নতুন করে পঁচিশে বৈশাখে কিছুই কি আর বলার থাকে? এই বিশ্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যেই আমাদের জীবনে এল রবিপ্রকাশের সেই দিন। কবির ১৫৯তম জন্মদিবসে তাঁকে শব্দে সুরে অক্ষরমালায় স্মরণ করতে বাংলালাইভের সামান্য প্রয়াস থাকল ওয়েবসাইটে। ২০০৮ সালে প্রতিভাস প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হয় জয় গোস্বামীর লেখা ‘নিজের রবীন্দ্রনাথ’ বইটি। কবি তাঁর ব্যক্তিগত রবিযাপনের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন এই বইতে — গদ্যে ও পদ্যে। সেই বইয়েরই পুনর্মুদ্রণের অনুমতি পেয়েছে বাংলালাইভ। রইল সেই বইয়ের ‘পাগল যে তুই’ প্রবন্ধের পঞ্চম পরিচ্ছেদ থেকে শেষ পর্যন্ত।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম ঝগড়া করার কথা ভেবেছিলাম, সেই আমার, ছোট বেলাতেই। কেন অমল মরে গেল? কেন ফটিক? কেন জয়সিংহ? কিংবা পুরাতন ভৃত্য কেষ্টা? সবাই কেন মরে যাবে! খুব রাগ হত। ইচ্ছে করলে কি বাঁচিয়ে দেওয়া যায় না?
এই রাগের তবু একটা ভিত্তি আছে। কিন্তু, পরে আরেকটু বড়ো, অন্য একটা অযৌক্তিক রাগে ধরেছিল আমায়। কেননা, তখন আমার সঙ্গে রবীন্দ্রভক্তদের দেখা হওয়া শুরু হয়েছে। বিশ্ববীক্ষা, ঔপনিষদিক চেতনা, ভূমা, ভারতের আত্মা- এইসব ভয়ানক শব্দের সঙ্গে তখন আমার ধাক্কা লাগছে, আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ততদিন পর্যন্ত আমার পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত যে নিভৃত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা ছিঁড়েখুঁড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। রবীন্দ্রভক্তরা রবীন্দ্রসহ আরো পাঁচরকম জয়ন্তীতে সভাপতি, প্রধান অতিথি হন। আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিচারক হন। ধুতি পাঞ্জাবি পরেন। রবীন্দ্রনাথের পরের জেনারেশনের কিংবা তার পরের যারা তাদের কথায় কথায় নস্যাৎ করেন।
রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসলে কি অন্য সবাইকে বাধ্যতামূলক গালাগাল দিতে হবে?- ব্যাপারটা চরমে উঠল একদিন। আমি দু-চারদিন কলকাতায় ঘুরে এলাম। তার মধ্যেই একদিন ২৫শে বৈশাখ পড়েছিল। কিন্তু আমি জোড়াসাঁকো যেতে পারিনি। কারণ ভবানীপুর থেকে জোড়াসাঁকো অনেকটাই রাস্তা। আমি মফসসল থেকে নতুন গেছি- ভিড়ের বাসে উঠতে পারিনি।
ব্যস। ছিছি, একেই বলে কূপমন্ডুক। এই হচ্ছে মফসসল মেন্টালিটি। এ ছেলের কিচ্ছু হবে না। তাঁরা, সপরিবার আমায় প্রায় মারতে বাকি রাখলেন। তাঁরা সবাই আমার গুরুজন। গুরুজনদের ওপর ঘেন্না ধরে গেল।
দুর্ভাগ্যবশত, ওই সময় যাঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, পরে বুঝেছিলাম, তাঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসতে পারেননি। পরবর্তীকালে কোনো কোনো মানুষকে দেখেছি, যাঁরা হয়তো ধুতি পাঞ্জাবিই পরেন, সভা সমিতিতেও হয়তো যান, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে সত্যিকার ভালবাসেন। কোনো সভায় হয়তো বলছেন এঁদের একজন, আমি এই এতদূর থেকে ছুটে যাব সে ভাষণ শুনতে- না-যেতে পারলে বাড়িতে বসে ছটফট করব- ইস-যেতে পারলাম না। এমন মানুষও তো আছেন কেউ কেউ। আসলে ওই অত অল্প বয়সে ওইরকম কান্ডকারখানা দেখে হকচকিয়ে গিয়ে যুক্তিহীনভাবে রবীন্দ্রনাথকেই দায়ী করতে চেয়েছিলাম। তখন বুঝিনি যাঁরা রবীন্দ্রপ্রেমিক, তাঁদের প্রকাশ্যে ভক্ত হবার দরকার হয় না।
