সম্প্রতি হলিউডের ডাকসাইটে অভিনেত্রী গোয়েনেথ প্যালট্রোর একটা সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। একটা জায়গায় এসে চোখটা আটকে গেল। গোয়েনেথ আর ওঁর স্বামী নাকি এক বাড়িতে থাকেন না! ঝগড়াঝাঁটি বা মনোমালিন্যর কারণে নয়, প্রথম থেকেই তাঁরা এই ধরনের অ্যারেঞ্জমেন্টের পক্ষপাতী। সপ্তাহে চার দিন গোয়েনেথের স্বামী ওঁর বাড়িতে থাকেন আর বাকি দিন নিজের বাড়িতে। এতে নাকি সম্পর্কে স্পেস পাওয়া যায়! উনি বিশ্বাস করেন যে এই ভাবে থাকলে বিয়ে অসফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। গোয়েনেথের মতো সারা বিশ্বেই এখন ‘এলএটি’ দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে। ‘এলএটি’ মানে লিভিং অ্যাপার্ট টুগেদার। সহজভাবে বললে একই শহরে থেকে আলাদা থাকা!
অভিনেত্রী ক্যাথেরিন হেপবার্ন বহু আগে একবার বলেছিলেন যে সম্ভবত পুরুষ ও নারী একে অপরকে স্যুট করেন না। তার চেয়ে ভাল পাশাপাশি বাড়িতে আলাদা থাকা। উনি নিজেও তাই করতেন। পার্টনার স্পেনসার ট্রেসির সঙ্গে থাকতেন না। তাঁরা দু’জনেই আলাদা থাকতেন অথচ তাঁদের সম্পর্কে কোনও ফাঁক ছিল না। সম্ভবত ক্যাথরিন হেপবার্নই এলএটি-র প্রথা প্রথম চালু করে ছিলেন।
কী এই এলএটি
এলএটি ব্যাপারটি শুনতে যত সহজ, আদতে তা কিন্তু নয়। কারণ স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই এই বন্দোবস্ত খোলা মনে মেনে নিতে হবে। যদি এমন হয় যে একজন আর একজনকে এই ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য করছেন, তা হলে কিন্তু সম্পর্কে স্থিতিশীলতা আসা মুশকিল। আলাদা শহরে, এমনকী আলাদা দেশেও স্বামী –স্ত্রী থাকেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণটা কেরিয়ার বা পড়াশোনা। তবে একই শহরে থেকে আলাদা থাকা এবং সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলাকে এলএটি অ্যারেঞ্জমেন্ট বলে। আসলে দু’টো মানুষ যখন বিয়ে করেন এবং একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তখন দু’জনকে নিজেদের অবস্থান থেকে নড়তে হয়। অন্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। এখনকার প্রজন্ম এই মতে খুব একটা বিশ্বাস করেন না। তাঁরা নিজেদের শর্তে, নিজেদের মতো করে জীবনকে উপভোগ করতে চান। তার মানে এই নয় যে সঙ্গীর প্রতি তাঁদের কোনও ভালবাসা নেই, বা একসঙ্গে সময় কাটাতে তাঁরা চান না। তাই এই ব্যবস্থা ক্রমেই সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সোশ্য়াল মিডিয়ায় এই সংক্রান্ত পেজ, হ্যাশট্যাগস সবই দেখতে পাবেন। এমনকী এই বিষয়ে বই পর্যন্ত আছে। দম্পতিরা মনে করছেন এইভাবে থাকার ব্যবস্থা করলে সম্পর্কে কোনওরকম একঘেয়েমি আসে না। যেটুকু সময় তাঁরা একসঙ্গে কাটান, সেখানে কোনওরকম নেতিবাচক বা সাংসারিক কথাবার্তা হয় না। ফলে শুধু সঙ্গীর ভাল দিকটাই চোখে পড়ে। এতে ঝগড়া হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর মতান্তর, মনোমালিন্য না হলে বিয়ে ভাঙার সুযোগও নেই। ফলে একেবারে উইন-উইন সিচুয়েশন।
সাপ্তাহিক সান্নিধ্য
ব্যাঙ্ক কর্মী অনিন্দিতা বক্সী বিয়ের পর থেকেই আলাদা থাকেন। ওঁর অফিস কল্যাণীতে, ফলে বাপের বাড়ি থেকেই যাতায়াতের সুবিধে। সপ্তাহন্তে শ্বশুরবাড়ি আসেন। কখনও কখনও স্বামী গিয়ে ২-৩দিন কাটিয়ে আসেন। প্রথম দিকে এই ব্যবস্থা কাজের জন্য করে থাকলেও, এখনও ওঁরা দু’জনে এতেই খুশি। “বন্ধুরা বলে আমাদের তো উইকএন্ড ম্যারেজ। সত্যি কথা বলতেই এই বেশ ভাল আছি। সারা সপ্তাহ দু’জনেই মুখিয়ে থাকি শনি বারের জন্য। এক সঙ্গে থাকলে এই প্রেমটা বোধহয় ধরে রাখা যেত না। বিয়ের চার বছর পরও মনে হয় এই সবে বিয়ে হয়েছে। তা ছাড়া আমার শ্বশুরবাড়ি একটু কনসারভেটিভ। অনেক নিয়মকানুন মানতে হত। এখানে আমি বেশ ঝাড়া হাত পা। বিয়ের আগে আর পরের মধ্যে কোনও তফাত নেই। তবে শ্বশুরবাড়ির সকলের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ভাল। ছুটিছাটাতেও গিয়ে থাকি। আমি ভুলেও ট্রান্সফারের অ্যাপ্লিকেশন দিই না, কারণ আমার স্বামীও মনে করেন এই বন্দোবস্তটাই আমাদের সুন্দর সম্পর্কের ম্যাজিক স্পাইস,” হাসতে হাসতে জানালেন অনিন্দিতা।
