কথায় বলে, মাছের নামে গাছও হাঁ করে! তো মানুষ কোন ছার! তার মধ্যে মাছ আর বাঙালি তো এক্কেবারে অবিচ্ছেদ্য তাই না? বাঙালির জীবনে মাছ মানে কি স্রেফ খাবার? মাছ হলো একটা আস্ত আবেগ! বৃষ্টিতে ইলিশমাছ ভাজা আর খিচুড়ি, শীতের রাতে ইংরিজি কেতার মাছভাজা বা ফিশ ফ্রাই, ঘটি বাঙালের চিংড়ি ইলিশ তরজা, বিয়ের মাঙ্গলিক চিহ্ন হিসেবে মাছ– এ এক্কেবারে বাঙালির জিনের ভিতর দিয়া মরমে ঢুকে রয়েছে। মাছ জড়িয়ে বাঙালির সাহিত্যে সংস্কৃতিতেও, বাঙালির জীবনের প্রতিটি শুভকাজে, প্রতিদিনের ‘সামান্য দুটি’ মাছভাতের পাতে..। মাছ মিশে গেছে ভাষায় আর লোকগাথা-লোকাচারেও। বাংলা প্রবাদপ্রবচনই বলুন বা বাগধারা– কত রকম মাছ! কই মাছের প্রাণ, ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না, গভীর জলের মাছ, ধরি মাছ না ছুঁই পানি, রাঘব বোয়াল, চুনোপুঁটি, আরো কত কি। প্রচলিত ছড়াতেও সেই একই ছবি…
“খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি
কী দিয়ে ভাত খেয়ে
নাদন ঘাটের পাট ট্যাংরা
নদের বেগুন দিয়ে…”
এই যে, মায়েদের কাছে, খোকা খুকুরা সুখে থাকতে সোনাদানার চাহিদা নয়, দুটি মাছে ভাতে থাকলেই হলো… এ বড়ো কম কথা নয়! নদী নদ ভর্তি বাংলার সাহিত্যে তাই মাছের কথা বার বার আসে। সে গোপাল ভাঁড়ের সেই ইলিশ কেনার গল্পই হোক, কিম্বা মানিক বাবুর ‘পদ্মা নদীর মঝি’ র ইলিশ ঘাটের কথা হোক বা রাধাপ্রসাদ গুপ্তের ‘মাছ ও বাঙালি’! কিম্বা ধরো আরো একটু পিছনে গেলে, মঙ্গলকাব্যে তো মাছের ছড়াছড়ি। মনসামঙ্গলে বরিশালের বিজয় গুপ্ত লিখলেন..
“রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হলো হরষিত।
মৎস্যের ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত॥
মৎস্ত মাংস কাটিয়া ধুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস দিয়া রান্ধে কলতার আগ॥
মাগুর মৎস্ত দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ।
সাজ কটু তৈলে রান্ধে খরযুল মাছ।”
ময়মনসিংহের দ্বিজ বংশিদাস তার মনসামঙ্গল কাব্যে লিখলেন..
“বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি।
জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি”
অর্থাৎ কিনা বলা হচ্ছে, লখিন্দরের সঙ্গে বেহুলার বিয়েতে চাঁদ সওদাগর অতিথি আপ্যায়নে খাওয়াচ্ছেন বেসন দিয়ে চিতল মাছের কোল ভাজা, জিরে লবঙ্গ দিয়ে বড়ো বড় কই ভাজা, আম দিয়ে কাতলা, এরকম প্রায় আঠারোটি মাছের পদ! ওদিকে, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখলেন, “মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক”!
তা যে মাছ আর তার ডিম মৃতকেও বাঁচিয়ে তোলে, সেই মাছ দিয়ে এবারের জামাইষষ্ঠীর আয়োজন করা গেলে মন্দ কী! মাংস তো অনেক হল, এবারে ছেলে-বৌমা, মেয়ে-জামাইকে আদর করে মঙ্গল কামনায় না হয় মাছ দিয়েই পাত সাজানো যাক! মাছে বাতে জমে উঠুক ঘাম ছোটানো জামাই ষষ্ঠীর মেনু!