একবার এই ভক্ত সম্প্রদায়ের এক অধ্যাপক ভক্তকে বলেছিলাম যে, রঙ লাগালে বনে বনে, এই লাইনটা সুরসহ শুনলেই মনে হয় যেন রঙিন পোশাক পরা একগুচ্ছ মেয়ে চলে যাচ্ছে, গাছপালার ভিতর দিয়ে এই মাত্র চোখে পড়ল তাদের। ভদ্রলোক চটে গিয়ে আমাকে প্রকৃতিচেতনা ইত্যাদি বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু, সত্যিই কি এমন হয় না? হয়ই তো। ওই শান্তিনিকেতনেই, রাস্তার মোড় ঘুরতেই দেখেছিলাম নানারঙের একদল মেয়েকে, তাদের দুজনের হাতে আবার সাইকেলও ছিল। দেখামাত্র আমার মনে এল – কে রঙ লাগালে বনে বনে-।
অথচ এই গান যখন লেখা হয়েছিল তখন কত অন্যরকম ছিল সব- তখন কোথায় এসব সালোয়ার কামিজ আর কোর্তা- কোথায় বা সাইকেল- কতই আলাদা ছিল সব- শুধু মস্ত এক কবি, মস্ত এক পাগল- একটানে সমস্তটাই মিলিয়ে দিলেন।
৬
পাগল। গানে কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বারবার পাগলকে ডাকেন। নাটকে নিয়ে আসেন পাগলকে। সে-পাগল গান গায়। সে-পাগল ভালোবাসে। সে পাগল শিল্পী। বাইরে থেকে দেখে যারা, যারা নিজেদের স্বার্থ আর পাওনা নিয়ে ব্যস্ত, তারা বিদ্রুপ করে। কী হয়েছে তাতে। সেই পাগলের রবীন্দ্রনাথ আছেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন –তুই যে পাগল সেটাই তুই জানিয়ে দিবি। ব্যস্।
আজও যে কেউ কেউ পাগল থাকতে সাহস পায়, সে রবীন্দ্রনাথের জন্য।
মনে আছে, কৈশোরের কয়েকটি দিন। আমাদের ছোট্ট এই মফসসল শহরের ছোটো ছোটো রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াই। বাড়িতে বাড়িতে আঁচ পড়েছে সন্ধ্যের আগে। এ বাড়ি ও বাড়ির ধোঁয়া মিলেমিশে হালকা স্তর তৈরি করেছে কুয়াশার। মজা পুকুর পাড় আর ঝোপজঙ্গলের পাশে আধভাঙা একটা বাড়ি থেকে শুনতে পাচ্ছি খালি গলায় একটি মেয়ে গাইছে – জয় ক’রে তবু ভয় কেন তোর যায় না। – ‘ভয় কেন তোর’ এই জায়গাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর হায় ভীরু প্রেম হায় রে- এইখানটায় এসে আবছা হয়ে আসছে সুর, সুর ঠেলে শোনা যাচ্ছে রান্নাঘরের ঠং ঠঙাস- পাশের ঘরে কেউ ডাকল, ও দুলুর মা- আবার ফিরে আসছে সুর, সমস্ত বিরুদ্ধ আওয়াজকে হারিয়ে দিয়ে ভয় কেন তোর থেকে জেগে উঠছে হালকা মিষ্টি সেই অপরাজিত সুর।- সেই অভিজ্ঞতার পর থেকে-থেকেই যেতাম সেই রাস্তা দিয়ে, ঠিক ওই সময়। অন্তত আরও তিনদিন শুনেছি ওই একই গান, জয় ক’রে তবু- আর দুদিন অন্য গানও শুনেছি। ও আমার দেশের মাটি।
ওই দুটো ছাড়া আর বোধ হয় সে জানত না কিছু। সে মানে সেই কিশোরীটি। জামা পরা ফ্যাকাশে চেহারার সেই রোগা মেয়ের পায়ে ছিল ছোটোবেলায় ঘায়ের দাগ। তার নাম জানি না আজও। কথাও বলিনি কোনোদিন। তারা ছিল ভাঙা বাড়ির ভাড়াটে – কবে একদিন উঠে গেছে সেই বাড়ি থেকে। কোথায় গেছে কে জানে!