একান্তই ব্যক্তিগত
মনোবিদরা মনে করেন বিয়ের পর এক সঙ্গে থাকা বা না থাকা একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে দম্পতিদের একসঙ্গে সময় কাটানোটা খুব দরকার। না হলে একে অপরকে বুঝতে সমস্যা হতে পারে। সঙ্গীর শুধু ভাল দিকটা দেখাই তো আর বিয়ের মানে হতে পারে না। একে অপরের দোষ গুন জানা দরকার। আর সেগুলোর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করাটাও জরুরি। এবার সেটা যদি আলাদা থেকেও স্বামী-স্ত্রী করতে পারেন, তা হলে সেটা একেবারেই তাঁদের ইচ্ছে। সেখানে বাকি কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। তবে মনে রাখতে হবে প্রত্যেক মানুষই কিন্তু আলাদা। কারও ক্ষেত্রে এলএটি দারুণ কাজ করতে পারে, আবার কারওর ক্ষেত্রে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হতে পারে। আবার কখনও কখনও ব্যক্তিত্বের সংঘাত এড়াতেও আলাদা থাকাটাই ভাল। কিন্তু একটা সম্পর্ক পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সম্পূর্ণভাবে দেখাটা উচিত।
সাইকোথেরাপিস্ট এবং রিলেশনশিপ এক্সপার্ট মানসী পোদ্দার মনে করেন, “এই ধরনের লিভিং অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাস্থ্যকর হতেই পারে। তবে আলাদা থেকে কী ভাবে বিয়েটা ধরে রাখা সম্ভব, তা দম্পতিদের উপরই নির্ভর করবে। আমরা অনেক নিয়ম বানিয়ে থাকি, কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এক নিয়ম কাজ নাই করতে পারে। আলাদা থেকে যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সুন্দর থাকে, তাতে ক্ষতি কী! আমি তো বলব অবমাননাকর বা বিষাক্ত সম্পর্কে থাকার চেয়ে আলাদা থাকাই ভাল। আমার চেনার মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা স্বামীর সঙ্গে থাকেন না। ডিভোর্স করতে পারেন না সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণে। অনেকে আবার সন্তানের কথা ভেবেও বিবাহবিচ্ছেদের রাস্তায় হাঁটেন না। এঁরা সকলেই আলাদা থাকেন। এ ভাবে প্রতি দিনের অশান্তি এড়ানো যায়। তবে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার সময় আলাদা থাকাটা হয়তো কঠিন হতে পারে। এতে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়াও সম্ভব। সেই সিদ্ধান্তটা ভেবে চিন্তে নেওয়াই ভাল।”
একটু ভেবে দেখুন
এক সঙ্গে থাকা বা আলাদা থাকা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। প্রথমেই দম্পতিদের বিয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বিয়ে থেকে তাঁরা কী চান, আলাদা থাকার কারণ কী, কত দিন তাঁরা এ ভাবে থাকতে চান, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হতে পারে, এই প্রশ্নগুলো দম্পতিদের এক অপরকে এবং নিজেকেও করা দরকার। এই প্রতিটা উত্তরই কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের আধার কিন্তু পারস্পারিক বোঝাপড়া। বিয়ের পর যদি তা তলানিতে এসে ঠেকে, তা হলে আলাদা থাকার কথা ভেবে দেখা যায়। কিন্তু তা যদি না হয়, স্রেফ একে অপরের সমস্ত অভ্যাসগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন না বলে এই সিদ্ধান্ত নেন, তা হলে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়! আপনারা কী বলেন?