আমার মেয়ের স্কুলের মায়েদের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। তাতে রোজই বাচ্চাদের ব্যাপারে নানা আলোচনা হয়। বেশিরভাগকেই দেখেছি বাচ্চাকে নিয়ে বড় ব্যতিব্যস্ত। স্কুলে ক’টা ছবি ঠিক করে রং করল, ক’টা অ্যালফাবেট ঠিক করে ট্রেস করল তাই নিয়ে মাথা খারাপ করেন। কেউ কেউ তো এখনই তাঁদের বাচ্চাকে নাচ, গান আর আঁকায় ভর্তি করে দিয়েছেন। বাচ্চাদের বয়স কিন্তু এখনও সাড়ে তিন-এর গণ্ডি ছাড়ায়নি! আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাচ্চাদের উপর কি এতে অহেতুক চাপ পড়ে না? এতে কি ওদের ছেলেবেলার অফুরান আনন্দ, সারল্য হারিয়ে যায় না? সন্তান মানুষ করার কি এই একই পদ্ধতি আছে? সারা বিশ্বের বাচ্চাদের শৈশবই কি আজ কেবল মাত্র পড়াশোনা, নম্বর, পরীক্ষা, পাশ-ফেলের নিয়েমের বেড়াজালে আবদ্ধ? বোধহয় না। যেমন নেদারল্যান্ডে বাচ্চাদের ছেলেবেলা ঠিক রূপকথার মতো। পড়াশোনার চাপ নেই, বাবা-মার সঙ্গে সময় কাটানোর অফুরন্ত সুযোগ আছে, নিজের মতামত প্রকাশ করার অধিকার আছে। তাই বোধহয়, তারা বড্ড হাসি-খুশি। আর এই তকমা আমি নয়, দিয়েছে স্বয়ং ইউনিসেফ। ডাচেদের পেরেন্টিং স্টাইল বা সন্তান বড় করার পদ্ধতি একেবারেই আলাদা। আমরা তো বিদেশি কত কিছুই অনুকরণ করি। এবার নয় ডাচ পেরেন্টিং স্টাইল থেকে কিছু শিক্ষা নিই, যাতে আমাদের সন্তানরাও তাঁদের শিশু মনের সরলতা জিইয়ে রাখতে পারে। আসুন দেখে নিই ডাচ বাচ্চারা কেন এত সুখী:
বাচ্চারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমনোর সুযোগ পায়-একটি গবেষণা অনুযায়ী দেখা গেছে যে, আমেরিকার বাচ্চাদের তুলনায় নেদারল্যান্ডসের বাচ্চারা অনেক বেশি হাসে, খুশি থাকে। কথায় কথায় বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর একটা বড় কারণ ভাল ঘুম। ডাচ বাচ্চাদের শান্ত আচরণের নেপথ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম। অন্যান্য দেশে যেখানে বাচ্চাদের একসঙ্গে নাচ, গান, খেলাধুলো করার জন্য চাপ দেওয়া হয়, সেখানে নেদারল্যান্ডসে বাবা-মায়েরা বাড়ির কাজের উপর জোর দেন। বাচ্চারা বাড়ির কাজে সাহায্য করে আবার রিল্যাক্স করার, আরাম করার যথেষ্ট সুযোগ পায়। বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের বিশ্রাম নিয়ে কোনও রকম আপস করেন না। বাচ্চারা ভাল করে ঘুমোয় বলে, বাবা-মাও নিশ্চিন্তে আরাম করতে পারেন। সারা পৃথিবীতে ডাচরা সর্বাধিক পরিমাণ ঘুমোয়। প্রতি রাতে তাঁরা ঘুমোন প্রায় আট ঘণ্টা ১২ মিনিট!