আজ এতদিন পর মনে হয়, সেই মেয়ের সঙ্গে হয়তো আমার একটা বন্ধুত্ব হতে পারত। হয়নি। তবু তার সঙ্গে যে দেখা হয়েছিল- এই যথেষ্ট। আর এই দেখার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, আবারও সেই রবীন্দ্রনাথ। আমার মধ্যে, আমার মতো শুকনো মানুষের মধ্যেও যে ভালবাসা একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি – সে রবীন্দ্রনাথের জন্যই। তাঁর গান আমাকে স্পর্শ করা মাত্রই তা বুঝতে পারি আজও।
৭
তাহলে কে রঙ লাগাল? কেন? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে আছে রঙ লাগাবার মালিক? আসলে, রবীন্দ্রনাথ পড়ে যতটা- ততটাই এই পরিবেশ থেকে, এই জল হাওয়া থেকে তাঁকে পেয়েছি। তাই জোর গলায় তাঁকে স্বীকার করতে হয়নি। অস্বীকারও করতে হয়নি। রৌদ্রকে স্বীকার করে কেউ? কেউ কি বলে: ‘হ্যাঁ ভাই রোদ্দুর, তুমি ওরিজিন্যাল।’ কিংবা বৃষ্টিকে কেউ বলে- ‘না রে মেয়েটা, তুই মিথ্যে।’ মোটেই বলে না।
তবে মানতেই হবে কখনও কখনও তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়েছে। সবটাই যে নিজের চেষ্টায় – তা নয়। কখনও অন্য কারও সোনার কাঠির ছোঁয়ায়। ভাগ্যবলে।
সেই ভাগ্য শঙ্খ ঘোষ। সেই ভাগ্য বুদ্ধদেব বসু। আইয়ুবও ছিলেন নিশ্চয়, আমি তাঁরও অনুরাগী ছিলাম একদা, কিন্তু বুদ্ধদেবের ছিলাম একেবারে অনুগত প্রজা। বুদ্ধদেবই ছিলেন আমার কাছে শেষকথা। আর পরবর্তীকালে শঙ্খ ঘোষের রচনা আমাকে অন্য সকলের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। আমার খুব একটা সংকটের সময়ে, জীবনের খুব টালমাটাল একটা অবস্থায় ‘এ আমির আবরণ’ বইটি আমাকে বাঁচায়। ‘এ আমির আবরণ’ এবং ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’ এই বই দুটি আমার কাছে ধর্মগ্রন্থের মতো। যদিও সেই সঙ্গে স্বীকার করব বুদ্ধদেব এবং শঙ্খ ঘোষ না থাকলে জানতে পারতাম না রবীন্দ্রনাথের অনেক কিছু। জানতে পারতাম না কত দিগন্ত থেকে দিগন্তে তাঁর বিস্তার। ছোটবেলায় রেডিওতে শুনেছি- মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালো মাঝে- হ্যাঁ, গানের সময় উচ্চারণ কালো-ই হয়। ভাবতাম-মহাকাশ আর মহাকালো। মানে প্রচণ্ড কালো। মহা অন্ধকার। যেখানে আমি একা। পরে, পড়তে গিয়ে দেখি – কাল, মানে সময়। মহাসময়। সময় কি অসম্ভব কালো? এক নিমেষে সময় আর স্পেস এক হয়ে গেল যেন। একাকার। মনে হয় মাথার উপর যেন হাজার হাজার ফুট জল। আমি আরও তলিয়ে যাচ্ছি আরও। ‘মনে হয়, যেন মনে পড়ে/ যখন বিলীন ভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে/অজ্ঞাত ভুবন ভ্রূণ মাঝে, লক্ষ কোটি বর্ষ ধরে…’
তারপর জেগে যখন উঠলাম, তখন, আমারও আসল বয়স যেন পৌঁছে গেল কোটি বৎসর আগেকার দিনে- যখন চারদিকে শুধু পাথর আর জল।
সেই দেশ থেকে যেন দেখতে পাচ্ছি, সমুদ্রের গর্ভ থেকে- সূর্যের দিকে জেগে উঠেছে- সমস্ত জীবের অগ্রগামী গাছ। মৃত্যুর পর মৃত্যু পেরিয়ে যে বলতে পারে, আমি থাকব। আমি বাঁচব। রৌদ্রে বাদলে দিনে রাত্রে।
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন সেই গাছেরই মতো। যতদিন সভ্যতা থাকবে – থাকবেন রবীন্দ্রনাথ।
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।