সকালটা ইউনিভার্সিটিতে কাটিয়ে দুপুরে স্নান-খাওয়ার জন্যে ফিরে এসেই প্রজ্ঞান দাদুর সামনে পড়ল কুর্চি। মুচকি হেসে তিনি বললেন, “ভালো খেলছে তোর বাবা। এত ব্যস্ত ডাক্তার, কিন্তু শান্তিনিকেতনে এসে যেন ঘূর্ণি উইকেটে টেস্ট ম্যাচ খেলছে। কোনও তাড়া নেই, প্রত্যেকটা বল মেরিট দেখে খেলছে, এন্তার বল ছেড়ে একটা বাউন্ডারি। আজ যেমন একটা বাউন্ডারি মেরে গেল। কাল তোর ছুটি শুনে আমাদের সবাইকে দুপুরে খেতে বলে গেল ওর বাড়িতে। এবার বল তুই কী করবি?”
ক্রিকেটে না ঢুকে আমলা দাদুর অতীতের দিকে একটা ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিয়ে কুর্চি বলল, “দাঁড়াও। ফাইল তো সবে এল আমার টেবিলে। একটু খোঁজখবর নিই, একটু ভাবি, তারপর তো নোট দেব।” বলে আর দাঁড়াল না। ছুটতে ছুটতে গেল দোতলায়, দিম্মার কাছে। জিজ্ঞেস করল, “বলো তো, কী হল আজ সকালে?”
স্নান সেরে বারান্দায় বসে ভিজে চুল শুকোচ্ছিলেন মধুরা। কুর্চি পাশে এসে বসতেই তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “সুজাত এল। যেমন বলে গিয়েছিল গতকাল। কিন্তু কালকের মতো আজ আর এসেই তোর কথা জিজ্ঞেস করল না। তুই যে বাড়ি নেই, ইউনিভার্সিটি গিয়েছিস, সে কথা যেন ওর জানা। চা খেল তারিয়ে তারিয়ে। জানাল, আমাদের ব্যাচের দু’জনের হার্ট সার্জারি হয়েছে ওরই হাতে। বলল, ওর যেসব মাস্টারমশাই এখনও আছেন, তাঁদের বাড়ি যাচ্ছে দেখা করতে। পুরনো বন্ধুদের খোঁজ করছে। প্রাক্তনীদের একটা সভা আছে জেনে টুকুর বাড়িও গিয়েছিল। সেখানে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এসব বলে কাল দুপুরে ওর বাড়িতে খাওয়ার নেমন্তন্ন করে গেল। এমনভাবে বলল যে কুর্চিকেও নিয়ে আসবেন, যেন তুই আমাদের কাছেই থাকিস চিরকাল! একবার না, দু’বার বলল।”
– তোমরা কী বললে?
– আমি বললাম, কুর্চি এলেই জানাব। প্রজ্ঞান বলল, কুর্চিকে আর আমরা কি নিয়ে আসব! যেতে রাজি হলে কুর্চিই আমাদের নিয়ে যাবে। তবে রাজি না হলে জোর করতে পারব না। সুজাত উত্তর দিল, তা তো বটেই। জোর করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। এখন বল, তুই কী করবি?
– বলো তো দিম্মা, আমার কী করা উচিত?
