১
ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল। আলো মরে গিয়ে বেশ ঠান্ডা। এখানে ঈষৎ উঁচুতে দাঁড়িয়ে গাছের মাথা থেকে শিকড়ের দিকে সূর্য নামা দেখা যায়। হঠাৎ হঠাৎ সাদা বক উড়ে যায় পায়ের তলা দিয়ে– তখন সাঁৎ সাঁৎ করে সাইকেল চড়ে কেউ গেল মনে হয় – মাথায় সাদা হেলমেট।
আরও নিচে হ্রদ দেখা যাচ্ছিল – নীলচে রং এখন ঘন বেগুনি। জলের নাকি একটা হিলিং পাওয়ার আছে– রেণু কোথাও পড়েছে। শব্দটা যখন উপশম নয়, হিলিং পাওয়ার – মানে ইংরাজি বইতেই পড়েছিল। কিংবা কোনও কোটেশন– হয়ত হোয়াটস্যাপে। সে যেন পড়েছিল, যত দুঃখ তত জল লাগে হিলিংএর জন্য। কেউ হয়ত টুক করে স্নান করে নিল, কারওর লাগল গোটা সমুদ্র। আপাতত তার মনের কোনও শুশ্রূষার প্রয়োজন ছিল না – জলের দিকে তাকিয়ে একমনে স্মৃতিকে খেলিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল রেণু। সুবর্ণ পাশে দাঁড়িয়ে। কব্জিতে বিয়ের লাল সুতো – হনিমুনে এসেছে ওরা।
বঁড়শিতে স্মৃতির টুকরো টাকরা গাঁথলেই রেণু তা টেনে আনছিল – নেড়ে চেড়ে পরখ করে জলে ফেরত পাঠাচ্ছিল, কিংবা আঁচলে বাঁধছিল, অথবা সুবর্ণর পকেটে ভরে দিচ্ছিল। স্কুলের গেটের সামনের ফুচকা, চুরমুর, হজমিগুলি, বন্ধুরা, ওর তানপুরা, হারমোনিয়াম, ওস্তাদজি, ডোভার লেনে ভোর হচ্ছে– আমজাদ খান সিন্ধু ভৈরবী ধরেছেন – একটা টুকরো শুধু, জলে ফেলছিল অথচ বঁড়শিতে উঠে আসছিল বারবার। একটা ছবি – নেটেই দেখেছিল; ক্যাপশান ছিল – রথস্চাইল্ডস জিরাফ, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। রেণু পড়েছিল, এই জিরাফরা চুপচাপ- নাকি ইনফ্রাসোনিক সাউন্ড দিয়ে কমিউনিকেট করে। ছবিতে জলের সামনে জিরাফ আর অজস্র পেলিক্যান ছিল– যতটুকু জল, তাতে কেবলই পেলিক্যানের ছায়া। জিরাফের প্রতিবিম্ব স্বভাবতই ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে ।
আজ হনিমুনের তৃতীয় দিনে ছবিটা বারে বারে সুতো ধরে টেনে তুলছিল সে । সেই সঙ্গে আরও একটা ছবি – রিসেন্ট।
ওদের বৌভাতের রাতে, ভীড় টীড় যখন পাতলা, লোকজন পান মুখে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে, ডেকরেটরের লোক বালতি গামলা গোছাচ্ছিল আর রেণুকে ফুল সাজানো ঘরে নিয়ে যাচ্ছে ওর ননদ জা; জেঠি শাশুড়ি বললেন, ‘ পিন্টু কোথায় গেল? ‘
সুবর্ণকে কিছু আগে খেয়াল করেছিল রেণু –স্পীকারে তখন মালকোষ – সানাই; রেণুর পাশে সুবর্ণ পোজ দিয়ে ছবি তুলছিল– সামনে সুবর্ণর পিসেমশাই , পিসিমা– গা মা ধা মা গা মা গা সা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হচ্ছিল রেণু। পিসেমশাইয়ের জামাই বলছিল– ‘একটু কাছাকাছি দাঁড়ান বৌদি। ও বৌদি? বৌদি বুঝি গান বাজনা খুব ভালোবাসেন?’
