নিঃশব্দে ইতিহাস গড়েছেন এক নারী। তাঁকে নিয়ে বিশেষ হইহল্লা নেই গণমাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমেও। তবু তিনি আছেন। নীরবে নিজের কাজ নিয়ে। নিজের গড়া ইতিহাস নিয়ে। সেই ইতিহাসের শিখরে পৌঁছনোর একলা লড়াই নিয়ে।
তাঁর নাম মঙ্গলা মণি। বাড়ি হায়দরাবাদের এক গঞ্জ শহর সৈফাবাদে। সেখান থেকেই একদা স্কুল কলেজ হয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই যাত্রা শুরু করেছিলেন মঙ্গলা। মনে গোপনে সযত্নে লালিত স্বপ্ন থাকলেও তা সফল করে নজির গড়বেন, এমন আশা খুব একটা ছিল না। ৫৬ বছর বয়সে যখন সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটল, তখনও স্মিতহাস্য আর মৃদু কণ্ঠের কিছু কথা ছাড়া তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না তাঁর গলায় বা শরীরী ভাষায়। কারণ মঙ্গলা মানুষটাই এমন।
দক্ষিণ মেরুর ভয়াবহ প্রতিকূল আবহাওয়ায় ৪০৩ দিন কাটিয়ে ফিরে আসা প্রথম মহিলা বৈজ্ঞানিক হিসেবে মঙ্গলা মণির অবশ্যই প্রাপ্য ছিল আরও অনেকটা খ্যাতি, যশ, নামডাক। কিন্তু তা নিয়ে বিন্দুমাত্র খেদ নেই তাঁর মনে। নিজের কাজে আত্মমগ্ন এই নারী বরং সবার প্রথমে উল্লেখ করেন মেরুপ্রদেশের পরিবেশের বিষয়টি। যে দু’একটি সংবাদমাধ্যম তাঁর কাছে পৌঁছেছিল, তাদের গোড়াতেই জোরালো কণ্ঠে জানান, “সমস্ত বিচ্ছিন্ন বর্জ্যপদার্থ (খাবার, কার্ডবোর্ড, কাচ, টিন, প্লাস্টিক, কাগজ, জৈববর্জ্য) আমরা সঙ্গে করে নিয়ে ফিরে এসেছি। মেরু অঞ্চলের পরিবেশ যাতে কোনও ভাবেই দূষিত না হয় সে কথা মাথায় রেখেই। এটাই আমাদের কর্তব্য ছিল।”
কিন্তু কেন গিয়েছিলেন তিনি দক্ষিণ মেরুর সেই অগম গন্তব্যে?
গিয়েছিলেন ইসরো-র (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন) বৈজ্ঞানিক দলের অংশ হিসেবে। ২৩ সদস্যের এই দলের মধ্যে মঙ্গলা ছিলেন একমাত্র মহিলা। ‘ভারতী’ নামে দক্ষিণ মেরুতে ভারতের যে স্যাটেলাইট গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে, সেখানেই মহাকাশ গবেষণার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হয়েছিল তাঁর মেরুযাত্রা। শেষ হয়েছিল গত ডিসেম্বরে। তবে শুধু ভারতীয় নয়, সেই সময় গোটা মেরুপ্রদেশে সারা বিশ্বের যত গবেষক ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও মঙ্গলা ছিলেন একমাত্র নারী।
গত একবছরে তাঁকে নিয়ে খুব সামান্যই লেখালিখি হয়েছে। তবে আগেই বলেছি, তা নিয়ে একেবারেই ভাবিত নন কর্মযোগিনী মঙ্গলা। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ভারতীয়দের উত্তেজনা মেটাতে স্মিতহাস্যে বলেছেন, “মেরু অঞ্চলের শীতলতম এলাকায় আমরা ছিলাম। সেখানে যে ভয়ানক ঠান্ডা থাকবে, সেটা তো জানাই ছিল। অবশ্যই সেটা প্রধানতম চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের কাছে। যদিও রিসার্চ স্টেশনের ভিতরটা ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাইরের আবহাওয়া সেখানে আঁচ ফেলতে পারত না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই তো বাইরে বেরতে হত গবেষণার কাজে। মেরু-পরিচ্ছদ এক বিশেষ ধরনের পোশাক যা আমাদের পরতে হত বাইরে বেরতে গেলে। কিন্তু সেটা চাপিয়েও দু’তিন ঘণ্টার বেশি বাইরে থাকা যেত না। তাপমাত্রা থাকে মাইনাস নব্বই ডিগ্রির কাছাকাছি। ঘণ্টা দু’তিন পরেই কোনওক্রমে রিসার্চ স্টেশনে ফিরে আসতাম নিজেকে একটু গরম করতে।”
সৈফাবাদ শহরে জন্মানো সাধারণ দক্ষিণী কিশোরী মঙ্গলার দক্ষিণ মেরু যাত্রাপথটা ঠিক কী রকম ছিল? কী ভাবে পৌঁছলেন তিনি অভীষ্ট লক্ষ্যে?
