পুজো (Puja) এসে গেলো, কাশবনে, শিউলির গন্ধে, শিশিরে, আর সাদা মেঘের ভেলায়। বহু বাঙালি উৎসবের রোশনাইতে মেতে উঠবে। নতুন জামার গন্ধ, প্যান্ডেল, ঠাকুর, আড্ডা আর হইহই। ভ্রমণবিলাসী বাঙালি যাবে, পাহাড় বা সমুদ্দুরে।আবার বহু মানুষের কাছে এই চারদিন উৎসবে (Puja) মাতামাতি করার বদলে নিখাদ বিশ্রাম নেওয়ার সময়। বছর ভরের ক্লান্তি কাটানোর সময়। বাঙালি উৎসবে মেতে উঠুক, বা নিরিবিলিতে সময় কাটাক, পুজোর (Puja) চারদিন মানে কিন্তু একটু স্বাদ বদল, পাতে একটু নতুনত্ব।
এই যেমন ষষ্ঠীর দিন! পাট ভাঙা নতুন সুতির শাড়ি বা জামা পরে প্যান্ডেলে মা দুর্গার বাড়ি আসার আনন্দে মন মশগুল। সেই সকালে পাতে থাকুক, সাদা ফুলকো লুচি সঙ্গে ছানার দমপোক্ত। (Puja)
ছানার দমপোক্ত
উপকরণ – ২৫০ গ্রাম ছানা ভালো করে চাপ দিয়ে জল ঝরিয়ে চৌকো টুকরো করে কাটা, দই ৫০ গ্রামধনে বাটা ১ চা চামচ ,১টা লাল শুকনো লঙ্কা বীজ ছড়িয়ে বাটা, ১/২ ইঞ্চি আদা বাাটা, পেঁয়াজ মাঝারি ১টি কুচি করা, কিসমিস ১৫/২০টা বাটা, খোয়া ক্ষীর মাঝারি ১ চামচ, স্বাদমতো নুন, ছোট এলাচ একটি, ফুল বাদ দেওয়া লবঙ্গ দু তিনটি, দারচিনি এক টুকরো, চিনি ১ চা চামচ, ঘি প্রায় ৫০ গ্রাম, বা তেল ঘি মিশিয়ে ৫০ গ্রাম, জাফরান ১ চিমটে (নাও দিতে পারেন)।

প্রণালী – ডেকচিতে ঘি দিয়ে আঁচে বসাতে হবে। গরম ঘিতে ডেলা ক্ষীর দিয়ে সামান্য লালচে হলে তুলে নিতে হবে এবং গুঁড়ো করে নিতে হবে। এই ঘিতেই ছানা লালচে করে ভেজে তুলে রাখতে হবে। তারপর পেয়াঁজ বাদামি করে ভেজে উঠিয়ে রাখতে হবে। ডেকচির ঘিতে ফেটানো দই, ধনেবাটা, আদাবাটা, লঙ্কাবাটা, কিসমিস বাটা, নুন, গুঁড়ো করা ক্ষীর ভাজা, একটু আধভাঙা করা লবঙ্গ এলাচ দারচিনি, পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে তাতে ভাজা ছানার টুকরোগুলো দিতে হবে। সম্ভব হলে জাফরান দিন। হালকা হাতে মিশিয়ে ঢাকনা দিয়ে, তার ওপর ভারী কিছু চাপা দিয়ে খুব কম আঁচে, ১৫-১৬ মিনিট রাখতে হবে, তারপর গরম গরম পরিবেশন, সাদা ফুলকো লুচির সাথে। ষষ্ঠীর দিন নিরামিষ দম পোক্ত করতে চাইলে পেয়াঁজ বাদ দেওয়া যেতে পারে।
সপ্তমীর (Puja) সকালে হালকা রঙের জামদানি আর কাঁথা কাজের পাঞ্জাবি জমিয়ে তুলবে প্যান্ডেলের আড্ডা। সময় বাঁচাতে ভাতের পাতে থাকুক “ইলিশের উল্লাস”। খুব সাদামাটা রান্না, অল্প সময়ে হয়ে যায়। এই রান্না ভেটকি বা কাতলার পেটি দিয়েও করা যেতে পারে। (Puja)
ইলিশ মাছের উল্লাস
উপকরণ – ইলিশ মাছ ৫০০ গ্রাম, রসুন ৩/৪ চা চামচ, শুকনো লঙ্কা দুটি, হলুদ ৬ গ্রাম, সরষেবাটা ২ বড়ো চামচের একটু বেশি, ভিনিগার ৬ বড় চামচ, মাছে মাখাবার নুন, আর বাটনায় দেবার নুন, সর্ষের তেল ৩ বড় চামচ।