সেই ফোটোসেশনের পরে সুবর্ণকে আর ওখানে দেখে নি রেণু।
জেঠিশাশুড়ি আবারও বললেন, ‘পিন্টুকে ডাক তো। ফুলশয্যার ধুতি পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি, হাত মুখ ধুয়ে পরে নিক, রাত হয়েছে-‘
ডাকাডাকি শুরু হ‘ল এর পর। বড় ভাসুরের ছেলে মোবাইল নাচাতে নাচাতে দৌড়ে এল– ‘ও ঠাকুমা, দেখবে এস, কাকু কত খাচ্ছে। কাকিমা, ভিডিও করেছি মোবাইলে, দেখবে?
সাড়ে ছ ইঞ্চি স্ক্রিনে সবার সঙ্গে রেণুও দেখেছিল, খানিক আগের জমজমাট জায়গা এখন লম্বাটে আর নিঃঝুম। খাওয়ার টেবিলে উল্টোনো ফুলদানি, খালি জলের বোতল, হাত মোছার রঙিন কাগজ গড়াগড়ি যায় । সেইখানে সুবর্ণ বসে- সামনে পাঁজা করা রাধাবল্লভি; কোনওদিকে দৃকপাত নেই, বিয়েবাড়ির আলো সানাই ডেকরেটরের লোকজন, দোতলায় নতুন বৌ– সমস্ত যেন লুপ্ত তার চেতনা থেকে –ঘিয়ে পাঞ্জাবি, ধুতিতে দীর্ঘদেহী সুবর্ণ রাধাবল্লভি আর আলুরদম খাচ্ছে গোগ্রাসে, যেন কতকালের খিদে নিয়ে সে বসে– তার গায়ে,হাতে রাধাবল্লভির টুকরো, চিবুক গড়িয়ে, লম্বা গলার অ্যাডামস অ্যাপেল বেয়ে হলুদ একটা লাইন টপ টপ করে পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিচ্ছে ।
জেঠিশাশুড়ি বলেছিলেন– ‘আহা কখন থেকে উপোস টুপোস –বয়সের ছেলে –খাবে না? তোদের সবেতেই বাড়াবাড়ি – এই তুই আবার মোবাইল নিয়ে খেলছিস?’। বাকিটা মুচকি হাসি আর গা ঠেলাঠেলিতে চাপা পড়ল। বাচ্চাটাও মোবাইল লুফতে লুফতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
সে রাতে সুবর্ণ অসাড়ে ঘুমোলে নতুন বালিশ চাদর ফুলের গন্ধে শুয়ে রেণু ঐ জিরাফ আর পেলিক্যানের ছবিটা স্বপ্নে দেখেছিল।
তারপর গত সাতদিনে কথা চুমু শরীর সবই হয়েছে – তবু, হনিমুনের তৃতীয়দিনে এই হ্রদের ধারে বেগুনী আকাশের তলায় পেলিক্যানের পাশে ল্যাগব্যাগে জিরাফের ছবি মন থেকে সরাতে পারছিল না রেণু।
শীত শীত করছিল। চাদর টানল সে।
সুবর্ণ বলল– ‘এবার ওঠা যাক। সাড়ে আটটায় শুরু হবে বলেছিল না? মিনিট দশেক লাগবে এখান থেকে অটো নিলে। তার আগে রাতের খাওয়া সেরে নিই? ‘
সারাদিন ঘোরাঘুরির পরে স্বাভাবিক ভরপেট খেলো দুজনে। রেণু আড়চোখে তার বর কে দেখছিল। ন্যাপকিন, টেবল ম্যানার্সে সুবর্ণ যথাযথ। ওরা অটোয় উঠল-পরদেশি পরদেশি যানা নেহি বাজছে। সুবর্ণ বলেছিল-‘এখনও এই সব গান লোকে শোনে? এ তো আমাদের ছোটবেলার গান-‘