– আমার মন বলছে যাওয়াই উচিত, তবে সেটা তোরও মনের কথা হলে তবে।
“একদম ঠিক বলেছ,” বলে উঠে পড়ল কুর্চি। “তাড়াতাড়ি চান করে আসি, নইলে তোমাদের খেতে দেরি হয়ে যাবে।”
খাওয়ার পরই কুর্চি বেরিয়ে পড়ল, ফিরে গেল কাজে। ঘণ্টা তিনেক পরে বেরিয়েই দেখে, জোর হাওয়া দিচ্ছে হঠাৎ। ডিপার্টমেন্টের ঠিক সামনের গাছটার বেশ কয়েকটা হলুদ ফুল ঝরে পড়েছে মাটিতে। তার নাম নিয়ে উৎসুক আলোচনা হচ্ছে মাঝবয়সী তিন পর্যটকের মধ্যে। প্রথম জন বলছেন, “এটা তো বাঁদরলাঠি, এখানকার লোকে বলে অমলতাস।” দ্বিতীয় জন বললেন, “বাঁদরলাঠি তো গাছে লাঠি কই? নির্ঘাত রাধাচূড়া, এই তো ফোটার সময়।” তৃতীয় জন বললেন, “দূর থেকে দেখে মনে হয়েছিল ফাগুন বৌ, কিন্তু এখন তো দেখছি হলুদ পলাশ। এই সময়ে শান্তিনিকেতনে এলেই দেখা যায়।” সাইকেলে উঠতে উঠতে তৃতীয় জনের দিকে তাকিয়ে কুর্চি বলল, “ঠিক বলেছেন আপনি, হলুদ পলাশ।” বলেই চালিয়ে দিল তার সাইকেল। শেষ বিকেলের বিষণ্ণ আলোয় মায়াময় হয়ে উঠেছে আকাশ। জোর হাওয়ায় উড়ছে তার চুল। ঝড় উঠবে নাকি, কুর্চি একবার ভাবল। কিন্তু চলতেই থাকল। মধুরা-প্রজ্ঞানের বাড়ি নয়, সে আজ ধরেছে তার ঠাম্মার বাড়ির পথ।
বসন্ত বসেছিল বাগানের এক কোণে। ছুটে এল কুর্চিকে দেখতে পেয়েই। সাইকেলটা স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড় করাতে করাতে কুর্চি বলল, “তোমার সাইকেল এখনও ফেরত দিতে পারছি না বসন্তদা।” বসন্ত লজ্জা পেয়ে বলে উঠল, “কতদিন পর এলে! এখন এসব কথা কেন? আমি কি সাইকেল ফেরত চেয়েছি?” কুর্চি হাসল, বলল, “আমি কি জানি না তোমার কত অসুবিধে হচ্ছে! বাবা কোথায়?”
– বাইরের ঘরে। আরও অনেকে এসেছেন। গিয়ে দেখ।
কুর্চি একবার ভাবল ফিরেই যাবে কিনা। তারপর নিজেকে বোঝাল, অনেক ভেবেচিন্তেই তো এখানে এসেছে সে। এখন ফিরেই বা যাবে কেন? একতলায় বসার ঘরে ঢুকে দেখল, খালি গলায় গাইছেন মানিনীদি আর বাবার সঙ্গে বসে একমনে গান শুনছেন নন্দিতাদিদা, সুচিরাপিসি আর সুশোভনজেঠু। কুর্চি যেদিক দিয়ে ঢুকল, তার উল্টো দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁরা, মানিনীদির দিকে মুখ করে। চোখ বন্ধ করে গাইছিলেন মানিনী, গান শেষ হতে তিনিই প্রথম দেখতে পেলেন কুর্চিকে। বললেন, “ওই তো কুর্চি এসে গেছে।” সুজাত তাঁর সোফায় পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, “আয়, বোস।” গলা এত স্বাভাবিক, যেন এখন তো আসার কথাই ছিল কুর্চির। সব কিছু এত স্বাভাবিক! কিন্তু কুর্চি বুঝতেই পারছে না ওর বুকের ভেতরটা কেন ভয়ানক জোরে ধকধক করছে। করেই চলেছে। বাবাকে হাত দিয়ে অপেক্ষা করার একটা মুদ্রা দেখিয়ে কুর্চি পেছন দিকের একটা চেয়ার টেনে বসল। আর একটা গান গেয়ে শেষ করলেন মানিনীদি। সাধু সাধু বলে উঠলেন সুজাত, চোখ বড় করে কুর্চি শুনল। এর আগে কি বাবার মুখে কখনও শুনেছে কুর্চি, শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ধারার এই তারিফ? কুর্চির মনে পড়ল না। কিন্তু তার সম্পর্কে অতিথিদের কী বলে থাকতে পারে বাবা, যাতে কেউ একটা প্রশ্নও তুলছে না!
