পরদিন সানরাইজ-এ গিয়ে কাজের ফাঁকে অপালা একবার দুশো দশ নম্বরে ঢুকল। অভিজিৎকে নিচের রিহ্যাব সেন্টারে ফিজিও থেরাপি করাতে নিয়ে গেছে। পাশের বেডের রোগী খবর দিল। অপালার অপেক্ষা করার সময় নেই। ভাবল লাঞ্চের সময় এসে খবর নিয়ে যাবে। কী এমন দরকার পড়ল যে, অভিজিৎ শুধু মৈনাকের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। তার মানে অসুখ-বিসুখের কথা নয়।(deshantorer swajan)
লাঞ্চের(Lunch) সময় ফ্রিজ থেকে ছোট ছোট প্লাস্টিকের কৌটো ভর্তি ভাত, শুক্তো আর চিংড়ি মাছের ঝোল নিয়ে অপালা অভিজিতের ঘরে গেল। তখনও ওঁর টেবিলে লাঞ্চের ট্রে দিয়ে যায়নি। অপালা পেপার প্লেটে ভাত দিতে দিতে বলল —আজ বাড়ির রান্না খান। কাল রঞ্জনারা এখান থেকে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। ওদের জন্যে একটু রান্না করেছিলাম…
অভিজিৎ খুশি হলেন —শুক্তো নাকি? এসব খাওয়া ভুলেই গেছি। উইক এন্ডে তোমাদের সকলের বাড়ি ঘুরে ঘুরে নেমন্তন্ন খাওয়াও শেষ।
—একথা বলছেন কেন? কখনও কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলে বলবেন। আমাদের ক্লাব থেকে মেম্বারদের কাছে ই-মেইল এসেছে। আপনার যদি কিছু দরকার হয়, সবাই যাতে হেল্প করতে পারি।
—সো কাইন্ড অফ ইউ। হেল্প তোমরা সব সময় করছ। লাস্ট দু’বছরে কতবার অসুস্থ হলাম। আমার ফ্যামিলি নেই। আত্মীয়-স্বজন নেই। এই কমিউনিটিই তো দেখাশোনা করেছে।
অভিজিৎ খাওয়া শুরু করেছেন। অপালা চলে যাওয়ার আগে বলল —আপনার আমেরিকান নেবাররাও যা করেছে! সেদিন আপনি হাঁটতে বেরোননি। ড্রাইভ-ওয়ে থেকে সকালের খবরের কাগজ তোলেননি। এতেই ওদের সন্দেহ হয়েছিল। না হলে যে কি হত!
—অনেকদিনের চেনাশোনা। একটা বন্ড তৈরি হয়ে যায়। দেখো না, কেউ না কেউ মাঝেমাঝেই দেখতে আসে।
অপালার লাঞ্চ আওয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে। ও আর বেশিক্ষণ থাকতে পারল না।

বিকেলের দিকে মৈনাকের ফোন এল। ওর সানরাইজ-এ আসতে একটু দেরি হবে। অপালা বলল —আমি আর অতক্ষণ ওয়েট করতে পারব না। তুমি অভিজিৎদার সঙ্গে কথা-টথা বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো।
মৈনাক জিজ্ঞেস করল —তুমি বলেছ যে আমি আজ আসব?
—না। যদি কোনও কারণে আসতে না পারো, উনি সারা সন্ধে আশা করে বসে থাকবেন।
—ঠিক আছে। দেখি, যদি অফিস থেকে একটু আগে উঠতে পারি।
অপালা বাড়ি ফিরে মেয়ের ফোন পেল। অনিকা বলল —তোমার বিকেলের মেসেজটা পেয়েছিলাম। কল ব্যাক করার সময় পাইনি। আমাদের ট্র্যাভল প্ল্যান একটু চেঞ্জ করতে হচ্ছে।
অপালা জানতে চাইল —কেন? ওই সময় তোর নিউইয়র্কে কনফারেন্স আছে না? ফাদার্স-ডে’র আগে চলে আসবি বলেছিলি?