-‘ আহা কত যেন বুড়োমানুষ‘- রেণু সুবর্ণর গা ঘেঁষে বসল।
হ্রদের পাশ দিয়ে চওড়া রাস্তা গিয়েছে, জল পেরোলেই সরু গলি , অনুজ্জ্বল দোকানপাট , ঘর বাড়ি মানুষজন – দেওয়ালে, দরজায় ছবি আঁকা। সেই সব ঘর দোরের গা ঘেঁষে অটো চলেছে। ছোট ছোট দোকানে দুধ উথলাচ্ছে কড়াইতে, ডাঁই করা জিলিপি, কচুরি, ইয়াব্বড়া লংকাভাজা – পাগড়ি পরা , চুমড়োনো গোঁফ দোকানদার– রেণু বলছিল– ‘দেখো, যেন রাজপুত্র, না?’ ওরা নাক টেনে গন্ধ নিচ্ছিল, হাসছিল অকারণ।
-‘উফ যা খেয়েছি আজ। ‘ সুবর্ণ হাল্কা হেউ করল।
রেণু ব্যাগ হাতড়ে বলল– ‘হজমের ওষুধ আছে, খেয়ে নেবে ?’
-‘আরে না। ওষুধ খাওয়ার মত কিছু নয়‘
সুবর্ণ হাত ধরল রেণুর, আঙুল জড়িয়ে নিল।
অটো থেমেছিল। ওরা গেট পেরিয়ে ভিতরে এলো । ছোট একটা ঘাসজমি পেরিয়ে পুরোনো হাভেলি। ভিতরের উঠানে খোলা মঞ্চ ঘিরে শতরঞ্জি , মশা, লোকজন, আলো জ্বলছিল – এই শহরে এসে পুতুল নাচ না দেখে কেউ ফেরে না। ওরা টিকেট কেটে মাটিতে বসল।
ম্লান অনুজ্জ্বল আলো, ঠান্ডা কনকনে মাটি – রেণুর সামান্য হতাশ লাগছিল– হ্রদের ধারে অনেক আলো লোকজন– ঐখানেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল রেণুর। ঠিক সেই সময় জোরালো স্পটলাইট পড়ল মঞ্চে। সারেঙ্গিতে ছড় –সঙ্গে রাবণহাত্তা আর ঢোল– রেণুর মনে হচ্ছিল কোথাও যেন একটা ঢাকনা খুলে যাচ্ছে– প্রথমটায় টাইট ঢাকনা খুলতে যেমন হয় একটু ধীরে ঘটছিল ব্যাপারটা তারপর বয়ামের প্যাঁচের সুতো আর ঢাকনার প্যাঁচ একসঙ্গে চলতে শুরু করল; জোরালো পুরুষালি গলায় গান উঠল পধারো মেরে দেশ – কেশরিয়া–
অমনি খুট করে খুলে গেল ঢাকনা আর বন্যার জলের মত সুর ঢুকতে লাগল রেণুর শরীরে; তোলপাড় করছিল রক্ত –এই মশা ধুলো ঠান্ডা মেঝের ড্যাম্প লাগা গন্ধ ছাপিয়ে রাগ মান্ড ওকে ভাসিয়ে নিচ্ছিল – সুরে সুরে দুলছিল রেণু , ভাসছিল, স্নান করছিল।
একের পর এক গান , নাচ হচ্ছিল সামনে– রেণুর চোখ সরছিল না– এত সুর এত আলো এত গান এই শীতের রাতে কল্পনাও করেনি।
অনুষ্ঠান শেষ হতে, সে তখনও সুরে সুরে মজে – সুবর্ণর হাত ধরতে গেল রেণু ; সুবর্ণ ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল-একটু দ্রুতই। তারপর রাস্তায় নেমে গতি আরো বাড়িয়ে দিল – যেন দৌড়োবে। রেণু তাল রাখতে হিমসিম খাচ্ছিল।
সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কি হ‘ল? শরীর খারাপ লাগছে? বাথরুম যাবে?’