ইচ্ছে করলেই তো আর ব্যাগপত্তর গুছিয়ে দক্ষিণ মেরু যাওয়া যায় না! তাও আবার মহাকাশ গবেষণা করতে! দক্ষিণ ভারতের এক সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে মঙ্গলা জানিয়েছেন তাঁর বেড়ে ওঠার গল্প। ছ’ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মঙ্গলা তাঁর মূল্যবোধ এবং সুশিক্ষার সবটুকু কৃতিত্ব দিয়েছেন তাঁর বাবা-মাকে। স্কুলে পড়াকালীনই খবরের কাগজে নাসা-র মঙ্গল অভিযান সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্বপ্ন দেখার শুরু তখন থেকেই। স্কুল পাশ করার পরেই হায়দরাবাদের সরকারি পলিটেকনিকে ‘মডেল ডিপ্লোমা ফর টেকনিশিয়ান্স – রেডিও এপারেটাস” নামে একটি চার বছরের পাঠক্রমে ভর্তি হন মঙ্গলা। শুনেছিলেন এখান থেকেই বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য গবেষক নিয়োগ করে ইসিআইএল, হ্যাল, ইসরোর মতো সংস্থাগুলি। কলেজেও আশি জনের ব্যাচে একমাত্র ছাত্রী ছিলেন মঙ্গলা মণি। ফলে পুরুষশাসিত কর্মক্ষত্রে তাঁর একা চলার অভিজ্ঞতার শুরু সেখান থেকেই।
হ্যাল (HAL)-এ কিছুদিন অ্যাপ্রেন্টিসশিপ করার পরেই ইসরো থেকে ডাক পান মঙ্গলা। গোড়ায় বাবা মায়ের ভয় ছিল মেয়েকে এই অজানা দুর্গম পথে একলা চলতে দেওয়ায়। কিন্তু মঙ্গলার জেদের সামনে ধোপে টেঁকেনি তাঁদের আপত্তিও। দীর্ঘ সময় যুক্ত রয়েছেন ইসরোর সঙ্গে। বর্তমানে হায়দরাবাদের ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার (NRSC) তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র। দক্ষিণ মেরুর রিসার্চ স্টেশনে স্যাটেলাইট থেকে প্রচুর তথ্যাবলি ডাউনলোড করা হয়। সেগুলি আবার স্যাটেলাইট লিঙ্কের মাধ্যমে হায়দরাবাদের গবেষণাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। এই তথ্যই জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় সাহায্য করে।
কিন্তু যে মেয়ে জীবনে কখনও বরফের মুখ দেখেননি, দক্ষিণ মেরু যাওয়ার কথায় তাঁর কি একবারের জন্যও বুক কাঁপেনি?
হয়তো কেঁপেছিল!
