ওকে ওর বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে দিইনি, আমার জন্য ওর সংসর্গ ত্যাগ করেছে ওর বাবা-মা।
তবু, আমি হাঁপাচ্ছি। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠে আসছে… ঘরের দরজা ঠেলে দেবদাসের ঐশ্বর্যা রাইয়ের মতো এই যে আলুথালু ঢুকল মিতুল, চেয়ার ঠেলে সরালো, সরাতে গিয়ে পড়ে গেল ছোট প্লাস্টিকের রঙিন টুলটা… ধাক্কা লেগে উল্টে গেল কাচের গেলাস, দেরাজের হ্যান্ডেলে ফেঁসে গেল মিতুলের আঁচল… এক টানে খুলে আসছে বুক থেকে, ভেতরে ঘন কাঁঠালের আঠার মতো ওর লাল ব্লাউজ, ব্লাউজভর্তি বুক।
কতদিন পর মিতুল আমার গায়ের ওপর উপুড় হয়ে… যে ব্যথাটা সারাদিন শুধু কামড়ায়, কুটকুট করে, বিষ ঢালে… সারাগায়ে বিষপিঁপড়ের মতো ছড়িয়ে থাকে… সেই ব্যথা আর নেই। কী ঘন হয়ে আমার ওপর আছড়ে পড়ল ওর আঁটোসাঁটো শরীর… একদম সিনেমার মতো… কতদিন পর… ইশ…!
কলকাতার বাসিন্দা | নব্বই দশকের কবি | কৃতি ছাত্রী | সরকারি আধিকারিক | একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত | উল্লেখ্যোগ্য গ্রন্থের নাম পিশাচিনী কাব্য (১৯৯৮)‚ আবার প্রথম থেকে পড়ো (২০০১)‚ মেয়েদের প্রজাতন্ত্র (২০০৫) | কবিতাগদ্যে মননশীল্‚ গল্পেও স্বচ্ছন্দ |