আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮][১৯]
আমার জীবনে গানের(song) অবস্থান সবচেয়ে ওপরে। চলতে, ফিরতে, ঘুমাতে, কাজ করতে সব সময় কোনও না কোনও গান আমার মধ্যে গুণগুণ করে। এটা স্বাভাবিক না কী অস্বাভাবিক আমার জানা নেই। শুধু জানি গান নিয়েই আমার জীবন কাটবে। কখনও মনে হয়নি গানকে পেশা করব। কিন্তু গাইব। ঘরে, বাইরে, দেশে, বিদেশে, চেনা মহলে, অচেনা সমাবেশে, ঘরোয়া আড্ডায়, খোলা আকাশের নিচে। যখন যেখানে ইচ্ছে হবে আমার বা আমার চারপাশের পরিচিত বা অপরিচিত পরিবেশে—সর্বত্র গান ছড়িয়ে দেব। আমার কাছে গান গাওয়া আর ঈশ্বরের আরাধনা দুটোই একই অর্থ বহন করে। এই গান দিয়ে আমি সারা বিশ্বকে একসূত্রে গেঁথেছি। যখন যেখানেই গেছি গান আমার সঙ্গী। কোনও যন্ত্রানুসঙ্গের প্রয়োজন হয় না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুর আসে কণ্ঠে। তবে হ্যাঁ, রবিঠাকুর না থাকলে কী হত বলা মুশকিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রচিন্তা, সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন আমি। এই গানের কথা যখন পাড়লাম-ই তাহলে অনেক ঘটনার মধ্যে দু-একটা উল্লেখ না করলেই নয়।

১৯৮৭ সাল। পণ্ডিত রবিশঙ্করের(Pandit Ravi Shankar) সঙ্গে আমি, শঙ্কর, আমার ছোট্ট কন্যা সবাই একসঙ্গে শান্তিনিকেতন(Shantiniketan) সফরে। হ্যাঁ, আরও অনেকে আছেন। পণ্ডিতজীর তরফে। আমরা পূর্বপল্লী গেস্ট হাউসে। রবুদা’রা সবাই রতনপল্লী গেস্ট হাউসে। ঘরে থাকা হয় খুব কমই। সারাদিনই এদিক-ওদিক অনুষ্ঠান। সবাই একসঙ্গে, তিন-চারটে গাড়িতে ঘুরে বেড়াই। রবুদার মত ভিভিআইপি। বলার অপেক্ষা রাখে না। কী পরিমাণ ব্যস্ততা সকাল, বিকেল, রাত্রি।

একদিন এক অনুষ্ঠানে আলাপ হল ভারী মিষ্টি, ফরসা, ছোট্টখাট্টো এক কংগ্রেস(Congress) নেত্রীর সঙ্গে। আমি কিন্তু কোনওদিনই রাজনীতিতে আগ্রহী নই। শুধুমাত্র মা যোগমায়াদেবী কলেজে পড়াকালীন জেনারেল সেক্রেটারি ছিল। সেই সূত্রে কিছু তৎকালীন নেতার আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। তাঁদের চিনতাম, পরবর্তীকালে মা যখন রেডিও’র সংবাদ পাঠিকা তখন তাদের সঙ্গে কাজের সূত্রেই মা’র বন্ধুত্ব বাড়ে। তাঁরা হলেন সুব্রত মুখার্জি এবং প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সুব্রতদা এবং আমার একই দিনে জন্ম। সালটা অবশ্যই আলাদা। পরবর্তীকালে আমরা বহু বছর একসঙ্গে আমার বাড়িতে জন্মদিন পালন করেছি। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত পরে আসব।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। শান্তিনিকেতনে আলাপ হল ১৯৮৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমি মমতা’র রাজনৈতিক কার্যকলাপ বা ওর রাজনৈতিক ব্যক্তিসত্ত্বাকে একদম একপাশে রেখে বলছি। সেই বন্ধুত্ব এখনও বজায় আছে। যদিও দীর্ঘকাল ব্যক্তিগত আলাপচারিতা বা দেখাসাক্ষাৎ থেকে অনেক অনেক দূরে এখন আমি। এখন আমি আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে আলোচনা করার ধৃষ্টতা দেখানোর পুরোপুরি বিরুদ্ধে। আমি সেই পুরনো সম্পর্ক নিয়ে দু-একটা ঘটনা বলব।