বাচ্চাদের অনেক বেশি সময় দেন বাবা-মা– ১৯৯৬ সালে নেদারল্যান্ডসের সরকার ফুল টাইম আর পার্ট টাইম চাকুরিজীবিদের অধিকার সমান করে দেয়। ফলে নেদারল্যান্ডসে এখন বহু মানুষই পূর্ণ সময় চাকরি না করে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। সপ্তাহে মাত্র ২৯ ঘণ্টা কাজ করলেই হয় তাঁদের। তাই তাঁরা সন্তানকে অনেক বেশি সময় দেন আর শুধু মায়েরা নন, বাবারাও সন্তানের ভাল-মন্দ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। সপ্তাহে একটা পুরো দিন তাঁরা বার করেন সন্তানের জন্য। স্থানীয়রা এই দিনটিকে নাম দিয়েছেন, ‘পাপাডগ’ যার অর্থ ‘ড্যাডি ডে’।
পরীক্ষায় ভাল ফল করার জন্য বাচ্চাদের উপর চাপ দেওয়া হয় না-বাচ্চাকে কোন স্কুলে ভর্তি করব, তা নিয়ে বাবা-মায়েদের চিন্তার শেষ নেই। ডাচ বাবা-মায়েরা কিন্তু এমন ভাবে ভাবেন না। তাঁদের কাছে পড়াশোনা সন্তানের ভাল থাকা এবং বিকাশের একটা মাধ্যম মাত্র। নেদারল্যান্ডসে দু’ধরনের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা আছে—গবেষণা সংক্রান্ত ডিগ্রি যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হয় এবং পেশা সংক্রান্ত ডিগ্রি যা কলেজগুলোয় পড়ানো হয়। হাই স্কুল পাশ করলেই অ্যাডমিশন পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট কোনও গ্রেড বা নম্বরের প্রয়োজন পড়ে না। ‘ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি’-র হ্যাপিনেস প্রফেসর রুট ভিনেভেন-এর মতে নেদারল্যান্ডসে সাফল্যের চেয়ে বেশি সামাজিক দক্ষতার উপর জোর দেওয়া হয়। সুখী হতে আই কিউ-র চেয়ে তাই বেশি জরুরি। ফলে বাবা-মায়েদেরও পড়াশোনা নিয়ে ভাবতে হয় না এবং ছেলেমেয়েদের উপর অযথা চাপ সৃষ্টি করতে হয় না।
বাচ্চাদের নিজেদের মতামত প্রকাশ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়-পরিবারের সকলের এমনকী বাড়ির সবচেয়ে খুদে সদস্যের মতামতের দাম দেওয়া হয়। তিন বছর বয়স থেকেই বাচ্চারা বুঝতে পারে তাদের কোনটা ভাল লাগে, কোনটা নয়। তার মানে এই নয় যে বাচ্চা যা বলে তা মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু তার বক্তব্য শোনা হয় এবং তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নেগোশিয়েশন পেরেন্টিংয়ে বিশ্বাস করেন ডাচ বাবা-মা। এর ফলে বাচ্চা নিজেই বুঝতে শিখে যায় কোনটা ঠিক এবং কোনটা ভুল। নিজের গণ্ডি নিজেই ঠিক করে নেয়। বাবা-মা বুঝিয়ে দেন কেন ওর কথা শোনা হচ্ছে এবং শোনা হচ্ছে না । ছোট থেকেই যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয় বলে ওরা বড় হয়ে সব পরিস্থিতি যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। চট করে অন্যদের দ্বারা চালিত হয় না। নিজের মতাদর্শে বিশ্বাস রাখতে শেখে।
বাচ্চারা ব্রেকফাস্টে চকোলেট স্প্রিঙ্কলস খায়-চকোলেট? রোজ সকালে? অনেকেই নিশ্চয় বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবে এর পিছনে গভীর অর্থ আছে। সকলে মিলে একসঙ্গে টেবলে বসে খাওয়াটা ডাচেদের পারিবারিক রীতি। ছোটরা প্রথম থেকে একসঙ্গে বসে খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে না, তাই তাঁদের ব্রেকফাস্টে চকোলেট স্প্রিংকলস দিয়ে বসানো হয়। যাতে তারা সকলের সঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট করার কারণ খুঁজে পায়। পরবর্তীকালে অবশ্য আর চকোলেটের প্রলোভন দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না। এমনকী, বাচ্চারা যতক্ষণ টেবলে এসে না বসে, ততক্ষণ কেউ খাওয়া শুরু করেন না। আসলে ছোটদেরও এখানে সম্মান করা হয়। সার্ভেতে দেখা গেছে যে সমস্ত বাচ্চারা পরিবারের সকলের সঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট খায়, তাঁরা স্কুলে খুব ভাল পারফর্ম করে। পারিবারিক বন্ধনও এতে দৃঢ় হয়।
তা হলে বুঝতেই পারছেন, আমরা কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক হলেও এখনও পুরোপুরি উদারমনস্ক হয়ে উঠতে পারিনি। তার জন্য অবশ্য আমাদের সামাজিক কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থাও দায়ী। এখানে সাফল্যের এক মাত্র মাপকাঠি, পরীক্ষার নম্বর, ডিগ্রি কিংবা আয়ের অঙ্ক। শিশু মনের ভাল থাকাটা সেখানে নেহাতই গৌণ। কিন্তু আমরা সবাই মিলে তো এই ছবিটা বদলাতে পারি। চেষ্টা করতে পারি এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে, যেখানে বাচ্চারা চাপ মুক্ত হয়ে থাকতে পারে।