গলিতে তখন লোকে লোকে ছয়লাপ – সুবর্ণকে আর দেখতে পাচ্ছিল না রেণু। অস্বস্তি, দুর্ভাবনা আর বিষাদ জেঁকে বসছিল ওর মনে – কান্না পাচ্ছিল, ঘাম – চাদর খুলে ফেলল সে। গা ঘেঁষে মানুষ, অটো, শিংওলা গরু– অনুজ্জ্বল আলোয় হোঁচট খেতে খেতে যে পথে এখানে এসেছিল সেই পথ খুঁজে ফিরছিল রেণু। সুবর্ণ কোথায় যেতে পারে স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না তার। সে হাঁটছিল, দ্রুত হাঁটতে গিয়ে তার পায়ে টান ধরছিল, হাঁটু অবশ লাগছিল, মাথার মধ্যে হাতুড়ি পিটছিল কেউ। তবু হাঁটার জোর বাড়িয়ে দিল রেণু।
২
সাত দিনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার রেণুকে কুহেলির সন্ধ্যা রায় মনে হ‘ল সুবর্ণর। আজ প্রথমে যখন গান শুরু হ‘ল – ঢোলক, সারেঙ্গি, রাবণহাত্তা আর রেণু দুলতে শুরু করল, অনেক দূরের মনে হ‘ল রেণুকে। ঠিক সেদিনের মত। রেণু দুলছিল; পিছনের দিক থেকে রেণুকে ব্যান্ড মাস্টারের মত লাগছিল অথবা অপেরার কন্ডাক্টর। সারেঙ্গির সুরে সুরে মেরুন শাড়িতে রেণু সুরের তালে দুলছে, আর সুবর্ণর মনে হচ্ছে রেণু সম্পূর্ণ অন্য কিছু শুনছে; সম্ভবতঃ রেণুর কান বেয়ে একটা পিয়ানোর গমগমে আওয়াজ পৌঁছে যাচ্ছে – রেণু ক্রমশ দূরের হয়ে যাচ্ছে –দূরের এবং রহস্যময়। এরপর একটা ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে রেণু নামবে; পিয়ানো যেখানে বাজছে সেদিকেই যাবে রেণু– নামতেই থাকবে –তাকে আর আটকাতে পারবে না সুবর্ণ– আস্তে আস্তে রেণু কুহেলির সন্ধ্যা রায় হয়ে যাবে।
সুবর্ণ তখন স্কুলে, ওদের টিভি দেখার বড় ঘর, ভনভন মশা, ঠাকুমা পিঁড়িতে বসে মালা জপতে জপতে ঢুলে পড়ছে , এদিকে টিভির চিত্রহারে গ্র্যান্ড পিয়ানোয় বিশ্বজিৎ আর গলা মেলানোর ঠিক আগে সন্ধ্যা রায় ঢাকাই শাড়ি পরে ঘোরানো সিঁড়িতে একলা দাঁড়িয়ে, কাজল পরা বিশাল চোখ – যেন ফিনফিনে চিনেমাটির ডল। পাশের ঘর থেকে মা আর বাবার গলা পাচ্ছিল রোজকার মত। মা খুব জোরে চেঁচাচ্ছিল, পিয়ানোর আওয়াজ, তুমি রবে নীরবে ছাপিয়ে সেই সব কথা সুবর্ণর কানে আসছিল। মা বলছিল চলে যাবে। বলছিল, এ‘ সংসারে মানুষ থাকে? বলছিল, ‘ আমার গান, আকাশবাণীর অডিশন– সব সব নষ্ট হ‘ল শুধু তোমাদের জন্য।‘
সুবর্ণর বুক পেট খালি হয়ে গিয়েছিল – তার মানে ও কেউ নয়। কেউ নয় মায়ের? ও তবে কে? মা চলে গেলে ওর কি হবে? ভয় আর শূণ্যতা বালক সুবর্ণ আর কখনও এইভাবে পায় নি – ওর ভয় সেই মুহূর্তে সন্ধ্যা রায়ে শিফট করে গেল– ওর মনে হয়েছিল, যেন একটা ফিনফিনে পুতুল সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর নামলেই , অবশ্যম্ভাবী পড়বে আর চুরচুর হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে একদম। ভয়ে কাঁটা হয়ে সুবর্ণ সন্ধ্যা রায় কে সিঁড়ির ধাপেই ফ্রিজ করে দিতে চেয়ে, রিমোট টিপে টিভি অফ করে দিয়েছিল।