প্রণালী – ইলিশ মাছ ধুয়ে নুন মাখিয়ে রাখতে হবে। রসুন, হলুদ, লঙ্কা, সরষে সব আলাদা করে বেটে রাখতে হবে। এরপর সব বাটনাগুলোর সঙ্গে একসাথে ভিনিগার মিশিয়ে সেটা ছেঁকে নিতে হবে, শুধু ভিনিগার ও মশলা মেশানো জলটা লাগবে। এবার ওই ভিনিগার মশলার জলটায় মাছ সাজিয়ে দিতে হবে। তারপর সর্ষের তেল দিয়ে, পাত্রটি ঢেকে খুব কম আঁচে রান্না করতে হবে। দশ বারো মিনিটের পর রেডি হয়ে যাবে সুস্বাদু আর মুখরোচক ইলিশ মাছের উল্লাস।
অষ্টমীর (Puja) সকাল। নদীর ধারের কুয়াশা মোড়া কাশবনে তখন মুনিয়া পাখি দোল খায়। তিরতির বয়ে যায় নদী। বর্ষার রূপ এখন আর নেই। নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে গেলেই ছোট প্যান্ডেল। কচিকাঁচারা হাত ধরে পুজো (Puja) দেখতে এসেছে, অঞ্জলি দেবে। কারোর হাতে বেলুন বা কারোর হাতে হাওয়ায় ঘোরা ঘূর্ণি চাকা। সবার সঙ্গে অঞ্জলি দিয়ে বাড়ি ফিরে শুদ্ধ মনে, দুপুরের পাতে থাকুক “ছোলার ডালের ভুনা খিচুড়ি”, সঙ্গে আলুর দম, বেগুন ভাজা আর চাটনি। (Puja)
ছোলার ডালের ভুনা খিচুড়ি
প্রণালী – ছোলার ডাল ১০০ গ্রাম, মিহি সুগন্ধ যুক্ত পুরোনো আতপ চাল ২৫০ গ্রাম, আদাবাটা ১ চা চামচ, হলুদবাটা ১/২ চা চামচ, গরম মশলা বাটা ১/২ চা চামচ, ছেঁচা গরম মশলা (২ ছোট এলাচ, ২ লবঙ্গ, ছোট ৪-৫ টুকরো দারচিনি), আদা কুচি মাঝারি ১/২ চামচ, ফোড়নের জিরে ১ চা চামচ, তেজপাতা ২/৩ টি, হিং গুঁড়ো ১ চিমটি, পরিমাণমতো নুন, চিনি আড়াই চা চামচ, কাঁচালঙ্কা ৫/৭ টা, তেল আর ঘি।

উপকরণ – চাল আর ডাল ভালো করে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে, চালের জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। ডাল শক্ত সেদ্ধ হবে, বেশি নরম নয়। ডাল সেদ্ধ করে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। একটা ডেকচিতে তেল দিয়ে, ওই গরম তেলে জিরে, তেজপাতা দিয়ে লাল হলে, ছেঁচা গরম মশলা, আদাকুচি আর হিং দিয়ে খানিকটা ঘি দিতে হবে। এর পর তাতে যাবে জল ঝরানো চাল। একটু নাড়াচাড়া করে তাতে যাবে ডাল। আদাবাটা, হলুদবাটা দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে, সুগন্ধ বেরোলে দিতে হবে ডাল সেদ্ধ জল। পরিমাণমতো নুন চিনি কাঁচালঙ্কা দিয়ে টগবগ করে ফুটলে আঁচ কমিয়ে দিতে হবে। তারপর ঢাকা দিয়ে রান্না হবে যতক্ষণ চাল ডাল সুসিদ্ধ হয়। একদম ঝরঝরে হবে এই খিচুড়ি। তাই এতে অল্প জল দিয়েই রান্না করতে হবে। লাগলে অল্প করে গরম জল দেওয়া যেতে পারে। শেষে ঘি গরম মশলা মিশ্রণ দিয়ে মুখ ঢেকে দমে রাখতে হবে। ব্যাস তৈরি!
নবমীর সন্ধ্যে, পুজো (Puja) প্রায় যায় যায়, বন্ধুবান্ধব সবাইকার মন জয় করতে পাতে থাক খুলনার ঐতিহ্যবাহী “চুই ঝাল মাংস..” এর স্বাদ গন্ধ দুই অতুলনীয়। চুই ঝাল পান প্রজাতিভুক্ত একটি লতানে গাছ। যার কাণ্ড টুকরো করে খোসা ছাড়িয়ে মাংস রান্নায় দেওয়া হয়। মাংসর সাথে চিবিয়ে রস খেতে হয়। সমস্যা হলো, এটি পাওয়া যায় কোথায়। অনলাইনে শুকনো কাণ্ড পাওয়া যায়। আর সবচেয়ে ভালো হয়, বাড়ির টবে একটা গাছ বসিয়ে নিলে। টাটকা চুই ঝালের স্বাদই আলাদা। শুকনো কিনলে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে সারারাত। ভিজানো জল রান্নায় ব্যবহার করা যাবে। ভেজানো চুই, পরদিন খোসা ছাড়িয়ে ব্যবহার হবে রান্নায়। (Puja)
চুই ঝাল মটন
প্রণালী – ১ কেজি মাংস, এক কাপ সরু করে কাটা স্লাইস পেয়াঁজ, গোটা রসুন ৪/৫ টা, আদাবাটা এক চামচ, রসুনবাটা এক চামচ, গোটা লবঙ্গ ৩/৪, দারচিনি ২/৩ টুকরো, তেজপাতা দুটো, ছোট এলাচ ৩/৪ টে, ধনেগুঁড়ো ৩ চামচ, জিরেগুঁড়ো ২ চামচ, হলুদগুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়ো ৩/৪ চামচ, নুন স্বাদমতো, চুই ঝাল ডাল ১০০ গ্রাম, তেল আধ কাপ।