আমাকে গান গাইবার জন্য নানান মানুষ, নামী, অনামী, সাধারণ, অসাধারণ, রাজনীতির আঙিনার ব্যক্তিত্ব—অনেকেই ডাকতেন, আমি খুব অবলীলায় সেইসব অনুষ্ঠানে গাইতাম আবার অনুষ্ঠান পরিচালনার কাজও করতাম। পারিশ্রমিক কখনও পেতাম, কখনও পেতাম না। কিন্তু কখনও চাইতাম না বা এ-ব্যাপারে কোনও আশা বা আশাভঙ্গ কিছুই হত না। কারণ, গান গাইবার আনন্দে, কাজের নেশায় আমি যেতাম, গাইতাম। কাজ করতাম, সংবাদপাঠের সঙ্গে এটাও আমার একটা বাড়তি দায়িত্ব হয়ে পড়েছিল।
যে কারণে এই প্রসঙ্গে অবতারণা, সেইটা এইবার বলি।
একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবর পাঠালেন একটা অনুষ্ঠানে থাকতে হবে। তখনও তৃণমূল হয়নি, কংগ্রেসেই মমতা আছেন। আমরা গোঁড়া কংগ্রেসি বাড়ি। জন্মসূত্রে, আমিও কংগ্রেসের সমর্থক। কোথায় যাব, কী করব কিছুই জানি না, জানার চেষ্টাও করি না কখনও। গাড়ি আসবে। মমতা বলেছেন বা সৌগতদা খবর দিয়েছেন, অথবা প্রিয়দা বা সুব্রতদা। যেই যেতে বলুন না কেন। কাজের জন্য। গানের জন্য। আমাকে যেতে হবে। এটা আমার সামাজিক দায়িত্ব।
একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবর পাঠালেন একটা অনুষ্ঠানে থাকতে হবে। তখনও তৃণমূল হয়নি, কংগ্রেসেই মমতা আছেন। আমরা গোঁড়া কংগ্রেসি বাড়ি। জন্মসূত্রে, আমিও কংগ্রেসের সমর্থক। কোথায় যাব, কী করব কিছুই জানি না, জানার চেষ্টাও করি না কখনও। গাড়ি আসবে। মমতা বলেছেন বা সৌগতদা খবর দিয়েছেন, অথবা প্রিয়দা বা সুব্রতদা। যেই যেতে বলুন না কেন। কাজের জন্য। গানের জন্য। আমাকে যেতে হবে। এটা আমার সামাজিক দায়িত্ব।

গাড়ি এল। উঠে বসলাম। কোনও এক জায়গায় গাড়ি এসে থামল। জানি না সেই জায়গার নাম, অবস্থান। এখনও রাস্তাঘাট মোটেও চিনি না। এইটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খামতি। আমি কলকাতার মানুষ। কিন্তু কলকাতার দু-একটা জায়গা ছাড়া কিছুই চিনি না, সবটাই ড্রাইভারের ভরসায়। যা হোক, গন্তব্যে পৌঁছে মঞ্চে বসলাম। মঞ্চে আরও অনেকের সঙ্গে আছেন বিখ্যাত শিল্পী ওয়াসিম কাপুর, সুব্রতদা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। আমি সেখানে হংসমধ্যে বক যথা। আমাকে দেখেই মমতা বললেন, ইন্দ্রাণীকে কী করতে হবে, কী বলতে হবে বুঝিয়ে দাও। কোনও এক স্বেচ্ছাসেবক এসে একটা কাগজে মোটামুটি অনুষ্ঠানের একটা ফ্লোচার্ট আমাকে দিল।

অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি সংযোজনায়। একের পর এক বক্তারা বক্তব্য রাখছেন। এইবার আসল অনুষ্ঠান। হঠাৎ মমতা আমার দিকে তাকিয়ে। ইন্দ্রাণী একটা গান গাও। তারপর উদ্বোধন হবে। পর্দা উন্মোচন হবে।
—আমার কোনও তাপ-উত্তাপ নাই। খালি কণ্ঠে গেয়ে উঠলাম—
এদিন আজি কোন ঘরে গো
খুলে দিল দ্বার…
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা
সফল হল কার।
কাহার অভিষেকের তরে
সোনার ঘটে আলোক ভরে
ঊষা কাহার আশিস বহি
হল আঁধার পার…
গান শেষ হল। তুমুল করতালির মধ্যে উদ্বোধন হল।
কী উদ্বোধন হল?
কর্পোরেশনের শৌচাগার।
জয়তু রবীন্দ্রনাথ।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য : লেখক
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
2 Responses
বেশ ভালো লাগলো। অন্য পর্বের চেয়ে এই পর্বের গল্পটা বেশ আলাদা!
বেশ ভালো লাগলো। অন্য পর্বের চেয়ে এই পর্বের গল্পটা বেশ আলাদা!