—ঠিক আগের দিন আসব। জেনিভা থেকে। নিউইয়র্কের মিটিং অ্যাটেন্ড করছি না। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের কনফারেন্সে জেনিভা যেতে হচ্ছে। সঞ্জয় এখান থেকে ওমি, শমীকে নিয়ে ফ্রাইডে ইভনিং ফ্লাইটে পৌঁছবে। বাবাকে ওদের ফ্লাইট নাম্বার জানিয়ে দেবে।
—তুই ওই শনিবার কখন এসে পৌঁছবি?
অনিকা বলল —আমাকে পিক-আপ করতে হবে না। এয়ারপোর্ট থেকে কার সার্ভিস নিয়ে নেব। বাবাকে একটু ফোনটা দেবে? শমী, দাদুকে হ্যালো বলতে চাইছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অপালা উত্তর দিল —ও তো এখনও ফেরেনি। অভিজিৎদাকে দেখতে সানরাইজ-এ গেছে।
—অভিজ্যেঠু কেমন আছে? আই হোপ, হি ইজ গেটিং বেটার।
—গ্র্যাজুয়ালি ইমপ্রুভ করছেন। তোদের কথা প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন।
ফোন রাখার আগে অনিকা বলল —যদি সময় পাই একবার ওঁকে দেখে আসব।
সানরাইজ-এর দু’শো দশ নম্বর ঘরে মৈনাক তখনও অভিজিতের কথাগুলো ভালভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। ওর মনে হত দীর্ঘদিনের একাকিত্ব, নিঃসঙ্গ জীবনে উনি একরকম অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। মাধবী ডিভোর্সের পরে এক ফার্মাসিস্টকে বিয়ে করে নর্থ ক্যারোলাইনা চলে গিয়েছিল। এখনও বোধহয় সেখানেই থাকে। এসব নিয়ে অভিজিতের সঙ্গে কোনও কথাও হয় না। এমনিতে ও পার্সোনাল আলোচনা বিশেষ করে না।
আজ দেশের কথা উঠতে মৈনাক প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল —তবে যে বলতেন আপনার কোনও পিছুটান নেই? আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কও তো রাখেননি? তাহলে কার ভরসায় এত বড় ডিসিশন নিচ্ছেন?
অভিজিৎ মাথা নাড়লেন —না, পিছুটান বলতে সেভাবে কিছু ছিল না। আমরা দুই ভাইবোন ছোট থাকতে মা নিউমোনিয়া হয়ে মারা গিয়েছিলেন। বাবা আবার বিয়ে করলেন। সেই মহিলার কাছে ওই শিশুবয়সে স্নেহ, মমতা, প্রশ্রয় কোনও কিছুই পাইনি। ওঁর নিজের ছেলেমেয়ে হল। আমরা দু’জন পরগাছার মতো বড় হয়ে উঠছিলাম। বোনের বিয়ের আগেই কলেজ পাস করে ক্যানাডায় চলে এসেছিলাম।

অভিজিতের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। মৈনাক বাধা দিল —আপনি টায়ার্ড হয়ে পড়ছেন। এবার রেস্ট নেওয়া দরকার। আমি একটা অন্য কথা ভাবছি…
—বলো। আমার ডিসিশনটা মানতে পারছ না, তাই তো?