রাত ঘন হতে মা ভাত বসিয়েছিল – চোখ লাল, উস্কোখুস্কো এলোমেলো শাড়ি। রান্নাঘরে তেলকালি, কতদিনের ঝুল। ভাতের হাঁড়ির খুব কাছে কান নিলে শোঁ শোঁ শব্দ কানে আসে। সুবর্ণর বুক ফেটে যাচ্ছিল। সুবর্ণ বলতে চাইল– মা , বড় কষ্ট। বলতে চাইল, মা চলে যেও না। অথচ বলল– ‘মা ভাত দাও।‘
-‘ রান্না শেষ হয় নি তো। শুধু ভাত খাবি নাকি?’
বালক সুবর্ণ বলেছিল-‘ খুব যে খিদে পেয়েছে, মা‘। তারপর মন্ড মন্ড সাদা ভাত উদ্গলায় খেতে শুরু করেছিল । তার লালায় আর চোখের জলে নোনতা ভাত অস্বাভাবিক দ্রুততায় গলায় ঢুকছিল কখনও আটকে যাচ্ছিল। সুবর্ণর চাইছিল, এই মুহূর্তটা ফ্রিজ করতে – যদি এই ভাবে সে ভাত চেয়ে যায়, চেয়ে যেতেই থাকে, মা আর চলে যেতে পারবে না। কোথায় যাবে মা ওকে ভাত না দিয়ে?
মা যায় নি সেদিন। পরেও নয়। গেল এই তো সেদিন – বাথরুমে গিয়ে সেরিব্রাল স্ট্রোক। অথচ এই আশ্চর্য বিপন্নতা সুবর্ণকে আর ছাড়ল না।
আজ এই পুরানো হাভেলিতে, হনিমুনের তৃতীয় রাতে সুবর্ণর চোখের ওপর রেণু কুহেলির সন্ধ্যা রায় হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশঃ – বড় বড় চোখ মেলে দেখে নিচ্ছিল চারপাশ যেন সুবর্ণর পাশ থেকে উঠে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করবে যে কোন সময়। সুবর্ণর খুব ইচ্ছে করল রেণুকে জাপটে ধরে বিছানায় নেয় –খুলে খুলে দেখে সব। কী গান ঢুকছে রেণুর কানে , কী বিক্রিয়া করে সেই গান রেণুর অভ্যন্তরে– সব জানতে চাইছিল সুবর্ণ।দেখতে চাইছিল রেণুর সবটুকু -সমস্ত জটিল কলকব্জা, বিক্রিয়া ও ফলাফল। ওদিকে পুতুল নাচ শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাজা রাণী রাজদরবার আলো করে বসে– আর একটা পেল্লায় সাপ বাঁশিশুদ্ধ সাপুড়েকে জাপটে ধরে গানের সুরে সুরে ওপরে উঠে যাচ্ছিল; এই ভীড় আলো লোকজন আর কাঠপুতলি– সমস্ত ফ্রিজ করে দিতে হবে ঠিক এইখানে- আলো আঁধারিতে পুরোনো টিভির রিমোট হাতড়াচ্ছিল সুবর্ণ, খ্যাপার মত। বার কয়েক উঠে দাঁড়নোর চেষ্টা করেছিল, বসে পড়েছিল তারপর।
নাচ শেষ হতে লোকজন উঠে বেরোচ্ছে সবে, রেণুর হাত ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় নেমে স্প্রিন্ট নিল সুবর্ণ।
অন্ধকার রাস্তা ঘাটের খানা খন্দ পেরিয়ে সে দৌড়োচ্ছিল । কনকনে উত্তুরে হাওয়ার ঝাপট লাগছিল মুখে – চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। গলির দোকান পাট সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু একটা ছোট চায়ের দোকানে একটি ছেলে – সুবর্ণর মতই বয়স– পাকানো গোঁফ ,কানে দুল, মাথায় পাগড়ি – যেন এক শাপগ্রস্ত রাজপুত্র – ঝাঁপ ফেলার আগে বারকোষ খালি