ষষ্ঠী স্পেশাল রকমারি মাছের রেসিপি রইল:
১ আম দিয়ে কাতলা
২ তিল বাটা দিয়ে ট্যাংরা
৩ গন্ধরাজ ভাপা ভেটকি
(এই তিনটি একটু স্বাস্থ্যসচেতন ছেলেমেয়েদের জন্যে)
৪ রুই মাছের দেহেবু
৫ কাতলার দমপোক্ত
৬ ভেটকি ইন ক্রিমি হোয়াইট সস
আর পাতশুরুর তোপসে ফ্রাই তো আছেই। ইলিশ চিংড়ির তো বাজার আগুন এখন। আর বাঙালির পকেটের কথা টের পেয়েই, ভালো ভালো ইলিশেরা পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। ওদিকে চিংড়ির ও মেজাজ ভারী! তাই সাধ্যের মধ্যে মাছের রান্না, একটু রাজকীয় করে পেশ করা…

আম কাতলা
লাগবে:
কাতলা পেটি চারটে
একটা পেঁয়াজ কুচানো
এক চামচ আদা রসুনবাটা
দু’চামচ কাঁচা আম বাটা
১/২ চামচ সরষেবাটা
লঙ্কাগুঁড়ো এক চামচ
হলুদ অল্প
দুটো শুকনোলঙ্কা ফোড়নের জন্যে
পাঁচফোড়ন হাফ চামচ
নুন, সামান্য চিনি স্বাদমতো
এবং অবশ্যই কাঁচা আমের লম্বা ফালি, ৫-৬ টা!
প্রণালী
তেল গরম করে, ফোড়ন দিয়ে, তাতে পেঁয়াজ কুচি ভেজে, আদা রসুনবাটা দিয়ে কষে, জলে গোলা হলুদ লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে কষতে হবে। তারপর সর্ষেবাটা (আমি ছেঁকে ব্যবহার করি) আর আমবাটা দিয়ে, অল্প ভেজে রাখা মাছ দিতে হবে। সঙ্গে কাঁচা আমের ফালিগুলোও! অল্প জল দিয়ে মিনিট পাঁচ ঢেকে রেখে, মাছ সেদ্ধ হলে নামিয়ে নেওয়া। ওহ! নুন আর কয়েক দানা চিনি দিতে ভুললে চলবে না! (কাতলা ছাড়া রুই বা অন্য বড়ো মাছ দিয়েও হবে)
তিল বাটা ট্যাংরা
লাগবে
ট্যাংরা মাছ গোটা বারো
তিলবাটা দুই বড়ো চামচ
পাঁচফোড়ন
শুকনোলঙ্কা দুটি ফোড়নের জন্যে
এক চামচ আদা রসুনবাটা
হলুদগুঁড়ো
কাঁচালঙ্কাবাটা এক চামচ
নুন, সামান্য চিনি স্বাদমতো
সর্ষের তেল

সর্ষের তেলে পাঁচফোড়ন দিয়ে, জলে গোলা আদা-রসুনবাটা লঙ্কাবাটা, নুন-হলুদ দিয়ে কষে, তিলবাটা দিয়ে দিতে হবে। কষে নিয়ে মাছ দিয়ে দিতে হবে। ফুটে সেদ্ধ হয়ে গেলে গরম গরম পরিবেশন। এটা যে কোনও ছোট চারা মাছ দিয়ে করলেও খেতে দারুন লাগে।
গন্ধরাজ ভাপা ভেটকি
লাগবে:
ভেটকি চার টুকরো
গন্ধরাজ লেবু বড় একটা
আদা এক ছোট চামচ
পেঁয়াজ একটা, ভেজে বেটে রাখা
জল ঝরানো টক দই এক কাপ
গন্ধরাজ লেবুর রস বড়ো দু’চামচ
লেবুর জেস্ট বা সবুজ খোসা গ্রেট করা এক চামচ
লেবুপাতা চারটে
নুন, সামান্য চিনি স্বাদমতো
শুকনোলঙ্কা ফ্লেক্স এক চামচ
কলাপাতা (মোড়ানোর জন্যে)

ভেটকির টুকরোতে লেবুর রস ও নুন মাখিয়ে আধঘণ্টা ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। দইয়ে পেঁয়াজ, আদাবাটা নুন মিশিয়ে রাখতে হবে। এরপর ভেটকিটা এই দইয়ের মিশ্রণে ভিজিয়ে রাখতে হবে আরও আধঘণ্টা। তারপর কলাপাতায় ভেটকি দিয়ে, ওপরে তেল, শুকনোলঙ্কা ফ্লেক্স আর লেবুর খোসা গ্রেট করা ছড়িয়ে, লেবুর পাতা দিয়ে চেপে কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে, ফুটন্ত জলে ভাপিয়ে নিতে হবে দশ মিনিট।
রুই মাছের দেহেবু
লাগবে:
রুই পেটি, চারটে
লঙ্কা সেদ্ধ করে রাখা ৩-৪ টে
আদাবাটা এক চামচ
এক চামচ মেথি, দুটো তেজপাতা আর শুকনোলঙ্কা ফোড়নের জন্যে
দু’চামচ কাজু কিসমিস বাটা, অল্পই লাগবে
দই জল ঝরানো আধ কাপ
নুন, সামান্য চিনি স্বাদমতো
সরষের তেল