উপকরণ – পাত্রে তেল গরম করে, তাতে পেঁয়াজ কুচি ভাজতে হবে। বেশ হালকা বাদামি হতে শুরু করলে গোটা গরম মশলা আর তেজপাতা দিয়ে নাড়তে হবে। তারপর সব কিছু বেশ সুন্দর বাদামি রং ধরলে মাংস আর নুন দিয়ে মিনিট দশেক ভাজতে হবে। মাংস ভাজতে ভাজতে এতে যাবে আদা-রসুন বাটা। একটু নাড়িয়ে নিয়ে দিতে হবে ধনে জিরে হলুদ লঙ্কা গুঁড়ো। খুব ভালো করে কষতে কষতে দিতে হবে চুই ঝালের ভিজানো টুকরো। নাড়াচাড়া করে ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে রাখতে হবে মাংস। তারপর প্রায় সেদ্ধ হবার মুখে গোটা রসুনগুলো একটু ছুরি দিয়ে চিরে দিয়ে দিতে হবে, সঙ্গে চুই ঝাল ভেজানো জল। ভালো করে সেদ্ধ হলে মাখা মাখা মাটন রেডি!
দশমীর (Puja) বিষন্নতা, মা’কে বরণ করে বিদায় জানিয়ে, বিজয়ার (Puja) পালা। বাড়িতে বানানো মিষ্টির স্বাদ আর চমক আলাদা। “ছানার রস গজা” কয়েকদিন আগেই ভেজে ফ্রিজে রাখা যাবে। বিজয়ার দিন শুধু গরম রসে ডুবিয়ে মিষ্টি মুখ করানো। আর রইলো চকোলেট আর রসগোল্লা প্রেমী দের জন্যে, চকোলেট মোড়া রাজভোগ। দুটির স্বাদ একদম স্বতন্ত্র ভাবে ধরা পড়বে রসনায়।
ছানার রস গজা
উপকরণ – জলশূন্য ছানা ২৫০ গ্রাম, ময়দা ২৫০ গ্রাম, খাবার সোডা সামান্য, ভাজার জন্য ঘি বা তেল, ৬০০ গ্রাম চিনির ঘন রস, সামান্য এলাচ গুঁড়ো, ময়ানের জন্যে ঘি এক বড় চামচ।

প্রণালী – ময়দাতে ঘি-এর ময়ান ও সামান্য সোডা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে তাতে ছানা ভালো করে ডলে মিহি করে ময়দার সঙ্গে মেখে নিতে হবে, খুব ভালো করে। এতে এলাচ গুঁড়ো মেশাতে হবে। তারপর পছন্দ মতো আকার দিয়ে, গরম ঘি’তে অল্প আঁচে ভেজে নিয়ে ঘন রসে ফেলতে হবে। দুই তিন ঘণ্টা রসে রাখলেই রেডি।
চকোলেট রাজভোগ
উপকরণ – রসগোল্লা দশটি ( বাড়িতে বানিয়ে নেওয়াও যেতে পারে), ডার্ক চকোলেট ২০০ গ্রাম, দারচিনি গুঁড়ো ২ চা চামচ, আখরোট কুচি এক চামচ।

প্রণালী – রসগোল্লার রস কিছুটা চিপে নিন। ডাবল বয়লারে গলিয়ে নেওয়া ডার্ক চকোলেট, আখরোট কুচি আর দারচিনি মিশ্রণে ভালো করে কোটিং দিন। একটা প্লাস্টিক পাত্রে মাখন লাগিয়ে তাতে ওই রসগোল্লা রেখে ডিপ ফ্রিজে ঠান্ডা করে নিতে হবে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পরিবেশন করা হবে।
এখানে রসগোল্লা বাড়িতে বানানো, আর ভিতরে অ্যাপ্রিকট ভরা -স্বাদ আর পুষ্টির মেলবন্ধন।
ছবি সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।