—অ্যাপারেন্টলি তাই। কিন্তু এখানে বসে এসব ডিসকাস করা যায় না অভিজিৎদা। অনেক ইনফর্মেশন নেওয়ার আছে। ভাবছি ডাক্তারের পারমিশন নিয়ে একটা উইক এন্ডে যদি আপনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই।
অভিজিৎ যেন স্বস্তি পেলেন —নিয়ে যাবে? তোমরা যদি এখানে ডঃ গোল্ডম্যানের সঙ্গে কথা বলো, এখন আমি বেশ ভাল আছি।
মৈনাক চলে যাওয়ার আগে বলে গেল —অপালা আপনার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করবে। ইন দ্য মিন টাইম আমি এল্ডার ল, উইলস অ্যান্ড ট্রাস্টস, পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। তবে ফাইনাল ডিসিশন নেওয়ার আগে এখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলুন। সেইজন্যে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছি।
—হোয়াট এভার ইউ সাজেস্ট! আজ বাড়ি যাও। গুড নাইট।
ভোরের দিকে কীসের অস্বস্তিতে অভিজিতের ঘুম ভেঙে গেল। গলার কাছে চাপ চাপ ভাব। সামান্য হাঁফ ধরছে। উঠে বসার চেষ্টা করতে ঢেঁকুর উঠল। অ্যাসিডিটির মতো লাগছে। কাল ডিনারে চিকেন পারমিসান খেয়েছিলেন। সস, চিজ মিলিয়ে অম্বল হয়ে গেছে।
অভিজিৎ জল খেলেন। সকালের কফির পরে আবার অ্যাসিডিটির মতো বুক, গলা চিনচিন করে উঠল। ভয়ে ভয়ে ব্রেকফাস্ট সামান্যই খেলেন। নার্সের কাছে অ্যান্টাসিড চেয়ে খাওয়ার পরে ক্রমশ বুকের ভেতর ভার ভার ভাবটা কমে গেল। ডাক্তার ভিজিট করতে এলে অভিজিৎ সকালের অস্বস্তির কথা বললেন না। সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে গ্যাস হবে না? আজ রি-হ্যাব এক্সারসাইজের আগে একটু হাঁটবেন।
শনিবার মৈনাকদের বাড়িতে আসার পর থেকে অভিজিৎ বুঝেছেন আজ তাঁকে নিজের ইচ্ছের কথা কিছুটা যুক্তি দিয়ে এদের কাছে খুলে বলতে হবে। শুধু মৈনাক, অপালা নয়, যাঁরা এত বছর তাঁর কাছাকাছি আছেন, আত্মীয়-বন্ধুর মতো সম্পর্ক রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে শুধু কৌতূহল নয়, যথেষ্ট উদ্বেগও তিনি লক্ষ্য করেছেন। সুতরাং তাঁর সিদ্ধান্ত, যা অনেকটাই আবেগ-নির্ভর, তা জানার অধিকার এদেরও আছে। মৈনাকরা সেইরকমই বলতে চাইছে।
সেদিন যে কথা সানরাইজ-এ শেষ হয়নি, সে প্রসঙ্গ তুলে অপালা জিজ্ঞেস করল —এত বছর পরে কেন আপনি ইন্ডিয়ায় ফিরতে চাইছেন অভিজিৎদা? কখনও তো বেড়াতে যেতেই চাইতেন না।
অভিজিৎ অতীতের প্রসঙ্গে কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে উত্তর দিলেন —বাড়ির ওপর ঠিক অভিমান করে নয়, বলতে পারো নিজের কেরিয়ার, ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রথমবার ক্যানাডায় চলে এসেছিলাম। তখন যা দিন ছিল, এখনকার মতো প্লেন ফেয়ার অ্যাফোর্ড করা সহজ ছিল না। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হত। তারপর আমার এক মাসি সম্বন্ধ করে মাধবীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলেন। সেবার দেশে গিয়ে বুঝতে পারলাম বাবার যাদবপুরের বাড়িতে আমার আর জায়গা নেই। বাবা তখনও বেঁচে। সৎ ভাইরা জানিয়ে দিল বাবা তাঁর উইলে আমাকে কোনও অংশ দেননি। সব লিখে দিয়েছেন ওদের মা’র নামে।
অভিজিৎ হাঁপিয়ে উঠছেন। কথা শেষ করার আগে শুধু বললেন —হয়তো সত্যি আমি বাড়ি আর সম্পত্তির ভাগ নিতে যেতাম না। কিন্তু সে সময় এত অভিমান হয়েছিল, আর কখনও দেশে যাইনি। শুধু বাবার জন্য টাকা পাঠাতাম। তাঁর ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য অনেক খরচ হয়েছিল। ওঁর ছেলেদের ফাইনান্সিয়াল সিচুয়েশন কেমন ছিল জানি না। আমি আমার কর্তব্য করে গেছি।

—ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, একটু পার্সোনাল কথা জিজ্ঞেস করছি। মাধবীদি কি এ ব্যাপারে সিমপ্যাথেটিক ছিলেন না?
