বাঙালির কাছে পুজো মানে সারা বছরের নিয়ম থেকে ছুটি। এই ক’টা দিনের জন্য আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। কাজে মন বসে না, সারাক্ষণ মনে খালি পুজো পুজো ভাব। তবে বাচ্চাদের কাছে পুজো যেন আরও বড় উৎসব। স্কুলের হোমওয়র্ক নিয়ে চিন্তা নেই, ডিসিপ্লিনের চোখ রাঙানি নেই। শুধুই দেদার মজা। কিন্তু এ ক’টা দিন সত্যি কি বাচ্চাদের লাগামছাড়া হতে দেবেন না কি অল্পবিস্তর শাসনও করবেন? বাচ্চাদের সামলে রাখাটা তো বাবা-মারই কাজ। তাই না? আসলে বাঙালির কাছে পুজো আর শাসন দুটো প্রায় পরস্পরবিরোধী। আমরা বড়রা নিজেরাই নিজেদের শাসনে রাখতে পারি না,তো বাচ্চারা! কিন্তু তার পরেও, বাবা মায়েদের কাছে পুজোর এই ক’টা দিন বেশ চিন্তা নিয়ে আসে।
‘আমার মেয়ে তো একেবারে মাতোয়ারা হয়ে যায়। এত অবাধ্যতা করে পুজোর সময়। ভয় লাগে যদি কোনও বিপদ হয়,’ জানালেন আই টি সেক্টরের কর্মী পিউ মুখোপাধ্যায়। পিউ-এর মতো অনেক মাই বুঝতে পারেন না, পুজোয় বাচ্চাদের ঠিক কীভাবে শাসন করবেন। বকাবকি করতে চান না, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দিলে উচ্ছনে যাবে, এই ভয় তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়।
স্কুল শিক্ষিকা দেবশ্রী সাহু অবশ্য অন্য রকম ভাবেন। ‘পুজোর কটা দিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের একঘেয়ে রুটিনে আবদ্ধ করে রাখা উচিত নয়। তাদের জন্য কিছুটা শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা শিথিল করাই যায় ওই ক’টা দিন। পুজোর দিনগুলি তারা যাতে বড়দের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে, নিজের মতো করে কাটাতে পারে, তা দেখা দায়িত্ব বাবা-মায়েরই। কয়েকটা দিন নাই বা থাকল ইঁদুড় দৌড়ে সামিল হওয়ার প্রতিযোগিতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার চাপ। এটা সত্যি যে পুজো চলে গেলে পুনরায় মূলস্রোতে ফিরিয়া আনাটা কঠিন। কিন্তু বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারে। প্রথম কিছু দিন হয়তো চঞ্চলতা থাকবে, কিন্তু তারপর ফিরতেই হবে নিয়মের রাজত্বে। তাই এই কটা দিন বরং শাসন মুলতুবিই থাক’, জানালেন দেবশ্রী।
ভিক্টোরিয়া কলেজের মনস্তত্ব বিভাগের শিক্ষিকা ফুলজানি ঘোষ অবশ্য মনে করেন একটা ব্যালেন্স প্রয়োজন। ‘পুজোয় বাচ্চাদের ছাড় তো দিতেই হবে, কিন্তু একটু সাবধানে। পুজোর শুরুতেই যদি বাচ্চারা কথা না শুনতে চায়, তা হলে তাদের বোঝাতে হবে যে পুজো শুরু হতে এখনও সময় আছে, এখন থেকে নিয়ম ভাঙলে চলবে না। পুজোয় বাচ্চাদের একলা একেবারে ছেড়ে দেবেন না। সঙ্গে বড়দের থাকা বাঞ্ছনীয়। তারপরেও একটা কাগজে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে বাচ্চার জামার সঙ্গে আটকে দিন। এই সময় খাওয়াদাওয়া নিয়ে একটু সচেতন কিন্তু থাকতেই হবে, তাতে যদি অল্পবিস্তর শাসনও করতে হয়, করুন।’
উনি আরও জানিয়েছেন, যে পুজোর সময় এত আলো, এত ভিড়, এত আকর্ষণ দেখে বাচ্চারা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। একে স্টিমিউলি ওভারএক্সপোজার বলে। এরকম অবস্থায় বাচ্চা কিছুতেই রোজকার রুটিন মেনে কাজ করতে চায় না। বাবা মায়ের কথা শুনতে একদমই চায় না। জেদ এবং কান্নাকাটি বেড়ে যায়। খাওয়া থেকে ঘুম সব ব্যাপারেই বাবা মায়েদের সমস্যা হয়। এই অবস্থায় কথা শোনানোর জন্য বাবা মায়েরা কিছু টেকনিক ব্যবহার করতে পারেন যেগুলো সাইকোলজিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন পসিটিভ রিইনফোর্সমেন্ট। কোনও একটা কথা শুনলে বাচ্চাকে তার পছন্দের কিছু একটা করতে অনুমতি দিন। দেখবেন বাচ্চা তখন আর জেদ করছে না। আবার বার বার বারণ করা সত্ত্বেও বাচ্চা যদি কথা না শোনে, তা হলে বকাবকি না করে,বলুন যে ঠাকুর দেখতে নিয়ে গেলেও ও আইসক্রিম পাবে না। কারণ ও কথা শোনেনি।
মনে রাখবেন পুজোর ক’টা দিন বাচ্চা কথা শুনতে চাইছে না মানে এরকম নয় যে বাচ্চা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। পুজো তো আমাদের রুটিনও পাল্টে দেয়, তাই না! বাচ্চারাও এই সময়টায় বড়দের সাথে পাল্লা দিতে চায়। তাই কথা না শোনাকে একটু আদর করে সামাল দিন। দেখবেন এই চারটেদিন বাচ্চাকে নিয়ে আপনাদের খুব ভাল কাটবে।