করছিল, উনুন, মেঝে মুছে ,পেডেস্ট্যাল ফ্যান চালিয়ে শুকোচ্ছিল। আগুন নিভে গিয়েছিল, শূণ্য কড়াইতে দুধের শুকনো সর পড়েছিল। দোকানের সামনে হাঁফাচ্ছিল সুবর্ণ; ফ্যানের তীব্র হাওয়ায় দোকানঘর কেমন করে শুকায় কোমরে হাত দিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। শুকিয়ে যাওয়ার একটা প্যাটার্ন ছিল – সেটা বুঝতে গেলে হাওয়ার গতি, মেঝের মাপ এসব মিলিয়ে একটা অংক কষতে হ‘ত। সে শুধু হাঁফাচ্ছিল আর বাঁ দিক থেকে ডাইনে ভেজা অংশের ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া দেখছিল।
রাজপুত্র ঘর মোছা থামিয়ে দোকান বন্ধ হয়ে গেছে বলেছিল। তারপর কি ভেবে আঙুল দিয়ে নেভানো আগুনের ওপর ছোট পাত্র দেখিয়েছিল – অগভীর ধাতব , কাচের ঢাকনা বেয়ে জল নামছে ন্যাতানো পরোটায় । তিনটে ঠান্ডা পরোটার প্রথমটি তুলে নিল তারপর ছিঁড়ল – ঘর শুকানোর প্যাটার্নের মত অনেকটা, বাঁ থেকে ডানে সামান্য ত্যারছা মত আবার ডান থেকে বাঁয়ে।
রাজপুত্র থালা এগিয়ে দিয়েছিল। বাঁ হাতে থালা ধরে টুকরো ভয়, বিপন্নতা আর দুঃখগুলি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল সুবর্ণ।
রেণু এসে দাঁড়িয়েছিল কখন যেন। সুবর্ণ মুখ তুলে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল – ‘ভাত খাব। ভাত দাও।‘
শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, 'আমরা যখন সত্যিকারের সংযোগ চাই, আমরা যখন কথা বলি, আমরা ঠিক এমনই কিছু শব্দ খুঁজে নিতে চাই, এমনই কিছু কথা, যা অন্ধের স্পর্শের মতো একেবারে বুকের ভিতরে গিয়ে পৌঁছয়। পারি না হয়তো, কিন্তু খুঁজতে তবু হয়, সবসময়েই খুঁজে যেতে হয় শব্দের সেই অভ্যন্তরীণ স্পর্শ।"
ইন্দ্রাণী খুঁজে চলেছেন । এ'যাবৎ প্রকাশিত দশটি গল্পের সংকলন-'পাড়াতুতো চাঁদ'।
8 Responses
Khub valo laglo. Purusher ei aschorjo biponnota niye
Emon chotogalpo age khub kom porechi. Galpo bolar vongiti vari sabolil . Sudhu seshta jeno ,sesh hoye hoye gelo sesh. Ovinondon
বিপন্নতা আর বিপন্নতা থেকে ফ্রিজ করতে চাওয়া। আকড়ে ধরতে না পেরে জৈবিক তাগিদে আশ্রয় সন্ধান, এই হলো সুবর্ণ। সাধ্য কি তার, রে রেণুর সূক্ষ সুরের তানে প্রবেশ করে ! জড়ানো হাত ও আঙুলের আড়ালে এই গল্পে প্রতিনিয়ত এক মানসিক দূরত্ব। বেশ ভালো লাগলো রে। একটানে পড়ে ফেললাম।
অসাধারন। ইন্দ্রানীর অন্যান্য গল্পের মতই মনের ছবি আকে আর পাকে গভীরে টেনে নিয়ে যায়
পাঠককে নমস্কার।
পাঠককে নমস্কার
Amar anubhuti diei shuru kori . Amio freeze hoe gechhilam galper shese . Pashapashi thakbe dujone , jodi thakte pare . Karon jug ta to ar maa baba der jug nei je thekei jabe , thekei jabe ..