তেলে ফোড়ন দিয়ে, তাতে লঙ্কা আর আদা দিয়ে কষে, কাজু কিসমিস বাটা দিয়ে দিতে হবে। অল্প গরম জল আর নুন মিষ্টি দিয়ে অল্প ভাজা মাছ (কাঁচা পেটি হলেও হবে) দিতে হবে। তারপর ঢেকে রেখে মাছ সেদ্ধ হলে ফেটানো দই দিতে হবে। দই দেওয়ার পর বেশি ফোটানো যাবে না, তাতে দই ছানা কেটে যেতে পারে। গ্রেভি গাঢ় হলে, ঘি গরম মশলা দিয়ে নামিয়ে নিলেই রেডি। চিংড়ি বা অন্য মাছ দিয়েও করা যায়। ঠাকুরবাড়ির রান্নার বইতে পড়া রেসিপিটি একটু অন্যরকম করে পেশ করলাম।
কাতলা দমপোক্ত
লাগবে:
কাতলা মাছ চার টুকরো
একটা পেঁয়াজ লম্বা কুচনো
আদাবাটা, এক চামচ
হলুদগুঁড়ো এক চামচ
ধনেগুঁড়ো এক চামচ
ফেটানো জল ঝরানো টক দই আধকাপ
আমন্ড বাটা দুই বড়ো চামচ
গোটা গরমমশলা, তেজপাতা আর শুকনোলঙ্কা ফোড়নের জন্যে
নুন, সামান্য চিনি স্বাদমতো
গোলাপজল এক চামচ
সরষের তেল

সরষের তেল গরম করে, ফোড়ন দিয়ে গন্ধ বেরলে, পেঁয়াজকুচি দিয়ে ভাজতে হবে। তারপর আদাবাটা দিয়ে কষে, জল দিয়ে গোলা গুঁড়োমশলা গুলো ঢেলে দিতে হবে। কষা হলে ফেটানো দই ও আমন্ডবাটা দিয়ে রান্না করতে হবে। অল্প ভাজা মাছ দিয়ে নাড়িয়ে, জল দিয়ে ঢেকে সেদ্ধ করতে হবে মাছ। সেদ্ধ হলে, গ্রেভি গাঢ় হলে নামানোর আগে গোলাপ জল দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
মেথি আর হোয়াইট গ্রেভিতে ভেটকি
লাগবে:
একটা পেঁয়াজ আধইঞ্চি আদা, ও চারটে রসুন বাটা
আমন্ড বাটা দুই চামচ
দুধ আধ কাপ, তাতে দু’চামচ কর্নফ্লাওয়ার গুঁড়ো গুলে রাখা
কসুরি মেথি এক চামচ
কাঁচালঙ্কা দু’তিনটে বাটা
লঙ্কাগুঁড়ো এক চামচ
নুন, সামান্য চিনি স্বাদমতো
সরষের তেল
মাছ হালকা ভেজে রাখতে হবে। সেই তেলে পেঁয়াজ, আদা রসুনবাটা কষে, কাঁচালঙ্কাবাটা দিয়ে তাতে আমন্ড পেস্ট মিশিয়ে অল্প জল দিয়ে কষতে হবে। মাছ মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর তাতে দুধ কর্নফ্লাওয়ার গোলা মিশিয়ে, কসুরি মেথি পাতা হাতে ভালো করে ঘষে নিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। ব্যাস, কয়েক মিনিট ফুটিয়ে নিলেই রেডি! এটা জাস্ট অসাধারণ খেতে হয় কিন্তু!
এর সঙ্গে শুরুর পাতে তোপসে ফ্রাই ভুললে হবে না! বেসন গোলায় ডুবিয়ে মুচমুচে করে ভাজা! শেষে মনে পড়ল ওই খরাজ বাবু গাইলেন না? ‘চিতল মাছের মুইঠ্যা, গরম ভাতে দুইটা.. ভুইলা বাঙালি খায় চিনা জাপানি লুইটা পুইটা..’ তাই কখনো হয় নাকি? চিনা জাপানি যাই হোক না কেন, নিত্যদিন এবং ষষ্ঠীও ভরে থাকুক বাঙালি রান্নার মাছের সুবাস আর স্বাদে! সকল সন্তান যেন থাকে মাছে ভাতে!
*সব ছবি, রান্না ও স্টাইলিং: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।
One Response
দারুন। এটা অনেক দিন চালাবো ,,,, অবশ্যই আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে । দারুন। দারুন!!! আজকাল দিদি, এই রান্না নিয়ে ভালো সময় কাটাচ্ছি। এইতো, লটে শুটকি দিয়ে টকটকে লাল কুমড়োর লাবড়া ,,আর সিদল শুটকি’র চাটনি রান্না হলো। আজ করলাম মোরলা মাছের টক!! এ যেন “”খাতা রহে মেরা দিল”” গোছের কিছু!! ধন্যবাদ!!