দেবশ্রীর প্রশ্নে অপালা সামান্য বিরক্ত হল। এত জেরা করার দরকার কী?
অভিজিৎ উত্তর দিলেন —ওঁর ইস্যুটা অন্য ছিল। ওঁর পক্ষে আমার লিভিং স্ট্যান্ডার্ড অ্যাকসেপ্ট করা ডিফিকাল্ট ছিল। পরে তো আমরা ভাল রেসিডেন্সিয়াল নেবারহুডে ছোট্ট বাড়ি কিনে চলে এসেছিলাম। কিন্তু ততদিনে সম্পর্ক ভেঙে গেছে। আমারই জেদ। তখন প্রচণ্ড সেভিং করছি। কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে বাবার ফ্যামিলিকে দেখিয়ে দেব, কত ভালভাবে থাকা যায়। এখানেও বাড়ি কেনার জন্যে ডাউন পেমেন্টের ডলার জমাচ্ছি। সব মিলিয়ে যেন একটা জেদের বশে চলেছিলাম। মাধবীকে নিয়ে কেথাও ভ্যাকেশনে যাইনি। নিউইয়র্কে কোনও থিয়েটার, ব্রডওয়ে-শো দেখতে যাইনি। একটা নতুন গাড়িও কিনিনি। আর সত্যি বলতে কী, তোমাদের মতো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের অ্যাফ্লুয়েন্সও আমার ছিল না। সব মিলিয়ে মাধবী আর অ্যাডজাস্ট করতে পারছিল না। আই ডোন্ট ব্লেম হার।
অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে। অভিজিতের সঙ্গে দুপুরের খাওয়া সেরে নেওয়া হল। একতলার গেস্টরুমে ওঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। অভিজিৎ ঘুমিয়ে পড়েছেন দেখে মৈনাক সকলকে নিয়ে পেছনের বাগানের ডেক্-এ গিয়ে বসল। ওদের স্ত্রীদের মধ্যে মন্দিরার গাছপালার রেণুতে অ্যালার্জি হয়। ও ফ্যামিলি রুমে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ নিয়ে বসল। যদি অভিজিতের কোনও দরকার হয় মন্দিরা খেয়াল রাখবে।
বসন্তের দুপুরে রোদের তাপ নেই। কাঠের ডেকের ধার ঘেঁষে ঘন সবুজ ঘাসে নীল টিউলিপ মাথা তুলেছে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় বাগানের শেষপ্রান্তে ঝরে পড়ছে সাদা, গোলাপি চেরী ফুলের পাপড়ি। দূর থেকে ঘাসকাটা যন্ত্রের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে।
ছুটির দুপুরে এমন একটা পরিবেশ। অথচ কেউ যেন গল্পগুজবের মেজাজে নেই। মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। কখনও অভিজিৎদার সিদ্ধান্ত নিয়ে। কখনও এই অভিবাসী জীবনে অন্য মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা অথবা নিজেদের ভূমিকা নিয়ে।
চা এল। ডাক্তার মলয় বোস চা-এর কাপ হাতে নিয়ে কথা শুরু করলেন —অভিজিতের যে দেশে আত্মীয়দের সঙ্গে কনট্যাক্ট আছে, তোমরা জানতে? হঠাৎ কোথা থেকে জামাই গজিয়ে উঠল? ওর এখন যা ফিজিক্যাল কন্ডিশন, কেউ গায়ে পড়ে ওখানে রেসপন্সিবিলিটি নিতে চাইছে, দ্যাট ডাজ নট সাউন্ড ভেরি নর্মাল। তোমরা একটু খোঁজ খবর নাও, সে কেমন আত্মীয়? তার কোনও ইনহেরিটেন্সের স্বার্থ আছে কী না?