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না কুর্চিকে, নন্দিতা দিদা চা খেতে খেতে বললেন, “মধুরাদির কাছে ক’দিন থেকে আসার ভাবনাটা খুবই ভালো কুর্চি। ওঁরা এত মানুষজন ভালোবাসেন। কিন্তু কেই বা আজকাল যাচ্ছে ওঁদের কাছে! বড্ড একা হয়ে গেছেন। অবশ্য আমরা সকলেই তাই। আমি তবু এখনও সব জায়গায় যেতে পারি বলে যোগাযোগের মধ্যে আছি। মধুরাদির তো সিঁড়ি ভাঙতে খুব অসিবিধে।” কুর্চি মাথা নিচু করে শুনল, কোনও উত্তর দিল না।
অতিথিরা চলে যাওয়ার পর কুর্চির পাশে এসে বসলেন সুজাত। বললেন, “বাড়ি ছাড়লি কেন? আমার ওপর কিসের রাগ তোর?”
“বাড়ি ছাড়তে হল নিজের মতো করে বাঁচতে চাই বলে। নিজের মতো, তোমার ইচ্ছেমতো নয়।” দমবন্ধ করে কথাগুলো বলল কুর্চি। এর বেশি কিছু বলতেই পারল না।
সুজাত শুনলেন, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখলেন কুর্চি আরও কিছু বলে কিনা। কুর্চিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শেষ পর্যন্ত নিজেই মুখ খুললেন আবার। বললেন, “তাই হোক তাহলে। তোর যেমন ইচ্ছে, তেমন করেই থাক। আমি কিচ্ছু বলতে যাব না। কাল এখানে আসার সময় তোর সব বইপত্র, জামাকাপড় নিয়ে আয় তাহলে। যদি চাস তো গাড়ি পাঠাই। তুই ফিরে এলে আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে কলকাতায় ফিরতে পারি।”
কুর্চি এবার সোজা হয়ে বসল। সটান তাকাল বাবার চোখের দিকে। বলল, “ফিরব, কিন্তু এখনই না। বললাম না, এবার আমার ইচ্ছেমতো বাঁচব? আমার ইচ্ছে, আমি ফেরার আগে অরিত্র আর ওর মা এই বাড়িতে মাসখানেক কাটিয়ে যাক। অরিত্রর সেরে ওঠার শেষ পর্বটা এখান থেকেই হোক।”
-কে অরিত্র? কুর্চির কথা শেষ হতে না হতেই অধৈর্য গলায় জানতে চাইলেন সুজাত।
– অরিত্র মিত্র। দক্ষিণী সম্মিলনীর গোলকিপার। খেলতে খেলতে মাথায় চোট পেয়েছিল। আজ বেলভেডিয়ার নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা।
চেয়ারে আর বসে থাকত পারলেন না সুজাত। উঠে চলে গেলেন জানলার ধারে। ঘরের মধ্যে কারও পায়ের আওয়াজ পেতেই মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন কৃষ্ণা ঢুকেছে। গভীর বিরক্তিতে বলে উঠলেন, “আঃ, এখন না। আমাদের কথা বলতে দাও। এখন কেউ যেন এখানে না আসে।” কৃষ্ণা পড়িমরি ছুটে পালাল। আর পাথরের মূর্তির মতো কুর্চি বসে রইল অবিচল। জানলা দিয়ে বাইরেই তাকিয়ে রইলেন সুজাত। তোলপাড় চলছে তাঁর মাথার মধ্যে। বাইরে প্রবল হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ। সেই হাওয়ায় বাগানের বড় বড় গাছগুলো দুলছে, না আনন্দে নাচছে? সুজাত দেখছিলেন, আর আস্তে আস্তে একটা কথা মনের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছিল তাঁর – এই হল কুর্চির জাস্টিস। মুখ খুললেন বেশ কিছুক্ষণ পর। নিচু গলায়, প্রায় স্বগতোক্তির মতো বললেন, “মায়ের মতো নয়, তুমি শেষ পর্যন্ত তোমার ঠাম্মার মতোই হলে।”
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।