anek bibahitoder dekhe ami anekdin holo bujhtei parina , ora biye kano korechhilo . Hoyto korte hoy bole korechhilo , hoyto sundar swapno mone mone dekhechhilo ar seta sakar korte biyeta kore felechhilo . Pore bojha galo , anek pore je , biye akta social contract taar sathe sex , security ar stabilityr samporko achhe , swapner kono samporko nei .
Amar profession ta chhilo dr kendrik . Bariatric surgery bole akta surgery last 10/15 bachhor dhore hochchhe , taate diabetis type 2 ar obesity komano jaye .
Kintu ai operation er akta long term effect hoto rogider , tara depression ba emni jateeyo kuchhu te akranto hoto . Dr der kathay etar case study korte gie dekhi 1. Kau kau age thekei depression ba PTSD r shikar . Taar fole tara kheto beshi karon khaoa ta chhilo tader kachhe khaoa noy , instant gratification . Operation er por stomach er size chhoto kore deoay khete parto na , obesity komto , kintu sei instant gratification na paoar jonyo abar anxiety te chole jeto .
Sei somoy prachur manus ke treat korechhi , case study o korechhi .
Uff ! Ki nirantar duhkher aborte ghurchhe .
Subarnar sange akjoner mil pelam .
Chheleti class three te porar somoy school chhutir dine khelte gie class theke doure bag na niei bus e uthe pore . Bari fire taar baba taar ghore dhuke belt khule pratyek baar taake marbe bole target kore na mere belt ta die dewal e mare . Ar chheleti pratyek baar bhabe belt ta taar gaaye porbe kintu pore na ar dewaler daag sakkhi theke jaye ghatonar .
Ki ajob bhoy se din katate katate akdin drug addict hoe jaye .
Subarnar modhye oi chheleta chhilo . Anador , upekkha , bhalobasaheenota sobi akjon manus ke khadyo akre banchte shekhay . Athocho somaaj bhabe era lobhi . Era lobhi noy , bipanno , asohaye . Renu bujhbe kina , sadeho achhe . Karon oto surer cocoon baniye taar modhye comfortzone khuje naye .
Akjon insecured , ar akjon comfortzone er cocoon e abhyostho , mel bandhan er sambhabona koi !!
Lekh ar patha , pore banchi .
Priyo bandhu ..
uff. kamon akta chapa aar ruddhoswas akta onubhuti Subarnake niye. shobdochayan chhoto chhoto bakye bishoyer obhibyakti sorbopori sonket proyog. sob mile asamanya..
মনস্তত্ব নির্ভর লেখা । ৯০ সেকেন্ডের একটি মুহূর্ত কত গুরুত্বপূণ হতে পারে আবার বুঝলাম। ইমোশনাল কন্ডিশনিংয়ের এক আদর্শ নিদর্শন এই গল্প । প্রতিবারের মতোই পড়ে ভালো লাগলো.