মৈনাক উত্তর দিল —প্রথমে তো ওঁর কাছেই শুনলাম। ওঁর যে নিজের বোন ছিল, এ নাকি তাঁর জামাই। বোন এখনও বেঁচে। মেয়ে, জামাই-এর কাছে থাকেন। অভিজিৎদার সঙ্গে আগে তাঁর চিঠিপত্রে, এখন ফোনে যোগাযোগ রয়েছে। তবে মহিলা খুব অসুস্থ।’
অপালা বলল —আমরা ওঁর মেয়ে-জামাইকে কল করেছিলাম। তাঁরা বলছেন অভিজিৎদা নাকি ক্যানসারের রেমিশন হওয়ার পর থেকে বোনের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।’
ডঃ বোস বললেন —তা হতে পারে। কিন্তু অভিজিৎ ওখানেই থেকে যাবে, এ কথা কি ওরা বলছে?
—অভিজিৎদা নিজেও তো তাই ভাবছেন।
দেবশ্রী জিজ্ঞেস করল —অভিজিৎদাকে ওরা কোথায় নিয়ে রাখবে? নিজেদের বাড়িতে? এরকম পেশেন্টকে কিভাবে টেক-কেয়ার করতে হয়, ওদের কোনও ধারণা আছে? ওই মেয়ে-জামাইকে কখনও চোখেও দেখেনি। সেবা করার নাম করে ওঁকে শেষ পর্যন্ত কী অবস্থায় রাখবে কে জানে?
সুরথ অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার দেবশ্রীর কথায় সায় দিল —অভিজিৎদা এখানে যা সোশ্যাল সিকিওরিটি বেনিফিট পান, দেশে থাকলে মাসে এক লাখ টাকা। তাছাড়া নিজের সেভিংস রয়েছে। একজন লোকের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। উনি হয়তো ভাবছেন ওই সব টাকাকড়ি খরচ করে একটা ফ্যামিলির মধ্যে থাকবেন। বাট ইজ ইট রিয়েলি পসিবল্? এত বছর বাদে দেশে ফিরে একটা অচেনা এনভায়রনমেন্টে মানিয়ে নিতে পারবেন? বিশেষ করে এই বয়সে।

সন্ধ্যেবেলার আলোচনায় এ সব প্রশ্নের উত্তর অভিজিৎ নিজেই দিচ্ছিলেন। বোনকে দেখতে যেতে চান। তাঁর মেয়ে-জামাই-এর সংসারে নয়, কয়েকদিনের জন্যে গেস্ট হাউসে থাকবেন। তারপর দমদমে ওদের ফ্ল্যাট-এর কাছাকাছি একটা ওল্ড-এজ হোমে চলে যাবেন। বোনের মেয়ে জামাই খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা করছে। অসুস্থ শরীরে এত ডিপেনডেন্ট হয়ে পড়ছেন যে একা থাকতে আর ভরসা পাচ্ছেন না।
ডঃ বোস বোঝাতে চেষ্টা করলেন —ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভল করার মতো শরীরের অবস্থা তোমার নয়। আর, এটা তো জানো, ইন্ডিয়ায় অসুস্থ হলে আমেরিকার মেডিকেয়ার ইনসিওরেন্সের কোনও বেনিফিট পাবে না। তোমার ক্যানসার হয়তো রেকার করবে না। কিন্তু অ্যানুয়াল চেক-আপ-এ থাকতে হবে। তোমার বয়স, হার্ট কন্ডিশন, ব্যাক ইনজুরির এফেক্ট, এতগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর আছে…
অভিজিৎ মাথা নাড়লেন —আই এগ্রি উইথ ইউ। এই পয়েন্টগুলো বাদ দিলে কলকাতায় হয়তো আমার খারাপ লাগবে না।
মন্দিরা জানতে চাইল না —আপনি তো বোনের কাছে থাকছেন না। যদি সেই ওল্ড-এজ হোমেই থাকতে হয়, তো এখানকার নার্সিং হোম, অ্যাসিসটেড লিভিং ফেসিলিটির সঙ্গে কী ডিফারেন্স হল? জীবনের পঞ্চাশটা বছর যেখানে কাটালেন, যে সমাজের মধ্যে রইলেন, আজ সেখানেই যদি নিজেকে লোনলি মনে হয়, দমদমের ওল্ড-এজ হোমে গিয়ে নতুন করে কার সঙ্গ পাবেন? আমাদের মানসিকতা বদলে গেছে অভিজিৎদা!