কিন্তু তাকে আমল দেওয়ার মানুষ নন মঙ্গলা মণি। পৃথিবীর শীতলতম, শুষ্কতম এবং নির্জনতম স্থানে ২২টি অচেনা পুরুষের সঙ্গে চলে যেতে হবে শুনেও এতটুকু বিচলিত হননি তিনি। বরং শুরু করে দেন প্রাণপণ ট্রেনিং। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিবিজ্ঞান মন্ত্রকের অন্তর্গত ন্যাশনাল সেন্টার ফর আন্টার্কটিক এন্ড ওশান রিসার্চ (NCAOR)-এর মাধ্যমেই শুরু হয় কাজ।
প্রথমেই নয়াদিল্লির এইমসে (AIIMS) লাগাতার হপ্তাখানেক ধরে চলে বিভিন্ন স্বাস্থ্যপরীক্ষা, যার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য অন্যতম, কারণ দীর্ঘ সময় প্রবল ঠান্ডায় থাকার ফলে সর্বপ্রথম প্রভাব পড়তে পারে স্নায়ুতন্ত্রে। এর পরের দু’সপ্তাহে মঙ্গলার বরফের সঙ্গে প্রথম মোলাকাত। তাঁদের গোটা দলকে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরাখন্ডের আউলি-তে (৯০০০ ফুট) এবং তারপর বদ্রিনাথে (১০,০০০ ফুট) “আইস এক্লিমেটাইজেশান” নামক প্রকল্পে। সেখানেই শুরু হয় বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা, নানা যন্ত্রপাতির ব্যবহার, মেরু-পরিচ্ছদ বহন করা, সতর্কতামূলক ব্যবস্থার প্রশিক্ষণ। মঙ্গলার কথায়, “ওই সময়েই দু’টি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস আমাদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক আত্মবিশ্বাস এবং দুই, টিম স্পিরিট। পরবর্তী ক্ষেত্রে এগুলোই আমাদের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।”
কেমন লেগেছিল প্রথমবার দক্ষিণ মেরুর তুষারাবৃত মাটিতে পা ঠেকাতে? মঙ্গলার জবানিতে, “উত্তেজনায় আর বিহ্বলতায় কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওইরকম ঘন তুষারাবৃত রানওয়েতে বিমান যখন ভূমিস্পর্শ করল, বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এটা সত্যি। চারিদিকে হিমশৈল, বরফের চাঁই, পায়ের নীচে পুরু বরফের চাদর, ধূধূ করছে তুষারপ্রান্তর – ওই নিসর্গ-সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। কোনও বিশেষণই তার জন্য যথেষ্ট নয়।” তবে মেরুপ্রদেশে পা দেবার পর পনেরোটি দিন কেটে গিয়েছিল শুধু প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতেই। মাঝে মাঝে আসত রসদের জাহাজ। নইলে খাবেন কী? দু’তিনমাস অন্তরই আসত টাটকা ফল, সবজি, দুধ, ডিম, গুঁড়ো দুধ, রুটি, মাখন, চাল, ডাল, নুন, চিনি, জ্যাম, ওটস, আচার, ভুট্টা-সহ নানা খাদ্যদ্রব্য। আর নিয়মিতই আসত মূল ভূখণ্ডের স্টেশন থেকে সতর্ক থাকার বার্তা, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ।
কিন্তু শুধুই কি কাজ? মোটেই না!
হোক না মাইনাস নব্বই। কাজের ফাঁকে আনন্দটুকু কি বাদ দেওয়া চলে? জন্মদিন থেকে শুরু করে নারী দিবস – সবই পালিত হত সেই মেরুগৃহে! ওখানেই মাইক্রোওয়েভে ডিম ছাড়া কেক বানাতে শিখেছেন মঙ্গলা। নারী দিবসে মায়ের জন্য মেরুদেশের নিসর্গের ছবি সেলাই করে বানিয়েছেন বালিশের ঢাকনা। ভয়, উদ্বেগ, মন-কেমন, এসব কি একেবারেই হত না? “কে বলেছে হত না?” সপ্রতিভ জবাব মঙ্গলার। “যখন দেখছিলাম দেশে ফেরার কোনও ঠিক নেই, খুব উদ্বেগ হত। খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমাদের রিলিভার দলটি পৌঁছতে পারছিল না। আমাদেরও ফেরার দিন পিছিয়ে যাচ্ছিল। তখন খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটত।”
অবশেষে গত বছর দেশে ফেরা হয়েছে মঙ্গলার। এই অভাবিত অভিজ্ঞতার রসদ সঞ্চয় করে ঘরের মেয়ে ফিরেছেন ঘরে। মুখে বলছেন, “হতে পারে পুরুষের পেশিশক্তি বেশি। কিন্তু মনের জোরে মেয়েরা অনেক এগিয়ে। সব মেয়েদের উচিত নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা আর নিরন্তর নিজের ভেতর থেকে সবচেয়ে ভালোটা বের করে আনা। আমার এই কাজ দেখে শুনেছি আরও এক দু’টি মেয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছে। এগিয়ে এসেছে মেরু-অভিযানের ব্যাপারে। এর চেয়ে বড় সাফল্য আমার আর কিছু নেই।”
শুধু দেখেই বা কেন মঙ্গলা? যাঁরা এ লেখা খুঁজলেন, পড়লেন, মনে রাখলেন, এমনকি যাঁরা আপনার কথা লিখলেন, কে বলতে পারে, তাঁরাও হয়তো আগামীর সকালগুলোয় দিনগত পাপক্ষয়ের শুরুটা করবেন ‘উহ আর পারি না বাপু’-র বদলে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে? ‘আমি সব পারি’-র মতো হাসি?
তথ্যঋণ – দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়া টুডে, দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!