মন্দিরার কথায় অভিজিৎকে কেমন যেন বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। মৈনাক প্রসঙ্গ বদল করার জন্যে সবাইকে ডাইনিং রুমে পাঠাল। অপালা ডিনারের জন্যে চাইনিজ খাবার আনিয়েছে। এবার বেশি আলোচনা বন্ধ করা দরকার। অভিজিৎ কাল ফিরে যাবেন। অপালা এর মধ্যে ওঁর ব্লাড প্রেসার নিয়েছে। ওঁর পা ফুলে যাচ্ছে। কাল ডাক্তারকে জানাতে হবে।
আরও পড়ুন : আকাশপ্রদীপ: পর্ব ১৪
সানরাইজ-এ ফেরার পর কয়েকদিন কেটে গেল। অপালা অভিজিতের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে, ডায়েটিশিয়ানের মত নিয়ে মাঝে মাঝে ডাল, তরকারি, মাছের ঝোল নিয়ে আসছে। ক্লাবের ‘উইমেন্স ফোরাম’-এর রঞ্জনা, পৌষালিরা এসব রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে। অভিজিৎ অবাক হয়ে যান। প্রফেশনালি সাকসেসফুল ব্যস্ত মেয়েগুলো তাঁর জন্য এত সময় দিচ্ছে! ওদের মধ্যে ক’জনকেই বা চেনেন? অপালা হাসে —আপনাকে আমেরিকায় ধরে বেঁধে রাখার জন্যে ওরা রোগীর ঝোল রাঁধতে শিখে গেল।
অভিজিতের শরীরে ক্রমশ নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। হার্টে জল জমছে। পা ফুলে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট। কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর-এর ওষুধপত্রে একটু উন্নতি হয়। আবার লক্ষণগুলো ফিরে আসে। রাতে ওষুধ খেয়েও ভালো ঘুম হয় না। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা। অভিজিৎ ভাবেন রুনুর সঙ্গে আর দেখা হল না। সময় থাকতে কখনও দেশে গেলাম না। রুনুও যেন আর আশা করত না। সারাজীবন দূরে থাকতে থাকতে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। সেদিন মৈনাকদের বাড়ি থেকে ফিরে অবধি বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছে। কাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছি? আমার সংসার ছিল না। এদের সঙ্গে এত বছরের মেলামেশা, সোশ্যাল ইন্টার্যাকশন, সুখে, দুঃখে কাছাকাছি থাকা। সেকেন্ড জেনারেশনও আমার জন্যে কিছু করতে চায়। মৈনাকের মেয়েটা ছোট থেকে আমার কোলে কোলে ঘুরছে। ফাদার্স ডে-তে ওদের সঙ্গে বাইরে খেতে নিয়ে যেত। এবার অনি ছেলেমেয়ে নিয়ে আসছে। ও নিজেও তো ডাক্তার। হয়তো আমার শরীর বুঝে কাছাকাছি কোথাও লাঞ্চে নিয়ে যাবে। বাচ্চাদুটোর জন্যে আমি কী নিয়ে যাব? নিচের গিফট শপ থেকে চকলেট নিতে পারি…

শুক্রবারের ফ্লাইটে অ্যাটলান্টা থেকে সঞ্জয় ওমি, শমীকে নিয়ে এসে পৌঁছলো। অনিকা আসবে পরদিন। রবিবার ফাদার্স ডে’র জন্যে ফোনে অপালাকে রেস্টুরেন্টে রিজার্ভেশন করে রাখতে বলেছে। তার আগে অভিজিৎকে দেখতে সানরাইজ-এ যাবে। মৈনাক মেয়েকে নিজেই এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসবে বলে দিল।
শনিবার অনিকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে মৈনাকের সেল ফোন বাজল। অপালা এমার্জেন্সি ফোন পেয়ে সানরাইজ-এ চলে গেছে। ফোনে সঞ্জয় আর কোনও খবর দিল না।
দু’শো দশ নম্বর ঘরের কাচের জানলার বাইরে বিকেলের ম্লান আলো। অভিজিৎদার জীবনের সূর্যাস্তের মুহূর্তে নার্স, ডাক্তারের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপালা। প্রবাসের এক আপনজন।
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।